লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

 এই ছােটাছুটির মধ্যেই মায়েরা গর্ভবতী হন। সন্তান প্রসব করেন। অপ্রয়ােজনীয় কন্যাসন্তানদের গর্ত করে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়। 

লীলাবতীর মৃত্যুপবিত্র কোরানশরিফে সূরা তাকবীরে জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যা-বিষয়ে আয়াত নাজেল হলাে। কেয়ামতের বর্ণনা দিতে দিতে পরম করুণাময় বললেন— 

সূর্য যখন তার প্রভা হারাবে, যখন নক্ষত্র খসে পড়বে, পর্বতমালা অপসারিত হবে। যখন পূর্ণগর্ভা উষ্ট্রী উপেক্ষিত হবে, যখন বন্যপশুরা একত্রিত হবে, যখন সমুদ্র স্ফীত হবে, দেহে যখন আত্মা পুনঃসংযােজিত হবে, তখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাস করা হবে—কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল ? যে মহামানব করুণাময়ের এই বাণী আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি এক অকৃতী তার জীবনী আপনাদের জন্যে লেখার বাসনা করেছি। সব মানুষের পিতৃঋণ-মাতৃঋণ থাকে। নবিজীর কাছেও আমাদের ঋণ আছে। সেই বিপুল ঋণ শােধের অতি অক্ষম চেষ্টা। 

ভুলভ্রান্তি যদি কিছু করে ফেলি তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি পরম করুণাময়ের কাছে। তিনি তাে ক্ষমা করার জন্যেই আছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করছি নবিজীর কাছেও। তার কাছেও আছে ক্ষমার অথৈ সাগর। 

লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

“তােরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে। বিখ্যাত এই গানের কলি শুনলেই অতি আনন্দময় একটি ছবি ভেসে ওঠে। মা মুগ্ধ চোখে নবজাত শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর কোলে পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চন্দ্র। তার চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। 

ঘটনা কি সে রকম? 

সে রকম হওয়ার কথা না। শিশুটির বাবা নেই। বাবা আবদুল্লাহ তাঁর সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারেন নি। মা আমিনার হৃদয় সেই দুঃখেই কাতর হয়ে থাকার কথা। আরবের শুষ্ক কঠিন ভূমিতে পিতৃহীন একটি ছেলের বড় হয়ে ওঠার কঠিন সময়ের কথা মনে করে তাঁর শঙ্কিত থাকার কথা। 

শিশুর জন্মলগ্নে মা আমিনার দুঃখ-কষ্ট যে মানুষটি হঠাৎ দূর করে দিলেন, তিনি ছেলের দাদাজান। আবদুল মােতালেব। তিনি ছেলেকে দু’হাতে তুলে নিলেন। ছুটে গেলেন কাবা শরিফের দিকে। কা’বার সামনে শিশুটিকে দু’হাতে ওপরে তুলে উচ্চকণ্ঠে বললেন, আমি এই নবজাত শিশুর নাম রাখলাম, মােহাম্মদ! 

সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। নতুন ধরনের নাম। আরবে এই নাম রাখা হয় না। একজন বলল, এই নাম কেন ? উত্তরে মােতালেব বললেন, মােহাম্মদ শব্দের অর্থ প্রশংসিত। আমি মনের যে বাসনায় নাম রেখেছি তা হলাে—একদিন এই শিশু স্বর্গে ও পৃথিবীতে দুই জায়গাতেই প্রশংসিত হবে। 

লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

শিশুর জন্ম উপলক্ষে (জন্মের সপ্তম দিনে) দাদা মােতালেব বিশাল ভােজের আয়ােজন করলেন। শিশুর চাচারাও আনন্দিত। এক চাচা আবু লাহাব তাে আনন্দের আতিশয্যে একজন ক্রীতদাসীকে আজাদ করে দিলেন। ক্রীতদাসীর নাম সুয়াইবা । সে-ই প্রথম আবু লাহাবের কাছে শিশু মােহাম্মদের জন্মের খবর পৌছে দিয়েছিল। এই সুয়াইবাই এক সপ্তাহ মােহাম্মদকে তার বুকের দুধ পান করিয়েছিলেন। নবিজী তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যা রুকাইয়া ও কুলসুমকে বিয়ে দিয়েছিলেন আবু লাহাবের দুই পুত্রের সঙ্গে। একজনের নাম উবা, অন্যজনের নাম উতাইবা। দুই বােনকে একসঙ্গে না। রুকাইয়াকে প্রথমে। রুকাইয়ার মৃত্যুর পর কুলসুমকে। যদিও পরবর্তী সময়ে আবু লাহাবের নামে পবিত্র কোরানে আয়াত নাজেল হলাে— 

ধ্বংস হােক সে। তার ধনসম্পদ ও উপার্জন তার কোনাে কাজে আসবে না। সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে। তার স্ত্রীও যে ইন্দন বহন করে। তার গলদেশ খেজুর গাছের আঁশের দৃঢ় রঙ্কু নিয়ে। (সূরা লাহাব) শিশু মােহাম্মদের জন্ম তারিখটা কী ? 

যাকেই জিজ্ঞেস করা হােক সে বলবে—৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ। বারােই রবিউল আউয়াল । দিনটা ছিল সােমবার। সারা পৃথিবী জুড়ে এই দিনটিই জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়। ঈদে মিলাদুন্নবীতে বাংলাদেশে সরকারি ছুটি পালন করা হয়। 

লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

নবিজীর জনের সঠিক তারিখ নিয়ে কিন্তু ভালাে জটিলতা আছে। ইতিহাসবিদরা মােটামুটি সবাই একমত যে, তাঁর জন্ম হয়েছে হস্তিবর্ষে (Year of the Elephant, 570)। নবিজীর আদি জীবনীকারদের একজন ইবনে আব্বাস বলছেন, তার জন্ম হস্তি দিবসে (Day of the Elephant)। একদল ইতিহাসবিদ বলছেন, মােটেই এরকম না। নবিজী জন্মেছেন এর পনেরাে বছর আগে। আবার একদল বলেন, নবিজীর জন্ম হস্তি বছরের অনেক পরে, প্রায় সতুর বছর পরে। 

জন্ম মাস নিয়েও সমস্যা। বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ বলছেন চন্দ্রবত্সরের তৃতীয় মাসে তার জন্ম। তারপরেও একদল বলছেন, তার জন্ম মােহররম মাসে। আরেকদল বলছেন, মােটেই না। তাঁর জন্ম সাফার মাসে। 

জন্ম তারিখ নিয়েও সমস্যা। একদল বলছেন রবিউল আউয়ালের ৩ তারিখ, একদল বলছেন ৯ তারিখ, আবার আরেক দল ১২ তারিখ। 

এখন বেশির ভাগ মানুষই নবিজীর আদি জীবনীকারের বক্তব্যকে সমর্থন করছেন। বারােই রবিউল আউয়াল সােমবার জন্ম তারিখ ধরা হচ্ছে। তারপরও কথা থেকে যাচ্ছে—বারােই রবিউল আউয়াল কিন্তু সােমবার না। এই হিসাব আধুনিক পঞ্জিকার ।। 

বিতর্ক বিতর্কের মতাে থাকুক। একজন মহাপুরুষ জন্মেছেন, যার পেছনে একদিন পৃথিবীর বিরাট এক জনগােষ্ঠি দাঁড়াবে—এটাই মূল কথা। 

লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

তখনকার আরবে অভিজাত মহিলারা নিজের শিশু পালন করতেন না। শিশুর জন্যে দুধমা ঠিক করা হতাে। দুধমা’রা আসতেন মক্কার বাইরের বেদুইনের ভেতর থেকে। 

দুধমা’র প্রচলনের পেছনে প্রধান যুক্তি, আভিজাত্য রক্ষা। দ্বিতীয় যুক্তি, শিশুরা বড় হতাে মরুভূমির খােলা প্রান্তরে হেসে-খেলে। এতে তাদের স্বাস্থ্য ভালাে থাকত। অর্থনৈতিক বিষয়ও মনে হয় ছিল। সম্পদের বণ্টন হতাে। হতদরিদ্র কিছু বেদুইন পরিবার উপকৃত হতাে শহরের ধনীশ্রেণীর কাছ থেকে। অতি ভাগ্যবানদের কেউ কেউ মরুভূমির সবচেয়ে দামি উপহার এক-দুইটা উট পেয়ে যেত। 

নবিজীর জন্যে দুধমা খোঁজা হতে লাগল। মা আমিনার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন শশাচনীয়। সম্পদের মধ্যে আছে মাত্র পাঁচটা উট এবং একজন মাত্র ক্রীতদাসী। ক্রীতদাসীর নাম বাহিরা। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু পরিবারের এতিম ছেলের জন্যে কে আসবে দুধমা হিসেবে! 

নবিজীর প্রথম দুধমা’র নাম আইমান। তিনি আবিসিনিয়ার এক খ্রিষ্টান তরুণী । অনেক পরে এই মহিলার বিয়ে হয় যায়েদ বিন হারিসের সঙ্গে। যায়েদ বিন হারিস নবিজীর পালকপুত্র। 

আইমানের পরে আসেন থুআইবা । তৃতীয়জন হালিমা। যিনি বানু সাদ গােত্রের রমণী। নবিজীর দুধমা হিসেবে আমরা হালিমাকেই জানি। আগের দু’জনের বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। 

লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

হালিমার অবস্থাটা দেখি। বানু সাদ গােত্রের সবচেয়ে দরিদ্র মহিলা । ঘরে তার নিজের খাওয়ার ব্যবস্থাই নেই। বুকে দুধ নেই যে নিজের শিশুটিকে দুধ খাওয়াবেন। মক্কায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তিনি দত্তক নেওয়ার মতাে কোনাে শিশু পেলেন না। কে এমন দরিদ্র মহিলার কাছে আদরের সন্তান তুলে দেবে! প্রায় 

অপারগ হয়েই তিনি শিশু মােহাম্মদকে নিলেন। 

পরের ঘটনা নবিজীর জীবনীকার ইবনে ইসহাকের ভাষ্যে শুনিযেই মুহূর্তে আমি এই শিশুটিকে বুকে ধরলাম, আমার স্তন হঠাৎ করেই দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। সে তৃপ্তি নিয়ে দুধ পান করল। তার দুধভাইও তা-ই করল। দুজনই শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার স্বামী উঠে গেল মেয়ে উটটাকে দেখতে। কী আশ্চর্য, তার শুকনাে ওলানও দুধে পূর্ণ। আমার স্বামী দুধ দুয়ে আনল। আমরা দুজন প্রাণভরে সেই দুধ খেয়ে পরম শান্তিতে রাত্রে ঘুমালাম। পরদিন সকালে আমার স্বামী বলল, হালিমা, তুমি কি বুঝতে পারছ তুমি এক পবিত্র শিশুকে (Blessed one) ঘরে এনেছ ? 

 শিশু মােহাম্মদের দুধভাইয়ের নাম আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহর তিন বােন— শায়মা, আতিয়া ও হুযাফা। বােন শায়মা সবার বড়। শিশু মােহাম্মদকে তার বড়ই পছন্দ। সারা দিনই সে চন্দ্ৰশিশু কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে-ওখানে চলে যায়। একদিন বিবি হালিমা মেয়ের ওপর খুব বিরক্ত হলেন। মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন, দুধের শিশু কোলে নিয়ে তুমি প্রচণ্ড রােদে রােদে ঘুরে বেড়াও। এটা কেমন কথা! বাচ্চাটার কষ্ট হয় না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *