তিনি ছেলেকে কাছে
পেয়ে বরং খুশি হলেন।
নাশতা সমস্যায় এমন একটা ভালাে চাকরি ছাড়ার যুক্তি আমার কাছে কখনােই গ্রহণযােগ্য মনে হয় নি। আমার ধারণা, ঢাকায় সে বন্ধুবান্ধব ফেলে গেছে। তাদের টানেই চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে।তার কাছে বন্ধুবান্ধব অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যে তাকে ডেকে কিছু উপদেশ দেব তাও সম্ভব না। কারণ উপদেশ দেওয়ার বিষয়টা আমাদের পরিবারে নাই। আমরা উপদেশ দেই না, কারও উপদেশ শুনিও না।
অবশ্য তাকে উপদেশ দেওয়ার যােগ্যতাও আমার ছিল না। সে বড় হয়েছে একা একা। আমি তখন সংসার নামক ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের সামান্য কিছু টাকা সম্বল। বিরাট সংসার। আমরা ছয় ভাইবােন, মা। আমার ছােটমামাও আমাদের সঙ্গে থেকে পড়াশােনা করেন। কোনােদিকে তাকানাের অবস্থা নেই। আহসান হাবীব স্কুলে ভর্তি হবে। কে তাকে নিয়ে যাবে ? বেচারা নিজেই খুঁজে খুঁজে একটা স্কুল বের করল। মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভর্তি হয়ে গেল। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব বললেন, বাবা, তােমার গার্জিয়ান কোথায় ?
সে হাসিমুখে বলল, স্যার, আমিই আমার গার্জিয়ান । কখন সে পাস করল, কখন কলেজে গেল, কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে—কিছুই তাে জানি । তাকে কী করে আমি বলি, তােমার ভালাে চাকরি মন দিয়ে করা দরকার। | সে তার উন্মাদ পত্রিকা নিয়ে আছে। ভালাে আছে বলেই আমার ধারণা। আর ভালাে না থাকলেই বা কী!
আহসান হাবীবকে নিয়ে লেখার একটা আলাদা কারণ আছে। কারণটা শুনলে পাঠক বিস্মিত হবেন বলেই এই লেখা।
আহসান হাবীব শব্দের রঙ দেখতে পায়। সে বলে যখনই কোনাে শব্দ হয় তখনই সে সেই শব্দের রঙ দেখে। কখনাে নীল, কখনাে লাল, সবুজ, কমলা। মাঝে মাঝে এমন সব রঙ দেখে যার অস্তিত্ব বাস্তব পৃথিবীতে নেই।
তরুণ গবেষক হিসেবে আমি তাকে নিয়ে কিছু গবেষণাও করি। হারমােনিয়ামের একেক রিড একেক ফ্রিকোয়েন্সিতে বাজে। আমি তাকে আলাদা আলাদা করে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সি বাজিয়ে শােনালাম। সে রঙ বলল। আমি লিখে রাখলাম। পনেরাে দিন পর আবারও সেই পরীক্ষা। রঙগুলাে যদি বানিয়ে বানিয়ে বলে তাহলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় এলােমেলাে ফল আসবে। আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। গানের সাতটা স্বর হলাে সা রে গা মা পা ধা নি। প্রথমবারের পরীক্ষায় সে বলেছে—
সা : নীল রে : সবুজ গা : গাঢ় সবুজ
মা : কমলা ইত্যাদি।
পনেরাে দিন পর একই পরীক্ষা যদি করা হয়, তাহলে একই উত্তর তাকে দিতে হবে। ভিন্ন উত্তর দিলে বুঝতে হবে রঙের ব্যাপারটা সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
ঘটনা সেরকম ঘটল না। সে একই উত্তর দিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ ধরনের রঙ দেখার কারও ক্ষমতা আছে তা আমার চিন্তাতেও ছিল না।
তার মতাে ক্ষমতা যে আরও কিছু মানুষের আছে তা জানলাম রাশিয়ান একটা পত্রিকা পড়ে। পত্রিকার নাম Sputnik। রিডার্স ডাইজেস্ট-এর মতাে পত্রিকা। সেখানে বিশাল এক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে যার বিষয় কিছু কিছু মানুষের শব্দের রঙ দেখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা।
উন্মাদ অফিসে বসে আহসান হাবীব এখনাে রঙ দেখে কি না জানি না। আমরা ভাইবোেনরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। কেউ কারও খবর রাখি না। বাবা–মা ভাইবােনকে নিয়ে একসময় ভালােবাসার বৃত্তের মধ্যে একটা সংসার ছিল। সেই বৃত্ত ভেঙে গেছে। নতুন বৃত্ত তৈরি করে প্রত্যেকেই আলাদা সংসার করছি। আমাদের সবার ভুবনই আলাদা। এই ভুবনও একদিন ভাঙবে। আমরা অচেনা এক বৃত্তের দিকে যাত্রা শুরু করব। সেই বৃত্ত কেমন কে জানে! পৃথিবীতেই এত রহস্য। না জানি কত রহস্য অপেক্ষা করছে অদেখা ভুবনে ।।
অসুখ
ছছাটখাটো অসুখ আমার কখনাে হয় না। সর্দিকাশি-জ্বর কখনাে না। পচা, বাসি খাবার খেয়েও আমার পেট নামে না। ব্যাকপেইনে কাতর হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি না। আধকপালি, সম্পূর্ণ কপালি কোনাে কপালি মাথাব্যথা নেই। মুড়িমুড়কির মতাে প্যারাসিটামল আমাকে খেতে হয় না।
এক বিকেলে দু’টা Ace নামের প্যারাসিটামল খেয়ে ফেললাম। শাওন বিস্মিত হয়ে বলল, মাথাব্যথা ?
আমি বললাম, না। এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যাব। সেখানে মাথা ধরতে পারে ভেবেই অ্যাডভান্স ওষুধ খাওয়া।
ঘােট রােগ-ব্যাধি যাদের হয় না, তাদের জন্যে অপেক্ষা করে বড় অসুখ । একদিন কথা নেই বার্তা নেই গলা দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। এক চামচ দু’ চামচ
, কাপভর্তি রক্ত। আমি হতভম্ব। কিছুক্ষণের মধ্যে নাক দিয়েও রক্তপাত শুরু হলাে। আমার শরীরে এত রক্ত আছে ভেবে কিছুটা আহ্লাদও হলাে।
তখন আমি চিটাগাংয়ের এক হােটেলে। শিশুপুত্র নিষাদকে নিয়ে শাওন আছে আমার সঙ্গে। নিষাদ অবাক হয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, এত রক্ত দিয়ে আমরা কী করব?
আমি তার কথায় হাে হাে করে হাসছি। শাওন বলল, এই অবস্থায় তােমার হাসি আসছে ?
আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসি বন্ধ করলাম । আসলেই তাে এই অবস্থায় হাসা ঠিক আমার উচিত কাগজ-কলম নিয়ে এপিটাফ লিখে ফেলা। কল্পনায় দেখছি। নুহাশপল্লীর সবুজের মধ্যে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবর। তার গায়ে লেখা
‘চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে নিয়াে না, নিয়াে না সরায়ে।
এখন বলি হার্ট অ্যাটাকের গল্প। সােহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলছে। প্রথম ধাক্কা সামলে ফেলেছি। আজরাইল খাটের নিচেই ছিল। ডাক্তারদের প্রাণপণ চেষ্টায় বেচারাকে মন খারাপ করে চলে যেতে হয়েছে। আমাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কেবিনে। কত দিন থাকতে হবে ডাক্তাররা পরিষ্কার করে বলছেন না।
এক সকালবেলায় হাসপাতালের লােকজনের মধ্যে অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখা গেল । আমার বিছানার চাদর বদলে দেওয়া হলাে। জানালায় পর্দা লাগানাে হলাে। ঝাড়দার এসে বিপুল উৎসাহে ফিনাইল দিয়ে মেঝে ঘষতে লাগল। তারপর দেখি তিনজন অস্ত্রধারী পুলিশ । একজন ঢুকে গেল বাথরুমে, দু’জন চলে গেল বারান্দায়। আমি ডিউটি ডাক্তারকে বললাম, ভাই, আমাকে কি অ্যারেস্ট করা হয়েছে ? অপরাধ কী করেছি তাও তাে জানি না।
ডিউটি ডাক্তার বললেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন সাহেব আপনাকে দেখতে আসছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন ?
সেটা তাে আমরাও জানি না। প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব খবর দিয়েছেন, তিনি আপনাকে দেখতে আসবেন।
আমি মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এই দফায় আমি মারা যাচ্ছি। শুধু মৃত্যুপথযাত্রী কবি-সাহিত্যিকদেরকেই দেশের প্রধানরা দেখতে আসেন।
প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন আমার প্রিয় মানুষদের একজন। তাঁর সততা, দেশের প্রতি ভালােবাসা তুলনাহীন। তিনি আমাকে দেখতে আসছেন জেনে নিজেকে খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।
ছােটখাটো মানুষটা দুপুরের দিকে এলেন। বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। যে কথাটা বললেন তাতে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল তিনি ময়মনসিংহের ভাষায় বললেন, এখন মারা গেলে চলবে ? আপনার নােবেল পুরস্কার আনতে হবে না!
আমি বললাম, আপনি কি জানেন এই মুহূর্তে আপনি আমাকে যে পুরস্কার দিয়েছেন তা নােবেল পুরস্কারের চেয়েও বড় ?
থাকুক এসব কথা, বাইপাস অপারেশনের গল্পে চলে যাই। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথের ডাক্তার আমার বাইপাস করবেন। অপারেশন হবে ভােরবেলায়। সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মূল কারণ আমাকে সাহস দেওয়া।
আমি বললাম, ঠিক করে বলুন তাে ডাক্তার, অপারেশনে আমার মৃত্যুর আশঙ্কা আছে না? আপনি কি ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিতে পারবেন যে বেঁচে থাকব ?
মৃত্যুর আশঙ্কা কত ভাগ ? ফাইভ পার্সেন্ট।
তাহলে আজ রাত বারােটা পর্যন্ত আমাকে ছুটি দিন। রাত বারােটা পর্যন্ত আমি আনন্দ করব । এক গ্লাস ওয়াইন খাব। সিগারেট খাব। মনের আনন্দ নিয়ে সিঙ্গাপুরের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখব । রাত বারােটা বাজার আগেই ফিরে
আসব।
ডাক্তার বললেন, কাল ভােরবেলায় আপনার অপারেশন। মেডিকেশন শুরু হয়ে গেছে। এখন এসব কী বলছেন?