মার আগের চারটি সন্তান আছে। তাদের মা’র মধ্যে মা হওয়ার আনন্দের এত তীব্রতা দেখি নি। কিংবা হয়তাে ছিল, আমি লক্ষ করি নি। অভাব-অনটনে আমি তখন পর্যদস্ত। গর্ভবতী মাকে ভালাে খাবার খাওয়াতে হয়, ফলমূল খাওয়াতে হয়। আমার সেই সামর্থ্য নেই।
আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির লেকচারার। অতি সামান্য বেতন। সব ভাইবােন নিয়ে একসঙ্গে থাকি। বাবর রােডে বাসা। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরি হেঁটে। রিকশায় করে যাওয়ার সামর্থ্য নেই । বাসে ঠেলাঠেলি করে উঠতে পারি না। বাসায় ফেরার পথে নিউমার্কেট থেকে দুটা পেয়ারা কিনি। গর্ভবতী মায়ের ফল এই পেয়ারাতে সীমাবদ্ধ।
শীলার জন্ম আমেরিকায় হয়েছে। তখন তার মার খাওয়া-খাদ্যের অভাব হয় নি। দেশে ফিরে আবার অভাবে পড়লাম। বিপাশা তখন মায়ের পেটে। তখনাে একান্নবর্তী সংসার। বিপাশা’র জন্ম হলাে সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম বলেই এই ব্যবস্থা। আমি অস্থির জীবনযাপনের চিন্তায়।
এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জীবন ধারণের অস্থিরতায় এখন আমি অস্থির না। দীর্ঘপথ হাঁটতে হয় না। ফলমূল কেনার টাকা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন আমার হাতে সময় আছে সন্তানসম্ভবা একটি মায়ের মানসিকতার পরিবর্তন আগ্রহ নিয়ে দেখার। আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি। বড় মায়া লাগে।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
একজন নর্তকী যখন মাথায় জলের ঘড়া নিয়ে নাচে তখন সে নাচের ভঙ্গিমায় হাত-পা নাড়লেও তার চেতনা থাকে জলের ঘড়ায় কেন্দ্রীভূত, যেন মাথার ঘড়াটা ঠিক থাকে। শাওন এরকম হয়ে গেল। তার ভুবন হলাে লীলাবতীময়। সেখানে
অন্য কারও স্থান নেই।
লীলাবতীর জন্ম হবে গরমে। তখন সে মােটা কাপড় পরতে পারবে না। কাজেই ইংল্যান্ড কানাডায় টেলিফোন করে করে সে পাতলা সুতির কাপড়ের ব্যবস্থা করল।
কার কাছে যেন শুনল ডায়াপার পরালে বাচ্চাদের র্যাশ হয়। কাজেই সে কথা বানাতে বসল। সারা রাত জেগে নিজে কাঁথা বানায়। সেইসব কাথাও সহজ কথা না। জসীমউদ্দীনের নকশি কাঁথা। পাখি ফুল লতাপাতার বিপুল সমারােহ।
এর মধ্যে 4D আন্ট্রাসনােগ্রাফি বলে এক যন্ত্র বাজারে চলে এসেছে। এই যন্ত্রে পেটের সন্তানের চেহারা স্পষ্ট দেখা যায়। সেই যন্ত্রে বাচ্চারা চেহারা দেখার পর তার একটাই কথা—আমার মেয়ে এত সুন্দর কেন ? আহ্লাদী মায়ের এই প্রশ্নের আমি কী জবাব দেব ?
ঘর ভর্তি হয়ে গেল 4D আলট্রাসনােগ্রাফিতে পাওয়া লীলাবতীর ছবিতে। শাওন অষ্টম মাসে পড়ল। আর মাত্র এক মাস। তার পরেই সে তার কন্যা কোলে নেবে।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
আমি নুহাশপল্লীতে। নাটকের শুটিং করছি। শাওন তার মা’র কাছে গুলশানে। হঠাৎ শাওন টেলিফোন করল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাচ্চা নাড়াচাড়া করছে না। আমার খুব ভয় লাগছে।
আমি বললাম, এক্ষুনি ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করাে।
যােগাযােগ করতে পারছি না। উনি টেলিফোন ধরছেন না। রাত দশটায় তিনি শুয়ে পড়েন। টেলিফোন রিসিভ করেন না। তুমি চিন্তা করবে না। আমার
এক ভাই আছেন ডাক্তার। উনাকে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি চলে আসছেন।
Murphys Law বলে একটি Law আছে। এই Law বলে, If anything can go wrong, it will go wrong. ঘটনা সেরকম ঘটল। শাওনের ডাক্তার ভাই এলেন না। আমি যতবারই টেলিফোন করি ততবারই শুনি—এই উনি আসছেন। তারপর শুনলাম, শাওনদের বাসায় গাড়ি আছে কিন্তু ড্রাইভার নেই।
গাজীপুর থেকে আমি ঢাকার দিকে রওনা হলাম। গাড়ি চলছে ঝড়ের মতাে। মাজহার গাড়ি চালাচ্ছে। একইসঙ্গে টেলিফোনে শাওনের ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করছে।
শাওনের ডাক্তারের নাম…। আচ্ছা নাম না-ই বললাম । জনসেবার মােড়কে তিনি যে ব্যবসা করছেন আমার লেখায় সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হােক তা চাই না। ব্যবসা একটা মহৎ পেশা, স্বয়ং নবিজী (দঃ) বলে গেছেন।
এই ডাক্তার একজন নামি ডাক্তার । রােগী দেখে কূল পান না। তখনাে আমি জানি না এই ডাক্তারের নামে কয়েকটি মামলা আছে। তার অবহেলায় রােগীর মৃত্যু হয়েছে। রােগীর আত্মীয়স্বজনেরা মামলা করেছেন।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
এই মহান চিকিৎসকের ক্লিনিক একসময় টেলিফোন ধরল। এবং জানাল—রােগীকে ক্লিনিকে নিয়ে আসুন।
আমি বললাম, ক্লিনিকে রােগী পাঠাতে পারি, তবে ডাক্তার সাহেব কি এসে তাকে দেখবেন ?
উনি ভােরে আসবেন।
আমি অনুনয় করে বললাম, উনি কি আমার সঙ্গে পাঁচটা মিনিট কথা বলবেন ? আমি বাংলাদেশের লেখক হুমায়ূন আহমেদ। উনি আমাকে চেনেন।
ক্লিনিক থেকে বলা হলাে, উনি কথা বলবেন না।আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ডাক্তারি পেশা এই ডাক্তার নিজের ইচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। আমরা তাঁকে হাতেপায়ে ধরে ডাক্তারি পড়াতে রাজি করাই নি; বরং হতদরিদ্র একটি দেশ তার পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তাঁকে ডাক্তার বানিয়েছে। এই পেশার দায়দায়িত্ব অবশ্যই তাঁকে নিতে হবে। একজন কেউ যখন সৈনিকের পেশা বেছে নেয়, তখন যুদ্ধকালে জীবন দেওয়ার জন্যে তাঁকে তৈরি থাকতে হয় ।
একজন ডাক্তারি পেশা বেছে নেবেন অথচ অতি দুঃসময়ে রােগীর কথা শুনবেন না, তার পাশে দাঁড়াবেন না, তা কী করে হয় ? ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগে ব্যর্থ হয়ে আমি শাওনকে বললাম, সে যেন তক্ষুনি অ্যাপােলাে হাসপাতালে চলে যায়। এক মুহূর্তও যেন দেরি না করে।
আমি হাসপাতালে পৌছালাম রাত একটায়। ডাক্তার বললেন, আপনার বাচ্চাটা হাসপাতালে আসার আগেই মারা গেছে। আমরা এই দুঃসংবাদ আপনার স্ত্রীকে দিই নি। আপনি খবরটা দেবেন।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
আমার হাত-পা জমে গেল।
শাওনকে একটা ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে তার মা। আমাকে দেখেই শাওন ভরসা ফিরে পাওয়া গলায় বলল, এই, আমাদের বাচ্চাটার হার্টবিট নাকি কম। তুমি দোয়া করাে। তুমি দোয়া করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ।
আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। এমন একটা ভয়ংকর খবর তাকে কীভাবে দেব ? আমি তার হাত ধরলাম। সে বলল, জীবনের বিনিময়ে জীবন চাওয়া যায়। আমি আমার মায়ের জীবনের বিনিময়ে লীলাবতীর জীবন আল্লাহর কাছে চেয়েছি। আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে চাই নি। আমি আমার বাচ্চাটাকে দেখব না ? আর তােমার জীবনের বিনিময়েও চাইতে পারি নি।
শাওনের মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তােমার সন্তানের জীবনের বিনিময়ে আমি যে-কোনাে সময় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত আছি গাে মা।
এই মেয়েকে আমি কী বলব? কী বুঝাব ?
দু’দিন দু’রাত মৃত বাচ্চা পেটে নিয়ে সে শুয়ে রইল। কী কষ্ট! কী কষ্ট! শারীরিক কষ্টের কাছে মানসিক কষ্ট গৌণ হয়ে দাঁড়াল। আমাকে জানানাে হলাে,
তার জীবন সংশয়। তার কষ্ট আমার পক্ষে দেখা সম্ভব না। আমি তাকে ফেলে বাসায় চলে এলাম। আমার অতি দুঃসময়ে মা এসে পাশে দাড়ালেন, ছুটে গেলেন হাসপাতালে।