আপনি আমার সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহারই করেন না কেন আপনাকে কিছুতেই খারাপ লােক বলা যাবে না। আপনি আসলে অতি মহৎ ব্যক্তি। মেসের ম্যানেজারী করে ধর্ম কর্ম করলে এতদিনে বড় সাধু হয়ে যেতেন।
মােবারক বসল। তার খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সে ভাবের জগতে চলে এসেছে। একা একা এসেছে বলে সামান্য মন খারাপ হচ্ছে। শাল এবং স্যুয়েটার কেনা হয়ে গেলেই জহির এবং বজলুকে খুঁজে বের করতে হবে। দুপুরে পুরনাে ঢাকায় গিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়া যায়। কাচ্চি বিরিয়ানী সঙ্গে চিকেন কোরমা। রাতে ছাতিম গাছের নিচে ভাল জিনিস নিয়ে বসতে হবে। বিদেশী জিনিস। সমস্যা হচ্ছে সন্ধ্যার পর বড় সাহেব কথা বলবেন। উনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হবে। দাদিজানের কথা বলে ছুটি নিতে হবে। বিদেশ যাবার আগে মুরুব্বীদের দোয়াতাে নিতেই হবে। বড় সাহেব আপত্তি করবেন বলেতাে মনে হয় না।
শালের দোকানের সেলসম্যান বলল, স্যার বলুন কোন প্রাইস রেঞ্জের ভেতর মাল দেখাব।
মােবারক বলল, ভাল কিছু দেখান। আমি আমার দাদিজানের জন্যে কিনছি। বুড়াে মানুষ কয়দিন আর বাঁচবে। একটা ভাল শাল গায়ে দিয়ে
মরুক।
কালার কী দেখাব স্যার? কালার কোনাে ব্যাপার না। দাদিজান চোখে দেখেন না। চোখে দেখেন বলেই জিনিসটা হতে হবে সুপার ফাইন। যেন হাত দিলেই কোয়ালিটি বােঝা যায়।
মাখনের মত মােলায়েম শাল দেখাব। হাতে নিলে মনে হবে শাল হাতের মধ্যে গলে যাচ্ছে। পাহাড়ি কচি ভেড়ার গায়ের পশমের শাল। তাও সব পশম না। পেটের পশম । পিঠের পশমের না ।
পিঠের পশমের সমস্যা কী ?
পিঠে সূর্যের আলাে বেশি পড়ে, পশম শক্ত হয়ে যায়। দাম স্যার সামান্য বেশি পড়বে। তবে জিনিসের মত জিনিস।
দেখি কেমন জিনিস। বুড়িকে কোনােদিন কিছু দেয়া হয় না। দেব যখন ভাল জিনিসই দেই । আর আপনার এখানে ভাল স্যুয়েটার আছে ?
পিওর আফগান উলের স্যুয়েটার আছে। শুধু স্যুয়েটার গায়ে দিয়ে বরফের চাঙে শুয়ে থাকতে পারবেন। কিচ্ছু হবে না। বরং গরমে ঘামাচি হয়ে যাবে।
আমার দুই বন্ধুর জন্যে দু’টা ভাল স্যুয়েটার বের করেন। আপনার এখানে সিগারেট খাওয়া যায় ?
জ্বি না স্যার। কাপড়ের দোকানতাে। তবে আপনি খান অসুবিধা নেই। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।
বজলু বা জহির কাউকেই পাওয়া গেল না। বজলু যে বাসায় থাকে সে বাসায় এক ভদ্রলােক বের হয়ে কঠিন গলায় বললেন, বজলু নামে কেউ
এখানে থাকে না।
মােবারক বলল, কতদিন ধরে থাকে না! অনেক দিন । কোথায় থাকে জানেন? জানি না ।
আমি বজলুর ফ্রেন্ড। তার জন্যে একটা চাকরির খোজ এনেছি। বান্দরবানে ফরেস্টে । মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন। বেতনের বাইরে এক্সট্রা ইনকামও আছে। আজকের মধ্যেই ছবিসহ বায়ােডাটা জমা দিতে হবে। যদি একটু কাইন্ডলি বলেন, কোথায় গেলে তাকে পাব।
কোথায় গেলে পাবেন আমি জানি না।
দ্রলােক ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মােবারকের মন সামান্য খারাপ হল। দ্রলােক যদি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন তাহলে ভদ্রলােকেরই লাভ হত। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট পেয়ে যেতেন।
প্যাকেট আশি টাকা। প্রতিটা সিগারেট চার টাকা। খারাপ কী ?
জহিরও বাসায় নেই। জহিরের বাবা বারান্দায় বসে ছিলেন। মােবারকের সঙ্গে তার কয়েকবার দেখা হয়েছে, তারপরেও তিনি মােবারককে চিনতে পারলেন না। মনে হয় চোখে ছানী পড়েছে। ছানী পড়া লােকজন রােদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসে। এই লােকও রােদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তুমি জহিরের বন্ধু? জ্বি।
অদ্ভুত কথা বললা। জহিরের কোনাে বন্ধু আছে বলেতাে জানতাম না। জহিরের আছে শত্রু। ও বাসায় নাই ?
নাই। সকালে রক্ত বমি করেছে। খবর শুনে দৌড় দিয়ে গেলাম। আমাকে বলে— রক্ত না বাবা। পানের পিক।
জর্দা দিয়ে পান খেয়েছি সেই পানের পিক। আরে ব্যাটা তুই আমারে পানের পিক শিখাস। কোনটা রক্ত কোনটা পানের পিক আমি জানি না ?
ডাক্তারের কাছে গিয়েছে ?
ও কি আর যেতে চায়। আমার বড় ছেলে বলতে গেলে কানে ধরে নিয়ে গেছে।
কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছে জানেন?
জানি না। তােমারে একটা কথা বলি— ডাক্তারে এখন তার কিছু হবে না। তুমি যদি চার পাঁচটা ডাক্তার পানিতে গুলে তাকে খাইয়ে দাও তারপরও কিছু হবে না। আজকে মুখ দিয়ে রক্ত পড়বে, কাল পড়বে নাক দিয়ে, তারপর পড়বে কান দিয়ে। তুমি যখন বলছ তুমি তার বন্ধু তাহলেতাে সবই জান।
মােবারক অত্যন্ত বিনয়ের সলে বলল, চাচাজী আমি আসলে কিছু জানি । স্কুলে তার সঙ্গে পড়েছি। বিদেশে চলে গিয়েছিলাম— অল্প কিছুদিন হল ফিরেছি।
তাহলেতাে তুমি ঘটনা কিছুই জান না। জ্বি না। কিছু জানি না। আমার ছেলে উচ্ছন্নে গেছে। বলেন কী ?
পরশু রাতে তিনটার সময় বাসায় ফিরেছে। আমি দরজা খুলে দিলাম— আমাকে চিনে না। আমাকে বলে– হ্যালাে আপনি কে ? কাকে চান ?
সর্বনাশ। নিজের বাবাকে বলে হ্যালাে হ্যালাে আপনি কে ?
বাইরের লােককে এইসব কথা বলতে ভাল লাগে না। তুমি ওর বন্ধু। তােমাকে বললাম। রােজগার নাই, রােজগারের চেষ্টা নাই । নেশা ভাং করে ।
| মােবারক এক প্যাকেট সিগারেট বাড়িয়ে দিল । বিনীত গলায় বলল, বিদেশ থেকে তেমন কিছু আনতে পারি নাই চাচাজী–– আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট।
বৃদ্ধ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাপা কাঁপা গলায় বললেন, মানুষের ছেলে পুলে দেশে বিদেশে যায়। কত কিছু আনে– আর আমারটাকে দেখ— রক্তবমি করে। পাতলা পায়খানা করে। সব কপাল। ভাঙ্গা কপাল ।।
মােবারক বলল, চাচাজী নেন। বৃদ্ধ ধরা গলায় বললেন, আবার কী? একটা লাইটার।
তােমার নামটা যেন কী বাবা। চেহারা মনে আছে। ছােট বেলায় দেখেছি নাম মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি গেছে। যার ঘরে এমন আজদহা তার স্মৃতিশক্তি থাকবে কেন? তুমিই বল থাকার কোনাে কারণ আছে ?
জ্বি না। বাবা তােমার নামটা বল ? আমার নাম মােবারক। এইতাে মনে পড়েছে মােবারক। মালয়েশিয়া গিয়েছিলে তাই না? জ্বি না। এখন মনে পড়েছে। কুয়েত। জি না সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম।
ও হ্যা হ্যা সুইজারল্যান্ড। এখন মনে পড়েছে। যাওয়ার আগে দেখা করে দোয়া নিলে।
জ্বি হ্যা। বিবাহ করেছ ? জ্বি না।
দেশে যখন এসেছ বিবাহ কর। দেশের একটা মেয়ের গতি থােক। আমার আজদহা যে বিয়ে করে ঘর সংসার করবে এই আশা করি না। এখন পরের ছেলের বিবাহ দেখে শান্তি পাওয়া ।