মােবারক ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগছে।বড় সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মানুষের ধারণা বিজনেসম্যানরা স্বপ্ন দেখতে পারেন না। স্বপ্ন দেখার অধিকার শুধু কবিদের, গল্পকারদের, চিত্রকরদের। খুব ভুল ধারণা। প্রতিটি সাকসেসফুল বিজনেসম্যান হচ্ছেন একজন ড্রিমার। এক অর্থে কবি সাহিত্যিকদের চেয়ে তারা বড় ড্রিমার। কবি সাহিত্যিকরা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারেন না, একজন ব্যবসায়ী ড্রিমার পারেন। ব্যবসায়ীদের স্বপ্নগুলি খুব জাগতিক হয় এটাও অবশ্যি একটা কারণ।
বড় সাহেব হঠাৎ চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছে তার কোনাে শারিরীক অসুবিধা হচ্ছে। মােবারক উঠে দাড়িয়ে বলল, স্যার আমি কি এখন যাব?
তিনি হা–সূচক মাথা নাড়লেন।
মােবারক বলল, আমার দাদিজান থাকেন নেত্রকোনায়, উনাকে একটু কি দেখে আসব ?
| অবশ্যই দেখে আসবে। আর শােন মােবারক তােমার শরীরের একটা অংশ আমি ব্যবহার করব। আমি ধরে নিচ্ছি এটা তােমার একটা উপহার । সেই কারণেই আমি FRUITS AND FLOWERS তুমি যাতে করতে পার সেই ব্যবস্থা করব। ভালমতই করব। আমার উপহারটাও খারাপ হবে না।
মােবারক বলল, স্যার দেখবেন আমরা তিনজন জান দিয়ে খাটব।। বড় সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তােমরা তিনজন মানে! আমার দুইজন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে স্যার।
ভাল। একজন বন্ধু থাকাই ভাগ্যের কথা। তােমার আছে দু’জন । তুমিতাে ভাগ্যবান মানুষ। আচ্ছা তুমি এখন যাও শরীরটা ভাল লাগছে না। কথা বলে আরাম পাচ্ছি না। আমি বিশ্রাম করব।
মােবারক ঘর থেকে বের হবার আগে আরেকবার বড় সাহেবের দিকে তাকালাে। আশ্চর্য, বড় সাহেব তার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
রাত এমন কিছু না। এগারােটাও বাজে নি। রাত শুরু হয় একটা থেকে। কাজেই রাত এখনাে শুরুই হয় নি। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে। তিনি নিশ্চয়ই রাত তিনটার সময় আবারাে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন না। তাঁর কাছে ছুটি নেয়া আছে। দাদিজানকে দেখতে যাবার ছুটি। কাজেই মােবারক এখন ঘর থেকে বের হতে পারে। দুই বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারে। তিন বন্ধু মিলে রাস্তায় খানিকক্ষণ হেঁটে ছাতিম গাছের নিচে বসতে পারে। জহিরকে টাকা দিলে সে ম্যাজিসিয়ানদের মত শূন্য থেকেও জিনিসপত্র জোগাড় করে ফেলতে পারে। পঁচিশ হাজার টাকার পুরােটা খরচ হয়নি এখনাে কিছু আছে। কত আছে সে জানে না। গােনা হয় নি। টাকা গুনলে টাকা কমে। তার কথা না, তার দাদিজান আকলিমা বেগমের কথা। টাকা নিয়ে তার একটা শ্লোকও আছে। সেই টাকা অবশ্যি কাগজের টাকা না, রূপার টাকা। তার সময়কার টাকা।
“চার মাসের নাতিন আমার ষােল মাসের পেট একশত তার উপপতি স্বামী হল এক। ধাতুতেই জন্ম কিন্তু নাই তার মা
এই শিল্পকে ভাঙ্গাইয়া দিয়া, নাতিন নিয়া যা।” টাকার ধাধাটা বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে হবে। যে পারবে সে একশ টাকা পাবে। একশ না পাঁচশ। টাকার পরিমাণ না বাড়ালে মজা জমে না। আশ্চর্যের ব্যাপার যে কোনাে জিনিস জমার জন্যে টাকা লাগে।
মােবারক বেরুবার জন্যে তৈরি হল। তৈরি হওয়া মানে দাদিজানের জন্যে কেনা শালটা বগলের নিচে নিয়ে নেয়া। বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঝামেলা হবে কি–না বুঝতে পারছে না। দারােয়ান হয়ত বলে বসবে— রাত এগারােটার পর বের হতে হলে পাশ লাগবে। পাশ থাকলে বের হবেন। পাশ থাকলে নাই। পাশ আছে।
কুকুর ছেড়ে দিয়েছে কি-না কে জানে। দুটা ভয়ংকর কুকুর এ বাড়িতে আছে। দূর থেকে সে দেখেছে। রাতে বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে কুকুর ছাড়া হয়। বড়লােকের বাড়ির কুকুর গায়ের গন্ধ বুঝে ফেলে কে বড়লােক কে গরীব লোেক। তারপর ঝাঁপ দিয়ে গরীবের উপর পরে। পশুও গরীব ধনী চেনে।
কোনাে রকম ঝামেলা ছাড়াই মােবারক গেট পার হল । দারােয়ান একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না। কুকুর দু’টাও ছাড়া ছিল। তারাও চোখ উচু করে তাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল । এরা কি টের পেয়ে গেছে যে মােবারক সাধারণ কেউ না। সে হল Fruits and Flowers এর মালিক।
গেটের বাইরে এসে মােবারকের মনে পড়ল সে আসল জিনিস ফেলে গেছে। দুই বন্ধুর জন্যে দু’টা স্যুয়েটার কিনেছিল, স্যুয়েটার সঙ্গে নেয়া হয় নি। থাক স্যুয়েটার। স্যুয়েটারের জন্যে ঢুকলে আর হয়ত বের হওয়া যাবে।
আহ্ বড় আনন্দ লাগছে। শীষ দিয়ে গানের সুর তুলতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। সে শীষ দিতে পারে না। পারে বজলু। শুধু যে পারে তা না অসম্ভব সুন্দর করে পারে। মনে হয় শীষ না যেন বাঁশি বাজছে। বজলুকে আজ ধরতে হবে। মুশকিল হচ্ছে হারামজাদার গায়ে চর্বি বেশি ।। তাকে কোনাে অনুরােধ করলে চর্বির উপরও আরেক পরত চর্বি জমে যায়। জমলে জমবে আজ বজলুকে ধরতে হবে। অনেকদিন তার শীষ শােনা হয়
বাচুপানকা দিন ভুলা না যা না” গানটা বাজাতে বলতে হবে। তবে শুরুতে না। ভাবের জগতে উঠার পর। সাধারণ গান-বাজনা একরকম, ভাবের গানবাজনা অন্যরকম। ভাবের গান-বাজনায় মনটা উদাস হয় অনেক বেশি। বাচুপানকা দিন‘ গানটা এম্নিতে শুনলে চোখে পানি আসবে না, কিন্তু ভাবের জগতে থাকার সময় শুনলে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে।
মােবারক কুদুসের চায়ের দোকানের দিকে রওনা হল। তার মন বলছে দু’জনকে সেখানেই পাওয়া যাবে। আর না পাওয়া গেলে মােবারক যে ভাবেই হােক খুঁজে বের করবে।
বজলু এবং জহিরকে চায়ের দোকানেই পাওয়া গেল। দুজনই আরাম করে মালাই চা খাচ্ছিল। মােবারককে দেখে উঠে দাঁড়াল। যেন তারা জানত এক্ষুণী মােবারক জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হবে।
জাহিরের বগলে একটা ক্রাচ । সে ক্রাচ নিয়ে যে ভাবে হাঁটছে তাতে মনে
হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে বগলে ক্রাচ নিয়ে। এবং এতে সে মােটেই দুঃখিত
বরং আনন্দিত। সে চোখ ছােট করে বলল, জিনিসটা উপকারী। ধর মারামারি লেগে গেল বগল থেকে ক্রাচ নিয়ে ঝাপ দিয়ে পড়লি । হা হা হা।
বজলু ভুরু কুঁচকে তাকাল। জহিরের রসিকতায় সে মজা পাচ্ছে না। তবে মােবারক মজা পাচ্ছে। জহিরের কথা তার মনে ধরেছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তারা তিন বন্ধু বগলে ক্রাচ নিয়ে ঘুরছে। কোনাে একটা ঝামেলা বাধল বের হয়ে এল তিন অস্ত্র।
মােবারক বলল, তুই কি পুরােপুরি ল্যাংড়া হয়ে গেছিস ? জহির বলল, হ্যা।
বলে দাত বের করে হাসল। পুরােপুরি ল্যাংড়া হওয়াতেও সে আনন্দিত। কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে আসে যখন সব কিছুতেই আনন্দ লাগে। ধাক্কা দিয়ে কেউ রাস্তায় ফেলে দিল, একটা সঁাত গেল ভেঙ্গে। তার মধ্যে আনন্দ।
জহিরের এই সময় চলছে। | ছাতিম গাছের তলাটা বেদখল হয়ে আছে। এক বুড়ােবুড়ি নীল পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাতারাতি সংসার পেতে বসেছে। ইটের চুলায় রান্না হচ্ছে। বুড়ি রান্না করছে। বুড়াে বটি পেতে কাটাকুটি করছে। রাত বাজে একটা। এই সময়ে কীসের রান্না কে জানে ?
পলিথিনের নীল বাড়ির ভেতর থেকে গল্পগুজব এবং হাসাহাসির শব্দ আসছে। আনন্দময় সংসার যাত্রা।
বজলু বলল, লে হালুয়া।
বুড়াে সবৃজি কাটা বন্ধ করে শক্ত হাতে বটি ধরে আছে। বুড়ি নির্বিকার। সে আগের মতই রান্না করে যাচ্ছে। একবার শুধু চোখ সরু করে দেখল।
জহির বলল, জায়গা ক্লিয়ার করে দাও। দশ মিনিট সময়। এর মধ্যে জায়গা পরিষ্কার না করলে অসুবিধা আছে।
পলিথিনের ঘর থেকে দু’টা মেয়ে উঁকি দিচ্ছে। দুজনের বয়সই আঠারাে উনিশ। ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলে লাল ফিতা বাঁধা। এরা সাজগোেজ করছিল। সাজ এখনাে শেষ হয় নি। চোখে কাজল দেয়া হচ্ছে।
মােবারক বুড়াের দিকে তাকিয়ে বললাে- এই দুই কন্যা কে ? তােমার নাতনী ?
বুড়াে বলল, তা দিয়া আপনার কি দরকার। দরকার আছে।
হ আমার নাতনী। এরা কি ভাড়া খাটে ?
বুড়াে কিছু বলল না। মেয়ে দু’টার একটা আফ্রাদী গলায় বলল, ঝামেলা কইরেন না ভাইজান।
মােবারক বলল, কোনাে ঝামেলা নাই। তােমরা তােমাদের মত বাণিজ্য করবে। কিন্তু জায়গা ছাড়তে হবে। এটা আমাদের জায়গা । দশ মিনিট সময়। আমরা এখানে নেশা করব।
এমন কোনাে হাসির কথা না, কিন্তু মেয়ে দুটি খিলখিল করে হাসছে। দুজনই মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে। মেয়ে দুটির একটি বলল, আপনেরার ‘লিশা’ আপনেরা করেন। আমরা না করছি ?
জায়গা ছাড়বে না।
জায়গা কি আমার যে ছাড়ব ? জায়গা আল্লাহ পাকের। হেতাে কিলিয়ার কইরাই ধুইছে। হি হি হি।
মােবারকের মনে হল মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে তাে। একটু আগেওভাে সুন্দর লাগছে না। এখন লাগছে কেন? হি হি করে হাসছে বলেই কি সুন্দর লাগছে ? হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায়। তবে সেই হাসি আসল হাসি হতে হবে।