রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-১২)

টুর চোখ স্থির হয়ে যায়। স্বরও কেমন খসখসে হয়ে যায় ছােট রফিক লােকটা ভাল না মন্দ এইটা আমি জানি না। এইটা আমারে জিগাইয়া লাভ নাই। আমি জানি না। আমি খালি জানি লােকটার দিল কতবড়। মানুষটার ওজন যদি হয় একমণ তার দিলের ওজন সাত মণ। | এ ধরনের গল্প বটু তাকে নিয়ে করবে না। কারণ সে ছােট রফিক নাসে মােবারক। তার দিল ছােট না বড় তা নিয়ে মানুষের কোনাে কৌতূহল নেই। ছােট রফিকের দিল ছােট না বড় এটা নিয়ে সবারই কৌতূহল আছে।রূপার পালঙ্ক

এখন কী করা যায় ? মেসে যাবে ? পরিমল দাসের টাকা পয়সা মিটিয়ে আবার এসে খোঁজ নেবে জহিররা এল কি-না ? করা যেতে পারে। সঙ্গে গাড়ি আছে। উঠে বসলেই হলগাড়ি থাকার কত মজা! রিকশা বা বেবী টেক্সির মত আগে জিজ্ঞেস করতে হয় না— অমুক জায়গায় যাবে কি-না। যেতে রাজি হলেই যে সব মুশকিল আহসান তা না— শুরু হয় ভাড়া নিয়ে কচাকচি। মােবারক পরিমল দাসের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল । মনু মিয়াকে বখশিশ হিসেবে কিছু দিতে হবে। একটা লুঙ্গি কেনার টাকা। যদিও হারামজাদা মহা 

বদ। কী আর করাএই দুনিয়ার সবাই বদ। কেউ বেশি কেউ কম। 

সন্ধ্যার দিকে মােবারক কুলুসের দোকানে গেল। যদি ওদের পাওয়া যায়। তাছাড়া কুদুসকে এক প্যাকেট সিগারেট দিতে হবে। হাজার হলেও বন্ধু মানুষ। বিপদে আপদে বাকিতে চা খাওয়ায়। গাড়িটা রাখতে হবে কুদুসের চায়ের দোকানের সামনে। কয়েকবার হর্ণ দিয়ে নামতে হবেএই সময় ছােট রফিক থাকলে ভাল হয়। সে অবশ্য ছােট রফিকের সঙ্গে খুবই দ্র ব্যবহার করবে। এক প্যাকেট সিগারেট ছােট রফিককেও দেয়া যেতে পারে। সিগারেট দেয়ার পর সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা। যেমন— 

ভাই ভাল আছেন। আপনার কথা শুনেছি এর আগে একবার দেখা হয়েছিল। চিনতে পারিনি। কেমন আছেন ভাই ? 

অতি ডেনজারাস লােক। বেশি খাতির দেখানাে ঠিক না। এদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায়। এদের কাছে মানুষের জীবনের দাম পাঁচ পয়সা। 

আল্লাহ পাকের দুনিয়াতে কত অদ্ভুত ব্যাপারই না আছেকালাে যে রঙ সেই রঙেরও কত পদ। পাতিল কালাে, কাক কালাে, ময়না কালাে। মন্দ মানুষেরও কত অদ্ভুত পদপৃথিবীর সবচে’ মন্দ মানুষটা কে জানা গেলে ভাল হত। পৃথিবীর সবচে’ মন্দ মানুষ এবং পৃথিবীর সবচে’ ভাল মানুষ এই দু’জনকে যদি মুখখামুখি বসিয়ে দেয় যেত। তারা যদি খানিকক্ষণ গল্প করে কী নিয়ে গল্প করবে ? | কুদুস আজ দোকানে আসেনি। তার শালীর বিয়ে। রাতে একবার ফিরতে পারে। কখন ফিরবে কেউ জানে না। মােবারক এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল। এই এক ঘণ্টায় চার কাপ মালাই চা খেয়ে ফেলল। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিডনির হয়ত ক্ষতি হচ্ছে । একজনের বায়না করা কিডনির ক্ষতি করা ঠিক না। চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকাও ঠিক না। উঠে যাবার মুখে বটুকে একটা একশ টাকার নােট দিল চায়ের দাম বাবদ । বটু বিরক্ত মুখে বলল, ছােট নােট দেন| মােবারক উদাস গলায় বলল, ছােট নোেট নাইরে। সবই বড় নােট। 

কথা সত্যি না। ভাংতি টাকা এখন মােবারকের কাছে আছেচার কাপ চায়ের দাম একশ টাকার নােটে দেয়ার পেছনে কারণ আছেবটু যখন ভাংতি নিয়ে আসবে তখন সে ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলবে- ভাংতি রেখে দে বখসিশ। 

ছােট রফিক একবার বটুকে চা খেয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নােট বখশিশ হিসেবে দিয়ে ছিল। এমন কোনাে লােক নেই যার সঙ্গে বটু এই গল্প করেনি। গল্প করার সময় বটুর চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে যেতএই গল্প করার সময়

পরিমল দাস মেসের বারান্দায় বসে জুতা পালিশ করাচ্ছিল। গাড়ির হর্ন শুনে তাকাল এবং যতটুকু অবাক হবার কথা তার চেয়েও বেশি অবাক হলমােবারক গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, পরিমলদা ভাল আছেন? পরিমল হঁ্যা সূচক মাথা নাড়লমােবারক বলল, রাতের বেলা জুতা পালিশ করানাে ঠিক না। পরিমল বলল, এই গাড়ি কার ? আমার গাড়ি আবার কার তােমার গাড়ি মানে ? মােবারক রহস্যময় গলায় বলল, সামান্য অন্যায় করে ফেলেছি পরিমলদা, কিছু মনে করবেন না। বাবা-মার সঙ্গে রাগ করে মেসে এসে লুকিয়ে ছিলাম। 

এখন মিটমাট হয়েছেঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছি। বল কী ? আপনার হিসাবটা দিনতাে মিটিয়ে দেইআর মনুকে আসতে বলুন। ওকে সামান্য বখশিশ দেব। 

এগিয়ে দিল। টাকাটা রাখুন। মনু মিয়া যদি কখনাে আসে টাকাটা তাকে দেবেনজ্বি আচ্ছা। আমার কি কোনাে চিঠি পত্র আছে? বলতে পারছি না। এলে আপনার ঘরেই আছে। আমি ঘরে ঢুকব না। আপনি যান দেখে আসুন । পরিমল অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে চিঠির খুঁজে গেল। মােবারক অপেক্ষা করছে। প্রতি মাসে একটা চিঠি সে দাদিজানের কাছ থেকে পায়। গত মাসে চিঠি আসে নি। এ মাসেও নাবুড়ি মরে গেছে কি-না কে জানে। পরিমল ফিরে এসে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, চিঠি নাইতাকে দেখে মনে হচ্ছে চিঠি না আসার অপরাধে সে অপরাধী। 

মনুতাে নাই। তার চাকরি নট হয়ে গেছে। কেন? মেসের স্টোর থেকে দু’ডজন ডিম চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। ধরা পড়েছে হাতে নাতে মার দেয়া হয় নাই ? এমন মার খেয়েছে এক মাস বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। চোখও মনে হয় একটা গেছে। চোখ গেছে মানে কী? ভিড়ের মধ্যে কেউ মনে হয় চোখে খামচি দিয়েছে। গলগল করে চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। মােবারকের মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। চোরের মারে এ রকম ঘটনা সব সময় ঘটে। ভিড়ের সুযােগে কেউ না কেউ ভয়ংকর কিছু করে শান্ত ভঙ্গিতে চলে যায়। যে এই কাজটা করে সে এম্নিতে সহজ সাধারণ মানুষ। দশটা পঁচটা অফিস করে।

সন্ধ্যাবেলায় বাচ্চাদের পড়তে বসায়। ছুটিছাটায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। বাদরের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বাঁদরের খেলা দেখে। মনু মিয়ার একটা চোখ তাহলে তুলে ফেলেছে ? মনে হয় সে রকমই। ভাল। দু’টা কিডনি যেমন মানুষের দরকার নাই। দু’টা চোখেরও দরকার নাই। একটাই যথেষ্ট। মােবারক পরিমল দাসের হিসাব মিটিয়ে দিল উদাস গলায় বলল, আমার বিছানা বালিশ কাউকে দিয়ে দেবেন। কাকে দেব ? যাকে ইচ্ছা দিবেন। পরিমল দাস লজ্জিত গলায় বলল, না বুঝে আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছিভাই মনে কিছু রাখবেন না । আচ্ছা রাখব না । মনু মিয়াকে কি হাসপাতালে নিয়ে গেছে ? 

। মেরে মেসের সামনে ফেলে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পরে নিজেই হেঁটে কোথায় যেন চলে গেছে। মােবারক পকেট থেকে দু’টা পাঁচশ টাকার নােট বের করে পরিমলের দিকে 

মােবারক তার থাকার ঘর দেখে মুগ্ধ । মনে মনে কয়েকবার বলল ‘খাইছে। রে!খাটের উপর বিছানাে চাদর দেখে প্রথম যে ইচ্ছাটা হল তা হচ্ছে চাদর গুটিয়ে হ্যান্ড ব্যাগে সামলে ফেলা। বড়ই বাহারী চাদর। খাটের পাশের টেবিলে নগ্নপরী লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। এই পরী কোনােমতে কুন্দুসের হাতে ধরিয়ে দিতে পারলে কুদুস চোখ বন্ধ করে দু’ হাজার টাকা দিবেপরীর পায়ের কাছে এসট্রে আছেএসট্রের রঙ গাঢ় লালমনে হচ্ছে জবা ফুল ফুটে আছে। এসট্রেটা অবশ্যই পাঞ্জাবির পকেটে ফেলে চলে যাওয়া যায়। এ বাড়ির লােকজন নিশ্চয়ই জিনিসপত্রের হিসেব রাখে না। প্রতি সন্ধ্যায় ম্যানেজার টাইপ একজন জাবদা খাতা এবং কলম নিয়ে উপস্থিত হয়ে জিনিসপত্রের রােলকল কি করবে? তার এ্যাসিস্টেন্ট একটা করে নাম বলবে আর সে জাবদা খাতায় টিক মার্ক দেবে— 

১টা পরী ১টা লাল এসট্রে ১টা পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি ১টা রঙিন TV ১৮ ইঞ্চি ১টা দেয়াল ঘড়ি ৪টা পেনটিং। ১টা পানির জগ ১টা ফ্লাস্ক ৩টা ফুলদানী 

১টা টেবিল ঘড়ি এমন সিস্টেম যেহেতু নাই পরীক্ষামূলক ভাবে এসট্রে সামলে দেখা যেতে পারে। 

একজন কাজের লােক মােবারকের সঙ্গে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। ট্রেনের টিকিট চেকার যখন হঠাৎ দেখে ফার্স্ট ক্লাস এসি কামরায় লুঙ্গিপরা প্যাসেঞ্জার পান খাচ্ছে এবং ভুড়ি বের করে ভুড়ি চুলকাচ্ছে তখন। প্রচণ্ড রাগতে গিয়েও রাগ সামলায় কারণ এই প্যাসেঞ্জারের টিকিট আছে। মােবারকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের লােকেরও সেই ট্রেনের টিকিট চেকারের মত অবস্থা। মােবারককে বের করে দিতে পারলে সে খুশি হয় । বের করা সম্ভব হচ্ছে না— মােবারকের টিকিট আছে। 

মােবারক বলল, এই ঘরে এসি নাই ? এমন ভাবে বলল যেন এসি না থাকলে রাতে তার ঘুমুতে সমস্যা হবে। কাজের লােক থমথমে গলায় বলল, শীতের দিনে এসি দিয়া কী করবেন? 

মােবারক বিরক্ত গলায় বলল, এসি দিয়ে কী করব সেটা আমার ব্যাপার। আছে কি-না বল। 

জ্বি আছে। 

এসি ছাড়ঘর ঠাণ্ডা করে লেপ গায়ে শুয়ে থাকার অন্য আরামটিভিতে আছে দেখতে পাচ্ছি। ভিসিআর আছে? 

ভিসিআর এই ঘরে নাই। 

অন্য ঘর থেকে জোগাড় করে ফিট করে দাও। রাতে ঘুম না হলে ছবি দেখবক্যাসেট আছে না? 

ইংরেজি ক্যাসেট আছে। 

হিন্দি জোগাড় কর। একটা ছবি আমার অনেক দিন থেকে দেখার শখ। আমার বন্ধু জহির এই ছবি দশবার দেখেছে। নাম হল ‘রােজা। একটা কাগজে নামটা লিখে নিয়ে যাও। ভিডিওর দোকান থেকে নিয়ে আসবে। পারবে না । 

 তােমার নাম কী ? আমার নাম সুলতান। শুধু সুলতান, না সুলতান মিয়া ? আমার নাম মােহাম্মদ সুলতান। 

শােন মােহাম্মদ সুলতান— আমার দিকে এই ভাবে তাকাবে না। আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমার শরীর থেকে কিডনি না নেয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করতে হবে। কিডনি না দিয়ে আমি যদি এখন ফুটে যাই তােমার বড় সাহেব বিরাট বিপদে পড়বে। বুঝতে পারছ ? 

মােহাম্মদ সুলতান কিছু বলল নামােবারক বলল, এখন বল ‘রােজা’ জোগাড় করা যাবে না

জ্বি যাবে। ভেরি গুড। তুমি রােজা দেখেছ ? জ্বি না ।। কোনাে অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে দেখবে। আপনার ডিনার কি এই ঘরে দিয়া যাব ? ঘরে ছাড়া অন্য কোথাও খাওয়ার ব্যবস্থা আছেগেস্ট ডাইনিং হল আছে । খুবই ভাল কথা। ডিনার গেস্ট ডাইনিং হলে দিবে। মেনু কী? আমি জানি না— বাবুর্চি জানে। 

বাবুর্চির কাছ থেকে জেনে আস। আরেকটা কথা এই ঘরেতাে গান শােনার কোনাে ব্যবস্থা দেখছি নাএকটা ক্যাসেট প্লেয়ার বা মিউজিক সেন্টার জোগাড় কর। আমি কিছু ক্যাসেট কিনেছি গাড়িতে আছেনিয়ে আসআমার ফেভারিট সব গান আছে- ইচুক দানা বিচুক দানা দানার উপর দানাশুনেছ এই গান? 

জ্বি নাআমার সাথে শুনবে কোনাে সমস্যা নেই। ম্যানেজার সাহেব বলেছিলেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *