রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-১০)

মােবারকের অস্বস্তি লাগছেব্যাপার বােঝা যাচ্ছেনাএরা কি তাকে বন্দি করে ফেলছে ? এদের চোখের নজর থেকে বাইরে যাওয়া যাবে না এই অবস্থা

রূপার পালঙ্ক

স্যার আমার তাে একটু দাদির সঙ্গে দেখা করা দরকার। 

দাদির সঙ্গে আপনি তাে আর আজই দেখা করছেন নাভিসা হয়ে যাক, তারপর স্যারকে বলে একদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসবেন। 

মােবারক ইতস্তত করে বলল, আজ থেকেই এই বাড়িতে থাকার আমি প্রয়ােজন দেখি না। শেষ কয়েকটা দিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, গল্প করে কাটাতে পারলে ভাল হয়। 

ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মােটেই ভাল হয় নাআপনার জন্যে সব ব্যবস্থা করা থাকবেসন্ধ্যার মধ্যে আপনি অবশ্যই এ বাড়িতে ফিরে আসবেনআজ সন্ধ্যার পর স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। 

একবার তাে কথা হয়েছে। আর কথা বলাবলির কী আছে

ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, স্যার বলেছেন সন্ধ্যার পর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন এই জন্যেই আপনাকে আসতে হবেনিন এইখানে সই করুন। | মােবারকের বুক ধক করে উঠল, কোথায় সই করিয়ে নিচ্ছে কে জানেআমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়এই জাতীয় কোনাে লেখা নাতাে

মােবারক বিড়বিড় করে বলল, সই করব কেন

টাকা নেবেন, সই করবেন না ? অডিটের কাছে আমাকে হিসাব দিতে হবে না ? গরিব মানুষের টাকা পয়সার হিসাব থাকে না, কিন্তু ধনী মানুষের প্রতিটি পয়সার হিসাব থাকে। 

মােবারক সই করল কত টাকা তাকে দেয়া হচ্ছে পাশে লেখা আছেলেখা অংকটা বিশ্বাস হচ্ছে না। পঁচিশ হাজার টাকা। মােবারকের মনে হচ্ছে টাকা আসলে দুই হাজার পাঁচশএকটা শূন্য বেশি লেখা হয়েছেদশমিকের ফুটা বসাতে গণ্ডগােল হয়ে গেছেএই টাকায় ম্যানেজার সাহেবের কোনাে কমিশন আছে কিনা বােঝা যাচ্ছে নাকমিশন তাে থাকবেইটাকা পয়সার লেনদেন হবে, কমিশন থাকবে নাতা হয় না। 

পকেট ফুলে আছে। গাড়ি থেকে নামার সময় ভাল করে চেক করতে হবে। একটা বান্ডেল পড়ে গেলে সর্বনাশ। 

মােবারক বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার গাড়িতে তেল আছে তাে ? ড্রাইভার বলল, জ্বি আছে। 

মােবারক উদাস গলায় বলল, না থাকলেও সমস্যা নেইতেল নিয়ে নেবগাড়িতে গান শােনার ব্যবস্থা কি আছে

জ্বি আছেদিন গান দিনইংরেজি না বাংলা

ইংরেজি বাংলা হিন্দি একটা দিলেই হয়আর শুনুন গাড়ি একটু স্লো চালানতাড়াহুড়ার কিছু নাইপ্রথমে একটা ফটোগ্রাফারের দোকানে যেতে হবে, ছবি তুলতে হবে। 

গাড়ি চলছেগান বাজছেইংরেজি গানকী অদ্ভুত গানের কথা 

Five Six Seven Eight My boot scooting Baby Is driving me crazy 

মােবারক গাড়িতে বসে আছেগাড়ির মালিক যেভাবে বসে সে সেইভাবেই বসেছেপেছনের সীটে বসেছেএকটা হাত ছড়িয়ে দিয়ে একটুখানি কাত হয়ে বসামােবারকের পকেটে সত্যি সত্যি পঁচিশ হাজার টাকা। একশ টাকার দু‘টো ব্যান্ডেল, পঞ্চাশ টাকার একটা বান্ডেলপ্যান্টের 

বান্ডেল খুলে টাকা বের করতে মায়া লাগছেমায়া করে লাভ নেইটাকা খরচ করতেই হবেটাকার বান্ডেল দেখিয়েতাে আর সওদা করা যাবে নাএক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনতে গিয়ে মােবারক পুরাে কার্টুনই কিনে ফেলল হঠাৎ এতগুলি টাকা পাওয়া গেছেবন্ধুবান্ধবকে কিছু না দিলে নিজেকে চশমখােরের মত লাগবেড্রাইভার বেচারা তাকে নিয়ে ঘুরছে তাকেও এক প্যাকেট সিগারেট দেয়া দরকারসে খুশি থাকবেমানুষের 

উচিত তার সাধ্যমত সবাইকে খুশি রাখা। 

মােবারক হাসি মুখে বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার নাম কী ? ড্রাইভার বলল, স্যার আমার নাম কিসমত। 

ড্রাইভার তাকে স্যার বলছে এটাও বিস্ময়ের ঘটনাইতিহাসের বইলিখে রাখার মত ঘটনা। 

কিসমতের দেশ কোথায়

কুমিল্লা। কুমিল্লা অত্যন্ত ভাল জায়গাবিউটিফুলআপনি সিগারেট খান ? জ্বি সামান্য বদঅভ্যাস আছে। 

মােবারক বেনসনের প্যাকেট এগিয়ে দিলউদার গলায় বলল, আমার সামনেই খানকোনাে অসুবিধা নেইতবে ধুমপান ছাড়ার চেষ্টা করবেনঅতি পাজি নেশা। লাভের লাভ কিছু হয় না শুধু ক্ষতি। 

ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিল মােবারক বলল, রাস্তার পাশে যে চায়ের স্টল আছে তার কোনাে একটার সামনে থামানআসুন চা খাইফুটপাত টিএর মজাই আলাদাচা খেতে খেতে সওদাপাতি কোথায় করব ভেবে নেই। 

 ড্রাইভার ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে থামলগাড়ির দরজা খােলা রেখে গাড়িতে বসে চা খাওয়ার আনন্দই অন্যরকমমােবারকের মনে হল বেহেশতেও নিশ্চয়ই এ জাতীয় ব্যবস্থা আছেবেহেশতবাসিরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেনগাড়ির ড্রাইভার একজন হুরবেহেশতের ফুটপাতে গাড়ি থামছেফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক গেলমান চা নিয়ে দৌড়ে চলে 

এল। 

ড্রাইভার সাহেবজ্বি স্যার। 

গানের ক্যাসেটগুলি আমার পছন্দ হচ্ছে নাFive Six Seven Eight কী রকম গান ? এটা হল ধারাপাতের নামতাগরম কাপড়ের দোকানে যাবার আগে কোনাে একটা ক্যাসেটের দোকানে যাবেনপুরনাে দিনের গান কিনতে হবেএকটা গান লিখ আমার জন্যেটাইপ। 

জ্বি আচ্ছাইচক দানা বিচুক দানাগানটা খোঁজ করতে হবেএক সময় হিট 

গান ছিলআরেকটা হিট গান হল মেরা জুতা হায় জাপানীআগে এইসব গান চায়ের দোকানে বাজাতএখন আর চায়ের দোকানে গান বাজে না আগে চারিদিকে আনন্দ ছিল। এখন চারদিকে নিরানন্দ। 

খাটি কথা বলেছেন স্যার। 

ড্রাইভার সাহেব আপনার ক্ষিধে লাগলে বলবেনভাল কোনাে রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়ে নেব লজ্জা করবেন না। আর এই একশটা টাকা রাখুনআমি যখন বাজার সদাই করব তখন আপনার যদি চাপান খেতে ইচ্ছা করে খাবেন লজ্জার কিছু নাই। 

চা খেতে খেতে মােবারক আজকের দিনের কর্মকাণ্ডের খসড়া মনে মনে তৈরি করে ফেলল। কাগজ কলম থাকলে ভাল হত, লিখে ফেলা যেত । মনের লেখা ঠিক থাকে না। উলট পালট হয়ে যায়। 

ড্রাইভার সাহেবের কাছে কি কাগজ কলম আছে ? জ্বি স্যার আছেএক পিস কাগজ আর কলম দিনতাে লিস্ট করে ফেলি। 

ড্রাইভার কাগজ কলম দিলমােবারক লিস্ট করতে গিয়ে দেখে কিছুই মনে আসছে না। যা করতে হবে তা হল কাগজ কলম হাতে নিয়েই থাকতে হবেকিছু একটা মনে হলেই লিখে ফেলাআপাতত তিনটা আইটেম মনে এসেছে। এই আইটেমগুলি লিখে ফেলা যায়— 

. ক্যাসেট : পুরনাে দিনের গানইচুক দানা বিচুকদানা, মেরা জুতা, একটা গান লিখ হেমন্তের কোনাে এক গাঁয়ের বধু, জগন্ময়ের চিঠি. দাদিজানের জন্যে গরম শাল দাম দিয়ে কিনতে হবেফাইন কোয়ালিটি। ফাইনের উপরেও যদি কিছু থাকেসুপার ফাইন। 

. পরিমল দাস(শয়তান নাম্বার ওয়ান।} | মােবারক ঠিক করল পরিমল দাসের সঙ্গে সে অত্যন্ত দ্র ব্যবহার করবে । মাসে চারশ টাকা করে ছয় মাসে হয় চব্বিশশ টাকাকচকচে একশ টাকার নােটে চব্বিশশ টাকা দেবেটাকার সঙ্গে এক প্যাকেট বেনসনএবং একটা লাইটারটাকাটা দিয়ে বলবে, অসুবিধায় ছিলাম বলে এতদিন দিতে পারি নিনিজগুনে ক্ষমা করে দেবেনছয় মাসে সিট রেন্ট না দেয়ার পরেও 

যে আপনি মেস থেকে বের করে দেন নি এটা অনেক বড় ব্যাপার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *