আমি ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডায় প্রায়ই ঈশ্বর-বিষয়ক একটি গল্প বলি। পাঠকদের গল্পটি জানাচ্ছি। ধরা যাক, এক কঠিন নাস্তিক মঙ্গল গ্রহে গিয়েছেন। সেখানকার প্রাণহীন প্রস্তরসংকুল ভূমি দেখে তিনি বলতে পারেন—একে কেউ সৃষ্টি করে নি। অনাদিকাল থেকে এটা ছিল। তার এই বক্তব্যে কেউ তেমন বাধা দিবে।
কিন্তু তিনি যদি মঙ্গল গ্রহে হাঁটতে হাঁটতে একটা ডিজিটাল নাইকন ক্যামেরা পেয়ে যান তা হলে তাকে বলতেই হবে, এই ক্যামেরা আপনাআপনি হয় নি। এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। মনে করা যাক, ক্যামেরা হাতে তিনি আরও কিছুদূর গেলেন, এমন সময় গর্ত থেকে একটা খরগােস বের হয়ে এল। যে খরগােসের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়েও হাজার গুণ জটিল। তখন কি তিনি স্বীকার করবেন যে, এই খরগােসের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে?
মনে হয় স্বীকার করবেন না, কারণ নাস্তিক আস্তিক দুই দলই জেগে ঘুমিয়ে থাকার ভান করেন বলে তাদের ঘুম ভাঙানাে যায় না। বিপদে পড়েন সন্দেহবাদীরা। যত দিন যায় ততই তাদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাড়তেই থাকে।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
পাদটীকা রাতের অন্ধকারে এক অতি ধার্মিক বাড়িঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন। তাঁকে একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? তিনি বললেন, ঈশ্বরের সন্ধানে।
সেই লােক অবাক হয়ে বলল, সে-কী! ঈশ্বর কি হারিয়ে গেছেন যে তার সন্ধানে বের হতে হচ্ছে ?
হাসপাতাল
ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একটি কেবিন।।
কবি শামসুর রাহমান শুয়ে আছেন। তাঁর নাকে অক্সিজেনের নল । গায়ে হাসপাতালের পােশাক নেই। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে শুয়ে আছেন। গেঞ্জি গলা পর্যন্ত ওঠানাে বলে কবির বুক যে হাপরের মতাে ওঠানামা করছে তা দেখা যাচ্ছে। কবি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দষ্টিতে প্রাণের স্পর্শ নেই।
হাসপাতালের ওই কেবিনে আমার সঙ্গে আছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং দৈনিক বাংলার সহকারী-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী। আরও কেউ কেউ হয়তাে ছিলেন, তাদের নাম মনে করতে পারছি না। আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কবির রােগযন্ত্রণা দেখছি, হঠাৎ সৈয়দ শামসুল হক নৈঃশব্দ ভঙ্গ করলেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কবি, আপনাকে বাঁচতেই হবে। আমি আমার আয়ু থেকে খানিকটা আপনাকে দিলাম।’ | ঘােষণায় নাটকীয়তা ছিল, আবেগ ছিল, যুক্তি ছিল না। একজন তার আয়ুর খানিকটা অন্যকে দিতে পারেন না। বাংলাদেশের সব মানুষ এক মিনিট করে আয়ু কবিকে দান করলে কবি বেঁচে থাকতেন তিন শ’ বছর।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
তবে মােঘল সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে নিজের আয়ু দান করেছিলেন। ঘটনাটা এ রকম—হুমায়ুন মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসকদের সব চিকিৎসা ব্যর্থ। এইসময় সুফি দরবেশ মীর আবুল কাশেম সম্রাটকে বললেন, আপনি আপনার জীবনের একটি অতি প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইতে পারেন। এটা হবে শেষ চেষ্টা।
সম্রাট বাবর বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলাে নিজ জীবন। এর বিনিময়ে আমি পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।
মীর আবুল কাশেম আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! নিজের জীবন না, আপনি বরং বহুমূল্যবান কোহিনূর হীরা দান করে দিন।
সম্রাট বললেন, আমার পুত্রের জীবন কি সামান্য হীরকখণ্ডের তুল্যমূল্য ? আমি আমার জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।
সমাট তিনবার পুত্রের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রার্থনা করলেন। তিনবার বললেন, পুত্র, তােমার সমস্ত ব্যাধি আমি নিজ দেহে তুলে নিলাম। পরম করুণাময়, আমার প্রার্থনা কবুল করাে ।।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন অবচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থায় এসে পানি খেতে চাইলেন আর বাবর হলেন অসুস্থ।
আমার নিজের জীবনেও এরকম একটি ঘটনা আছে। আমার ছেলে রাশেদ হুমায়ূনের বয়স দুই দিন। তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। সে মারা যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল থেকে শহীদুল্লাহ হলের বাসায় ফিরে এলাম। অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ালাম। আমি ঠিক করলাম, ম্রাট বাবরের মতাে নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইব। জায়নামাজে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলাে, এই প্রার্থনা কবুল হবে।।
শেষ মুহূর্তে প্রবল ভীতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি জীবনের বিনিময়ে জীবনের প্রার্থনা করতে পারি নি। আমি আমার মৃত শিশুপুত্রের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
নুহাশপল্লীর ঔষধি উদ্যানে একটি স্মৃতিফলক আছে— রাশেদ হুমায়ুন ঔষধি উদ্যান। তার নিচে লেখা—আমার ছােট্ট বাবাকে মনে করছি।’
আমার শিশুপুত্র তিন দিনের আয়ু নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে এসেছিল। সে এই সৌন্দর্যের কিছুই দেখে নি। আমি প্রায়ই নিজেকে এর জন্যে দায়ী করি।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
থাকুক পুরনাে কথা, হাসপাতালের অন্য গল্প করি।
গর-১ স্থান : হৃদরােগ ইনস্টিটিউট। শেরেবাংলা নগর। আমার বড় ধরনের হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। ভর্তি হয়েছি হাসপাতালে। নানান যন্ত্রপাতি এবং মনিটর শরীরে লাগানাে। আমার বড় ছেলে নুহাশ আমাকে দেখতে এসেছে। নুহাশের বয়স পাঁচ। সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। মনিটরে ঢেউয়ের মতাে রেখা দেখা যাচ্ছে।
নুহাশ বলল, বাবা, এখানে কী হচ্ছে আমি জানি।
কী হচ্ছে?
এই যে ঢেউয়ের মতাে রেখাগুলি দেখছ, একসময় রেখা সমান হয়ে স্ট্রেইট লাইন হবে। তখন তুমি মারা যাবে।
আমি বললাম, ও!
নুহাশ গভীর আগ্রহ নিয়ে মনিটর দেখছে। কখন স্ট্রেইট লাইন হবে কখন তার বাবা মারা যাবে এই প্রতীক্ষা ।
গল্প-২ স্থান : বেলিভিউ হাসপাতাল। নিউইয়র্ক। আমার এনজিওগ্রাম করা হবে। পায়ের ধমনী কেটে একটা সুই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সুঁই চলে যাবে হৃৎপিণ্ডে। আমাকে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে প্রতি এক হাজারে একজন মারা যায়। আমি কাগজপত্রে সই করে জানিয়েছি মৃত্যু হলে দায়দায়িত্ব হাসপাতালের না, আমার ।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
অপারেশন হবে ভাের ন’টায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম ?
হ্যা।
কাল ভােরে তােমার অপারেশন। তুমি কি চাও তােমার জন্যে তােমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হােক ?
তার মানে কী?
এই হাসপাতালে রােগীদের জন্যে প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। প্রার্থনার জন্যে আলাদা ফি আছে। তুমি ফি’র ডলার জমা দিলেই প্রার্থনার ব্যবস্থা হবে।
হাসপাতাল হলাে চিকিৎসার জায়গা। প্রার্থনার জায়গা এটা জানতাম না।
কাউন্সিলর বললেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে যাদের জন্যে প্রার্থনা করা হয় তাদের আরােগ্যের হার বেশি। এইজন্যেই প্রার্থনা বিভাগ খােলা হয়েছে।
আমি প্রার্থনা করাব না। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই ।
তােমার অপারেশনটি জটিল। তুমি যদি চাও আমি ডিসকাউন্টে প্রার্থনার জন্যে সুপারিশ করতে পারি। একজন মুসলমান আলেম প্রার্থনা করবেন।
ডিসকাউন্টের প্রার্থনাতেও আমার বিশ্বাস নেই। তুমি কি নাস্তিক? আমি নাস্তিক না বলেই ডিসকাউন্টের প্রার্থনায় বিশ্বাসী ।