পানি খেলেন। পান মুখে দিয়ে গােয়ালঘরে ঢুকে গেলেন দড়ির খোঁজে। এই হলাে ব্যাপার।সবই আমার শােনা কথা। আমরা বছরে একবার ছুটির সময় নানার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। থাকতাম দশ-পনেরাে দিন। এই সময়ের মধ্যে নারিকেল মামার দড়ি নিয়ে ছােটাছুটির দৃশ্য দেখি নি। তাকে আমার মনে হয়েছে অতি ভালাে একজন মানুষ। আমাদের মনােরঞ্জনের চেষ্টায় তার কোনাে সীমা ছিল না। একটা গল্পই তিনি সম্ভবত জানতেন। সেই গল্পই আমাদের শােনাবার জন্য তার ব্যস্ততার সীমা ছিল না। কাইক্যা মাছের গল্প।
এক দিঘিতে একই কইক্যা মাছ বাস করত। সেই দিঘির পাড়ে ছিল একটা চাইলতা গাছ। একদিন কাইক্যা মাছ চাইলতা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ একটা চাইল তার গায়ে পড়ল। সে দারুণ বিরক্ত হয়ে বলল, চাইলতারে চাইলতা, তুই যে আমায় মাইলি ?
উত্তরে চাইলতা বলল, কাইক্যারে কাইক্যা, তুই যে আমার কাছে আইলি ? এই হলাে গল্প । কেনই-বা এটা একটা গল্প, এর মানে কী—আমি কিছুই জানি । কিন্তু এই গল্প বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে নারিকেল-মামার চোখে পানি এসে যেত। আমি তার কাছে এই গল্প বারবার শুনতে চাইতাম তার কাণ্ডকারখানা দেখার জন্যে।
সেবার রােজার ছুটিতে নানার বাড়িতে গিয়েছি। তখন রােজা হতাে গরমের সময়। প্রচণ্ড গরম। পুকুরে দাপাদাপি করে অনেকক্ষণ কাটাই। আমরা কেউই সতার জানি না। নারিকেল-মামাকে পুকুরপাড়ে বসিয়ে রাখা হতাে যাতে তিনি আমাদের দিকে লক্ষ রাখেন। তিনি চোখ-কান খােলা রেখে মূর্তির মতাে বসে থাকেন। একদিন এইভাবে বসে আছেন। আমরা মহানন্দে পানিতে ঝপাচ্ছি, হঠাৎ
শুনি বড়দের কোলাহল—ফাস নিছে! ফাঁস নিছে!
পানি ছেড়ে উঠে এলাম। নারিকেল-মামা নাকি ফাস নিয়েছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। নানার বাড়িতে পেছনের জঙ্গলে জামগাছের ডালে দড়ি হাতে নারিকেল মামা বসে আছেন। দড়ির একপ্রান্ত জামগাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা। অন্য প্রান্ত তিনি তার গলায় বেঁধেছেন। তিনি ঘােড়ায় চড়ার মতাে ডালের দু’দিকে পা দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসে আছেন।
আমরা ছােটরা খুব মজা পাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লােক দড়িতে ঝুলে মরবে, সেই দৃশ্য দেখতে পাব—এটা সে সময় আমাদের মধ্যে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। বড়রা অবশ্যি ব্যাপারটাকে মােটেও পাত্তা দিল না। আমার নানাজান বললেন, আজ গরমটা অতিরিক্ত পড়েছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে। তিনি নারিকেল-মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাম হারামজাদা। নারিকেল-মামা বিনীত গলায় বললেন, জে-না মামুজি। ফাঁস দিমু।
তােরে মাইরা আজ হাড়ি গুঁড়া করব। খেলা পাইছস ? দুইদিন পরে পরে ফাস নেওয়া। ফাস অত সস্তা। রােজা রাখছস?
রাখছি। রােজা রাইখ্যা যে ফাঁস নেওন যায় না এইটা জানস ?
জে-না।
নাইম্যা আয় । ফাস নিতে চাস ইফতারের পরে নিবি। অসুবিধা কী? দড়িও তাের কাছে আছে। জামগাছও আছে। নাম কইলাম। রােজা রাইখ্যা ফাঁস নিতে যায়! কত বড় সাহস। নাম।
নারিকেল-মামা সুড়সড় করে নেমে এলেন। মােটেও দেরি করলেন না। আমাদের মন কী যে খারাপ হলাে! মজার একটা দৃশ্য নানাজানের কারণে দেখা হলাে না। নানাজানের ওপর রাগে গা জ্বলতে লাগল। মনে ক্ষীণ আশা, ইফতারের পর যদি নারিকেল-মামা আবার ফাস নিতে যান।
ইফতারের পরও কিছু হলাে না। খাওয়াদাওয়ার পর নারিকেল-মামা হৃষ্টচিত্তে ঘুড়ে বেড়াতে লাগলেন। কোথেকে যেন একটা লাটিম জোগাড় করলেন। শহর থেকে আসা বাচ্চাদের খুশি করার জন্যে উঠোনে লাটিম খেলার ব্যবস্থা হলাে । আমি একফাকে বলেই ফেললাম, মামা, ফাস দিবেন না ? তিনি উদাস গলায় বললেন, যাউক, রমজান মাসটা যাউক। এই মাসে ফাস নেওয়া ঠিক না।
রমজানের পরে আমরা থাকব না। চলে যাব। আমরা দেখতে পারব না। নারিকেল-মামা উদাস গলায় বললেন, এইসব দেখা ভালাে না গাে ভাইগ্না ব্যাটা। জিহ্বা বাইর হইয়া যায়। চউখ বাইর হইয়া যায়। বড়ই ভয়ংকর।
আপনি দেখেছেন?
ভাইগ্না ব্যাটা কী কয়? আমি দেখব না! একটা ফাঁসের মরা নিজের হাতে দড়ি কাইট্যা নামাইছি। নামাইয়্যা শইল্যে হাত দিয়ে দেখি তখনাে শইল গরম। তখনাে জান ভেতরে রইছে। পুরাপুরি কবজ হয় নাই।
হয় নি কেন?
মেয়েছেলে ছিল। ঠিকমতাে ফাস নিতে পারে নাই। শাড়ি পেঁচাইয়া কি ফাস হয় ? নিয়ম আছে না ? সবকিছুর নিয়ম আছে। লম্বা একটা দড়ি নিবা। যত লম্বা হয় তত ভালাে। দড়ির এক মাথা বাবা গাছের ডালে, আরেক মাথা নিজের গলায় ফাঁস গিট্ট বইল্যা একটা গিটু আছে। তারপর চউখ বন্ধ কইরা দিবা লাফ।
দড়ি যদি বেশি লম্বা হয় তাহলে তাে লাফ দিলে মাটিতে এসে পড়বেন।
মাপমতাে দড়ি নিবা। তােমার পা যদি মাটি থাইক্যা এক ইঞ্চি উপরেও থাকে তাইলে হবে। দড়ি লম্বা হইলে নানান দিক দিয়া লাভ। দশের উপকার।
দড়ি লম্বা হলে দশের উপকার কেন তাও নারিকেল-মামা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন।
ফাঁসের দড়ি নানা কাজে লাগে বুঝলা, ভাইগ্না ব্যাটা? এই দড়ি সােনার দড়ির চেয়েও দামি। একটুকরা কাইট্যা যদি কোমরে বাইন্ধ্যা থয় তা হইলে বাত-ব্যাধির আরাম হয়। ঘরের দরজার সামনে একটুকরা বাইন্ধ্যা থুইলে ঘরে চোর-ডাকাত ঢােকে না। এই দড়ি সন্তান প্রসবের সময় খুব কাজে লাগে। ধরাে, সন্তান প্রসব হইতেছে না—দড়ি আইন্যা পেটে ছুঁয়াইবা, সঙ্গে সঙ্গে সন্তান খালাস।
সত্যি ?
হ্যা। সত্যি। ফঁসের দড়ি মহামূল্যবান। অনেক ছােট ছােট পুলাপান আছে বিছানায় পেসাব কইরা দেয়। ফাঁসের দড়ি একটুকরা ঘুনসির সঙ্গে বাইন্ধ্যা দিলে আর বিছানায় পেসাব করব না। এইজন্যেই বলতেছি যত লম্বা হয় ফাঁসের দড়ি ততই ভালাে। দশজনের উপকার। ফাঁস নিলে পাপ হয়। আবার ফাঁসের দড়ি দশজনের কাজে লাইগ্যা পাপ কাটা যায়। দড়ি যত লম্বা হইব পাপ তত বেশি কাটা যাইব। এইটাই হইল ঘটনা। মৃত্যুর পর পরেই বেহেশতে দাখিল ।।
নারিকেল-মামার মৃত্যু হয় পরিণত বয়সে। ফাঁস নিয়ে না, বিছানায় শুয়ে। শেষ জীবনে পক্ষাঘাত হয়েছিল, নড়তে-চড়তে পারতেন না। চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে হতাে। মৃত্যুর আগে গভীর বিষাদের সঙ্গে বলেছিলেন, আল্লাহপাক আমার কোনাে আশা পূরণ করে নাই । ঘর দেয় নাই, সংসার দেয় নাই। কিছুই দেয় নাই । ফাঁস নিয়া মরণের ইচ্ছা ছিল, এইটাও হইল না। বড়ই আফসােস।
আমার বন্ধু সফিক
ইদানীং পুরােনাে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলে বড় ধরনের ধাক্কা খাই। কী চেহারা একেকজনের—দাঁত পড়ে গেছে, গালের চামড়া গেছে কুঁচকে, মাথায় অল্প কিছু ফিনফিনে চুল। কলপ দিয়ে সেই চুলের বয়স কমানাে হয়েছে, কিন্তু সাদা সাদা গােড়া উঁকি দিচ্ছে। | ওদের দিকে তাকালে মনে হয়—হায় হায়, আমার এত বয়স হয়ে গেছে ? এখন কি তাহলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করব ? মিরপুর গােরস্থানে জমি দেখতে যাব ?
আয়নায় যখন নিজেকে দেখি তখন এতটা বয়স মনে হয় না। হাস্যকর হলেও সত্যি, নিজেকে যুবক-যুবকই লাগে। ওই তাে কী সুন্দর যুবক! চোখের নিচে কালি পড়েছে। এটা এমন কিছু না, রাত জাগি, কালি তাে পড়বেই। কয়েক রাত ঠিকমতাে ঘুমুতে পারলে চোখের কালি দূর হয়ে যাবে। মুখের চামড়ার বলিরেখা ? ও কিছু না। অনেক যুবক ছেলেদের মুখেও এমন দাগ দেখা যায়। মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে ? এটা ব্যাপারই না। চুল পাকা বয়সের লক্ষণ নয়। মানুষের যৌবন শরীরে না, মনে।
আমাদের মতাে বয়সীদের হঠাৎ রঙিন কাপড়ের দিকে ঝোঁক দেখা যায় । চক্রাবক্রা হাওয়াই শার্ট। এরা তেজি তরুণের মতাে হাঁটতে চেষ্টা করে—জরাকে অগ্রাহ্য করার হাস্যকর চেষ্টা।