রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৭)

জহির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করলদলামচা সিগারেট । দেখেই বােঝা যাচ্ছে সাধারণ সিগারেট নাবিশেষ সিগারেট । তামাকের সঙ্গে ‘জিনিস মেশানাে হয়েছে

রূপার পালঙ্কসিগারেটে মিশানাের জিনিসও কয়েক পদের আছে। একটা আছে সামান্য টানলেই মাথার তালু জ্বলেআরেকটায় হাই প্যালপটিশনের মত মাথায় প্যালপিটিশন। এই দুইটাই খারাপ। জিনজির নামে একটা পাওয়া যায় এক্সপাের্ট কোয়ালিটি । বাজারের সেরা । জহির ওস্তাদ লােক। সে জিনজিরছাড়া অন্য কিছু আনবে না । টাকা পয়সা না থাকলেও জহিরের নজর উঁচা। 

জহির বলল, সিগারেটও না ? মােবারক বলল, না। 

পান খা একটা মিষ্টি পান আছে। জর্দা দিয়ে একটা পান খেলে ভাল লাগবে। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দাবেহেশতী জিনিস। 

মােবারক না-সূচক মাথা নেড়ে নিজের সিগারেট বের করল। জহির ধরালাে তার বিশেষ সিগারেট। দু‘জনের সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। শীত শীতও লাগছে। মােবারকের গায়ে দামি শাল, মাথায় পশমি টুপি তারপরেও তারই শীতটা বেশি লাগছে। জহির তার বােতলে একবারই চুমুক দিয়েছেএকা একা ভাবের আসর শুরু করা যায় নাসঙ্গী লাগে। ভাল কাজ 

মানুষ একা করতে পারেবেশির ভাগ সময় তাই করেকিন্তু কোনাে মন্দ কাজই মানুষ একা করতে পারে না। মন্দ কাজে সঙ্গী সাথি লাগে, উৎসাহদাতা লাগে। তালি বাজানাের লােক লাগে। 

মােবারক বলল, তুই দেখি আজ মেলা খরচ করেছিসএক হাজার টাকার পুরােটাই শেষ? 

জহিরের মুখে সামান্য হাসির আভা। মােবারক কথা বলা শুরু করেছে। এটা ভাল লক্ষণ। এখন যদি বজলু চলে আসে তাহলেই আসর জমে যাবে। আজকের সাপ্লাই ভালশুধু ভাল না, খুবই ভাল। জহিরের কাপড়ের ব্যাগে ভদকার একটা বােতল আছে। পুরাে বােতল না, অর্ধেকেরও কম আছে। এটা জহির ইচ্ছা করে রেখে দিয়েছে ফিনিশিং দেয়ার জন্যে।

ফিনিশিং-এর জন্য ভদকার মত জিনিস হয় না। যে জাতি ভদকার মত “আসলি চিজ বের করেছে সেই জাতি আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারল না। পাছায় লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এটা ভাবাই যায় না। 

গাছপালার ফাঁক দিয়ে কে যেন আসছে। তার মুখেও জ্বলন্ত সিগারেটহ্যা বজলুই ফিরে আসছেজহির নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। ভাবের আসর এখনি শুরু হবে। 

বজলুকে আসতে দেখেই মােবারকের মনে হয় মুড ভাল হয়ে গেছে। সে জহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটা বােতলসামান্য খাব। দুই চুমুক। 

জহির নিজের বােতল এগিয়ে দিল। এবং অতি দ্রুত আরেকটা বােতলের মুখ খুললবােতলের টিনের মুখায় লেগে হাত মনে হয় কেটেছে। রক্ত বের হচ্ছে। বের হােক। এত কিছু দেখলে চলবে না। বজলু এসে দাঁড়ানাে মাত্র তার হাতে বােতল তুলে দিতে হবে। জহিরের এত আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে 

সে কেঁদে ফেলবে। 

বরং বেশি হাসে। এই হাসি এই আনন্দ যে-কোনাে মুহূর্তে গভীর বিষাদে রূপান্তরিত হতে পারে। এদের এখনাে হচ্ছে না কারণ এরা তিন জন। আনন্দের ভাব প্রবল থাকে যখন সংখ্যায় তিন বা তিনের বেশি থাকে। দু’জন থাকলে উল্টোটা হয়। 

এদের পােষাক আশাকেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মােবারকের শাল এবং মাথার টুপি জহির গায়ে দিয়ে বসে আছে। মােবারক বসে আছে গেঞ্জি গায়ে কারণ তার শার্টে ডাইল’ পড়ে গেছে। জহির বসে আছে, বাকি দু’জন মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। 

মােবারক বলল, ক্ষিধে লেগেছে। বজলু উঠে বসতে বসতে বলল, ক্ষিধে লেগেছেজহির বলল, ক্ষিধার চোটে পেট জ্বলে যাচ্ছে। ভাবের রাজ্যে ভিন্নমতের স্থান নেই। সবাই সব বিষয়ে একমত হয়। এখানেও তাই । একজনের ক্ষিধে লাগলে সবার লাগতে হবে। 

বজলু বলল, ক্ষিধে লাগলে মাকড়সা কী করে জানিস ? মােবারক উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, কী করে ? 

যদি পােকা মাকড় না থাকে তাহলে নিজের একটা দু’টা পা ছিড়ে খেয়ে ফেলে। ক্ষিধা মিটায়। 

বলিস কী ? 

পা খেয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। মাকড়সাদের পা আবার গজায়টিকটিকির মতটিকটিকির যেমন লেজ গজায়মাকড়সারও পা গজায়। 

জহির সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, দোস্ত সত্যি কথা বলছিস তাে ? 

বজলু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোনদিন মিথ্যা বললাম ? তােরা বুকে হাত দিয়ে বল, মিথ্যা কোনদিন বলেছি ? 

না, তা অবশ্যি ঠিক। 

মাকড়সার পা খাওয়ার বিষয়ে যা বললাম, এটাও ঠিক। আমরা মাকড়সা হলে ভাল হত। নিজেদের পা নিজেরা খেয়ে বসে থাকতাম। কিংবা আমি খেতাম মােবারকেরটা। মােবারক খেত আমারটা। 

মােবারক ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে বলল, অসম্ভব। আমি মরে গেলেও মানুষ খাব না। 

খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বলে তুই খাচ্ছিস না। খাবার ব্যবস্থা থাকলে তুই 

জমিয়ে কুয়াশা পড়ছে। চারপাশ ঝাপসা। ছাতিম গাছের পাতায় শিশির জমেছে। মাঝে মাঝে দু’একটা ফোঁটা এদের গায়ে পড়ছে। যার গায়েই ফেঁাটা পড়ছে সেই বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলছে, “গাছ মুতে দিয়েছে। এই রসিকতায় হেসে তিনজনই গড়াগড়ি খাচ্ছেভাবের রাজ্যে কোনাে রসিকতাই পুরনাে হয় না। প্রথমবার যেমন হাসি হাসে সপ্তমবারেও তেমন হাসি হাসে। 

খেতি । 

খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও খেতাম না। তুই নিজেকে বেশি চিনে ফেলেছিস ? আমাকে আমি চিনি না আর তুই চিনে ফেললি ? | অবশ্যই আমি তােকে চিনি। চোর চিনতে সময় লাগে না। তুই একটা বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান । থিফ অফ বাগদাদের মত তুই হলি থিফ অফ ঢাকা। 

মােবারক হতভম্ব গলায় বলল, আমি চোর ? | বজলু বলল, অবশ্যই চোর । তুই বুকে হাত দিয়ে বল যে শালটা তুই গায়ে দিয়েছিস এটা চুরির মাল না ? 

মােবারক বুকে হাত দিয়ে বলল, এই শালটা আমার এক দূর সম্পর্কের মামার। মামার কাছে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মামা বললেন, আমার একটা পুরনাে শাল আছে। নিয়ে যা। 

এ রকম দিলদরিয়া মামা তাের আছে ? এক কথায় শাল দিয়ে দিল। 

হার্ট’ বড় লােকজন পৃথিবীতে আছে না? আমার এই মামার হার্ট খুবই বড়। সব সময় নামাঝে মাঝে বড়মনে কর আমার একশ টাকার দরকার । আমি যদি মামার পায়ে ধরে কেঁদে পা ভিজিয়েও দেই কোনাে লাভ হবে নাআবার কোনােদিন চলে আসার সময় হুট করে বলবে— ধর রিকশা ভাড়া নিয়ে যা । বলেই একটা একশ টাকার নােট ধরিয়ে দেবে। 

তুই যে শুধু চোর তাই না, তুই মিথ্যা কুমার। সমানে মিথ্যা কথা বলছিস। 

আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান। 

জহির বলল, আহা তােরা কী শুরু করলি । চুপ কর না। সামান্য ভদকা আছে এক ঢােক করে হবে। ফিনিশিং টাচ। এখন খাবি না পরে খাবি? 

বজলু বলল, এখনই খাব। পরে আবার কী? জিনিস কিন্তু শেষ। আর কিছুই নাই। লাগবে না। ভদকা পেটে এক ফোটা পড়লেই হবে। 

জহির বলল, তােরা চাইলে আমি ব্যবস্থা করি। আমার কাছে টাকা আছে। 

মােবারক বলল, কত টাকা আছে ? 

বজলু বলল, খবরদার কত টাকা আছে বলবি না। মােবারক হাপিস করে দেবে। হারামজাদা বিরাট চোর। থিফ অফ ঢাকা। 

মােবারক চোখ লাল করে বলল, আমি যদি চোর হয়ে থাকি তাহলে এই মাটি ছুঁয়ে বলছি— আমি অসতী মায়ের গর্ভের জারজ সন্তান। 

জহির বলল, তােরা একটু চুপ করবি ? চেঁচামেচি শুরু করলি কেন ?

 মােবারক বলল, তাতে তাের অসুবিধা হচ্ছে ? তুই ঝিম মেরে বসে আছিস বসে থাক। 

জহির বলল, কোলকাতার একটা গল্প মনে পড়েছে। 

জহির বছর তিনেক আগে চারদিনের জন্য কোলকাতায় গিয়েছিল। সেই গল্প তিন বছরেও শেষ হয় নি। কোনােদিন শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে-কোনাে পরিস্থিতিতে যে-কোনাে উপলক্ষে তার কোলকাতার একটা গল্প থাকে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *