মােবারকের অস্বস্তি লাগছে। ব্যাপার বােঝা যাচ্ছেনা। এরা কি তাকে বন্দি করে ফেলছে ? এদের চোখের নজর থেকে বাইরে যাওয়া যাবে না এই অবস্থা ।
স্যার আমার তাে একটু দাদির সঙ্গে দেখা করা দরকার।
দাদির সঙ্গে আপনি তাে আর আজই দেখা করছেন না। ভিসা হয়ে যাক, তারপর স্যারকে বলে একদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসবেন।
মােবারক ইতস্তত করে বলল, আজ থেকেই এই বাড়িতে থাকার আমি প্রয়ােজন দেখি না। শেষ কয়েকটা দিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, গল্প করে কাটাতে পারলে ভাল হয়।
ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মােটেই ভাল হয় না। আপনার জন্যে সব ব্যবস্থা করা থাকবে। সন্ধ্যার মধ্যে আপনি অবশ্যই এ বাড়িতে ফিরে আসবেন। আজ সন্ধ্যার পর স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
একবার তাে কথা হয়েছে। আর কথা বলাবলির কী আছে?
ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, স্যার বলেছেন সন্ধ্যার পর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন এই জন্যেই আপনাকে আসতে হবে। নিন এইখানে সই করুন। | মােবারকের বুক ধক করে উঠল, কোথায় সই করিয়ে নিচ্ছে কে জানে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়— এই জাতীয় কোনাে লেখা নাতাে ?
মােবারক বিড়বিড় করে বলল, সই করব কেন ?
টাকা নেবেন, সই করবেন না ? অডিটের কাছে আমাকে হিসাব দিতে হবে না ? গরিব মানুষের টাকা পয়সার হিসাব থাকে না, কিন্তু ধনী মানুষের প্রতিটি পয়সার হিসাব থাকে।
মােবারক সই করল । কত টাকা তাকে দেয়া হচ্ছে পাশে লেখা আছে। লেখা অংকটা বিশ্বাস হচ্ছে না। পঁচিশ হাজার টাকা। মােবারকের মনে হচ্ছে টাকা আসলে দুই হাজার পাঁচশ। একটা শূন্য বেশি লেখা হয়েছে। দশমিকের ফুটা বসাতে গণ্ডগােল হয়ে গেছে। এই টাকায় ম্যানেজার সাহেবের কোনাে কমিশন আছে কি–না বােঝা যাচ্ছে না। কমিশন তাে থাকবেই। টাকা পয়সার লেনদেন হবে, কমিশন থাকবে না। তা হয় না।
পকেট ফুলে আছে। গাড়ি থেকে নামার সময় ভাল করে চেক করতে হবে। একটা বান্ডেল পড়ে গেলে সর্বনাশ।
মােবারক বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার গাড়িতে তেল আছে তাে ? ড্রাইভার বলল, জ্বি আছে।
মােবারক উদাস গলায় বলল, না থাকলেও সমস্যা নেই। তেল নিয়ে নেব। গাড়িতে গান শােনার ব্যবস্থা কি আছে ?
জ্বি আছে। দিন গান দিন। ইংরেজি না বাংলা ?
ইংরেজি বাংলা হিন্দি একটা দিলেই হয়। আর শুনুন গাড়ি একটু স্লো চালান। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। প্রথমে একটা ফটোগ্রাফারের দোকানে যেতে হবে, ছবি তুলতে হবে।
গাড়ি চলছে। গান বাজছে। ইংরেজি গান— কী অদ্ভুত গানের কথা
Five Six Seven Eight My boot scooting Baby Is driving me crazy
মােবারক গাড়িতে বসে আছে। গাড়ির মালিক যেভাবে বসে সে সেইভাবেই বসেছে। পেছনের সীটে বসেছে। একটা হাত ছড়িয়ে দিয়ে একটুখানি কাত হয়ে বসা। মােবারকের পকেটে সত্যি সত্যি পঁচিশ হাজার টাকা। একশ টাকার দু‘টো ব্যান্ডেল, পঞ্চাশ টাকার একটা বান্ডেল। প্যান্টের
বান্ডেল খুলে টাকা বের করতে মায়া লাগছে। মায়া করে লাভ নেই। টাকা খরচ করতেই হবে। টাকার বান্ডেল দেখিয়েতাে আর সওদা করা যাবে না। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনতে গিয়ে মােবারক পুরাে কার্টুনই কিনে ফেলল । হঠাৎ এতগুলি টাকা পাওয়া গেছে। বন্ধুবান্ধবকে কিছু না দিলে নিজেকে চশমখােরের মত লাগবে। ড্রাইভার বেচারা তাকে নিয়ে ঘুরছে তাকেও এক প্যাকেট সিগারেট দেয়া দরকার। সে খুশি থাকবে। মানুষের
উচিত তার সাধ্যমত সবাইকে খুশি রাখা।
মােবারক হাসি মুখে বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার নাম কী ? ড্রাইভার বলল, স্যার আমার নাম কিসমত।
ড্রাইভার তাকে স্যার বলছে এটাও বিস্ময়ের ঘটনা। ইতিহাসের বই–এ লিখে রাখার মত ঘটনা।
কিসমতের দেশ কোথায় ?
কুমিল্লা। কুমিল্লা অত্যন্ত ভাল জায়গা। বিউটিফুল। আপনি সিগারেট খান ? জ্বি সামান্য বদঅভ্যাস আছে।
মােবারক বেনসনের প্যাকেট এগিয়ে দিল। উদার গলায় বলল, আমার সামনেই খান। কোনাে অসুবিধা নেই। তবে ধুমপান ছাড়ার চেষ্টা করবেন। অতি পাজি নেশা। লাভের লাভ কিছু হয় না শুধু ক্ষতি।
ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিল । মােবারক বলল, রাস্তার পাশে যে চায়ের স্টল আছে তার কোনাে একটার সামনে থামান। আসুন চা খাই। ফুটপাত টি। এর মজাই আলাদা। চা খেতে খেতে সওদাপাতি কোথায় করব ভেবে নেই।
ড্রাইভার ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে থামল। গাড়ির দরজা খােলা রেখে গাড়িতে বসে চা খাওয়ার আনন্দই অন্যরকম। মােবারকের মনে হল বেহেশতেও নিশ্চয়ই এ জাতীয় ব্যবস্থা আছে। বেহেশতবাসিরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাড়ির ড্রাইভার একজন হুর। বেহেশতের ফুটপাতে গাড়ি থামছে। ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক গেলমান চা নিয়ে দৌড়ে চলে
এল।
ড্রাইভার সাহেব। জ্বি স্যার।
গানের ক্যাসেটগুলি আমার পছন্দ হচ্ছে না। Five Six Seven Eight কী রকম গান ? এটা হল ধারাপাতের নামতা। গরম কাপড়ের দোকানে যাবার আগে কোনাে একটা ক্যাসেটের দোকানে যাবেন। পুরনাে দিনের গান কিনতে হবে— একটা গান লিখ আমার জন্যে‘ টাইপ।
জ্বি আচ্ছা। ‘ইচক দানা বিচুক দানা’ ঐ গানটা খোঁজ করতে হবে। এক সময় হিট
গান ছিল। আরেকটা হিট গান হল ‘মেরা জুতা হায় জাপানী‘। আগে এইসব গান চায়ের দোকানে বাজাত। এখন আর চায়ের দোকানে গান বাজে না । আগে চারিদিকে আনন্দ ছিল। এখন চারদিকে নিরানন্দ।।
খাটি কথা বলেছেন স্যার।
ড্রাইভার সাহেব আপনার ক্ষিধে লাগলে বলবেন। ভাল কোনাে রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়ে নেব । লজ্জা করবেন না। আর এই একশটা টাকা রাখুন। আমি যখন বাজার সদাই করব তখন আপনার যদি চা–পান খেতে ইচ্ছা করে খাবেন । লজ্জার কিছু নাই।
চা খেতে খেতে মােবারক আজকের দিনের কর্মকাণ্ডের খসড়া মনে মনে তৈরি করে ফেলল। কাগজ কলম থাকলে ভাল হত, লিখে ফেলা যেত । মনের লেখা ঠিক থাকে না। উলট পালট হয়ে যায়।
ড্রাইভার সাহেবের কাছে কি কাগজ কলম আছে ? জ্বি স্যার আছে। এক পিস কাগজ আর কলম দিনতাে লিস্ট করে ফেলি।
ড্রাইভার কাগজ কলম দিল। মােবারক লিস্ট করতে গিয়ে দেখে কিছুই মনে আসছে না। যা করতে হবে তা হল কাগজ কলম হাতে নিয়েই থাকতে হবে। কিছু একটা মনে হলেই লিখে ফেলা। আপাতত তিনটা আইটেম মনে এসেছে। এই আইটেমগুলি লিখে ফেলা যায়—
১. ক্যাসেট : পুরনাে দিনের গান। ইচুক দানা বিচুকদানা, মেরা জুতা, একটা গান লিখ । হেমন্তের কোনাে এক গাঁয়ের বধু, জগন্ময়ের চিঠি। ২. দাদিজানের জন্যে গরম শাল । দাম দিয়ে কিনতে হবে। ফাইন কোয়ালিটি। ফাইনের উপরেও যদি কিছু থাকে। সুপার ফাইন।
৩. পরিমল দাস। (শয়তান নাম্বার ওয়ান।} | মােবারক ঠিক করল পরিমল দাসের সঙ্গে সে অত্যন্ত দ্র ব্যবহার করবে । মাসে চারশ টাকা করে ছয় মাসে হয় চব্বিশশ টাকা। কচকচে একশ টাকার নােটে চব্বিশশ টাকা দেবে। টাকার সঙ্গে এক প্যাকেট বেনসন। এবং একটা লাইটার। টাকাটা দিয়ে বলবে, অসুবিধায় ছিলাম বলে এতদিন দিতে পারি নি। নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। ছয় মাসে সিট রেন্ট না দেয়ার পরেও
যে আপনি মেস থেকে বের করে দেন নি এটা অনেক বড় ব্যাপার।