লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১৪) হুমায়ূন আহমেদ

তারা সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি কিছুক্ষণ আগেই গাঁজা খেয়ে এসেছি। ওই জিনিস তখন কুঠিবাড়ির আশপাশে খাওয়া হচ্ছে। লালন শাহ র কিছু অনুসারী এসেছেন। তাঁরা গাজার ওপরই মত্ত আছেন। উৎকট গন্ধে তাঁদের কাছে যাওয়া যায় না।লীলাবতীর মৃত্যুতাঁদের একজন আমাকে হাত ইশারা করে কাছে ডেকে বলছেন, আচ্ছা স্যার, রবিঠাকুর যে লালন শাহ্-র গানের খাতা চুরি করে নােবেল পেল এই বিষয়ে ভদ্রসমাজে কিছু আলােচনা করবেন। এটা অধীনের নিবেদন। 

তৃতীয় দিনেও যখন ছেলেটার দেখা পেলাম না, তখন নিশ্চিত হলাম, ঝড় বৃষ্টির রাতে যা দেখেছি তার সবটাই ভ্রান্তি। মধুর ভ্রান্তি। নানান ধরনের যুক্তিও আমার মনে আসতে লাগল । যেমন, আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করাে ? সে জবাব দেয় নি। আমার সঙ্গে সরকারি বাসে আসতেও রাজি হয় নি। নিজের আসল নামটিও বলে নি । 

অনুষ্ঠানের শেষ দিনে দেখি সে প্যান্ডেলের এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। এই রবি, এই। 

রবি হাসিমুখে তাকাল, এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল। আমি বললাম, এই ক’দিন আস নি কেন? 

শরীরটা খারাপ করেছিল। ওই দিন বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেল। আজ শরীর কেমন ? আজ ভালাে। এই ক’দিন আমি তােমাকে খুব খুঁজেছি। 

আমি অনুমান করেছি। আচ্ছা হমায়ুন ভাই, দিনের আলােতেও কি আমাকে রবীন্দ্রনাথের মতাে লাগে ? 

হ্যা লাগে, বরং অনেক বেশি লাগে। | সে ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেখুন মানুষের ভাগ্য। আমি শুধু দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতাে, এই কারণে আপনি কত আগ্রহ করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। 

তার জন্য কি তােমার খারাপ লাগছে? 

খারাপ লাগছে না। ভালাে লাগছে। খুব ভালাে লাগছে। নিজেকে মিথ্যামিথ্যি রবীন্দ্রনাথ ভাবতেও আমার ভালাে লাগে। 

তুমি টিভিতে কখনাে নাটক করেছ ? কেন বলুন তাে? তােমাকে আমি টিভি নাটকে ব্যবহার করতে চাই। 

আমি কোনােদিন নাটক করি নি, কিন্তু আপনি বললে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে করব। কী নাটক ? 

এই ধরাে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটক । যৌবনের রবীন্দ্রনাথ। কুঠিবাড়িতে থাকেন। পদ্মার তীরে হাঁটেন। গান লিখেন, গান করেন। এইসব নিয়ে ডকুমেন্টারি ধরনের নাটক। 

আপনি লিখবেন? 

হ্যা, লিখব। একটা কাগজে তােমার ঠিকানা লিখে দাও। ঠিকানা আপনি হারিয়ে ফেলবেন। আমি বরং আপনাকে খুঁজে বের করব। 

ছুটির সময়ে মন সাধারণত তরল ও দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। ছুটির সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পরে আর মনে থাকে না। আমার বেলায় সেরকম হলাে না। আমি ঢাকায় ফিরেই টিভির নওয়াজিশ আলি খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। আমার পরিকল্পনার কথা বললাম। তিনি এক কথায় বাতিল করে দিলেন। তিনি বললেন, রবিঠাকুরকে সরাসরি দেখাতে গেলে অনেক সমস্যা হবে। সমালােচনা হবে। রবীন্দ্রভক্তরা রেগে যাবেন। বাদ দিন। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। 

মাস তিনেক পর ছেলেটার সঙ্গে আবার দেখা হলাে টিভি ভবনে। সে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল—নাটক লিখছি কি না। আমি সত্যি কথাটা তাকে বলতে পারলাম না। তাকে বললাম, লিখব লিখব। তুমি তৈরি থাকো। 

আমি তৈরি আছি। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। চেহারাটা ঠিক রাখাে, চেহারা যেন নষ্ট না হয়। 

আমি টিভির আরও কিছু লােকজনের সঙ্গে কথা বললাম। কোনাে লাভ হলাে  ছেলেটির সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি বলি—হবে হবে, ধৈর্য ধরাে। এই মিথ্যা আশ্বাস যতবার দিই ততবারই খারাপ লাগে। মনে মনে বলি, কেন বারবার এর সঙ্গে দেখা হয়। আমি চাই না দেখা হােক। তারপরেও দেখা হয়। 

একদিন সে বলল, হুমায়ূন ভাই, আপনি কি একটু তাড়াতাড়ি নাটকটা লিখতে পারবেন? 

কেন বলাে তাে? এমনি বললাম। হবে হবে, তাড়াতাড়িই হবে। 

তারপর অনেক দিন ছেলেটির সঙ্গে দেখা নেই। নাটকের ব্যাপারটা প্রায় ভুলে গেছি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছি অন্য কাজে। তখন ১৪০০ সাল নিয়ে খুব হইচই শুরু হলাে। আমার মনে হলাে, এ-ই হচ্ছে সুযােগ । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটকটা লিখে ফেলা যাক। নাটকের নাম হবে ‘১৪০০ সাল। প্রথম দৃশ্যে কবি একা একা পদ্মার পাড়ে হাঁটছেন, আবহসংগীত হিসেবে কবির বিখ্যাত কবিতাটি (আজি হতে শতবর্ষ পরে…) পাঠ করা হবে। কবির মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবে একঝাঁক পাখি। কবি আগ্রহ নিয়ে তাকাবেন পাখির দিকে, তারপর তাকাবেন আকাশের দিকে। 

দ্রুত লিখে ফেললাম। আমার ধারণা, খুব ভালাে দাঁড়াল। নাটকটা পড়ে শােনালে টিভির যে-কোনাে প্রযােজকই আগ্রহী হবেন বলে মনে হলাে। একদিন ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করছি টিভি’র বরকতউল্লাহ সাহেবের সঙ্গে। পাশে আছেন জিয়া আনসারী সাহেব। তিনি কথার মাঝখানে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, রবিঠাকুরের ভূমিকায় আপনি যে ছেলেটিকে নেওয়ার কথা ভাবছেন তাকে আমি চিনতে পারছি। গুড চয়েস। 

আমি বললাম, ছেলেটার চেহারা অবিকল রবিঠাকুরের মতাে না ? হা। তবে ছেলেটিকে আপনি অভিনয়ের জন্যে পাবেন না। কেন ? 

ওর লিউকোমিয়া ছিল। অনেক দিন থেকে ভুগছিল। বছরখানিক আগে মারা গেছে। 

আমি অনেকক্ষণ কোনাে কথা বলতে পারলাম না। গভীর আনন্দ ও আগ্রহ নিয়ে ছেলেটা অপেক্ষা করছিল। তার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। সে কাউকে 

তা জানতে দেয় নি। 

বাসায় ফিরে নাটকের পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে ফেললাম। এই নাটকটি আমি রবিঠাকুরের জন্যে লিখি নি। ছেলেটির জন্যে লিখেছিলাম। সে নেই, নাটকও নেই।। 

ছেলেটির নাম নিয়ে আমি সমস্যায় পড়েছি। নাম মনে করতে পারছি না। ভােরের কাগজ-এর সাংবাদিক জনাব সাজ্জাদ শরিফের ধারণা তার নাম হাফিজুর রশিদ। ডাক নাম রাজু। 

নারিকেল-মামা 

তাঁর আসল নাম আমার মনে নেই। 

আমরা ডাকতাম নারিকেল-মামা। কারণ নারিকেল গাছে উঠে নারিকেল পেড়ে আনার ব্যাপারে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। পায়ে দড়ি-টুড়ি কিচ্ছু বাঁধতে হতাে না। নিমিষের মধ্যে তিনি উঠে যেতেন। নারিকেল ছিড়তেন শুধু হাতে। তাঁর গাছে ওঠা, গাছ থেকে নামা, পুরাে ব্যাপারটা ছিল দেখার মতাে। তাঁর নৈপুণ্য যে পর্যায়ের তা দেখাবার জন্যই একদিন আমাকে বললেন, এই, পিঠে উঠো। শক্ত কইরা গলা চাইপা ধরাে। আমি তা-ই করলাম। তিনি আমাকে নিয়ে তরতর করে নারকেল গাছের মগডালে উঠে দুই হাত ছেড়ে নানা কায়দা দেখাতে লাগলেন। ভয়ে আমার রক্ত জমে গেল। খবর পেয়ে আমার নানাজান ছুটে এলেন। হুংকার দিয়ে বললেন, হারামজাদা, নেমে আয়। 

এই হচ্ছেন আমাদের নারিকেল-মামা। আত্মীয়তা সম্পর্ক নেই। নানার বাড়ির সব ছেলেই যেমন মামা, ইনিও মামা। আমার নানার বাড়িতে কামলা খাটেন। নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ। খুব গরম পড়লে মাথা খানিকটা এলােমেলাে হয়ে যায়। কিংবা কে জানে মাথা হয়তাে তাঁর সব সময়ই এলােমেলাে। শুধু গরমের সময় 

অন্যেরা তা বুঝতে পারে। 

নারিকেল-মামার মাথা এলােমেলাে হওয়ার প্রধান লক্ষণ হলাে—হঠাৎ তাঁকে দেখা যাবে গােয়ালঘর থেকে দড়ি বের করে হনহন করে যাচ্ছেন। পথে কারও সঙ্গে দেখা হলাে, সে জিজ্ঞেস করল, কই যাস? 

নারিকেল-মামা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলবেন, ফাঁস নিব। উঁচা লম্বা একটা গাছ দেইখ্যা ঝুইল্যা পড়ব। 

প্রশ্নকর্তা তাতে বিশেষ বিচলিত হয় না। বিচলিত হওয়ার তেমন কারণ নেই। এই দৃশ্য তার কাছে নতুন নয়। আগেও দেখেছে। একবার না, অনেকবার দেখেছে। প্রশ্নকর্তা শুধু বলে, আচ্ছা যা। একবার জিজ্ঞেসও করে না, ফাস নেওয়ার ইচ্ছেটা কেন হলাে। 

তাঁর আত্মহননের ইচ্ছা তুচ্ছ সব কারণে হয়। তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছে। ভাত-তরকারি সবই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লবণ দিতে ভুলে গেছে। তিনি লবণ চেয়েছেন। যে ভাত দিচ্ছে সে হয়তাে শােনে নি। তিনি শান্তমুখে খাওয়া শেষ করলেন ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *