রূপা – হুমায়ূন আহমেদ

বৃহন্নলা (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

ভাই, আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান?

আমি ভদ্রলোকের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাও এমন কোনো আলাপ না। আমি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি কি-না জানতে চাইলেন। আমি বললাম, “হ্যা, এবং ভদ্রতা করে জানতে চাইলাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার স্ত্রীকে রিসিভ করতে এসেছি। ও চিটাগাং থেকে আসছে। ট্রেন দু’ঘণন্টা লেট। ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না । বাসায় যাবো আবার আবার আসবো, তারচেয়ে ভাবলাম অপেক্ষা করি।’

তার সঙ্গে এইটুকুই আমার আলাপ: এই আলাপের সূত্র ধরেই কেউ যখন বলে, ভাই আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান, তখন খানিকটা হলেও বিস্মিত হতে হয়। অপরিচিত লোকের কাছ থেকে গল্প শোনার আগ্রহ আমার কম। তা ছাড়া আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় লক্ষ করেছি, ইন্টারেস্টিং বলে যে গল্প গুলো শুরু হয় সেগুলো কখনোই ইন্টারেস্টিং হয় না।

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক বুদ্ধিমান হলে আমার চুপ করে থাকার অর্থ বুঝবেন। আর বুদ্ধিমান না হলে এই গল্প আমার শুনতেই হবে।
দেখা গেল ভদ্রলোক মোটেই বুদ্ধিমান নন। পকেট থেকে পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে সাজাতে গল্প শুরু করলেন।

“আপনি নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়ে আমার

কথা শুনছেন। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ হড়বড় করে গল্প বলা শুরু করেছে, বিরক্ত হবারই

কথা । কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন? আজ আমার জন্যে একটা বিশেষ দিন। এই বিশেষ দিনে আমার মজার গল্পটা কাউকে না কাউকে বলতে ইচ্ছা করে। যদি অনুমতি দেন তাহলে গল্পটা বলি।”

-বলুন।
-আপনি কি পান খান?
-জি-না ।

-একটা খেয়ে দেখুন, মিষ্টি পান। খারাপ লাগবে না।
-আপনি কি বিশেষ দিনে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে পানও খাওয়ান?

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। আন্তরিক ভঙ্গিতেই হাসলেন। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের মতো হবে। অত্যন্ত সুপুরুষ। ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবিতে তাকে চমৎকার মানিয়েছে। মনে হচ্ছে তিনি স্ত্রীর জন্যে খুব সেজেগুজেই এসেছেন।

-প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করছি-পদার্থবিদ্যায়। এখানে অন্ধকার বলে আপনি সম্ভবত আমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন না। আলো থাকলে বুঝতেন আমি বেশ সুপুরুষ। কুড়ি বছর আগে দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিলাম। ছাত্রমহলে আমার নাম ছিল- দ্যা প্রিন্স। কিন্তু আপনি ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন কি-না জানি না- পুরুষদের রুপের প্রতি প্রতি মেয়েরা কখনো আকৃষ্ট হয় না। পুরুষদের সবকিছুই তাদের চোখে পড়ে কিন্তু রুপ খুব একটা চোখে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনো মেয়ে ভাব করার জন্যে কিংবা

কথা বলার জন্যে এগিয়ে আসেনি । আমিও তাদের দিকে এগিয়ে যাইনি । আর একটা সমস্যা ছিল – আমার তোতলামি আছে।

কথা আটকে যায়।

আমি ভদ্রলোককে থামিয়ে দিয়ে বললাম, কই, আমিতো কোন তোতলামী দেখছি না। আপনিতো চমৎকার কথা বলছেন।পরে আমার তোতলামী ঠিক হয়ে যায়। আগে প্রচণ্ড রকম ছিল। অনেক চিকিৎসা করেছি । মারবেল মুখে নিয়ে কথা বলা থেকে শুরু করে হোমিওপ্যাথি ঔষধ, পীর সাহেবের তাবিজ কিছুই বাদ দেইনি । যাই হোক গল্পে ফিরে যাই, আমার সাবসিডিয়ারি ছিল ম্যাথ এবং কেমিস্ট্রি। কেমিস্ট্রি সাবসিডিয়ারিতে ১ম দিন ক্লাসে ঢুকেই একটি মেয়ের উপর আমার চোখ পড়ে। আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো কী মিষ্টি চেহারা! দীর্ঘ পল্লব, ছায়াময় চোখ । সেই চোখ সব সময় হাসছে। ভাইজান, আপনি কি কখনো প্রেমে পড়েছেন?

জি-না।

প্রেমে না পড়লে আমার সেই সময়কার মানসিকতা আপনাকে বুঝাতে পারব না। আমি প্রথম দিন মেয়েটিকে দেখেই পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সারারাত ঘুম হলো না। প্রচণ্ড পানির পিপাসায় একটু পরপর গলা শুকিয়ে যায়। পানি খাই আর মহসিন হলের বারান্দায় হাটাহাটি করি। সপ্তাহে আমাদের দুটা মাত্র সাবসিডিয়ারি ক্লাস। রাগে-দুঃখে আমার কাঁদতে ইচ্ছা করে। প্রতিদিন একটা করে কেমিস্ট্রি সাবসিডিয়ারি ক্লাস থাকলে কী ক্ষতি হতো? সপ্তাহের দুটা ক্লাস মানে পঞ্চাশ মিনিট করে একশ মিনিট । এই একশ মিনিট, চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। তা ছাড়া মেয়েটা খুব ক্লাস ফাঁকি দেয়। এমনও হয়েছে সে পরপর দু’সপ্তাহ কোনো ক্লাস করল না। তখন আমার ইচ্ছা করতো লাফ দিয়ে মহসিন হলের ছাদ থেকে নিচে পড়ে সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান ঘটাই । সে যে কী ভয়াবহ কষ্ট আপনি বুঝবেন না! কারণ, আপনি কখনো প্রেমে পড়েননি ।

মেয়েটার নাম তো বললেন না, তার নাম কী?

তার নাম রূপা। সেই সময় আমি অবশ্য তার নাম জানতাম না। নাম কেন কিছুই জানতাম না। কোন ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তাও জানতাম না । শুধু জানতাম তার সাবসিডিয়ারিতে কেমিস্ট্রি আছে এবং সে কালো রঙের একটা মরিস মাইনর গাড়িতে করে আসে । গাড়ির নাম্বার ভ – ৮৭৮১ ।

আপনি তার সম্পর্কে কোনো রকম খোঁজ নেননি?

না। খোজ নেইনি । কারণ, আমার সব সময় ভয় হতো খোজ নিতে গেলেই হয়তো জানতে পারবো মেয়েটির হয়তো বিবাহিত বা কারো সাথে এনগেজড। একদিনের একটা ঘটনা বললেই আপনি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারবেন। একদিন মেয়েটাকে দেখলাম একটা ছেলের সাথে

কথা বলছে। আমার সমস্ত শরীর কাপতে লাগল। মনে হলো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। সব ক্লাস বাদ দিয়ে হলে চলে এলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে শরীর কাঁপিয়ে আমার জ্বর এসে গেল।

আশ্চর্য তো!

আশ্চর্য তো বটেই! পুরো দুই বছর এইভাবেই কাটলো । পড়াশোনা মাথায় উঠল। তারপর একদিন অসীম সাহসের কাজ করে ফেললাম। মরিস মাইনর গাড়ির ড্রাইভার থেকে বাড়ির ঠিকানা জেনে নিলাম। তারপর মেয়েটিকে একটি সম্বোধনহীন চিঠি লিখেছিলাম। কি লিখেছিলাম আমার মনে নেই। চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। তাকে রাজি হতেই হবে। রাজি না হলে আমি তাদের বাড়ির সামনে না খেয়ে পড়ে থাকব । যাকে পত্রিকার ভাষায় বলে “আমরণ অনশন” গল্পটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে?

হ্যা হচ্ছে। তারপর কী হলো বলুন । চিঠি ডাকে পাঠিয়ে দিলেন?

না। নিজেই হাতে করে নিয়ে গেলাম। ওদের বাড়ির দারোয়ানের হাতে দিয়ে বললাম, এ বাড়ির একজন আপা আছেন-না ইউনিভার্সিটিতে পড়েন তার হাতে দিয়ে এসো । দারোয়ান লক্ষ্মীছেলের মতো চিঠি নিয়ে চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, আপা বলেছেন তিনি আপনেরে চিনেন না।

আমি বললাম, তিনি ঠিকই বলেছেন, তবে আমি তাকে চিনি । এটাই যথেষ্ট ।

-এই বলে আমি গেটের বাইরে খুঁটি গেড়ে দাড়িয়ে গেলাম। বুঝতেই পারছেন- নিতান্তই পাগলের কাণ্ড। সেই সময় মাথা আসলেই বেঠিক ছিল। লজিক নষ্ট হয় গিয়েছিল । যাই হোক, সকাল ন’টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কোনো রকম ঘটনা ছাড়াই গেটের সামেন দাড়িয়ে রইলাম। লক্ষ করলাম দোতলার জানালা থেকে মাঝে-মধ্যে কিছু কৌতূহলী চোখ আমাকে দেখছে। বিকেল চারটায় এক ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বের হয়ে কঠিন গলায় বললেন, “যথেষ্ট পাগলামি করা হয়েছে। এখন বাড়ি যাও।”

আমি তার চেয়েও কঠিন গলায় বললাম, ‘যাবো না।’

-পুলিশে খবর দিচ্ছি। পুলিশ এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।
-কোনো অসুবিধা নেই খবর দিন।
-ইউ রাস্কেল মাতলামি করার জায়গা পাও না?
-গালাগালি করছেন কেন? আমি তো আপনাকে গালি দিচ্ছি না।

ভদ্রলোক রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। তার পরপরই শুরু হলো বৃষ্টি । ঢালাও বর্ষণ । আমি ভিজছি নির্বিকার ভঙ্গিতে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝছি যে জ্বর এসে যাচ্ছে । সারা দিন রোদে পোড়ার পর এই ঠান্ডা বৃষ্টি সহ্য হবে না। তখন একটা বেপরোয়া ভাব চলে এসেছে – যা হবার হবে। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন । মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আমি আশেপাশের কৌতুহলি মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সমর্থ হয়েছি। বেশ কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস-করছেন, কী হয়েছে? এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভিজছেন কেন? আমি সবাইকে বলেছি, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমি একজন পাগল মানুষ।

মেয়েটির বাড়ি থেকেও এই ঘটনা কাউকে না কাউকে জানানো হয়েছে। তিনটি গাড়ি তাদের বাড়ির ভেতরে এলো। আরোহীরা রাগী ভঙ্গিমায় আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন।

রাত ন’টা বাজলো। বৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যে থামল না। জ্বরে তখন আমার গা পুড়ে যাচ্ছে । দাড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। দারোয়ান এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘সাহেব পুলিশ আনতে চাইতেছে, বড় আফা রাজি না। বড় আফা আপনের অবস্থা দেইখ্যা খুব কানতেছে। টাইট হইয়্যা বইসা থাকেন।’
আমি বসে রইলাম।

রাত এগারোটা বাজলো। ওদের বাড়ির বারান্দায় বাতি জ্বলে উঠল। বসার ঘরের দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়ে এলো । মেয়েটির পেছনে পেছনে ওদের বাড়ির সব ক’জন মানুষ । ওরা কেউ বারান্দা থেকে নামল না। মেয়েটি একা এগিয়ে এলো । আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং অসম্ভব কোমল গলায় বলল, কেন এমন পাগলামি করছেন?

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম । কারণ, এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। অন্য একটি মেয়ে । একে আমি কোনোদিন দেখিনি । মরিস মাইনর গাড়ির ড্রাইভার আমাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে। হয়তো ইচ্ছা করেই দিয়েছে। মেয়েটি নরম গলায় বলল, আসুন, ভেতরে আসুন। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। আসুন।

আমি উঠে দাড়ালাম । বলতে চেষ্টা করলাম, কিছু মনে করবেন না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনি সেই মেয়ে নন। আপনি অন্য একজন । মেয়েটির মমতায় ডুবানো চোখের দিকে তাকিয়ে এই

কথা বলা সম্ভব হলো না। এত মমতা নিয়ে কোনো নারী আমার দিকে তাকায়নি।

জ্বরের ঘোরে আমি ঠিকমতো পা ফেলতে পারছিলাম না। মেয়েটি বলল, আপনার বোধহয় শরীর খারাপ। বাসার সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের সবার কঠিন দৃষ্টি উপক্ষো করে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো । যে গভীর ভালোবাসায় হাত বাড়ালো ভালোবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে দেননি। আজ এত বছর তার হাত ধরেই আছি।

-মাঝে মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করি। ভ্রান্তির এই গল্প আমার স্ত্রীকে বলতে ইচ্ছা করে। বলতে পারি না । আপনার মতো অপরিচিত একজন কাউকে খুজে বের করি। কারন, আমি জানি এই গল্প কোনোদিন আমার স্ত্রীর কানে পৌঁছাবে না। আচ্ছা ভাই, উঠি । আমার ট্রেন এসে গেল।

ভদ্রলোক উঠে দাড়ালেন। দুরে ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে। রেললাইনে ঘরঘর শব্দ করছে। ট্রেন এসে গেল ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *