শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কিছুক্ষণের ভেতর আবার মিটমাট। লুকিয়ে লুকিয়ে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখা। সাজগােজের দিকে প্রচণ্ড নজর। সব মিলিয়ে বেশ একটা দ্রুত পরিবর্তন। আগের যে রুনু-ঝুনুকে চিনতাম, এরা যেন সেই রুনু-ঝুনু নয়। বিশেষ করে সেই গােপন চিঠিলেখার ভঙ্গিটা খট করে চোখে লাগে। শঙ্খনীল কারাগাররাবেয়া মােড়ায় বসে সােয়েটার সেলাই করছিল। তাকে বললাম, আচ্ছা, কোনাে ছেলের সঙ্গে কি রুনুর চেনাজানা হয়েছে নাকি?’ 

রাবেয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিটকির কথা রাত দিন ভেবে ভেবে তাের এমন হয়েছে। কিটকির চিঠি পাস নি নাকি?” 

‘না, আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। শরীফ সাহেবের ছেলেটা দেখি প্রায়ই আসে, মনসুর বােধ হয় নাম। 

আসে আসুক না। যখন ন্যাংটা থাকত, তখন থেকে এ বাড়িতে এসে খেলেছে রুনু-ঝুনুর সঙ্গে। 

যখন খেলেছে তখন খেলেছে। এখন রুনু-ঝুনুও বড়াে হয়েছে, ও নিজেও বড়াে হয়েছে।’ 

‘কি বাজে ব্যাপার নিয়ে ফ্যাচ ফ্যাচ করছিস! বেশ তাে, যদি ভালােবাসাবাসি হয়, বিয়ে হবে। মনসুর চমৎকার ছেলে। ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে কোথায় যেন চাকরিও পেয়েছে। 

এক কথায় সমস্যার সমাধান করে রাবেয়া সেলাই-এ মন দিল। 

মটারও ভীষণ পরিবর্তন হয়েছে। মস্ত জোয়ান। পড়াশােনায় তেমন মন নেই। প্রায়ই অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। কি এক কায়দা বের করেছে, বাইরে থেকেই টুকুস করে বন্ধ দরজা খুলে ফেলে। 

পত্রিকায় নাকি মাঝে মাঝে তার কবিতা ছাপা হয়। যেদিন ছাপা হয়, সেদিন লজ্জায় মুখ তুলে তাকায় না। যেন মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে এমন হাব-ভাব। চমৎকার গানের গলা হয়েছে। গানের মাষ্টার রেখে শেখালে হয়তাে ভালাে গাইয়ে। হ’ত। মাঝে মাঝে আপন মনে গায়। কোনাে কোনাে দিন নিজেই অনুরােধ করি, 

মন্টু একটা গান কর তাে৷’ 

কোনটা? ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। ‘রবীন্দ্রসংগীত না, একটা আধুনিক গাই, শােন। ‘বাতি নিবিয়ে দে, অন্ধকারে গান জমবে। 

বাতি নিবিয়ে গান গাওয়া হয়। এবং গানের গলা শুনলেই বাবা টুকটুক করে হাজির। বাবার শরীর ভীষণ দুর্বল হয়েছে। হাঁপানি, বাত–সব একসঙ্গে চেপে ধরেছে। বিকেলবেলায় একটু হাঁটেন, বাকি সময় বসে বসে কাটে। রাবেয়া রাত আটটা বাজতেই গরম তেল এনে বুকে মালিশ করে দেয়। তখন বাবা বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলেন। রাবেয়া বলে, ‘একা একা কী বলছেন বাবা? 

না মা, কিছু বলছি না, কী আর বলব।’ একটু আরাম হয়েছে? 

‘হবে না কেন মা? তাের মতাে মেয়ে যার আছে, তার হাজার দুঃখ-কষ্ট থাকলেও কিছু হয় না। লক্ষ্মী মা আমার। আমার সােনার মা। 

‘আহ্ বাবা, কি বলেন, লজ্জা লাগে।’ ‘তাহলে থাক। মনে মনে তাের গুণ গাই।’ ‘বাবা চুপ করেন।’ 

সবচেয়ে ছােট যে নিনু সেও দেখতে দেখতে বড়াে হয়ে গেল। মার চেয়েও রূপসী হয়েছে সে। পাতলা ঠোট, একটু থ্যাবড়া নাক, বড়াে বড়াে ভাসা চোখ সব সময় ছলছল করছে। ঐ তাে সেদিন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াত। থ থ থ বলে আপন মনে গান করত, আর আজ একা একা স্কুলে যায়। সাবলীল গর্বিত হাঁটার ভঙ্গি। একটু পাগলাটে হয়েছে সে। স্কুল থেকে ফিরে এসেই বই-খাতা ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে, তারপর জাপটে ধরে রাবেয়াকে। 

‘ছাড় ছাড়, কি করিস? ছাড়। ‘না, ছাড়ব না।’ ‘কী বাজে অভ্যেস হয়েছে তাের! ‘হােক।’ 

‘হাত-মুখ ধুয়ে চা খা। ‘পরে খাব, এখন তােমাকে ধরে রাখব। 

বেশ থাক ধরে। ‘রাবেয়া আপা। ‘কি? ‘কোলে নাও। ‘এত বড়াে মেয়ে, কোলে নেব কি রে বোেকা! ‘না-না, নিতেই হবে। 

তারপর দেখি নিনু রাবেয়ার কোলে উঠে লাজুক হাসি হাসছে। আমার সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছে তার। রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে আমার বিছানায় উঠে এসে বালিশ নিয়ে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে। 

‘কি হচ্ছে রে নিনু? ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছি। দাদা। ‘কি?’ ‘গল্প বলবে কখন? ‘আরাে পরে, এখন পড়াশােনা কর। ‘না, আমি পড়ব না, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলব।’ 

বেশ খেল। ‘তুমি খেলবে, দাদা? 

আস না? এই বালিশটা তুমি নাও। হ্যাঁ, এবার মার তাে দেখি আমাকে? 

রাবেয়ার আগের হাসিখুশি ভাব আর নেই। সারাক্ষণ দেখি একা একা থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে বাতি জ্বলে। রাত জেগে সে কী করে কে জানে? রাবেয়াটার জন্যে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ে করল না শেষ পর্যন্ত। মেঘে মেঘে বেলা তাে আর কম হয় নি। আমি মনে-প্রাণে চাই তাকে হাসিখুশি রাখতে। মাঝে মাঝে বলি, ‘রাবেয়া সিনেমা দেখবি?” 

“না।” ‘চল না, যাই সবাই মিলে। কত দিন ছবি দেখি না। ‘তুই যা রুনু-ঝুনুদের নিয়ে–কত কাজ ঘরের। ‘যা কাজ, রুনু-ঝুনুই করতে পারবে। আয়, তুই আর আমি দু জনে যাই। ‘না রে, ইচ্ছে করছে না। ‘তাহলে চল, একটু বেড়িয়ে আসি। 

কোথায়? 

‘তুই যেখানে বলিস। ‘আজ থাক। 

আমি অস্বস্তিতে ছটফট করি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *