এক গভীর রাতে আমাকে জানানাে হলাে, শাওন মৃত সন্তান প্রসব করেছে। হাসপাতালে তার ঘরে ঢুকলাম। হাসিখুশি ভাব দেখিয়ে বললাম, হ্যালাে। সেও ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যালাে।
খুব চেষ্টা করছি কোনাে-একটা রসিকতা করে তাকে হাসিয়ে দিতে। কিছুই মনে পড়ছে না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল নিয়ে একটা রসিকতা করলাম। সে হেসে ফেলল। সে হাসছে, একইসঙ্গে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অদ্ভুত দৃশ্য!
ঘরের এক কোনায় সবুজ টাওয়েলে মুড়ে কী যেন রাখা। অনেকেই সেখানে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন। শাওনের দৃষ্টি ওইদিকে। সে হঠাৎ বলল, ওইখানে আমাদের লীলাবতী। যাও দেখে এসাে।
হাসপাতালের সবুজ টাওয়েলের ভেতর লীলাবতী শুয়ে আছে। মেয়েটি মৃত, আমার মনে রইল না। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। কী সুন্দর! কী সুন্দর! পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে সে রাঙা রাজকন্যাদের মতাে ঘুমিয়ে আছে ।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
আমার প্রথম পুত্রও হাসপাতালে মারা গিয়েছিল। সেও এসেছিল পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে। পরিষ্কার মনে আছে, আমার মা সেই শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবং মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, তােমরা সবাই দেখাে আমার কোলে পদ্মফুল ফুটে আছে।
লীলাবতীর কবরের ব্যবস্থা হলাে বনানী গােরস্থানে। হঠাৎ মনে হলাে বিরাট ভুল হচ্ছে। লীলাবতীর কবর হবে আজিমপুর গােরস্থানে। সেখানে তার বড় ভাই আছে। বােন খেলবে ভাইয়ের হাত ধরে। পিতৃ-মাতৃস্নেহ বঞ্চিত এই দেবশিশু আর নিঃসঙ্গ বােধ করবে না।
আমি প্রায়ই আজিমপুর গােরস্থানে যাই। আমি আমার পুত্র-কন্যার জন্যে দোয়া প্রার্থনা করি না। কেন প্রার্থনা করব ? তারা তাে ভুল করার বা অন্যায় করার কোনাে সুযােগই পায় নি। তাদের প্রার্থনার প্রয়ােজন নেই। আমি কবরস্থানে ঢুকেই বলি—এই, তােমরা কোথায় ? তােমাদের মজা হচ্ছে তাে ? ভাইবােন হাত ধরাধরি করে খুব খেলা হচ্ছে ?
নিতান্তই ব্যক্তিগত কাহিনি লিখে ফেললাম। লেখকদের কাজই তাে ব্যক্তিগত দুঃখবােধ ছড়িয়ে দেওয়া। এই লেখার মাধ্যমেই যারা আমাদের প্রবল দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। শাওনের বাবা ও মাকে ।
কন্যার শােকে পাথর হয়ে যাওয়া জনক-জননীর করুণ ছবি এখনাে চোখে ভাসছে। শাওনের মা হাসপাতালের মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিলেন। আহারে! আহারে!
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
অ্যাপােলাে হাসপাতালের একজন নার্স লীলাবতীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছিল। অপরিচিত সেই নার্স মেয়েটিকেও ধন্যবাদ। তার চোখের জলের মূল্য দেওয়ার সাধ্য আমার নেই, থাকলে দিতাম।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাই। তিনি লিখেছেন,
শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা; বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়াে৷ আমাদের লীলাবতী পৃথিবীর সৌন্দর্য এক পলকের জন্যেও দেখতে পেল —এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি ?
অমরত্ব
আমার বাবার ফুফুর নাম সাফিয়া বিবি। তিনি অমরত্বের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী-পুত্র-কন্যা মরে গেল, নাতি মরে গেল; তিনি আর মরেন
চোখে দেখেন না, নড়তে চড়তে পারেন না। দিন-রাত বিছানায় শুয়ে থাকার কারণে পিঠে বেডসাের’ (শয্যাক্ষত) হয়ে গেল। পচা মাংসের গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। রাতে তার ঘরের চারপাশে শিয়াল ঘুরঘুর করে। পচা মাংসের গন্ধে একদিন তার ঘরের টিনের চালে দু’টা শকুন এসে বসল। টিন বাজিয়ে, ঢিল ছুড়ে শকুন তাড়ানাে হলাে। সেই তাড়ানােও সাময়িক। এরা প্রায়ই আসে। কখনাে একা কখনাে দলেবলে। গ্রামের প্রচলিত বিশ্বাস, তওবা পড়ানাে হলে রােগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। তওবা পড়ানাের জন্যে মুন্সি আনা হলাে।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
সাফিয়া বিবি বললেন, নাগাে! আমি তওবার মধ্যে নাই। তওবা করতে হইলে অজু করা লাগবে। শইল্যে পানিই ছোয়াইতে পারি না, অজু ক্যামনে করব ? সাফিয়া বিবির মনে হয়তাে ভয় ঢুকে গিয়েছিল, তওবা মানেই মৃত্যু। তিনি মৃত্যু চান না, তবে রাত গভীর হলেই আজরাইলকে ডাকাডাকি করেন। এই ডাকাডাকি মধ্যরাতে শুরু হয়, শেষ হয় ফজর ওয়াক্তে। কারণ তখন তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সাফিয়া বিবির আজরাইলকে ডাকার নমুনা
ও আজরাইল! তুই কি অন্ধ হইছস ? তুই আমায় দেখস না! সবের জান কবচ করস, আমারটা করস না কেন? আমি কী দোষ করছি ?
সাফিয়া বিবির বিলাপ চলতেই থাকে। আজরাইল তার বিলাপে সায় দেয় না। তবে এক রাতে দিল। গম্ভীর গলায় বলল, আমারে ডাকস কেন ? কী সমস্যা?
হতভম্ব সাফিয়া বিবি বললেন, আপনি কে ? তুই যারে ডাকস আমি সে। সাফিয়া বিবি বললেন, আসসালামু আলায়কুম। গম্ভীর গলা উত্তর দিল, ওয়ালাইকুম আসসালাম!
(পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারছেন, দুষ্ট কোনাে লােক আজরাইল সেজে সাফিয়া বিবির সঙ্গে মজা করছে। দুষ্টলােকের পরিচয়, তিনি আমার ছােট চাচা এরশাদুর রহমান আহমেদ। প্রাকটিক্যাল জোকের অসামান্য প্রতিভা নিয়ে আসা পৃথিবীর
অতি অকর্মণ্যদের একজন। তিনি নিশিরাতে মুখে চোঙা ফিট করে বুড়ির সঙ্গে কথা বলছেন।]
সাফিয়া বিবি! বলাে কী জন্যে এত ডাকাডাকি ?
এমনি ডাকি। আমি ভালাে আছি। সুখে আছি। আপনি চলে যান। কষ্ট করে এসেছেন, এইজন্যে আসসালাম।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
মরতে চাও না ? কী বলেন? কেন মরব ? অনেক কাইজ কাম বাকি আছে। সাফিয়া বিবি হলেন জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার দুটি লাইন
‘গলিত স্থবির ব্যাং আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। বঙ্গদেশের হতদরিদ্র সাফিয়া বিবি দুই মুহূর্তের জন্য ভিক্ষা মাগছেন। এই ভিক্ষা তাে অতি ক্ষমতাবান নৃপতিরাও মাগেন। বিশ্বজয়ী চেঙ্গিস খা শেষ বয়সে সমরখন্দ এসেছেন—যদি সমরখন্দের আবহাওয়ায় তার শরীর কিছুটা সারে। তিনি চিকিৎসকদের হুকুম দিয়েছেন অমরত্ব পানীয় (Elixir of Life) তৈরির। যে এই পানীয় তৈরি করতে পারবে সে বেঁচে থাকবে, অন্যদের জন্যে মৃত্যুদণ্ড।
চীনের মিং সম্রাট খবর পেলেন, জিন সেং নামের এক গাছের মূলে আছে যৌবন ধরে রাখার গােপন রস। তিনি ফরমান জারি করলেন, মিং সম্রাট ছাড়া এই গাছের মূল কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। শুধু রাজকীয় বাগানে এই গাছের চাষ হবে। অবৈধভাবে কাউকে যদি এই গাছ লাগাতে দেখা যায় বা গাছের মূল সেবন করতে দেখা যায় তার জন্যে চরম শাস্তি । মৃত্যুদণ্ড।
পারস্য সম্রাট দারায়ুস খবর পেলেন, এক গুহার ভেতরে টিপটিপ করে পানির ফোটা পড়ে। সেই পানির ফোটায় আছে অমরত্ব। সঙ্গে সঙ্গে গুহার চারদিকে কঠিন পাহারা বসল। স্বর্ণভাণ্ডে সংগৃহীত হতে থাকল অমৃত। লাভ হলাে না ।
Elixir of Life-এর সন্ধানে এগিয়ে এলেন বিজ্ঞানীরা। তারা এটার সঙ্গে ওটা মেশান। আগুনে গরম করেন। ঝাকাঝাকি করেন। অমরত্ব ওষুধ তৈরি হয় না। সবই পণ্ডশ্রম। তবে এই পণ্ডশ্রম জন্ম দিল ‘আলকেমি’র রসায়নশাস্ত্রের।