উপায় নাই । বিদেশ যাব। কাজ কর্ম বাকি আছে। তুমি কোনাে চিন্তা করবা না। দেশে ফিরেই গ্রামে চলে আসব। বন্ধু দু’জনকে সাথে নিয়ে আসব। আর শােন সরুফার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছ–— সেটা ফাইন্যাল।
বৃদ্ধা হাসছেন। হাসতে হাসতে বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে ?
মােবারক বলল, খুব বেশি না। মােটামুটি হয়েছে। মেয়ের লজ্জা বেশি। তার উপর বুদ্ধি সামান্য কম আছে। সহজ একটা শিলুক দিয়েছি ভাঙ্গাতে পারে নাই। যাই হােক এইসব কথা তাকে বলে লাভ নাই। বেচারী মনে কষ্ট পাবে। বাচ্চা মেয়ে মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
বৃদ্ধা শব্দ করে হেসে ফেললেন। মােবারক বিষ্মিত হয়ে বলল, হাস কেন?
বৃদ্ধা বললেন, মেয়েটারে তাের খুব বেশি পছন্দ হইছে এইজন্যে হাসতেছি। মনের খুশিতে হাসতেছি। কি আমি ভুল কইছি ?
মােবারক জবাব দিল না। বৃদ্ধা ঘােরলাগা গলায় বললেন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তাের বিবাহ দিব। তুই নয়া বউরে নিয়া রুপার পালঙ্কে বাসর করবি।
মােবারক অবাক হয়ে বলল, রুপার পালঙ্ক পাব কোথায় ?
এই পালঙ্কইতাে রুপার পালঙ্ক। তাের দাদাজান আর আমি যে পালঙ্কে জীবন শুরু করছি। যে পালংকে তাের বাবা তাের মা’রে নিয়া প্রথম ঘুমাইতে গেছে সেই পালঙ্ক রুপার পালঙ্ক না?
একটু আগে বৃদ্ধা হাসছিলেন। এখন কাঁদছেন। মােবারকের চোখেও পানি এসে গেল। পানিতে ঝাপসা চোখে পালঙ্ক দেখছে বলেই হয়ত তার মনে হল পালঙ্কটা ঝকমক করছে। আসলেই যেন এটা রুপার পালঙ্ক।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
আমার বাবা। একের ভেতর তিন। উনার শেষ ইচ্ছা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। কাজেই বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছি। মেয়ের চেহারা ছবি মােটামুটি। বুদ্ধির সামান্য শর্ট। কী আর করা...। ইত্যাদি...।
চায়ের দোকানে বজলু বা জহির কেউ নেই। ছােট রফিক আছে। সে বসে আছে মােবারকের চেয়ারে। তার সামনে এক কাপ চা। কিন্তু সে চা খাচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কারাে জন্যে অপেক্ষা করছে। সে রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মােবারক চায়ের দোকানে ঢােকার পর সে কঠিন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মােবারকের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
মােবারককে দেখেই কুদুস বলল, তুমি ছিলা কই। বজলু আধা পাগল হইয়া তােমারে খুঁজতেছে।
মােবারক বলল, কেন?
জহিরের খবর কিছু জান না? রক্তবমি করতেছে। চাইর ব্যাগ রক্ত দেওয়া হইছে। কোনাে লাভ হয় নাই। এই যাত্রা বাচব বইল্যা মনে হয় না। আমি দেখতে গেছিলাম। আমারে চিনে নাই।
সে আছে কোথায় ? মেডিকেলে। দুই নম্বর ওয়ার্ড
ঢাকায় পৌছতে পৌঁছতে মােবারকের রাত দশটা বেজে গেল। সে বলে গিয়েছিল রাতে ফিরবে। রাত দশটাও রাত, দুটাও রাত। কাজেই এক্ষুনী যে বড় সাহেবের রাজপ্রাসাদে বন্দি হতে হবে এমন কোনাে কথা নেই। রাত দু’টার দিকে গেলেই হবে। গেটে দারােয়ান থাকে। দারােয়ান নিশ্চয়ই গেট খুলে দিবে। এবং সে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত তলব করবে না, গলার রগ ফুলিয়ে বলবে না— এত রাত হল কেন?
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
যদি জিজ্ঞেস করেও বললেই হবে রাজেন্দ্রপুরের কাছে বাস এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে অল্পের জন্যে বেঁচেছে। একজন মারা গেছে, কয়েকজনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। সে নিজেও বুকে ব্যথা পেয়েছে। হাসপাতাল থেকে এক্সরে করিয়ে তারপর এসেছে। দেরী হবার এই কারণ। তবে জিজ্ঞেস করবে বলে মনে হয় না।
মােবারক কুন্দুসের চায়ের দোকানে চলে গেল। আজ একটু শীত পড়েছে। বড় সাহেবের বাড়ি থেকে আনা চাদরটা থাকলে ভাল হত। চাদরটা জহিরকে দিয়েছিল। জহির নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলেছে–– বিক্রি করে দিয়েছে।
জহিরের একটা খোজ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। রক্তবমি বন্ধ হয়েছেতাে বটেই। পাতলা পায়খানা অনেকদিন থাকে। রক্তবমির মত জটিল ব্যাধি অল্প সময় থাকে। জহিরের শরীর যদি ভাল থাকে আর বজলুকে যদি পাওয়া যায়— তিনজনের আসর বসাতে হবে। সে কিছু খাবে না। সে শুধু দেখবে। আসরে উপস্থিত থাকার আনন্দও কম না। বন্ধুদের কাছ থেকে সে অনেক কিছু গােপন করেছে— কিডনি বিক্রির ব্যাপারটা গােপন করা উচিত হয় নি । খুবই অন্যায় হয়েছে। ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
সরুফার ব্যাপারটাও বলতে হবে। একটু অন্যভাবে বলতে হবে। দাদিজানের শেষ ইচ্ছা। কী আর করি। দাদিজানের কথা ফেলি কী করে? বাবা মা মারা গিয়েছিলেন আমি যখন কোলের শিশু। দাদিজানই আমাকে বড় করেছেন। দাদিজান সেই কারণে একই সঙ্গে আমার দাদি, আমার মা এবং
মােবারক জহিরের বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মােবারকের পাশে বজলু। বজলু ফিসফিস করে বলল, তােকে দেখে খুবই সাহস পাচ্ছি। মনটা ভেঙে গিয়েছিল বুঝলি। আজ সারাদিন ছয় কাপ চা ছাড়া কিছু খাইনি। তুই ছিলি কোথায় ?
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
মােবারক জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে জহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। জহিরকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষ না, মর্গের কোনাে মৃতদেহ।
বজলু বলল, রক্ত বমিটা বন্ধ হয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছে আশা খুবই
কম।
মােবারক জহিরের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল, এই জহির। জহির! জহির চোখ মেলল।
মােবারক বলল, আমাদেরকে চিনতে পারছিস ? চিনতে পারলে কথা বলার দরকার নেই। একটু চোখের পাতি নাড়া। তাহলেই বুঝব চিনতে পারছিস।
জহির চোখের পাতি নাড়ল এবং দুই বন্ধুকে অবাক করে দিয়ে সামান্য হাসল।
বজলু বিস্মিত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল- আরে ব্যাটা দেখি হাসে। ব্যাটাকেতাে বিল্লি মে কাট দিয়া।
মােবারক বলল, দোস্ত ঝুলে থাক। খবরদার মরবি না। খবরদার না। কোনাে চিন্তা নেই। আমি সব ব্যবস্থা করেছি। দোস্ত আমি কিডনি বেঁচে দিয়েছি। অনেক টাকা পাব। দেখবি এই টাকা দিয়ে আমি আমাদের ভাগ্য বদলে ফেলব— FRUITS AND FLOWERS. বিশ্বাস কর দোস্ত সত্যি কথা বলছি । সবই সত্যি। এক বর্ণ মিথ্যা না।
কথা বলতে বলতে মােবারকের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। | ঝাপসা চোখে তার হঠাৎ মনে হল জহির যে খাটে শুয়ে আছে সেটা সাধারণ খাট না। খাটটা রুপার তৈরি। রুপার পালঙ্ক।
পরিশিষ্ট
মােবারক তার কিডনি বিক্রি করতে পারে নি। তাদের বিদেশ যাত্রার আগের দিন বড় সাহেব হঠাৎ করে মারা যান। মােবারক ফিরে যায় আগের জীবনে। ছাতিম গাছের নিচে তিন বন্ধু বসে থাকে। মাঝে মাঝে তারা ভাবের জগতে চলে যায়, তখন সময়টা বড় আনন্দে কাটে। বজলু হঠাৎ বলে, জহির, তাের বিল্লির গল্পটা বলতাে। বিল্লি মে কাট দিয়া।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
জহির সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু করে। তিন বন্ধু প্রাণ খুলে হাসে। শুধু পূর্ণিমার রাতে মােরকের খুব কষ্ট হয় আকাশ ভেঙে জোছনা নামে। মােবারকের মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি বিশাল এক রুপার পালঙ্ক। এত প্রকাণ্ড এক পালঙ্কে সে বসে আছে একা। অনেক দূরে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছে লাজুক একটা মেয়ে।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একবার যদি বলা যায়, খুকি এসাে। সে ছুটে চলে আসবে। কিন্তু মােবারক বলতে পারছে না। কারণ কথাগুলি বলার জন্যে তাকে রুপার পালঙ্ক থেকে নেমে মেয়েটার কাছে যেতে হবে। সে যেতে পারছে না। যে রুপার পালঙ্কে সে বসে আছে সেখান থেকে নামার ক্ষমতা তার নেই।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাদের আলাে তীব্র হয়। রুপার পালঙ্ক ঝকমক করতে থাকে।