লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১৩) হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, অপারেশনের পর আমি তাে মারাও যেতে পারি। আপনি কী করেন জানতে পারি? আমি একজন লেখক। গল্প বানাই। লীলাবতীর মৃত্যুএকজন লেখকের পক্ষেই এমন উদ্ভট প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব। আচ্ছা দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রাজি করানাে কঠিন হবে। 

আশ্চর্যের ব্যাপার, বিশেষ ব্যবস্থায় আমাকে রাত বারােটা পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হলাে। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের আমিই নাকি প্রথম বাইপাস পেশেন্ট— যাকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। 

অপারেশন টেবিলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দু’জন নার্স চাকা লাগানাে বিছানা ঠেলতে ঠেলতে নিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। একজন হাস্যমুখি আবার হি হি করে কিছুক্ষণ পরপর হাসছে। তার গা থেকে বােটকা গন্ধও আসছে। চায়নিজ মেয়েদের গা থেকে গা গুলানাে গন্ধ আসে। চায়নিজ ছেলেরা হয়তাে এই গন্ধের জন্যেই পাগল। 

আমি চোখ বন্ধ করলাম। কোনাে সুন্দর দৃশ্যের কল্পনা করা যায় কি না তার চেষ্টা। জোছনামাত অপূর্ব কোনাে রজনীর স্মৃতি। কিংবা শ্রাবণের ক্লান্তিবিহীন বৃষ্টির দিনের স্মৃতি। কিছুই মাথায় আসছে না। চোখ মেললাম এনেসথেসিস্টের কথায়। এনেসথেসিস্ট বললেন (তিনি একজন মহিলা), তুমি ভয় পাচ্ছ? 

আমি বললাম, না। 

আশ্চর্যের কথা, আসলেই ভয় পাচ্ছিলাম না। কেন ভয় পাচ্ছি না তাও বুঝতে পারছি না। পরে শুনেছি ভয় কমানাের একটা ইনজেকশন নাকি তারা দেয়। 

অজ্ঞান করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শরীর হালকা হতে শুরু করেছে। অস্পষ্টভাবে কোনাে-একটা বাদ্যযন্ত্রের বাজনা কানে আসছে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাবে না। তাহলে কে বাজাচ্ছে ? 

এরশাদ সাহেবের সময়কার কথা। সরকারি পর্যায়ে শিলাইদহে রবীন্দ্রজয়ন্তি হবে। আমার কাছে জানতে চাওয়া হলাে আমি উৎসবে যােগ দেব কি না। 

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে যে-কোনাে নিমন্ত্রণে আমি আছি। এরশাদ সাহেবের উদ্যোগে অনুষ্ঠান হচ্ছে, হােক না, আমি কোনাে সমস্যা দেখছি না। রবীন্দ্রনাথকে ভালােবাসার অধিকার সবারই আছে। 

যথাসময়ে শিলাইদহে উপস্থিত হলাম। কুঠিবাড়িতে পা দিয়ে গায়ে রােমাঞ্চ হলাে। মনে হলাে পবিত্র তীর্থস্থানে এসেছি। এক ধরনের অস্বস্তিও হতে লাগল, মনে হলাে—এই যে নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তা বােধহয় ঠিক হচ্ছে না। চারদিকে রবীন্দ্রনাথের পায়ের ধুলা ছড়িয়ে আছে। কবির কত স্মৃতি, কত আনন্দ বেদনা মিশে আছে প্রতি ধূলিকণায়। সেই ধুলার ওপর দিয়ে আমি হেঁটে যাব, তা কি হয়? এত স্পর্ধা কি আমার মতাে অভাজনের থাকা উচিত ? 

 নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে এত ভালাে লাগছে! কুঠিবাড়ির একটা ঘরে দেখলাম কবির লেখার চেয়ার-টেবিল। এই চেয়ারে বসেই কবি কত-না বিখ্যাত গল্প লিখেছেন। কুঠিবাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়ল কবির প্রিয় নদী প্রমত্তা পদ্মা। ১২৯৮ সনের এক ফাল্গুনে এই পদ্মার দুলুনি খেতে খেতে বজরায় আধশােয়া হয়ে বসে কবি লিখেছেন, 

শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি 

যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী! একদিকে উৎসব হচ্ছে, গান, কবিতা আলােচনা; অন্যদিকে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজের মনে। সন্ধ্যাবেলা কঠিবাড়ির গানের অনুষ্ঠানে আমি নিমন্ত্রিত অতিথি, উপস্থিত না থাকলে ভালাে দেখায় না বলে প্যান্ডেলের নিচে গিয়ে বসেছি। শুরু হলাে বৃষ্টি, ভয়াবহ বষ্টি। সেইসঙ্গে দমকা বাতাস। বাতাসে সরকারি প্যান্ডেলের অর্ধেক উড়ে গেল। আমি রওনা হলাম পদ্মার দিকে। এমন ঝমঝম বৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথও নিশ্চয়ই ভিজতেন। আমি যদি না ভিজি তাহলে কবির প্রতি অসম্মান করা হবে। 

বৃষ্টিতে ভেজা আমার জন্যে নতুন কিছু না। কিন্তু সেদিনকার বৃষ্টির পানি ছিল বরফের চেয়েও ঠান্ডা। আর হাওয়া ? মনে হচ্ছে সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসছে। আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। নবধারা জলে স্নানের আনন্দ ধুয়ে-মুছে গেছে। রেস্ট হাউজে ফিরে শুকনাে কাপড় পরতে পারলে বাঁচি। 

কাঁপতে কাঁপতে ফিরছি। পদ্মা থেকে কুঠিবাড়ি অনেকটা দূর। কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টির পানিতে সেই রাস্তা কাদা হয়ে গেছে। দ্রুত হাঁটা যাচ্ছে না। জায়গাটাও অন্ধকার। আধাআধি পথ এসে থমকে দাঁড়ালাম। কে যেন রাস্তার পাশে গাছের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে আলাে করে বিদ্যুৎ চমকালাে। আর তখনই আমার সারা শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, গাছের নিচে যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কি কোনাে মায়া ? কোনাে ভ্রান্তি ? বিচিত্র কোনাে হেলুসিনেশন? আমার চিন্তা-চেতনা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই তাঁকে দেখছি ? 

আমি চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই ছায়ামূর্তি বলল, কে, হুমায়ূন ভাই না? 

নিজেকে চট করে সামলে নিলাম । রবীন্দ্রনাথের প্রেতাত্মা নিশ্চয়ই আমাকে হুমায়ূন ভাই’ বলবে না। আমি ভৌতিক কিছু দেখছি না। এমন একজনকে দেখছি যে আমাকে চেনে এবং যাকে অন্ধকারে খানিকটা রবীন্দ্রনাথের মতাে দেখায় । ছায়ামূর্তি বলল, হুমায়ূন ভাই, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কোথায় যাচ্ছেন ? 

আমি বললাম, কুঠিবাড়ির দিকে যাচ্ছি। আমি কি আপনাকে চিনি ? 

জি-না, আপনি আমাকে চেনেন না। হুমায়ূন ভাই, আমি আপনার অনেক ছােট। আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। 

তােমার নাম কী ? রবি। ও আচ্ছা, রবি। আমি আবার বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলাম। নাম রবি মানে? হচ্ছেটা কী ? রবি বলল, চলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাই। চলাে। 

ভিজতে ভিজতে আমরা কুঠিবাড়িতে উপস্থিত হলাম। ঝড়ের প্রথম ঝাপটায় ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল, এখন আবার এসেছে। চারদিকে আলাে ঝলমল করছে। আলােতে আমি আমার সঙ্গীকে দেখলাম, এবং আবারও চমকালাম। অবিকল যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথ। আমি বললাম, তােমাকে দেখে যে আমি বারবার চমকাচ্ছি তা কি তুমি বুঝতে পারছ ? 

পারছি। আপনার মতাে অনেকেই চমকায়। তবে আপনি অনেক বেশি চমকাচ্ছেন। 

তােমার নাম নিশ্চয়ই রবি না ? জি-না। যারা যারা আমাকে দেখে চমকায় তাদের আমি এই নাম বলি। এসাে, আমরা কোথাও বসে গল্প করি।। আপনি ভেজা কাপড় বদলাবেন না? আপনার তাে ঠান্ডা লেগে যাবে। লাগুক ঠান্ডা। 

আমরা একটা বাঁধানাে আমগাছের নিচে গিয়ে বসলাম। রবি উঠে গিয়ে কোথেকে এক চাওয়ালাকে ধরে নিয়ে এল । গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আমি আধভেজা সিগারেট ধরিয়ে টানছি। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। সেই চা-ও বৃষ্টির পানির মতােই ঠান্ডা। খুবই লৌকিক পরিবেশ। তারপরেও আমি লক্ষ করলাম, আমার বিস্ময়বােধ দূর হচ্ছে না। 

রবি হাসিমুখে বলল, হুমায়ুন ভাই! আমি শুনেছিলাম আপনি খুব সিরিয়াস ধরনের মানুষ। আপনি যে বাচ্চাদের মতাে বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করেন তা ভাবি নি। আপনাকে দেখে আমার খুব মজা লেগেছে। 

আমি বললাম, তােমাকে দেখে শুরুতে আমার লেগেছিল ভয়। এখন লাগছে বিস্ময়। 

 আপনি এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন ? মানুষের চেহারার সঙ্গে মানুষের মিল থাকে না? 

থাকে, এতটা থাকে না। 

রবির সঙ্গে আমার আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল। সম্ভব হলাে না। সরকারি বাস কুষ্টিয়ার দিকে রওনা হচ্ছে। বাস মিস করলে সমস্যা। রবি আমার সঙ্গে এল না। সে আরও কিছুক্ষণ থাকবে। পরে রিকশায় করে যাবে। তবে সে যে ক’দিন অনুষ্ঠান চলবে, রােজই আসবে। কাজেই তার সঙ্গে দেখা করার সুযােগ রয়ে গেল । 

রাতে রেস্টহাউজে ফিরে আমার কেন জানি মনে হলাে পুরাে ব্যাপারটাই মায়া। ছেলেটির সঙ্গে আর কখনােই আমার দেখা হবে না। রাতে ভালাে ঘুমও হলাে না। 

আশ্চর্যের ব্যাপার! পরদিন সত্যি সত্যি ছেলেটির দেখা পেলাম না। অনেক খুঁজলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, দেখতে অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতাে 

এমন একজনকে দেখেছেন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *