নকল হাসিতে মানুষকে ভয়ংকর দেখায়। তবে হাসি এমন জিনিস যে তার নকল হয় খুব কম।বজলু হঠাৎ উদার গলায় বলল, এরা থাকুক এদের মত। আয় আমরা এক কোণায় বসে পড়ি। মােবারকের মনে হল বজলু তার মনের কথাটা বলেছে। সবাই থাকবে সবার মত ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার কি? মেয়ে দু’টা ইচ্ছা করলে তাদের সঙ্গে বসতে পারে। ইচ্ছা করলে কাস্টমারের খুঁজে যেতে পারে।
জহির মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তােদের নাম কি ? তুই তুকারি করেন ক্যান? ভাল মত জিগান নাম কমু। তােমাদের নাম কি ? আমার নাম ছুইটি, এর নাম বিউটি । নকল নাম?
হ নকল। আমরা মানুষও নকল আমরার নামও নকল আপনেরা কি ‘লিশা’ করতে আইছেন?
লিশা বড়ই খারাপ জিনিস গাে লিশা কইরেন না। চুপ থাক। আইচ্ছা যান চুপ থাকলাম। চিল্লাইয়েন না।
ছাতিম গাছের অন্য দিকটায় তারা তিনজন বসল । মেয়ে দু‘টি বের হয়ে গেল খদ্দেরের খুঁজে। মেয়ে দুটি যাবার আগে জহির ধমকের গলায় বলল, খবর্দার কাস্টমার নিয়া এই দিকে আসবি না। আসলে বিপদ আছে। বিল্লি মে কাট দিবে।
দুইটি অবাক হয়ে বলল, বিল্লি মে কাট দিবে কি গাে ?
জহির উদাস গলায় বলল, যখন কাট দিবে তখন বুঝবি কী। এখন বুঝবি না।
বিউটি বলল, আপনেরা ভদ্রলােকের ছেলে। আপনেরা তুই তুকারি করেন ক্যান।
বজলু বলল, আমরা ভদ্রলােকের ছেলে তােদের কে বলল ? আমরা বিল্লি কাট দিয়া মানুষ। আমাদেরকে বিল্লি কেটে দিয়েছে। বজলুর কথা শেষ হবার আগেই জহির এবং মােবারক হাসতে শুরু করল। বােতল খােলার আগেই তিনজন চলে যাচ্ছে ভাবের জগতে। আজকের ভাব হবে জটিল ভাব। রাতটা বড়ই আনন্দে কাটবে।
| বুড়াে বুড়ির রান্না হয়ে গেছে। দুজনে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া করছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বড়ই আনন্দে আছে। মােবারকরা তেমন আনন্দে নেই। বজলু শীষ দিয়ে কি একটা গান বাজাচ্ছে। গানের সুর এতই করুণ যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
দু’টি মেয়ের একটি (ছুইটি) ফিরে এসে তিন বন্ধুর পাশে বসেছে। মনে হচ্ছে তিন বন্ধুকে দেখে মেয়েটা খুব মজা পাচ্ছে।
বজলু শীষ বাজানাে বন্ধ করতেই মােবারক বলল, দোস্ত একটা কথা বলি। ইচ্ছা হলে জবাব দিবি ইচ্ছা হলে দিবি না। তুই কি ছােট রফিকের দলে ঢুকেছিস ?
বজলু বলল, ই। কাজটা কি ঠিক হয়েছে? ঠিক হয় নাই। কিন্তু উপায় কী? আমার বাঁচা লাগবে না ?
মােবারক বলল, দোস্ত তুই ছােট রফিকের কথা ভুলে যা। আমি আমাদের তিনজনের জন্যে ব্যবস্থা করেছি।
বজলু কঠিন গলায় বলল, তুই হলি ছিছকা চোর। থিফ অফ ঢাকা। তুই কি ব্যবস্থা করবি ? চোরের দল করবি? চোরের দলের লীডার হবি। আমি চুরির মধ্যে নাই। আমি ভদ্রলােকের ছেলে। আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার।
ছােট রফিকের সাথে থেকে তুইতাে মানুষ খুন করবি।
করব। যার কপালে খুন লেখা থাকবে সে খুন হবে। আমার কি করার আছে। আমার কিছু করার নাই।
কঠিন তর্কাতর্কিতে নেশা কেটে যায়। আজ কাটছে না। বরং আজ নেশা আরাে চেপে আসছে। | জহির বলল, আমি পিশাব করতে যাচ্ছি তােরা কেউ যাবি আমার সাথে ? কাটাকুটি খেলবি ? সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন উঠে দাঁড়াল। জহির বরল, বুড়াে বুড়ির পলিথিনের বাড়িতে পিশাব করলে কেমন হয়। আমাদের জায়গা দখল করে আছে শাস্তি হওয়া দরকার না ?
বজলু বলল অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার। ওদের গায়েই পেশাব করা দরকার। তা না করে আমরা ওদের রাজপ্রাসাদ ভিজিয়ে দেব।
দুইটি বিড় বিড় করে বলল, লিশা কি খারাপ জিনিসগাে। কি খারাপ জিনিস।
দিয়ে দিলেন। বাড়ি ভর্তি কত লােক, কত আনন্দ, কত উল্লাস। আকলিমা বেগমের তরুণ বর— হাসিখুশি এবং খানিকটা বােকালােকা ধরনের মানুষটা কারণে অকারণে ঘরে ঢুকে পড়ছে এবং মায়ের বকা খাচ্ছে— তাের হইছেটা কী ? মুরগির ছাও এর লাহান এইখানে ঘুরতাছ।
মানুষটা লজ্জা পেয়ে নিচু করে বলল, খড়ম খুঁজতে আসছি। যা কইলাম। না গেলে খড়ম দিয়া তাের মাথাত বাড়ি।
সবার সে–কী হাসি। সবচে‘ বেশি হেসেছেন আকলিমার শাশুড়ি। আহা কী হাসিই না তিনি হাসতে পারেন। সারাক্ষণ কারণে এবং অকারণে হাসছেন। তার মৃত্যুর সময়ও তার মুখে চাপা হাসি দেখা গেল। তিনি আকলিমা বেগমকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বললেন, তােমার শ্বশুর সাহেবের আইজ খবর আছে। সে হুরপরী নিয়া খুব নাচানাচি করতাছে । আমি উপস্থিত হইয়া এমন ঝাটাপিটা করব । হি হি হি ।
পুরনাে দিনগুলি বারবার ফিরে ফিরে আসে কেন? আজ কেন নিজেকে বউ বউ লাগছে? মােবারক যে গরম শালটা গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে সেই শালটা থেকে কেন অনেক অনেক দিন আগে তার গায়ে যে চাদর তার শাশুড়ি জড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই চাদরের গন্ধ আসছে? কেন মনে হচ্ছে বাড়ি ভর্তি লােকজন। কেন মনে হচ্ছে তার মানুষটা একটু আগেই একবার খড়ম খুঁজে গিয়েছে, আবারাে আসবে।
মােবারক বলল, কানতেছ কেনগাে দাদিজান ?
আকলিমা বেগম বললেন, কান্দি না রে । বয়স হইছে, অখন খালি খালি চউখ দিয়া পানি পড়ে ।
শালটা তােমার মনে ধরছে দাদিজান ?
আকলিমা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, মােবারক তুই একটা চটের বস্তা আমার শইল্যে দিয়া দে। হেই বস্তাও মনে ধরব।
তুমি খুশি হইছ দাদিজান ?
আমি বেজার হইছি। খুবই বেজার হইছি। আয় কাছে আয় মুখটা দেখি।
চোখতাে নাই মুখ কীভাবে দেখবা? হাত দিয়া দেখব। চউখ নাইতাে কী হইছে। হাত আছে না?
মােবারক খাটে উঠে এল। আকলিমা বেগম মােবারকের চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগলেন। মােবারকের চোখে পানি এসে গেল।
বৃদ্ধা আকলিমা বেগম রেলিং দেয়া খাটের মাঝখানে জুথবু হয়ে বলে আছেন। তার সাজানাে জীবন–যাপন এই মুহূর্তে খানিকটা এলােমেলাে, কারণ তার গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা গরম চাদর জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিজেকে তার বউ বউ মনে হচ্ছে। অনেক অনেক কাল আগে বউ সেজে তিনি এই খাটের মাঝখানে ঠিক এই ভাবেই বসেছিলেন। তখন ছিল পৌষ মাস। তিনি শীতে মাঝে মাঝে কাঁপছিলেন বলে তার শাশুড়ি এসে তার গায়ে চাদর
মােবারক। জি।
আমারে ফালাইয়া থুইয়া তুই একলা একলা কই থাকস ? কী করস ? আমি যখন মরব তখন তােরে দেখতে ইচ্ছা করব না।
মােবারক উদাস গলায় বলল, এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবা। ঢাকায় ঘর ভাড়া করব। বলতে পার ভাড়া করা হয়েছে।
ঢাকায় গিয়া থাকব ক্যামনে। এই খাট ছাড়া আমার ঘুম হয় না।
তােমার এই খাট নিয়া যাব। কোনাে অসুবিধা নাই। এই খাটতাে। যাবেই খাটের উপরে জিনিসপত্র যা আছে সব যাবে।
চাকরি পাইছস মােবারক ।
চাকরি পাই নাই। ব্যবসা করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিয়ের ব্যবসা ? ফুলের ব্যবসা। তুই দেখি আগের মতই পাগলা আছস? ফুলের আবার ব্যবসা কী ?
বিরাট এক দোকান দিতেছি নাম হল FRUITS AND FLOWERS বাংলা হল, ফুল ও ফল। আমার দোকানে ফলও পাওয়া যাবে— আঙ্গুর, বেদানা, নাসপাতি, আপেল, কলা, কমলা, আনারস, বানারস...
বানারসটা কী ? আছে বানারসও আছে। দেখতে আনারসের মত। সাইজে, ছােট।
আকলিমা বেগম মুগ্ধ হয়ে নাতির কথা শুনছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরাে একজন মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। তার নাম–– সরুফা। বাবা–মা মরা মেয়ে। আকলিমা বেগমের দেখাশােনা করে। এই বাড়িতেই থাকে। বয়স চৌদ্দ পনেরাে। মেয়েটা অস্বাভাবিক ধরনের লাজুক। আজ তার লজ্জা আকাশ স্পর্শ করছে কারণ আকলিমা বেগম তাকে অসংখ্যবার বলেছেন তার এক নাতি আছে। নাম মােবারক। তিনি মৃত্যুর আগে অতি অবশ্যই মােবারকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে যাবেন। সরুফাকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনাে চিন্তা করতে হবে না।
মােবারক নামের মানুষটা চলে এসেছে। মানুষটাকে সে যত দেখছে ততই ভাল লাগছে। কী অদ্ভুত মানুষ, ঘরে ঢুকেই একটা চাদর দিয়ে দাদিকে পেঁচিয়ে ফেলল। কোনাে কথা নাই । পা ছুঁয়ে সালাম নাই। তারপরই মানুষটা তার
দিকে তাকিয়ে বলল— এই খুকি। তুমি দাদিজানের দেখাশােনা কর ? শােন তুমি কি চা বানাতে পার। আমি চা পাতা নিয়ে এসেছি। চা বানাওতাে। যদি চা ভাল হয় তাহলে পুরস্কার, ভাল না হলে তিরস্কার। আর যদি খুব খারাপ হয় তাহলে— মারস্কার। হা হা হা।
সরুফার তখনাে বিশ্বাস হচ্ছে না এমন অসাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে! তার বাপ নেই, মা নেই। তাকে আত্মীয় স্বজনরা ঘরে জায়গা দেয় না। সে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিল অন্যের বাড়িতে। তারই কি–না এমন একটা ভাল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে ?
বাড়িতে মেহমান এসেছে। সরুফার হাতে কত কাজ। রান্নাবান্নার আয়ােজন দেখতে হবে। মাছ আনতে হবে। মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ সে দরজার আড়াল থেকে নড়তেই পারছে না। মানুষটা দাদিজানের সঙ্গে যে সব কথা বলছে তার সবই শুনতে ইচ্ছা করছে।