তিনি তাদের বললেন তার শৈশবের কথা। আমি আসরে যােগ দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আপনি আসবেন না। এই আসরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই। অন্যান্য ফ্ল্যাটে খবর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা আসছে। তারাও গল্প শুনতে চায়। আমার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অতি সম্মানিত এই মানুষটিকে সে কী খাওয়াবে! তিনি তাে কিছুই খেতে পারেন না।
তিনি আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন, শুধু মুখে যাবেন না। কিছু খাবেন। পাকা পেঁপে থাকলে ভালাে হয়।
ঘরে পাকা পেঁপে নেই । আমি ছুটলাম পাকা পেঁপের সন্ধানে। লিফট থেকে নামতেই এক দ্রলােক চোখ বড় বড় করে বললেন, জানেন, আমাদের এই বাড়ির কোন-এক ফ্ল্যাটে জাহানারা ইমাম এসেছেন।
আনন্দে আমার মন দ্রবীভূত হলাে। এই মহীয়সী নারী কত অল্প সময়ে মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন।
তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে দেন আসাদুজ্জামান নূর।
বাসায় তখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। আমার মেয়েরা জন ডেনভারের গান শুনছে রকি মাউন্টেন হাই, কলারডাে।’ সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আন্দোলন এখন কে এগিয়ে নিয়ে যাবে ? আমি তাকে বললাম, দ্বিতীয় জাহানারা ইমাম আমাদের নেই। জাহানারা ইমাম দুটা তিনটা করে জন্মায় । একটাই জন্মায়। তবে কেউ-না-কেউ এগিয়ে আসবেই। অপেক্ষা করুন।
মা জায়নামাজে বসলেন।
আর আমি একা একা বসে রইলাম বারান্দায়। এক ধরনের শূন্যতাবােধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলই মনে হতে লাগল, একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল তা তাঁকে জানানাে হয় নি। আমার একটাই সান্ত্বনা, মৃত্যুর ওপাশের জগৎ থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই | আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা অনুভব করতে পারছেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন
আমি সব সময়ই তার পাশে ছিলাম। যে ক’দিন বেঁচে থাকব তা-ই থাকব। বঙ্গজননীর পাশে তার সন্তানরা থাকবে না, তা কি কখনাে হয় ?
বাংলার পবিত্র মাটিতে তাঁর পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। স্বাধীনতাবিরােধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড়ঝাপটা যত প্রচণ্ডই হােক না কেন সেই শিখা জুলতেই থাকবে। কী সৌভাগ্য আমাদের, তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।
একদিন চলিয়া যাব
আমার বড় মামা খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যা পেতেছেন। তিনি শেষ বারের মতাে তার সব প্রিয়জনকে দেখতে চান, এই খবর পেয়ে আমি ছুটে গেলাম নেত্রকোনার মােহনগঞ্জে। মামার সঙ্গে দেখা হলাে না। আমি পৌছালাম বিকেলে, তিনি মারা গেলেন সেইদিন সকালে। মৃত্যুশােকে পাথর হয়ে আছে আমার নানার বাড়ি। গিজগিজ করছে মানুষ। মেয়েরা সুর করে কাঁদছে। মাদ্রাসার তালেবুল এলেমরা চলে এসেছে—তারা কোরানপাঠ শুরু করেছে।
আমি প্রচণ্ড শশাকেও চাপা এক উৎসবের ছোঁয়া পেলাম। বড় কোনাে উৎসবের আগে যে উত্তেজনা থাকে, যে ব্যস্ততা থাকে—এখানেও তাই। মুরব্বিরা উঠোনে গােল হয়ে বসে আছেন। তাঁরা গম্ভীর মুখে তামাক টানছেন। গুরুত্বপূর্ণ | সিদ্ধান্ত তাঁদের কাছ থেকে আসছে। মরা বাড়িতে তিন দিন আগুন জ্বলবে না। খাবার আসবে বাইরে থেকে। এই খাবারের নাম তােলা খাবার। কোন কোন বাড়ি থেকে এই খাবার আসবে তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। তােলা খাবার সবাই পাঠাতে চায়। কিন্তু সবার খাবার নেওয়া যাবে না। সামাজিক মানমর্যাদার ব্যাপার আছে।
খান সাহেবের বাড়ি থেকে একবেলা ভােলা খাবার পাঠানাের প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাবে সবাই বিব্রত। এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যাচ্ছে না, আবার তাদের না’ বলাও যাচ্ছে না। তারা ক্ষমতাশালী। এই ভয়াবহ (!) সমস্যার সমাধান বের করার জন্যে মুরব্বিরা নিচু গলায় ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তামাক পুড়ছে প্রচুর।
মুরব্বিদের দ্বিতীয় দল (এরা অনেক বয়স্ক। এদের কেউ কেউ অথর্ব পর্যায়ে চলে গেছেন! চলচ্ছক্তি নেই, চোখে দেখেন না—এমন) অন্য সমস্যা নিয়ে বসেছেন—কে গােসল দেওয়াবে ? মড়ার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিলে তাে হবে না। জটিল নিয়মকানুন আছে। সবাই এইসব নিয়ম জানে না। যে জানে তাকে দিয়ে গােসল দেওয়ানাে যাবে না, কারণ সে শরাব’ খায়–এরকম গুজব সম্প্রতি শােনা যাচ্ছে । মুরব্বিদের একজন বললেন, আচ্ছা ফজলু কি মৃত্যুর আগে | কিছু বলেছে—কে তারে গােসল দিবে ? বা কবর কোনখানে হবে ?
, বলে নাই । বলে গেলে কাজকর্মের সুবিধা হয়। বলে যাওয়া উচিত।
মৃতের ওপর রাগ করা যায় না, তবে মৃতের বােকামির জন্যে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হওয়া যায়।
ভেতরবাড়ি থেকে মেয়েরা চিৎকার করে কাঁদছে। এত উঁচু স্বরে বিলাপ শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের গলা নিচু করতে বলা হলাে। তালেবুল এলেমরা কোরানশরিফ এত মাধা’ গলায় পড়ছে কেন ? গলায় জোর নাই ? তাদের মৃদু ধমক দেওয়া হলাে।
আত্মীয়স্বজন সবাই কি খবর পেয়েছে ? ভুলক্রমে কাউকে খবর না দেওয়া হলে বিরাট জটিলতা হবে। যাদের খবর দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কারা কারা উপস্থিত হয়েছে ? সবাই উপস্থিত না হলে জানাজার সময় ঠিক করা যাবে না।
কবর দিয়ে দিতে হবে আসরের নামাজের পর পর। দেরি করা যাবে না। কবর দিতে দিতে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে যাবে। মসজিদে মাগরেবের নামাজ আদায় করে গােরযাত্রীরা ঘরে ফিরবে ।
কবরের জায়গা কি ঠিক হয়েছে?
হ্যা, ঠিক হয়েছে। বাড়ির পেছনে। গােরস্থানে কবর হলে মেয়েছেলারা যেতে পারে না। মৃত ছেলের মা ছেলের কবর ঘরের পাশে চাচ্ছেন, যাতে তিনি যখন তখন যেতে পারেন ।
মসজিদের লাগােয়া গােরস্থানে কবর হলেই ভালাে হতাে। তবু মা’র ইচ্ছাই বড়। বাড়ির পেছনে কবর খননের অনুমতি দেওয়া হলাে। তখনই আসল সমস্যা দেখা দিল। যে কবর খুঁড়বে সে নেই। সে গিয়েছে শম্ভুগঞ্জ, তার মেয়ের বাড়ি। কী সর্বনাশ! শম্ভুগঞ্জ থেকে তাকে ধরে আনার জন্য তৎক্ষণাৎ লােক ছুটল। মনে হচ্ছে বাদ-আছর কবর হবে না। বিলম্ব হবে। উপায় কী ? আল্লা আল্লা করে ওই লােককে পাওয়া গেলে হয়।
আমি ভেবে পেলাম না, মােহনগঞ্জের মতাে এত বড় একটা জায়গায় কবর খোড়ার কি একজনই মানুষ ? আমার অজ্ঞতায় সবাই মজা পেলেন। আমাকে জানানাে হলাে, জামাল উদ্দিন কবর খোড়ার ব্যাপারে অঞ্চল-বিখ্যাত। তার মতাে সুন্দর করে কেউ কবর খুঁড়তে পারে না। তাকে না পাওয়া গেলে এক কথা। পাওয়ার সম্ভাবনা যখন আছে চেষ্টা করা যাক।
আমি নিচু গলায় বললাম, কবর খোড়ার মধ্যে সুন্দর-অসুন্দর কী আছে ? আমার নির্বুদ্ধিতায় আবারও সবাই বিরক্ত হলেন।
মানুষের আসল বাড়ি কবর। সেই বাড়িটা সুন্দর করে বানাতে হবে না ? দালানকোঠা সুন্দর করে বানিয়ে ফয়দা কী ?
জালালউদ্দিন এসে পৌছালেন রাত দশটায়। রােগা পাতলা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পানের ব্যবসা করেন। তুচ্ছ ধরনের ব্যবসা। কেউ তাকে পােছে না। কিন্তু কারও মৃত্যু হলে সবাই তার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জালাল উদ্দিনকে লাগবে । যেখান থেকে পারাে তাকে ধরে আনাে।
তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে কবর খোঁড়া শুরু হলাে। আমি গভীর আগ্রহে কবর খোঁড়া দেখছি। জালাল উদ্দিন মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে তুলছেন। মনে হচ্ছে কাজটায় তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। একসময় মুখ তুলে হাসিমুখে বললেন, ফজলুর ভাগ্য ভালাে। মাটি ভালাে পাইছি। সচরাচর এমন ভালাে মাটি পাওয়া যায় না ।
মেয়েদের মধ্যে কে যেন এদিকে এসে পড়ল। তাকে প্রচণ্ড ধমক দেওয়া হলাে।
মেয়েদের কবর খোড়া দেখতে নেই। এটা পুরুষদের কাজ। কবর খােড়া শেষ হলাে রাত একটায়। জালাল উদ্দিন তার কাজ শেষ করে উঠে পড়লেন। হ্যাজাকের আলাে ফেলা হলাে কবরে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম—এটা সামান্য গর্তবিশেষ নয়। এ এক শিল্পকর্ম। পৃথিবীর অন্যান্য শিল্পকর্মের মতাে এই শিল্পকর্মের দিকেও মুগ্ধ হয়ে তাকানাে যেতে পারে।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ফজলুর ভাগ্য আসলেই ভালাে। কবরটা যেন হাসতেছে।
আমি বললাম, আমি একটু কবরে নেমে দেখতে চাই ।
কেউ কোনাে আপত্তি করল না। শুধু বলা হলাে যেন অজু করে নামা হয়। আমি অজু করে কবরে নেমেছি। আমার চারদিকে মাটির দেয়াল। যারা ওপরে আছে তাদের কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার মনে হলাে, আমাকে যেন আলাদা করে ফেলা হয়েছে—এই পৃথিবী, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথির সঙ্গে আর আমার কোনাে যযাগ নেই।
জীবনে কোনাে বড় ধরনের অতিপ্রাকৃত অনুভূতির মুখােমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। সেই মধ্যরাত্রের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই প্রথম এবং এ পর্যন্ত শেষ অভিজ্ঞতা।
মৃত্যু
তার পেটে ক্যানসার। দু’বার অপারেশন হয়েছে। প্রথমবার দেশে, দ্বিতীয়বার কলকাতায়। লাভ কিছু হলাে না। অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল । তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলাে ব্যাংককের আমেরিকান হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসা নাকি ভালাে। অনেক সময় এমন হয়েছে, দেশের ডাক্তাররা বলেছেন ক্যানসার; ওখানে গিয়ে দেখা গেছে অন্য কিছু।
তিনিও হয়তাে তেমন কিছু আশা করছিলেন। কিন্তু ব্যাংককের ডাক্তাররা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, রােগ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শুধু যন্ত্রণা কমানাের চেষ্টাই করা যাবে। আর কিছু না।
তিনি হতভম্ব হয়ে ডাক্তারদের কথা শুনলেন। পাশে দাঁড়ানাে তাঁর বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে নেত্রকোনার ডায়ালেক্টে বললেন, নাকচেপ্টা ডাক্তার, এইতা কী কয় ?
ছেলে বলল, বাবা, তুমি কোনাে চিন্তা করবে না। আমি তােমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। যে চিকিৎসা কোথাও নেই—সেই চিকিৎসা আমেরিকায় আছে।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, গাধার মতাে কথা বলিস না। আমেরিকার মানুষ বুঝি ক্যানসারে মরে না ? চল দেশে যাই। মরণের জন্য তৈয়ার হই।
দ্রলােক মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।
গল্প-উপন্যাসে এরকম চরিত্র পাওয়া যায়। অমােঘ মৃত্যুর সামনেও দেখা যায় গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা নির্বিকার থাকে। একটা হিন্দি ছবিতে দেখেছিলাম, নায়ক জানতে পেরেছে ক্যানসার হয়েছে। অল্প কিছুদিন বাঁচবে। জানবার পর থেকে তার ধেই ধেই নৃত্য আরও বেড়ে গেল। কথায় কথায় গান। কথায় কথায় হাসি।
বাস্তব কখনােই সেরকম নয়। বাস্তবের অসীম সাহসী মানুষও মৃত্যুর মুখােমুখি হতে পারে না। মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করা তাে অনেক দূরের ব্যাপার
আমরা বেঁচে থাকতে চাই। শুধুই বেঁচে থাকতে চাই। যখন শেষ সময় উপস্থিত হয় তখনাে বলি, দাও দাও। আর একটি মুহূর্ত দাও। দয়া করাে ।
‘গলিত স্থবির ব্যাঙ আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।’