লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১৬) হুমায়ূন আহমেদ

 চোখে-মুখে এমন একটা ভাব যেন এইমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পড়া চুকিয়ে রাস্তায় নেমেছে। বান্ধবীকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনাে ক্যাফেতে চা খেতে যাবে কিংবা বাদাম ভাঙতে ভাঙতে হাঁটবে।লীলাবতীর মৃত্যুএরকম একদিনের কথা। নাপিতের দোকান থেকে চুল কেটে বের হয়েছি। চুল কাটার ফলে গােড়ার সাদা চুল বের হয়ে এসেছে। বিশ্রী দেখাচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে এক পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি। সিগারেট কিনে বাসায় ফিরব। হঠাৎ দেখি যুবক একটা ছেলে কদবেল কিনছে। সে বসেছে উবু হয়ে। বেল এঁকে এঁকে দেখছে। তার পেছনেই শাড়িপরা এক তরুণী। তরুণী লজ্জা পাচ্ছে বলে মনে হলাে। ছেলেটিকে খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। আবার চিনতেও পারছি না। সে দুটা কদবেল কিনে উঠে দাঁড়াল। আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, আরে তুই! 

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ হচ্ছে আমাদের সফিক। ঢাকা কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তারপর যােগাযােগ নষ্ট হয়ে গেছে। 

সফিক বলল, তুই এত বিশ্রী করে চুল কেটেছিস! তােকে দেখাচ্ছে পকেটমারের মতাে।  আমার হতভম্ব ভাব তখনাে কাটে নি। আমি অবাক হয়ে সফিককে দেখছি । ব্যাটার বয়স বাড়ে নি । জরা তাকে স্পর্শ করে নি। তাকে ইউনিভার্সিটিতে ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র বললে কেউ অবিশ্বাস করবে না । 

সফিক বলল, দোস্ত, এ হচ্ছে আমার বড় মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এর নাম শাপলা। শাপলা মা, চাচাকে পা ছুঁয়ে সালাম কর। 

আমি বললাম, বাজারের মধ্যে কিসের সালাম ? বাজার-টাজার বুঝি না। সালাম করতে হবে। 

মেয়ে একগাদা লােকের মধ্যে নিচু হয়ে সালাম করল। সফিক আমার হাত ধরে বলল, চল আমার সঙ্গে। 

কোথায় ? আমার বাসায়, আবার কোথায় ? আরে না। চুল কেটেছি—গােসল করব। 

কোনাে কথা না। শাপলা মা, তুই শক্ত করে চাচার একটা হাত ধর। আমি আরেক হাত ধরছি। দুজনে মিলে টেনে নিয়ে যাব। 

আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হলাে। ছােট ফ্ল্যাট বাড়ি। বােঝাই যাচ্ছে আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে। বসার ঘরে বারাে ইঞ্চি ব্ল্যাক অ্যান্ড হােয়াইট টিভি। ইদানীং টিভির মাপ থেকে অর্থনৈতিক অবস্থা আঁচ করার একটা সুবিধা হয়েছে। সফিক আমাকে টানতে টানতে একেবারে রান্নাঘরে নিয়ে উপস্থিত—দাঁড়া, বউকে অবাক করে দিই। সে তাের নাটক দেখে গ্যালন গ্যালন পানি ফেলে। চোখের পানির মূল মালিককে ধরে নিয়ে এসেছি। 

রান্নাঘরে আমাকে দেখে সফিকের স্ত্রী অত্যন্ত ব্ৰিত হলাে এবং দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। স্বামীর পাগলামির সঙ্গে বেচারি বােধহয় এত দিনেও মানিয়ে নিতে পারে নি। 

ছিঃ ছিঃ কী অবস্থা রান্নাঘরে! এর মধ্যে আপনাকে নিয়ে এসেছে। ওর কোনােদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না । ও কি ছাত্রজীবনেও এরকম ছিল ? 

আমি জবাব দিতে পারলাম না। ছাত্রজীবনে সফিক কেমন ছিল আমার মনে নেই। ডিম-সেদ্ধ তার খুব পছন্দের খাবার ছিল—এইটুকু মনে আছে। সিদ্ধ ডিমের খােসা ছাড়িয়ে আস্ত মুখে ঢুকিয়ে দিত। এই সময় তার আরামে চোখ বন্ধ হয়ে যেত। 

আমি লক্ষ করলাম, সফিকের বয়স না বাড়লেও তার স্ত্রীর ঠিকই বেড়েছে। দ্রমহিলাকে দেখে মনে হয়, জীবনযুদ্ধে তিনি পরাজিত । ক্লান্তি ও হতাশা তাকে পুরােপুরি গ্রাস করেছে। অসুখবিসুখেও মনে হয় ভুগছেন। যতক্ষণ কথা বললেন, ক্রমাগত কাশতে থাকলেন। কাশতে কাশতে বললেন, আপনি এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। আপনাকে যে যত্ন-টত্ব করব সেই সামর্থ্য নেই। সংসারের অবস্থা ভাঙা নৌকার মতাে। কোনােমতে টেনে নিচ্ছি। ইভিনিং শিফটে একটা স্কুলে কাজ করি । ওই বেতনটাই ভরসা। কাজটা না থাকলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভিক্ষা করতে হতাে। 

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সফিক কিছু করে না? 

করে। ও একটা ব্যাংকের ম্যানেজার। তাতে লাভ কিছু নেই। আপনি আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করুন তাে—পুরাে বেতন কখনাে সে আমার হাতে দিয়েছে কি না। এমনও মাস যায় একটা পয়সা আমাদের দেয় না। আপনিই বলুন, আমি কি বাচ্চাগুলােকে পানি খাইয়ে মানুষ করব ? 

সফিক বলল, চুপ করাে। প্রথম দিনেই কী অভিযােগ শুরু করলে। এইসব বলার সুযােগ আরও পাবে। আজ না বললেও চলবে। ফাইন করে চা বানাও। হুমায়ুন খুব চা খায়। সে আগের জন্মে চা-বাগানের কুলি ছিল। 

সফিকের স্ত্রী কঠিন গলায় বলল, ভাই, চা আপনাকে খাওয়াচ্ছি, কিন্তু আমার কথা আপনাকে শুনতে হবে এবং আপনার বন্ধুকে বুঝিয়ে বলে যেতে হবে—তার নিজের সংসারটাই আসল। আগে সংসার দেখতে হবে…। 

অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ভদ্রমহিলার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। বেড়াতে এসে এ কী পারিবারিক সমস্যার মধ্যে পড়লাম! সফিক প্রায় জোর করে তার স্ত্রীকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিল। আমি বললাম, তাের সমস্যাটা কী ? 

আরেক দিন বলব। আজই শুনে যাই।। 

সফিক খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সমস্যা বলা শুরু করল। সফিকের জবানিতেই তার সমস্যা শুনি। 

বুঝলি দোস্ত, তখন সবে চাকরি পেয়েছি। বিয়ে-টিয়ে করি নি। নিউ পল্টন লাইনে এক কামরার একটা বাসা নিয়ে থাকি। দেশে টাকা পাঠাতে হয় না। বেতন যা পাই নিজেই খরচ করি। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হইচই। এখানে ওখানে বেড়ানাে খানিকটা বদঅভ্যাসও হয়ে গেল মাঝে মধ্যে মদ্যপান করা। বন্ধুবান্ধব এসে ধরে একটা হুইস্কির বােতল কিনে আন। বেতন পেয়েছিস, সেলিব্রেট কর । কিনে ফেলি। অভ্যাসটা স্থায়ী হলাে না, কারণ আমার বডি সিস্টেম অ্যালকোহল সহ্য করে না। সামান্য খেলেও সারা রাত জেগে থাকতে হয় এবং অবধারিতভাবে শেষরাতে হড়হড় করে বমি হয়। 

এক রাতের কথা—সামান্য মদ্যপান করে বাসায় ফিরছি। সামান্যতেই নেশা হয়ে গেছে। একটা রিকশা নিয়েছি। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে রিকশা থেকে পড়ে যাব। অনেক কষ্টে হুড ধরে বসে আছি, এমন সময় এক লােক তার ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা চাইতে এল। তার ছেলের চিকিৎসার জন্যে খরচ। আমি ছেলেটিকে দেখে চমকে উঠলাম। সাত-আট বছর বয়স। ফুটফুটে চেহারা। সম্পূর্ণ নগ্ন । নগ্ন থাকার কারণ হলাে—তার অসুখের ডিসপ্লে নগ্ন না হলে সম্ভব নয়। ছেলেটির অণ্ডকোষ ফুটবলের মতাে প্রকাণ্ড। তাকালেই ঘেন্না হয়। আমি দ্রুত একটা এক শ’ টাকার নােট বের করে দিলাম। ছেলের বাবা আনন্দের হাসি হাসল। এই হাসি দেখেই মনে হলাে—এই লােক তাে ছেলের চিকিৎসা করাবে না। ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করাই তার পেশা। ছেলে সুস্থ হলে বরং তার সমস্যা। 

আমি বললাম, রােজ ভিক্ষা করে কত পাওয়া যায় ? সে গা-ছাড়া ভাব করে বলল, ঠিক নাই। কোনােদিন বেশি, কোনােদিন কম। আজ কত পেয়েছ? আমারটা বাদ দিয়ে কত ? আছে কিছু। কিছু-টিছু না। কত পেয়েছ বলাে ? 

লােকটি বলতে চায় না। কেটে পড়তে চায়। আমি তখন নেশাগ্রস্ত । মাথার ঠিক নেই। আমি হুংকার দিলাম, যাচ্ছ কোথায় ? এক পা গেছ কি খুন করে 

ফেলব। বলাে আজ কত পেয়েছ ? 

ধরেন দুই শ’। 

তুমি কি এই ছেলেকে চিকিৎসার জন্যে কোনাে দিন হাসপাতালে নিয়ে গেছ ? বলাে ঠিক করে, মিথ্যা বললে খুন করে ফেলব। 

সে পুরােপুরি হকচকিয়ে গেল। আমি বললাম, এখনই চলাে আমার সঙ্গে হাসপাতালে। মেডিকেল কলেজে আমার এক বন্ধু আছে, ডাক্তার। তাকে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। বাচ্চা কোলে নিয়ে রিকশায় উঠে আসাে । 

 সে কিছুতেই আমার সঙ্গে যাবে না। আমি নিয়ে যাবই। মাতালদের মাথায় একটা কিছু ঢুকে পড়লে সহজে বের হতে চায় না। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিকিৎসা করাবই। এর মধ্যে আমার চারদিকে লােক জমে গেছে। সবাই আমাকে সমর্থন করছে। লােকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। সে মিনমিন করে বলল, ডাক্তার অপারেশন করব। অপারেশন করলে আমার পুলা মারা যাইব। 

আমি আবারও হুংকার দিলাম, ব্যাটা ফাজিল! ছেলের অসুখের চিকিৎসা করাবে না। অসুখ দিয়ে ফায়দা লুটবে! চলাে হাসপাতালে। 

অসাধ্য সাধন করলাম। দুপুররাতে এদের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বন্ধুকে খুঁজে বের করলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, এই দুপুররাতে রােগী ভর্তি করব কীভাবে ? তাের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল ? এই যন্ত্রণা কোথেকে জুটিয়েছিস ? 

আমি বললাম, কিছু শুনতে চাই না। তুই এর ব্যবস্থা করবি। খরচ যা লাগে আমি দিব । 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *