রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-১৩)

বড় সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলবেন। কখন বলবেন জান ? 

জ্বি না। 

জেনে আসযদি উনার দেরি হয় তাহলে আমি গােসল করববাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থা আছে ? 

জি আছে। 

গরম পানি কীভাবে ছাড়ে দেখিয়ে দিয়ে যাও। গােসলের আগে কফি খাবমগ ভর্তি করে এক মগ কফি আন। এক্সট্রা চিনি আনবে। আমি চিনি বেশি খাই ।রূপার পালঙ্কসুলতান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মােবারক মানিব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নােট বের করল সুলতানের বখশিশ। বড় জায়গায় থাকলে মন বড় হয়ে যায়। একশ টাকার কমে বখশিশ দিতে ইচ্ছা করে নামােবারক বিছানায় বসে ইচুক দানা বিচুক দানা গানটার সুর শীষে তুলতে চেষ্টা করছে। সুরটা ঠিকমত আসছে না। 

সুলতান কফির মগ নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, বড় সাহেব আপনেরে ডাকে। কফি শেষ কইরা উনার সঙ্গে দেখা করেন। 

বড় সাহেবের ঘরে আর কে আছে ? এখন কেউ নাইস্যার একা। কেন স্যারের বেগম সাহেব কোথায় ? বেগম সাহেব স্যারের সাথে থাকেন না। আলাদা বাড়িতে থাকেন। কেন ? স্যারের সাথে বনিবনা হয় না। অসুখে দেখতেও আসেন না ? প্রত্যেক দিনই একবার করে আসেন। আজও সকালে আসছিলেন। তোমার স্যার লােক কেমন ? লােক অত্যন্ত ভাল। খালি রাগ বেশি। 

মােবারক কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল, ভাল মানুষের রাগ থাকে বেশি। যারা মিচকা শয়তান— তারা রাগে না। পাছায় লাথি মারলেও লাখি খেয়ে হাসবে । শােন সুলতান আমি যদি দশ পনেরাে মিনিট পরে যাই কোনাে অসুবিধা আছে। গােসল করে ফিটফাট হয়ে যেতে চেয়েছিলাম। 

আপনি এখনি চলেন। 

মােবারক সরাসরি বড় সাহেবের শােবার ঘরে ঢুকতে পারল না। তাকে জুতা খুলে রাখতে হলবাথরুমে ঢুকে ডেটল-পানি দিয়ে হাত মুখ ধুতে হল। প্রথমবার যখন তার সঙ্গে দেখা হয় তখন এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল না। এখন কেন কে বলবে? 

ঘরের মুখেই ডাক্তারডাক্তার সাহেব অত্যন্ত সুদর্শন। টিভির প্যাকেজ প্রেমের নাটকে নায়ক হিসেবে খুব মানানসই। ডাক্তার সাহেব লজ্জিত মুখে বললেন, আমরা স্যারের ঘরটাকে স্টেরাইল রাখার চেষ্টা করছি। একটু এক্সট্রা প্রিকশন। আপনার ইনকনভেনিয়েন্সের জন্যে দুঃখিত। যান স্যারের সঙ্গে কথা বলুন। আমি পাশের ঘরেই আছি। 

মােবারক ভীত মুখে ঘরে ঢুকল । যদিও ভয় করার তেমন কোনাে কারণ নেই। বড় সাহেব নিশ্চয়ই তাকে ধমক দেবেন না । 

মানুষটাকে আজ খুবই অসুস্থ লাগছেহাত-পামুখ কেমন হলুদ হলুদ। এটা অবশ্যি হলুদ পায়জামা পাঞ্জাবির জন্যেও হতে পারে। তবে উনার চোখ উজ্বল। তারচেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার দ্রলােকের মুখ হাসি হাসি। 

মােবারক বলল, স্যার কেমন আছেন ? 

ভদ্রলােক হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালেন যার অর্থ— আমি ভাল আছিতারপরই বললেন, মােবারক বস। 

মােবারক ধাধায় পড়ে গেল। কোথায় বসবে ? ঘরটা বড়। বেশ বড়। কিন্তু বসার কোনাে ব্যবস্থা নেই। খাটের দু’পাশে দুটা টেবিল আছে। একটা টেবিল ভর্তি বই, অন্য টেবিলটায় অষুধপত্র। মােবারক নিশ্চয়ই টেবিলের উপর উঠে বসবে নাস্যারের বিছানায় বসার প্রশ্নই উঠে না। তাহলে কোথায় বসবে— মেঝেতে ? না-কি পাশের ঘর থেকে মােড়া জাতীয় কিছু নিয়ে আসবেপাশের ঘরে ডাক্তার সাহেব আছেনউনাকে বললে উনিও হয়ত সমস্যা সমাধান করে দেবেন। 

বড় সাহেব আজ তাকে তুমি তুমি করে বলছেন। এটা ভাল। তুমি বলার মধ্যে কাছের মানুষ, কাছের মানুষ ভাব আছে। বড় সাহেব তার নাম মনে রেখেছেন— এটা বিস্ময়করযদিও সে বড় সাহেবের নাম জানে না। নাম জানাটা উচিত ছিল। আজ এই ঘর থেকে বের হয়েই নামটা জেনে নিতে হবে। 

বড় সাহেব বললেন, বিছানায় বােস। এই ঘরে ইচ্ছে করেই আমি সােফা বা চেয়ার রাখিনিসােফা চেয়ার থাকলেই রােগী দেখতে এসে লােকজন বসে পড়ত। মানুষের স্বভাব হচ্ছে একবার বসলে সে উঠতে চায় না। 

মােবারক বড় সাহেবের পায়ের কাছে খুব সাবধানে বসল। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে লােকটাকে তার পছন্দ হচ্ছেএটা খুবই ভাল লক্ষণ যে লােকটার শরীরে তার শরীরের একটা অংশ থাকবে সেই লােকটা পছন্দের না হলেতাে মুশকিল। | বড় সাহেব হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে একটা কমলা নিয়ে মােবারকের দিকে গড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, কমলা খাও। 

কমলা মােবারকের খুবই অপছন্দের ফল। কিন্তু বড় সাহেব দিচ্ছেন না খাওয়াটা বিরাট বেয়াদবীমােবারক কমলার খােসা ছড়াচ্ছে। তার প্রধান চিন্তা খােসাগুলি কোথায় ফেলবে ? ময়লা ফেলার ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে নাখােসা হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে নাকি। 

মােবারকজ্বি স্যার। বলতাে দেখি একটা কমলার কয়টা কোয়া থাকেস্যার বলতে পারছি না। 

বড় সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, দশটা কোয়া থাকে। তুমি গুনে দেখ। 

মােবারক গুনে দেখল আসলেই দশটা কোয়াকেউ একজন আগে ভাগে না গুণে বলে দিচ্ছে কমলার দশটা কোয়া এটা এমন কিছু ব্যাপার নাআগে গুণে দেখেছেতবু মােবারক খুবই অবাক হয়েছে এমন ভঙ্গি করল। 

বড় সাহেব গল্প বলার ভঙ্গিতে সহজ গলায় বললেন, আমার বাবা ছিলেন বাংলা বাজারে প্রুফ রিডারহতদরিদ্র মানুষআমরা ছিলাম তিন ভাই বােনশীতের সময় বাবা মাঝে মধ্যে একটা কমলা নিয়ে ফিরতেনকোয়া ভাগাভাগি করে তিন ভাই বােনকে দিতেনএকটা কোয়া সব সময় বেশি হতসেই থেকেই আমি জানি কমলার দশটা কোয়া। 

মােবারক বলল, বাড়তি কোয়াটা কে পেত স্যার। 

আমার বােন পেতপৃথিবীর সব বাবার মত আমার বাবাও তার কন্যাকেই সবচেবেশি আদর করতেন। এই গল্পটা তােমাকে কেন বললাম তুমি জান

জ্বিনা স্যার। 

গল্পটা তােমাকে বললাম, কারণ আজ আমার টোটেল এ্যাসেট প্রায় ১০০ কোটি টাকাপুরনাে দিনের কথা আমার কখনােই মনে পড়ে না। কিন্তু কমলা 

দেখলেই মনে হয় এর ভেতর দশটা কোয়া ।। 

আপনার বাবা কি আপনার এই অবস্থা দেখে গেছেন

দেখে যান নিতার জন্যে আমার খুব যে কষ্ট হয় তাও কিন্তু নাএই পৃথিবীতে সব মানুষই একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে আসেবাবা এসেছিলেন হত দরিদ্র প্রুফ রিডারের চরিত্রে অভিনয় করতেতিনি চমৎকার অভিনয় করে বিদায় নিয়েছেন। 

স্যার আপনি খুবই সুন্দর করে কথা বলেন। 

দ্যাটস টুআমি অবশ্যই খুব সুন্দর করে কথা বলিসুন্দর করে কথা বলি বলেই মিথ্যা কথাগুলি সত্যির মত করে বলিবাবার জন্যে আমার কষ্ট হয় নাএটা খুবই মিথ্যা কথাউনার জন্যে ভয়ঙ্কর কষ্ট হয়কমলাটা খাও মােবারকহাতে নিয়ে বসে আছ কেন ? | মােবারক কমলার একটা কোয়া মুখে দিলতার হঠাৎ করে খুব মনটা খারাপ হয়েছে সে যেন চোখের সামনে বড় সাহেবের দরিদ্র বাবাকে দেখতে পাচ্ছেবেচারা কমলার কোয়া ভাগ করছে। 

বড় সাহেব শান্ত গলায় বললেন, চোখটা মােছ মােবারকআমার গল্প শুনে তােমার চোখে পানি এসেছেআমি খুবই লজ্জা পাচ্ছিআমি কোনাে স্টোরি টেলার নাআমি রসকষহীন বিজনেস ম্যানতােমারওতাে বিজনেসম্যান হবার ইচ্ছা তাই না? 

জ্বিকীসের বিজনেস করবে ভেবেছ কিছু? জ্বি-না। 

তুমি ভাব নি, কিন্তু আমি ভেবেছিতুমি আধুনিক একটা ফলের দোকান দাওবাংলাদেশের মানুষ এখন ফল খাওয়া শুরু করেছেযেহেতু দেশে এখন ফ্রী ইকনমি, তুমি যেকোনাে দেশ থেকে ফল আমদানী করতে পারতােমার ফলের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব রকম ফল পাওয়া যাবে। স্ট্রবেরী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের লটকনদোকানটার একটা অংশ থাকবে ফুলের জন্যেটাটকা ফল এবং টাটকা ফুল বিক্রি হবেএকটা দাগ ধরা ফলও দোকানে থাকতে পারবে নাএকটা বাসি ফুলও থাকতে পারবে নাপুরাে দোকানটা হবে এয়ারকন্ডিশন্ডতােমার দোকানের নামও আমি ঠিক করে রেখেছি। 

FRUITS AND FLOWERS 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *