বলাই বাহুল্য, শল্যবিদ ডানকান তাঁর গবেষণাপত্রের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা হতাশ হলেন, তবে হাল ছাড়লেন না। তিনি অন্যদের এগিয়ে আসতে বললেন। দশ বছর পর একজন এগিয়ে এলেন।
তার নাম এইচ লাব টুইনিং (H. Lay. Twining)। তিনি একজন পদার্থবিদ, লসএঞ্জেলস পলিটেকনিক হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি নিজ খরচায় একটি বই প্রকাশ করলেন, বইটির নাম The Physical Theory of Soul। এই গ্রন্থে মানুষের আত্মার ওজনের বদলে তিনি ইঁদুরের আত্মার ওজন বের করলেন। দাড়িপাল্লায় জীবন্ত উঁদুর রেখে তাদের সায়ানাইড দিয়ে মৃত্যুর ব্যবস্থা করলেন। তিনি দেখলেন, মৃত্যুর পর ইঁদুরের ওজন কমে যাচ্ছে। পদার্থবিদ টুইনিং তাঁর বইতে বললেন, শুধু মানুষের না, সব প্রাণীর আত্মা আছে এবং আত্মার ওজনও আছে।
টুইনিংয়ের গবেষণায় এক ভেড়াপালক উৎসাহী হলেন। তাঁর নাম লুইস ই. হলান্ডার জুনিয়র। তিনি প্রচুর ভেড়া মারলেন। মৃত্যুর আগের ও পরের ওজন বের করলেন ।
তাঁর গবেষণার ফলাফল বেশ অদ্ভুত। তিনি দেখলেন, মৃত্যুর পরপর প্রতিটি ভেড়ার ওজন বিশ থেকে ত্রিশ গ্রাম বাড়ে। এক সেকেন্ড পর বাড়তি ওজন চলে যায়। কিছু কিছু ভেড়ার ক্ষেত্রে ওজন কমে। মনে হয় এদের আত্মা আছে। অন্য ভেড়াদের নেই।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৭) হুমায়ূন আহমেদ
১৯৯৮ সালে ডােনাল্ড গিলবার্ড কারপেন্টার একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির বিষয়বস্তু আত্মার ওজন কীভাবে মাপা যায় (Physically weighing the soul)। আগ্রহী পাঠক বইটি পড়ে দেখতে পারেন। সাইবারস্পেসে 1stbook.com-এ চাপলেই পাওয়া যাবে। আমি উৎসাহ বােধ করি নি বলে এই বইটি পড়া হয় নি।
এতক্ষণের আলােচনায় আমরা কী শিখলাম ? একটা জিনিসই শিখলাম, বিজ্ঞানে ভুয়া অংশ আছে। একদল মানুষের চেষ্টাই থাকে ধর্মমত প্রচারে ভুয়া বিজ্ঞান হাজির করা।
আমার মতে ধর্ম থাকবে ধর্মের মতাে, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের মতাে। তেল-জলকে ঝাকিয়ে এক করার প্রয়ােজন নেই। এমন একদিন হয়তােবা আসবে যেদিন থিওসফি ও Physics এক হয়ে যাবে। দাড়িপাল্লায় মৃত্যুপথযাত্রী পশু ও মানুষ না
মেপে সেই দিনের প্রতীক্ষায় থাকাই যুক্তিযুক্ত।
পাদটীকা আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, মৃত্যুর পরপর মানুষের ওজন অনেক বেড়ে যায়। আমি মনে করি, এই ধারণা মানসিক। মৃত ব্যক্তির প্রতি এক ধরনের ভীতি আমাদের মধ্যে কাজ করে। এই ভীতির কারণে মৃত ব্যক্তির ওজন বেশি মনে হয়। মিসির আলি সাহেবও হয়তাে আমার সঙ্গে একমত হবেন।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৭) হুমায়ূন আহমেদ
মহেশের মহাযাত্রা
পরশুরামের লেখা একটি ভৌতিক গল্পের নাম মহেশের মহাযাত্রা’। পরশুরাম অতি পণ্ডিত এবং অতি রসিক একজন মানুষ। তার রসবােধের নমুনা দেই—
রেস্টুরেন্টে এক ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে চা খেতে গিয়েছে। ছেলেটির বাবাও হঠাৎ করে সেখানে গেলেন। ছেলেকে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে দেখে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রচুর গালাগালি করে বের হয়ে এলেন। ছেলের বন্ধুরা বলল, তাের বাবা তােকে এত গালমন্দ করল, আর তুই কিছুই বললি না ?
ছেলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবার কথার কী করে জবাব দেই! একে তাে তিনি বাবা, তারপর আবার বয়সেও বড়।।
বাবা ছেলের চেয়ে বয়সে বড়—এই হলাে পরশুরামের রসবােধ। তিনি হাসি তামাশা, ব্যঙ্গ-রসিকতার গল্পের ভিড়ে মহেশের মহাযাত্রা’ নামে অদ্ভুত এক ভূতের গল্পও লিখে ফেললেন। মহেশ নামের এক পাড় নাস্তিকের গল্প, যে মহেশ অংক দিয়ে প্রমাণ করেছে, ঈশ্বর সমান শূন্য।
একদল নাস্তিকের ঈশ্বরকে শূন্য প্রমাণ করার চেষ্টা যেমন আছে, আবার কঠিন আস্তিকদের চেষ্টা আছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার । ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নালে অংকের একজন শিক্ষক ইনফিনিটি সিরিজ দিয়ে প্রমাণ করলেন, ঈশ্বর আছেন। ভুবনখ্যাত অংকবিদ ইউলাম চার্চের সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি ব্ল্যাকবাের্ডে বিদঘুটে এক অংক লিখে বললেন, এই সমীকরণ প্রমাণ করে ঈশ্বর নেই। আপনারা কেউ কি এই সমীকরণ ভুল প্রমাণ করতে পারবেন ? চার্চের পাদরিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন, কারণ অংক-বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই ।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৭) হুমায়ূন আহমেদ
সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম কঠিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলেছেন, ঈশ্বর এবং আত্মা বলে কিছু নেই। স্বর্গ-নরক নেই। সবই মানুষের কল্পনা। মানব মস্তিষ্ক হলাে একটা কম্পিউটার। কারেন্ট চলে গেলে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায় । মৃত্যু হলাে মানব মস্তিষ্ক-নামক কম্পিউটারের কারেন্ট চলে যাওয়া।
স্টিফেন হকিং কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। মস্তিষ্ক ছাড়া তাঁর শরীরের সব কলকজাই অচল। তিনি নিজেই মনে করছেন, তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় মানুষ সাধারণত আস্তিকতার দিকে ঝুঁকে। তিনি পুরােপুরি অ্যাবাউট টার্ন
করে বললেন, ঈশ্বর নেই। কোনাে পবিত্র নির্দেশ ছাড়াই (Devine intervention) বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হতে পারে। শুরুতে এ ধরনের কথা সরাসরি তিনি বলতেন না। তাঁর কথাবার্তা ছিল সন্দেহবাদীদের মতাে—ঈশ্বর থাকতেও পারেন, আবার নাও থাকতে পারেন ।
স্টিফেন হকিংয়ের এক উক্তিতে ঈশ্বর ধ্বংস হয়ে গেছে মনে করার কারণ নেই। আবার অনেক নােবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়ে জোরালাে বক্তব্যে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা হয় না। ঈশ্বর অধরাই থেকে গেছেন ।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৭) হুমায়ূন আহমেদ
আমি সামান্য বিপদে পড়েছি। স্টিফেন হকিংয়ের মন্তব্যে আমার কী বলার আছে, তা অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। এইসব জটিল বিষয়ে আমি নিতান্তই অভাজন। তার পরেও বিচিত্র কারণে কিছু বলার লােভ সামলাতে পারছি না।
বিজ্ঞানীদের একটি শর্ত হকিং সাহেব পালন করেন নি। তারা পুরােপুরি নিশ্চিত
হয়ে কিছু বলেন না । যখন পুরােপুরি নিশ্চিত হতে পারেন না তখন বলেন, তিনি অনুমান করছেন বা তার ধারণা। হকিং সরাসরি বলে বসলেন, ঈশ্বর নেই। তিনি নিজেও কিন্তু পদার্থবিদ্যায় তাঁর থিওরি একাধিকবার প্রত্যাহার করেছেন।
হকিং সাহেবের ধারণা, অমরত্ব বলে কিছু নেই। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন, DNA অণু অমর। আমাদের এবং এ জগতের সৃষ্ট সকল প্রাণী ও বৃক্ষের প্রতি নির্দেশাবলী দেওয়া আছে DNA-তে। আমরা কখন যৌবনে যাব, কখন বুড়াে হব, সব নিয়ন্ত্রণ করছে DNA অণু । এই অণুই সদ্য প্রসব হওয়া গাে-শাবককে জানিয়ে দিচ্ছে, একটি বিশেষ জায়গায় তােমার জন্যে তরল খাবার রাখা আছে। মুখ দিয়ে সেখানে ধাক্কা দেওয়ামাত্র তােমার খাবার বের হয়ে আসবে। আমরা বাস্তবে কী দেখি ? বাছুর মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে ছুটে যাচ্ছে তার মায়ের ওলানের দিকে। তাকে কিছু বলে দিতে হচ্ছে না। তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে রহস্যময় DNA।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৭) হুমায়ূন আহমেদ
এই রহস্যময় DNA কি বলে দিচ্ছে না ?—“হে মানবজাতি, তােমরা ঈশ্বরের অনুসন্ধান করাে।’ এই কারণেই কি মানুষ নিজের জন্যে ঘর বানানাের আগে প্রার্থনার ঘর তৈরি করে ?
হকিং বলছেন, মানব-মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতাে। সুইচ অফ করলেই কম্পিউটার বন্ধ। মৃত্যু মানব কম্পিউটারের সুইচ অফ।।
সুইচ অফ করলেও কিন্তু কম্পিউটারের মেমরি থেকে যায়। আবার পৃথিবীর সব কম্পিউটারের মেমরি কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংরক্ষণ সম্ভব।
মহা মহা শক্তিধর (আল্লাহ্, ঈশ্বর, গড) কারও পক্ষে একইভাবে প্রতিটি মানুষের মেমরি সংরক্ষণও সম্ভব। তখনাে কিন্তু আমরা অমর। সংরক্ষিত মেমরি দিয়ে প্রাণ সৃষ্টিও সেই মহাশক্তিধরের কাছে কোনাে বিষয়ই না।
মানুষ নিজেও মহা মহা শক্তিধর। সেই মানুষ কোনাে কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয়ে গেল? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনাে বিশৃঙ্খলা নেই। তাকে কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হয়েছে। তাকে পদার্থবিদ্যার প্রতিটি সূত্র মেনে চলতে হচ্ছে। এই সূত্রগুলি আপনাআপনি হয়ে গেছে ? এর পেছনে কি কোনাে পবিত্র আদেশ (Devine order) নেই ?
একদল বলছেন, প্রাণের সৃষ্টি ‘Chaos’ থেকে। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে জটিল যৌগ তৈরি হলাে। একসময় জটিল যৌগ আরও জটিল হলাে। সে নিজের মতাে আরও অণু তৈরি করল । সৃষ্টি হলাে প্রাণ। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে একদিকে তৈরি হলাে ধীমান মানুষ; অন্যদিকে তৈরি হলাে গােলাপ, যার সৌন্দর্য ধীমান মানুষ বুঝতে পারছে। ব্যাপারটা খুব বেশি কাকতালীয় নয় কি?