লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ

ব্যবস্থা একটা হলাে। দেখা গেল, অসুখ তেমন জটিল নয়। খাদ্যনালির অংশবিশেষ মূত্রথলিতে নেমে গেছে। ডাক্তার খাদ্যনালিটা ওপরে তুলে দেবে। মূত্রনালির ফুটো ছােট করে দেবে। অসুখটা হলাে খারাপ ধরনের হার্নিয়া।লীলাবতীর মৃত্যুঅপারেশনের তারিখ ঠিক হলাে। আমি মহা খুশি। শুধু ছেলের বাবা কেঁদেকেটে অস্থির। তার ধারণা, ছেলে মারা যাচ্ছে। তার একটাই ছেলে। স্ত্রী মারা গেছে। ছেলেকে নিয়ে সে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। এটাই তার একমাত্র শখ। মনে মনে বললাম, হারামজাদা। ছেলের অসুখ হওয়ায় মজা পেয়ে গেছিস? দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানাে বার করছি। শুওর কা বাচ্চা। ঘুঘু দেখেছ দি দেখ নি। ছেলেকে শুধু যে ভালাে করব তাই না, স্কুলেও ভর্তি করাব। মজা বুঝবি। অপারেশন হয়ে গেল।

সাকসেসফুল অপারেশন। ছেলেটিকে অপারেশন টেবিল থেকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নেওয়া হলাে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইনটেনসিভ কেয়ারে নেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ছেলেটা মারা গেল। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হায়, হায়! এ কী সর্বনাশ। আমার কারণে ছেলেটা মারা গেল ? ছেলের বাবার সঙ্গে দেখা করার সাহসও হলাে না। আমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে চলে এলাম। 

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম—আর পরােপকার করতে যাব না। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। সারা রাত একফোটা ঘুম হলাে না। কেন ছেলেটা মরে গেল ? কেন ? 

বুঝলি দোস্ত, ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমার আসল সমস্যা শুরু হলাে। আমার রােখ চেপে গেল। ঠিক করলাম—যখন যেখানে অসুস্থ ছেলেপেলে দেখব, চিকিৎসা করাব। দেখি কী হয়। দেখি এরা বাঁচে না মরে। সেই থেকে শুরু। রাস্তায় অসুখবিসুখে কাতর কাউকে দেখলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। টাকাপয়সা সব এতেই চলে যায়। 

তারপর বিয়ে করলাম। সংসার হলাে। অভ্যাসটা গেল না। চিকিৎসার খরচ আছে। আমি বেতনও তাে তেমন কিছু পাই না। সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে। বিয়ের সময় তাের ভাবি বেশ কিছু গয়না-টয়না পেয়েছিল। সব বেচে খেয়ে ফেলেছি। এই নিয়েও সংসারে অশান্তি । হা হা হা। 

কতজন রােগী এইভাবে সুস্থ করেছিস ? অনেক। আর কেউ মারা যায় নি ? 

আর একজনও না। প্রথমজনই শুধু মারা গেল। আর কেউ না। এই মুহূর্তে কারও চিকিৎসা করছিস ? 

হ্যা, এখনাে একজন আছে। জয়দেবপুরের এক মেয়ে। ঠোট কাটা। প্লাস্টিক সার্জারি করে ঠোট ঠিক করা হবে। 

আমি মুগ্ধ গলায় বললাম, তুই যে কত বড় কাজ করছিস সেটা কি তুই জানিস ? 

সফিক অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বড় কাজ করছি, না ছােট কাজ করছি তা জানি না। তবে আমার একেকটা রােগী যেদিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে, সেদিন যে আমার কত আনন্দ হয় তা শুধু আমিই জানি। এই আনন্দের কোনাে তুলনা নেই। প্রতিবারই আমি আনন্দ সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাদি। লােকজন, ডাক্তার, সবার সামনেই কাদি। 

বলতে বলতে সফিকের চোখে পানি এসে গেল। পানি মুছে সে স্বাভাবিক গলায় বলল, তারপর দোস্ত, তাের খবর বল। তুই কেমন আছিস ? 

আমি মনে মনে বললাম, শারীরিকভাবে আমি ভালাে আছি। কিন্তু আমার মনটা অসুস্থ হয়ে আছে। তুই আমার মন সুস্থ করে দে। এই ক্ষমতা অল্প কিছু সৌভাগ্যবানের থাকে! তুই তাদের একজন। 

শিকড় 

মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা শহরে খাট, মিটসেফ, চেয়ার-টেবিল এবং লেপ-তােষক বােঝাই করে কিছু ঠেলাগাড়ি চলাচল করে। ঠেলাগাড়ির পেছনে পেছনে একটা রিকশায় বসে থাকেন এইসব মালামালের মালিক। তার কোলে থাকে চাদরে মােড়া বারাে ইঞ্চি ব্ল্যাক অ্যান্ড হােয়াইট টিভি কিংবা টু-ইন-ওয়ান। তাঁকে খুবই ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন মনে হয়, কারণ একইসঙ্গে তাকে লক্ষ রাখতে হচ্ছে ঠেলাগাড়ির দিকে এবং তাঁর কোলে বসানাে পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান সামগ্রীটির দিকে । তাঁকে খুব অসহায়ও মনে হয়। অসহায়, কারণ এই মুহূর্তে তার কোনাে শিকড় নেই। শিকড় গেড়ে কোথাও না বসা পর্যন্ত তার অসহায় ভাব দূর হবে না। 

মানুষের সঙ্গে গাছের অনেক মিল আছে। সবচেয়ে বড় মিল হলাে, গাছের মতাে মানুষেরও শিকড় আছে। শিকড় উপড়ে ফেললে গাছের মৃত্যু হয়, মানুষেরও এক ধরনের মৃত্যু হয়। মানুষের নিয়তি হচ্ছে তাকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয় চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে। 

শিকড় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে অনেক কিছু লাগে— নরম মাটি, পানি, আলাে, হাওয়া। মানুষের কিছুই লাগে না। কয়েকটা দিন একটা জায়গায় থাকতে পারলেই হলাে, সে শিকড় গজিয়ে ফেলবে এবং অবধারিতভাবে শিকড় উপড়ানাের তীব্র যাতনায় একসময় কাতর হবে। দৃশ্যটা কেমন ? একটা পরিবারের কথাই মনে করা যাক। ধরা যাক, এরা চার-পাঁচ বছর একটা ভাড়া বাড়িতে থেকেছে। বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালাদের স্বভাবমতাে এদের নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। ঠিকমতাে পানি দেয় নি। বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে দফায় দফায়, শেষপর্যন্ত নােটিশ দিয়েছে বাড়ি ছাড়ার । এরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। নতুন একটা বাড়ি পেয়েছে, যেটা এই বাড়ির চেয়েও সুন্দর। ভাড়া কম, সামনে খানিকটা খােলা জায়গাও আছে। পরিবারের সবাই এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, এই পচা বাড়ি ছেড়ে দিতে পেরে তারা খুবই আনন্দিত। কিন্তু পরিবারের কী মনের কষ্ট পুরােপুরি ঢাকতে পারছেন না। বারবার তার মনে হচ্ছে, এই বাড়ি ঘিরে তার কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। 

তার বড় ছেলের জন্ম হলাে এই বাড়িতে। এই বাড়িতেই তাে সে হাঁটতে শিখল। টুকটুক করে হাঁটত, একবার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে কী প্রচণ্ড ব্যথাই পেল। 

প্রথম কথা শিখে পাখি দেখে উত্তেজিত গলায় বলেছিল, পা…পা…পা…। 

তিনি বাঁধাছাদা করছেন, পুরােনাে সব কথা মনে পড়ছে আর চোখ মুছছেন। জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে বাবুর ছ’ মাস বয়সের একটি জুতা পেয়ে গেলেন। বাবু বেঁচে নেই, তার সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মৃতের কিছু জমা করে রাখতে নেই। কিন্তু তার একপাটি জুতা কীভাবে থেকে গেল ? এই জুতায় এখনাে বাবুর গায়ের গন্ধ। 

তিনি ঘর গােছানাে বন্ধ রেখে স্বামীকে নিচু গলায় বললেন, কিছু বেশি ভাড়া দিয়ে থেকে গেলে কেমন হয় ? স্বামী খুব রাগ করলেন। কী আছে এই বাড়িতে যে এখানেই থাকতে হবে ? এর বাড়ি নরক ছাড়া আর কী ? নচ্ছার বাড়িওয়ালা। বাসা ছােট। আলাে নেই, বাতাস নেই। 

যেদিন বাসা বদল হবে সেদিন ছােট বাচ্চা দুটা কাঁদতে লাগল। তারা এই বাসা ছেড়ে যাবে না। বাবা হুংকার দিলেন, খবরদার, নাকি কান্না না। এরচেয়ে হাজার গুণ ভালাে বাসায় তােমাদের নিয়ে যাচ্ছি। 

 বাবা জিনিসপত্র ঠেলাগাড়িতে তুলে বাসার চাবি বাড়িওয়ালাকে দিতে গেলেন। চাবি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িতে তার প্রােথিত শিকড় ছিড়ে গেল । তীব্র কষ্টে তিনি অভিভূত হলেন। তাঁর চোখে পানি এসে গেল। নতুন বাসার জন্যে অ্যাডভান্স টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। তার মতাে দরিদ্র মানুষের জন্যে অনেকগুলাে টাকা ।

তারপরেও তিনি বাড়িওয়ালাকে বললেন, ভাই সাহেব, ছেলেমেয়েরা এই বাসা ছাড়তে চাচ্ছে না। চারদিকে পরিচিত বন্ধুবান্ধব তাে…আচ্ছা না হয় পাঁচ শ টাকা বেশিই দেব…। তা ছাড়া ইয়ে, মানে আমার বড় ছেলে এই বাড়িতেই জন্মাল, আমার স্ত্রী মানে মেয়েমানুষ তাে, ইমােশন বুঝতেই পারছেন…ছেলের স্মৃতি…।। 

বাড়িওয়ালা রাজি হলেন না। বাবা ভেজা চোখে ছােট টিভিটা কোলে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলেন। 

অনেক দিন ধরেই আমি এই শহরে আছি। কতবার বাসা বদলালাম। প্রতিবারই এই কাণ্ড। বছরখানিক আগে শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটরের বাসাটা ছাড়লাম। অনেক দিন সেখানে ছিলাম। কত সুখস্মৃতি। বাসার সামনে গাছগাছালিতে ছাওয়া। গাছে বাসা বেঁধেছে টিয়া। একটি দুটি না—হাজার হাজার। বারান্দায় বসে দেখতাম, সন্ধ্যা হলেই ঝাঁক ঝাক টিয়া উড়ত। আমার মেয়েরা গাছের নিচে ঘুরঘুর করত টিয়া পাখির পালকের জন্যে। এরা পাখির পালক জমাত। 

হলের সঙ্গেই কী বিশাল দিঘি! কী পরিষ্কার টলমলে পানি! বাঁধানাে ঘাট। কত জোছনার ফিনকি ফোটা রাতে আমি আমার ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে নেমে গেছি দিঘিতে। এই দিঘিতেই তাে বড় মেয়েকে সাঁতার শেখালাম। প্রথম সাঁতার শিখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আমার মেয়ে একা একা মাঝপুকুরের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার ভয় পেয়ে ফিরে এল। কী সুন্দর দৃশ্য। 

হলের সামনের মাঠে আমার তিন কন্যা সাইকেল চালাতে শিখল, আমি তাদের ইন্সট্রাক্টর । সাইকেলে প্রথমবারের মতাে নিজে নিজে কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার আনন্দের কি কোনাে সীমা আছে ? না, নেই। এই আনন্দ আকাশ থেকে প্যারাট্রপারে প্রথম ঝাপ দেওয়ার আনন্দের মতাে। আমার কন্যাদের আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই হল। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *