লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১০) হুমায়ূন আহমেদ

কী-এক উৎসব উপলক্ষে আমরা অর্থাৎ ওল্ড ফুলস ক্লাবের সদস্যরা একটা হােটেলের বড় ঘরে জড়াে হয়েছি। সেখানে মধ্যবয়স্ক অচেনা এক ব্যক্তি ঢুকল। আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম।লীলাবতীর মৃত্যু

বৃদ্ধ বােকা সংঘের আড্ডায় কখনাে অপরিচিতজনদের আসতে দেওয়া হয় না। এ কে ? এখানে কী চায়? 

পরিচয়ে জানলাম—তার একটা প্রেস আছে। সেই প্রেসে অন্যপ্রকাশ’-এর বইয়ের কভার মাঝে মাঝে ছাপা হয়। সে এসেছে অন্যপ্রকাশের মালিক মাজহারের কাছে। তার কিছু টাকা দরকার। 

বেচারা ব্ৰিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, আপনি বসুন। সে সংকুচিত ভঙ্গিতে বসল। 

আড্ডা জমে উঠল। আমি তার কথা ভুলেই গেছি। নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছি। যুক্তিতর্কের আসর জমেছে। এখন মনে পড়ছে না কী-একটা যুক্তি দিলাম। হঠাৎ সে বলল, এখন আপনি যে যুক্তিটা দিলেন তাতে ভুল আছে। 

আমি বললাম, কী ভুল ? 

সে আমার যুক্তির ভুল ব্যাখ্যা করল। ব্যাখ্যা সঠিক। আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম, আপনার কী নাম ? 

স্যার, আমার নাম সাদেক। 

আপনি এত পিছনে কেন ? কাছে এগিয়ে আসুন। সাদেক কাছে এগিয়ে এল। এই আসরেই তার নতুন নাম করা হলাে ‘চ্যালেঞ্জার’। | তার নামকরণে আমার কোনাে ভূমিকা ছিল না। নামকরণ করেছিলেন অবসর প্রকাশনার মালিক আলমগীর রহমান। সাদেক আলমগীর রহমানের দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে চ্যালেঞ্জ জিতে নেন বলেই নাম চ্যালেঞ্জার । সাদেক কী বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তা বলতে চাইছি না। কোনাে এক বিশেষ তরল পদার্থ গলধঃকরণ বিষয়ক চ্যালেঞ্জ। ধরা যাক পেপসি। আলমগীর আট বােতল পেপসি খেয়ে বমি শুরু করল। চ্যালেঞ্জার নয় বােতল খেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল, যেন কিছুই হয় নি। 

তাকে আমি প্রথম যে নাটকে নিলাম, তার নাম হাবলঙের বাজার। নাটকের কাহিনি হচ্ছে, গরমের সময় ডাক্তার এজাজের মাথা এলােমেলাে হয়। তার বিয়ের দিন খুব গরম পড়ার কারণে মাথা এলােমেলাে হয়ে গেল। ঠিক করা হলাে, মাথা কামিয়ে সেখানে মাথা গরমের এলাজ দেওয়া হবে। শট নেওয়ার আগে আগে দেখা গেল নাপিত আনা হয় নি । নাপিতের সন্ধানে লােক পাঠানাে হলাে। সে ক্ষুর-কাঁচি পাঠিয়ে দিল । নিজে এল না। তার ভয় সে এলেই তাকে নাটকে নামিয়ে দেওয়া হবে। আমি পড়লাম বিপাকে। 

কীভাবে নাটক বানানাে হয় তা দেখার জন্যে চ্যালেঞ্জার তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। দু’জনই আগ্রহ নিয়ে নাটক বানানাে দেখছে। আমি চ্যালেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি তাে সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জ হিসাবে নাও। এসাে নাপিতের ভূমিকায় তাভিনয় করাে। 

চ্যালেঞ্জার বলল, স্যার, আপনি যা বলবেন তাই করব। মাটি খেতে বলতে মাটি খাব। নাটক পারব না। 

আমি বললাম, তুমি পারবে। নাও, ক্ষুর হাতে নাও। 

চ্যালেঞ্জার ছােট্ট একটা ভূমিকায় অভিনয় করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, তার ভেতর সহজাত অভিনয়ের আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। 

তাকে একঘণ্টার একটি নাটকে প্রধান চরিত্র করতে বললাম, নাটকের নাম ‘খােয়াবনগর। সেখানে আমার মেজ মেয়ে শীলা অভিনয় করেছিল। নাটকের শেষে আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা! চ্যালেঞ্জার নামের এই নতুন অভিনেতার অভিনয় তােমার কেমন লাগল । | শীলা বলল, আসাদুজ্জামান নূর চাচাকে আমার এ দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেতা বলে মনে হয়। আমি আজ যার সঙ্গে অভিনয় করলাম, তিনি নূর চাচার চেয়ে কোনাে অংশে কম না। 

বাবা! তােমার কি মনে হয় একদিন সুপার স্টার হিসেবে তার পরিচয় হবে ? 

শীলা বলল, অবশ্যই। 

উড়ে যায় বকপক্ষী’তে পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করে সে নিজেকে সুপার স্টার প্রমাণিত করল। 

আমি কোনাে অবিচুয়ারি লিখছি না। চ্যালেঞ্জার এখনাে জীবিত। আজ দুপুরে সে তার স্ত্রীকে ইশারায় বলল, সে আমাকে দেখতে চায়। 

তার স্ত্রী তাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলাে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চ্যালেঞ্জারের কথা বলার ক্ষমতা নেই। যে কথা বলতে পারছে না, তার সঙ্গে কথা বলে তার যন্ত্রণা বাড়ানাের কোনাে মানে হয় না। 

চ্যালেঞ্জার সম্পর্কে দু’টি ছােটগল্প বলতে ইচ্ছা করছে। 

গল্প-আমি আমার মেয়ে বিপাশা ও পুত্র নুহাশকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছি। তখন আমি মূল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। একা বাস করি। আমার এই দুই পুত্র-কন্যা হঠাৎ করেই ঠিক করল, বাবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাবে। কাজেই তাদের নিয়ে এসেছি সমুদ্রের কাছে। উঠেছি হােটেল সায়মনে। খুব ভােরবেলা দরজায় নক হচ্ছে। দরজা খুললাম, অবাক হয়ে দেখি, এক কাপ গরম চা এবং খবরের কাগজ হাতে চ্যালেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে সারা রাত গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে। 

গল্প-২ দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি। শীলার মা’র সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণে ওল্ড ফুলস ক্লাবের সব সদস্য আমাকে ত্যাগ করেছে। কেউ ফ্ল্যাটে আসে না। হঠাৎ কারও সঙ্গে দেখা হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অদ্ভুত ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আমার সেই দুঃসময়ের কাল বেশ দীর্ঘ ছিল। তখন প্রতিদিন দুপুরে এবং রাতে চ্যালেঞ্জার এসে বসে থাকত। সে আমার সঙ্গে খাবে। তার একটাই যুক্তি 

স্যার, আপনি একা খেতে পছন্দ করেন না। আমি কখনােই আপনাকে একা খেতে দেব না। একসময় ওল্ড ফুলস ক্লাবের সদস্যরা আসতে শুরু করল । চ্যালেঞ্জার দূরে সরে গেল। 

চ্যালেঞ্জারের নিজের একটা গল্প বলি। সে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তার সত্মা’র অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছােট ছােট ভাইবােন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। তার নিজের ভাষ্যমতে, স্যার, কত দিন গিয়েছে কোনাে খাওয়া নাই। গ্লাসভর্তি চা নিজে খেয়েছি। ভাইবােনদের খাইয়েছি।’ বড় ভাইয়ের দায়িত্ব সে পুরােপুরি পালন করেছিল, সব ক’টা ভাইবােনকে পড়াশােনা করিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। তারচেয়েও অদ্ভুত কথা, সে তার সম্মাকে নিজের কাছে এনে যতটুকু আদর-যত্ন করা যায় করেছে। মৃত্যুর সময় এই মহিলা তার সৎ ছেলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি কঠিন অন্যায়-অত্যাচার তােমাদের ওপর করেছি। তারপরেও তুমি নিজের মায়ের মতাে সেবাযত্ন আমাকে করলে। আমি দোয়া করি, তােমার জীবন হবে আনন্দ এবং ভালােবাসায় পূর্ণ। 

দুষ্ট মানুষের প্রার্থনা মনে হয় আল্লাহপাক গ্রহণ করেন না। চ্যালেঞ্জার এখন জস্বী। তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার কিছু করার নেই। ব্রেইন ক্যানসার নামক কালান্তক ব্যাধি তার কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে নিয়েছে। 

 বাংলাদেশের মানুষ সাহায্যের হাত গাঢ় মমতায় তার দিকে বাড়িয়েছে বলেই সে এখনাে বেঁচে আছে। 

তার সাহায্যের জন্যে চ্যানেল আই মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিল। দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তবে সাহায্যের নামে কেউ কেউ প্রতারণাও করেছেন। চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরার সামনে বড় বড় ঘােষণা দিয়েছেন। তাদের নাম প্রচারিত হয়েছে—এই পর্যন্তই। যারা এই কাজটি করেছেন তাঁদের নাম উল্লেখ করলাম না। আল্লাহপাক মানী মানুষের মান রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁরা মানী লােক। 

এই প্রসঙ্গে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। তাকে আমি একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখে জনাব আসাদুজ্জামান নূরের হাত দিয়ে পাঠাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ 

তার মঙ্গল করুন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *