রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-১৫)

নকল হাসিতে মানুষকে ভয়ংকর দেখায়। তবে হাসি এমন জিনিস যে তার নকল হয় খুব কম।রূপার পালঙ্কবজলু হঠাৎ উদার গলায় বলল, এরা থাকুক এদের মত। আয় আমরা এক কোণায় বসে পড়িমােবারকের মনে হল বজলু তার মনের কথাটা বলেছেসবাই থাকবে সবার মত ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার কি? মেয়ে দু’টা ইচ্ছা করলে তাদের সঙ্গে বসতে পারে। ইচ্ছা করলে কাস্টমারের খুঁজে যেতে পারে। 

জহির মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তােদের নাম কি ? তুই তুকারি করেন ক্যান? ভাল মত জিগান নাম কমুতােমাদের নাম কি ? আমার নাম ছুইটি, এর নাম বিউটি নকল নাম? 

হ নকল। আমরা মানুষও নকল আমরার নামও নকল আপনেরা কি ‘লিশাকরতে আইছেন? 

লিশা বড়ই খারাপ জিনিস গাে লিশা কইরেন নাচুপ থাক। আইচ্ছা যান চুপ থাকলাম। চিল্লাইয়েন না। 

ছাতিম গাছের অন্য দিকটায় তারা তিনজন বসল । মেয়ে দুটি বের হয়ে গেল খদ্দেরের খুঁজে। মেয়ে দুটি যাবার আগে জহির ধমকের গলায় বলল, খবর্দার কাস্টমার নিয়া এই দিকে আসবি না। আসলে বিপদ আছে। বিল্লি মে কাট দিবে। 

দুইটি অবাক হয়ে বলল, বিল্লি মে কাট দিবে কি গাে ? 

জহির উদাস গলায় বলল, যখন কাট দিবে তখন বুঝবি কী। এখন বুঝবি না। 

বিউটি বলল, আপনেরা ভদ্রলােকের ছেলে। আপনেরা তুই তুকারি করেন ক্যান। 

বজলু বলল, আমরা ভদ্রলােকের ছেলে তােদের কে বলল ? আমরা বিল্লি কাট দিয়া মানুষ। আমাদেরকে বিল্লি কেটে দিয়েছে। বজলুর কথা শেষ হবার আগেই জহির এবং মােবারক হাসতে শুরু করল। বােতল খােলার আগেই তিনজন চলে যাচ্ছে ভাবের জগতে। আজকের ভাব হবে জটিল ভাবরাতটা বড়ই আনন্দে কাটবে। 

| বুড়াে বুড়ির রান্না হয়ে গেছে। দুজনে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া করছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বড়ই আনন্দে আছে। মােবারকরা তেমন আনন্দে নেই। বজলু শীষ দিয়ে কি একটা গান বাজাচ্ছে। গানের সুর এতই করুণ যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। 

 দু’টি মেয়ের একটি (ছুইটি) ফিরে এসে তিন বন্ধুর পাশে বসেছে। মনে হচ্ছে তিন বন্ধুকে দেখে মেয়েটা খুব মজা পাচ্ছে। 

 বজলু শীষ বাজানাে বন্ধ করতেই মােবারক বলল, দোস্ত একটা কথা বলি। ইচ্ছা হলে জবাব দিবি ইচ্ছা হলে দিবি না। তুই কি ছােট রফিকের দলে ঢুকেছিস ? 

বজলু বলল, ই। কাজটা কি ঠিক হয়েছে? ঠিক হয় নাই। কিন্তু উপায় কী? আমার বাঁচা লাগবে না ? 

মােবারক বলল, দোস্ত তুই ছােট রফিকের কথা ভুলে যা। আমি আমাদের তিনজনের জন্যে ব্যবস্থা করেছি। 

বজলু কঠিন গলায় বলল, তুই হলি ছিছকা চোরথিফ অফ ঢাকাতুই কি ব্যবস্থা করবি ? চোরের দল করবি? চোরের দলের লীডার হবিআমি চুরির মধ্যে নাইআমি ভদ্রলােকের ছেলেআমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। 

 ছােট রফিকের সাথে থেকে তুইতাে মানুষ খুন করবি। 

করবযার কপালে খুন লেখা থাকবে সে খুন হবেআমার কি করার আছে। আমার কিছু করার নাই। 

কঠিন তর্কাতর্কিতে নেশা কেটে যায়আজ কাটছে নাবরং আজ নেশা আরাে চেপে আসছে| জহির বলল, আমি পিশাব করতে যাচ্ছি তােরা কেউ যাবি আমার সাথে ? কাটাকুটি খেলবি ? সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন উঠে দাঁড়ালজহির বরল, বুড়াে বুড়ির পলিথিনের বাড়িতে পিশাব করলে কেমন হয়আমাদের জায়গা দখল করে আছে শাস্তি হওয়া দরকার না

বজলু বলল অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকারওদের গায়েই পেশাব করা দরকারতা না করে আমরা ওদের রাজপ্রাসাদ ভিজিয়ে দেব। 

দুইটি বিড় বিড় করে বলল, লিশা কি খারাপ জিনিসগােকি খারাপ জিনিস। 

দিয়ে দিলেনবাড়ি ভর্তি কত লােক, কত আনন্দ, কত উল্লাস। আকলিমা বেগমের তরুণ বরহাসিখুশি এবং খানিকটা বােকালােকা ধরনের মানুষটা কারণে অকারণে ঘরে ঢুকে পড়ছে এবং মায়ের বকা খাচ্ছেতাের হইছেটা কী ? মুরগির ছাও এর লাহান এইখানে ঘুরতাছ। 

মানুষটা লজ্জা পেয়ে নিচু করে বলল, খড়ম খুঁজতে আসছিযা কইলামনা গেলে খড়ম দিয়া তাের মাথাত বাড়ি। 

সবার সেকী হাসি। সবচেবেশি হেসেছেন আকলিমার শাশুড়িআহা কী হাসিই না তিনি হাসতে পারেন। সারাক্ষণ কারণে এবং অকারণে হাসছেনতার মৃত্যুর সময়ও তার মুখে চাপা হাসি দেখা গেলতিনি আকলিমা বেগমকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বললেন, তােমার শ্বশুর সাহেবের আইজ খবর আছেসে হুরপরী নিয়া খুব নাচানাচি করতাছে আমি উপস্থিত হইয়া এমন ঝাটাপিটা করব হি হি হি । 

পুরনাে দিনগুলি বারবার ফিরে ফিরে আসে কেন? আজ কেন নিজেকে বউ বউ লাগছে? মােবারক যে গরম শালটা গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে সেই শালটা থেকে কেন অনেক অনেক দিন আগে তার গায়ে যে চাদর তার শাশুড়ি জড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই চাদরের গন্ধ আসছে? কেন মনে হচ্ছে বাড়ি ভর্তি লােকজনকেন মনে হচ্ছে তার মানুষটা একটু আগেই একবার খড়ম খুঁজে গিয়েছে, আবারাে আসবে। 

মােবারক বলল, কানতেছ কেনগাে দাদিজান

আকলিমা বেগম বললেন, কান্দি না রে । বয়স হইছে, অখন খালি খালি চউখ দিয়া পানি পড়ে । 

শালটা তােমার মনে ধরছে দাদিজান

আকলিমা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, মােবারক তুই একটা চটের বস্তা আমার শইল্যে দিয়া দেহেই বস্তাও মনে ধরব। 

তুমি খুশি হইছ দাদিজান

আমি বেজার হইছিখুবই বেজার হইছিআয় কাছে আয় মুখটা দেখি। 

চোখতাে নাই মুখ কীভাবে দেখবা? হাত দিয়া দেখবচউখ নাইতাে কী হইছেহাত আছে না

মােবারক খাটে উঠে এলআকলিমা বেগম মােবারকের চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগলেন। মােবারকের চোখে পানি এসে গেল। 

বৃদ্ধা আকলিমা বেগম রেলিং দেয়া খাটের মাঝখানে জুথবু হয়ে বলে আছেনতার সাজানাে জীবনযাপন এই মুহূর্তে খানিকটা এলােমেলাে, কারণ তার গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা গরম চাদর জড়িয়ে দেয়া হয়েছেনিজেকে তার বউ বউ মনে হচ্ছেঅনেক অনেক কাল আগে বউ সেজে তিনি এই খাটের মাঝখানে ঠিক এই ভাবেই বসেছিলেনতখন ছিল পৌষ মাসতিনি শীতে মাঝে মাঝে কাঁপছিলেন বলে তার শাশুড়ি এসে তার গায়ে চাদর 

মােবারকজি। 

আমারে ফালাইয়া থুইয়া তুই একলা একলা কই থাকস ? কী করস ? আমি যখন মরব তখন তােরে দেখতে ইচ্ছা করব না। 

মােবারক উদাস গলায় বলল, এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবাঢাকায় ঘর ভাড়া করব। বলতে পার ভাড়া করা হয়েছে। 

ঢাকায় গিয়া থাকব ক্যামনেএই খাট ছাড়া আমার ঘুম হয় না। 

তােমার এই খাট নিয়া যাবকোনাে অসুবিধা নাইএই খাটতােযাবেই খাটের উপরে জিনিসপত্র যা আছে সব যাবে। 

চাকরি পাইছস মােবারক । 

চাকরি পাই নাইব্যবসা করব সিদ্ধান্ত নিয়েছিবিয়ের ব্যবসা ? ফুলের ব্যবসাতুই দেখি আগের মতই পাগলা আছস? ফুলের আবার ব্যবসা কী

বিরাট এক দোকান দিতেছি নাম হল FRUITS AND FLOWERS বাংলা হল, ফুল ফল। আমার দোকানে ফলও পাওয়া যাবেআঙ্গুর, বেদানা, নাসপাতি, আপেল, কলা, কমলা, আনারস, বানারস..

বানারসটা কী ? আছে বানারসও আছেদেখতে আনারসের মত। সাইজে, ছােট। 

আকলিমা বেগম মুগ্ধ হয়ে নাতির কথা শুনছেনতাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরাে একজন মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। তার নাম– সরুফাবাবামা মরা মেয়েআকলিমা বেগমের দেখাশােনা করেএই বাড়িতেই থাকে। বয়স চৌদ্দ পনেরােমেয়েটা অস্বাভাবিক ধরনের লাজুকআজ তার লজ্জা আকাশ স্পর্শ করছে কারণ আকলিমা বেগম তাকে অসংখ্যবার বলেছেন তার এক নাতি আছেনাম মােবারকতিনি মৃত্যুর আগে অতি অবশ্যই মােবারকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে যাবেনসরুফাকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনাে চিন্তা করতে হবে না। 

মােবারক নামের মানুষটা চলে এসেছেমানুষটাকে সে যত দেখছে ততই ভাল লাগছেকী অদ্ভুত মানুষ, ঘরে ঢুকেই একটা চাদর দিয়ে দাদিকে পেঁচিয়ে ফেললকোনাে কথা নাই পা ছুঁয়ে সালাম নাইতারপরই মানুষটা তার 

দিকে তাকিয়ে বলল— এই খুকিতুমি দাদিজানের দেখাশােনা কর ? শােন তুমি কি চা বানাতে পারআমি চা পাতা নিয়ে এসেছিচা বানাওতােযদি চা ভাল হয় তাহলে পুরস্কার, ভাল না হলে তিরস্কারআর যদি খুব খারাপ হয় তাহলে— মারস্কারহা হা হা। 

সরুফার তখনাে বিশ্বাস হচ্ছে না এমন অসাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে! তার বাপ নেই, মা নেই। তাকে আত্মীয় স্বজনরা ঘরে জায়গা দেয় না। সে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিল অন্যের বাড়িতেতারই কিনা এমন একটা ভাল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে

বাড়িতে মেহমান এসেছেসরুফার হাতে কত কাজ। রান্নাবান্নার আয়ােজন দেখতে হবেমাছ আনতে হবেমুরগির ব্যবস্থা করতে হবেঅথচ সে দরজার আড়াল থেকে নড়তেই পারছে নামানুষটা দাদিজানের সঙ্গে যে সব কথা বলছে তার সবই শুনতে ইচ্ছা করছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *