শায়মা তখন একটা অদ্ভুত কথা বলল। সে বলল, মা, আমার এই ভাইটার রােদে মােটেও কষ্ট হয় না। যখনই আমি তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হই, তখনই দেখি আমাদের মাথার ওপর মেঘ। মেঘ সূর্যকে ঢেকে রাখে।
নবিজীকে মেঘের ছায়া দানের বিষয়টি জীবনীকার অনেকবার এনেছেন। তার চাচা আবু তালেবের সঙ্গে প্রথম সিরিয়ায় বাণিজ্য-যাত্রাতেও মেঘ তাঁর মাথায় ছায়া দিয়ে রেখেছিল।
একটি পুকুরের মধ্যস্থলে একটি জলপদ্ম ফুটিয়াছে। জলপদ্মটি পানির পৃষ্ঠদেশ হইতে এক ফুট উপরে। এমন সময় দমকা বাতাস আসিল, ফুলটি তিন ফুট দূরে সরিয়া জল স্পর্শ করিল। পুকুরের গভীরতা নির্ণয় করাে।
এ ধরনের প্রচুর অঙ্ক আমি আমার শৈশবে পাটিগণিতের বইয়ে দেখেছি। অঙ্কের শেষে লীলাবতী’ নাম লেখা। ব্যাপারটা কী? লীলাবতী মেয়েটা কে? তার সঙ্গে জটিল এইসব অঙ্কের সম্পর্ক কী? যা জানলাম তা হচ্ছে—সপ্তম শতকের বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ শংকরাচার্যের একমাত্র কন্যার নাম লীলাবতী। মেয়েটির কপালে বৈধব্যযােগ আছে, এই অজুহাতে কন্যা-সম্প্রদানের আগে আগে বরপক্ষ মেয়েটির বিয়ে ভেঙে দেয়। লীলাবতী যখন গভীর দুঃখে কাঁদছিল তখন শংকরাচার্য বললেন, মাগাে, তােমার জন্যে কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই, তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহু যুগ তােমাকে মনে রাখে আমি সেই ব্যবস্থা করে যাব।’ তিনি গণিতের একটা বই লেখেন। বইটির নাম দেন কন্যার নামে—লীলাবতী’।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
গল্পটি আমাকে এতই অভিভূত করে যে, একরাতে লীলাবতীকে আমি স্বপ্নেও দেখি। গােলগাল মুখ। দীর্ঘ পল্লবের বড় বড় চোখ। দৃষ্টিতে অভিমান। মাথাভর্তি লম্বা কোকড়ানাে চুল। গায়ের বর্ণ শঙ্খের মতাে সাদা।
খুব ইচ্ছা হলাে স্বপ্নের মেয়েটিকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার। শংকরাচার্যের গণিতের বইয়ের নামের মতাে উপন্যাসের নামও হবে লীলাবতী।
উপন্যাস শেষ পর্যন্ত লিখেছি। উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কোনাে লেখা ছাপা হয়ে বের হওয়ার পর লেখার বিষয়ে আমার কোনাে উৎসাহ থাকে না। বইয়ের কাহিনি, পাত্র-পাত্রীদের নাম এবং অনেক সময় বইয়ের নাম পর্যন্ত ভুলে যাই। লীলাবতী’র ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘটনা ঘটল, নামটা ভুললাম না। প্রায়ই মনে হতাে আমার তিনটা পরীর মতাে মেয়ে, তাদের কারাের জন্যে এই সুন্দর নামটা মাথায় এল না কেন ?
আমি আমার তিন কন্যার নাম হেলাফেলা করে রেখেছি। ভেবেচিন্তে রাখা হয় নি। বড় মেয়েটির নাম নােভা। কার্ল সেগান আমেরিকার টিভিতে কসমস নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেখানে নােভা, সুপারনােভা নিয়ে নানান কথা থাকত। নােভা নামটি এসেছে সেখান থেকে। শীলা নামটি নিয়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প শৈলজ শীলা’ থেকে। সবচেয়ে ছােট মেয়ে বিপাশার নাম তারাশংকরের বিপাশা’ নামের উপন্যাস থেকে নেওয়া।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
অন্য লেখকদের গল্প-উপন্যাস থেকে নাম নিয়েছি, অথচ নিজের কোনাে উপন্যাস থেকে নাম নিলাম না, এটা কেমন কথা ?
এই ভেবে সান্তনা পেলাম যে, লীলাবতী নাম রাখার সুযােগ নষ্ট হয়ে যায় নি। আমার মেয়েদের বিয়ে হবে। ছেলেমেয়ে হবে। তারা নিশ্চয়ই লেখক বাবার কাছে পুত্র-কন্যাদের নামের জন্যে আসবে, তখন একজনের নাম দিয়ে দেব লীলাবতী। ঘটনা সেভাবে ঘটল না। হঠাৎ করেই আমি আমার ছেলেমেয়ের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়লাম। কারণ আমি গায়িকা এবং অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করে ফেলেছি।
কী প্রচণ্ড ঝড়ই না উঠল! পত্রপত্রিকায় কত না কুৎসিত লেখা। যার যা ইচ্ছা লিখছে। যেমন ইচ্ছা গল্প ফাঁদছে। আমার মা-ভাইবােনেরা আমাকে ত্যাগ করল । আত্মীয়স্বজনেরা ত্যাগ করল। একই ঘটনা ঘটল শাওনের ক্ষেত্রেও। সেও বাড়ি থেকে বিতাড়িত। শাওনের বিবাহিত জীবন শুরু হলাে চোখের জলে । এই বয়সের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে। হইচই, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শাড়ি-গয়না, পার্লারের সাজ। তার কপালে কিছুই নেই। সে একা একাই পার্লারে সাজতে গেল। একা একাই নিউ মার্কেটে ঘুরতে লাগল, বিয়ে উপলক্ষে একজোড়া স্যান্ডেল কিনবে।
আমার ভাইবােনেরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সমাজে প্রতিষ্ঠিতরা সমাজপতির ভূমিকায় অভিনয় করতে পছন্দ করেন। তারা সবাই সমাজপতি। শাওনকে বিয়ে করার আগে আমি দীর্ঘ চার বছর একা একা কাটিয়েছি। উত্তরায় একটি বাড়ি ভাড়া করে এক বছর থেকেছি, পরে উঠে এসেছি দখিন হাওয়ায়। আমার একা থাকার ব্যবস্থাও সমাজপতিরা মিটিং করে করেছেন। হুমায়ূন দুষ্ট মানুষ। সে পরিবারে থাকবে না। আলাদা থেকে সংশােধিত হবে। যখন হবে তখন ফিরতে পারবে সংসারে।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
আলাদা বাস করছি। উত্তরার একটা বিশাল বাড়িতে একা থাকি। রাতে সব ক’টা বাতি জ্বালিয়ে রাখি। চেষ্টা করি রাতে না ঘুমাতে, কারণ ঘুমের মধ্যে আমাকে ‘বােবায়’ ধরে। এটা একধরনের রােগ। রােগের লক্ষণ—ঘুমের মধ্যে
মনে হবে কেউ বুকের ওপর বসে গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। ভয়ঙ্কর কষ্টের ব্যাপার ।
মানসিক এই অবস্থায় খবর পেলাম আমার ভাইবােনেরা মা’কে সঙ্গে নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমার অনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করা হবে। মূল পরিবারের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক নেই তা বলা হবে। এবং সাংবাদিকদের বলা হবে, আমার কোনাে বিষয় নিয়ে যেন তাদেরকে এবং আমার ছেলেমেয়ে ও তাদের মা’কে বিরক্ত বা বিব্রত না করা হয়।
খবরটা শুনে মনে কষ্ট পেলাম। ছুটে গেলাম মা’র কাছে । জানতে চাইলাম, এটা কি সত্যি ? তিনি স্বীকার করলেন, সত্যি।
আপনি নিজে কি থাকবেন সংবাদ সম্মেলনে ? তিনি বললেন, হ্যা, থাকব।
আমি হতভম্ব হয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছি ।
সেদিন মাকে আমি কী কথা বলেছিলাম আজ আর তা মনে নেই। শুধু মনে আছে, মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলাম। মা শেষ পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনটি তাঁর ছেলে মেয়েদের করতে দেন নি। হয়তাে পুত্রস্নেহের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
আমাদের বিয়ের তিন মাসের মাথায় শাওনের মা তাঁর কন্যাকে হয়তােবা ক্ষমা করলেন। তিনিও কন্যাস্নেহের কাছে পরাজিত হলেন । শাওন তার অতি আদরের ধন। তাঁর কাছে সমস্ত পৃথিবী একদিকে আর শাওন আরেক দিকে। এই অন্ধ ভালােবাসার কারণ আমি জানি। তবে এই লেখায় সেই কারণ ব্যাখ্যার সুযােগ নেই। কন্যাকে ক্ষমা করার লক্ষণ হিসেবে তিনি তাঁর পুত্রবধূর হাতে শাওনের জন্যে একসেট গয়না পাঠালেন। শাওন তার বিয়ের একমাত্র উপহার পেয়ে কেঁদেকেটে অস্থির। রাতে সে মায়ের দেওয়া প্রতিটি গয়না পরে বসে থাকল এবং কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলল। শাওনের বাবা কঠিন অবস্থানে গেলেন। তিনি বললেন, শাওন বিয়ে করে ফেলেছে ভালাে কথা, তার যেন সন্তান
হয়। তাকে আমি অবশ্যই আবার বিয়ে দেব। ছেলেমেয়ে হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।
হায়রে কপাল! শাওন কনসিভ করে ফেলল। তার কী যে আনন্দ! সন্তানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে সারা রাত পাগলের মতাে আচরণ করল । এই কাঁদছে এই হাসছে। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছি। একসময় সে আমাকে বলল, এই, আমার ছেলে হবে না মেয়ে? আমি বললাম, তােমার মেয়ে হবে। মেয়ের নাম-লীলাবতী।
দিন কাটে, আমি অবাক হয়ে শাওনকে দেখি। সন্তান নিয়ে তার এত আনন্দ। এত অস্থিরতা! এত উত্তেজনা! প্রায় রাতেই কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি, সে ফুপিয়ে কাঁদছে । আমি অবাক হয়ে জানতে চাই, কাঁদছ কেন ? সে বলে, আনন্দে কাঁদছি। একটি শিশু আমাকে মা ডাকবে, এই আনন্দ।