রাবেয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও সাজ্জা হয়। যেন তার মানসিক দুঃখ-কষ্টের অনেকটা দায়ভাগ আমার। এক দিন রাবেয়া নিজেই বলল, ‘চল খােকা, বেড়িয়ে আসি।
আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘চল, সারা দিন আজ ঘুরব। বল কোথায় কোথায় যাবি?
‘প্রথম যাব আমার এক বন্ধুর বাসায়। একটা রিক্সা নে।” রিক্সা যে-বাড়ির সামনে থামল, তা দেখে চমকালাম। রাজপ্রাসাদ নাকি? বাড়ির সামনে কি প্রকাণ্ড ফুলের বাগান। আমি বললাম, রাবেয়া, তুই ঠিক জায়গায় এসেছিস তাে? কার বাড়ি এটা?
‘আবিদ হােসেনের, ঐ যে ছােটবেলায় আমাকে গাড়িতে করে স্কুলে পৌছে ‘বাসা কী করে চিনলি ? ‘এসেছিলাম তাে তাঁর সঙ্গে বাসায়।
আবিদ হােসন বাসায় ছিলেন না। এক জন বিদেশিনী মহিলা খুব আন্তরিকভাবে আমাদের বসতে বললেন। কী দরকার, বারবার জিজ্ঞেস করলেন। চমৎকার বাংলা বলেন তিনি।
রাবেয়া বলল, ‘কোনাে প্রয়ােজন নেই। এমনি বেড়াতে এসেছি। ছােটবেলায় তিনি আমার খুব বন্ধু ছিলেন।
ভদ্রমহিলা কফি করে খাওয়ালেন। বেরিয়ে আসবার সময় মস্ত বড়াে বড়াে ক’টি গােলাপ তুলে তােড়া করে দিলেন রাবেয়ার হাতে। এক জন অপরিচিত বিদেশিনীর এমন ব্যবহার সত্যিই আশা করা যায় না।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
রাবেয়া বেরিয়ে এসে বলল, ‘চল খােকা, এই ফুলগুলি মার কবরে দিয়ে আসি। এই তিনটা দিবি তুই, বাকি তিনটা দেব আমি। আয় যাই।
বেশ কেটে যাচ্ছে দিন। কিটকির চিঠি হঠাৎ মাঝে মাঝে এসে পড়ে। কেমন আছেন ভালাে আছি গােছের। একঘেয়ে জীবনের মধ্যে এইটুকুই যেন ব্যতিক্রম। হঠাৎ করে এক দিন সবার একঘেয়েমী কেটে গেল। মনসুরের বাবা এক সন্ধ্যায় বেড়াতে এসে অনেক ভণিতার পর বাবাকে বললেন, ‘আপনার মেয়ে রুনুকে যদি দেন আমাদের কাছে, বড়াে খুশি হই। মনসুরের নিজের খুব ইচ্ছা। মনসুরকে আপনি ছােটবেলা থেকেই দেখেছেন। চাকরিও পেয়েছে চিটাগাং স্টীল মিলে, নয় শ’ টাকার মতাে বেতন, কোয়ার্টার আছে। তা ছাড়া আপনার মেয়েরও মনে হয় কোনাে অমত নেই।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। বারােই আশ্বিন বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল। এক মিনিটে বদলে গেল সারাটা বাড়ি। বাবার সমস্ত অসুস্থতা কোথায় যে পালাল! বিয়ে নিয়ে এর সঙ্গে আলাপ করা, ওর কাছে যাওয়া, বাজারের হাল অবস্থা দেখা,
মেয়েকে কী দিয়ে সাজিয়ে দেবেন সে সম্বন্ধে খােজ নেওয়া–এক মুহূর্ত বিশ্রাম। রইল না তাঁর।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মন্টু তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সারাক্ষণই হৈচৈ করছে। গেট কোথায় হবে, ইলেকট্রিকের বাল্বে সাজান হবে কি না, কার্ড কয়টি ছাপাতে হবে, নিমন্ত্রণের ভাষাটা কী রকম হবে, এ নিয়ে তার ব্যস্ততা প্রায় সীমাহীন। রাবেয়াকে নিয়ে আমি কেনাকাটা করতে প্রায় প্রতিদিনই বেরিয়ে যাই। ঝুনুটা সারাক্ষণ আহ্লাদী করে বেড়ায়। শীতের শুরুতে ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এমনিতেই একটু উৎসবের ছোঁয়াচ থাকে, বিয়ের উৎসবটা যুক্ত হয়েছে তার সাথে।
রুনুর চাঞ্চল্য কমে গেছে। হৈচৈ করার স্বভাব মুছে গেছে একেবারে। সারা দিন শুয়ে শুয়ে গান শােনে। একটু যে কোথাও যাবে, আমাদের সঙ্গে কিংবা বাইরের । বারান্দায় এসে বসবে–তাও নয়। দুপুরটা কাটায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে–বড় ভালাে লাগে দেখে। যদি বলি, কিরে রুনু, বিয়ের আগেই বদলে গেছিস দেখি।
যাও দাদা, ভালাে লাগে না। ‘তাের চিটাগাং-এর বাড়িতে বেড়াতে গেলে খাতির-যত্ন করবি তাে? ‘না, করব না। তােমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখব।
রুনুর চোখ জ্বলজ্বল করে। সারা শরীরে আসন্ন উৎসবের কী গভীর ছায়া। মনসুর দেখি প্রায়ই আসে। এক দিন সিনেমার টিকেট নিয়ে এল রুনু-ঝুনুর জন্যে। রুনু কিছুতে যাবে না। রুনু বলে, নিনুকে নিয়ে যাক।’ নিও যাবে না, আমার জন্যে তাে আনে নি। আমি কেন যাব?’
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
এই বয়সেই পাকা পাকা কথা। | এক দিন সে মনসুরের সঙ্গে হেসে হেসে সারা দুপুর গল্প করেছে, আজকে তার সাড়া পেলেই রুনু বন্দী হয়ে যায় নিজের ঘরে। রাবেয়া হেসে হেসে বলে, বেচারা বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি ধরিয়ে ফেলেছে, রুনু যা, বেচারাকে দর্শন দিয়ে আয়।
‘থাকুক বসে, আমি যাচ্ছি না।’
কেন যাবি না? ‘রােজ রােজ বেহায়ার মতাে আসবে, লজ্জা লাগে না বুঝি? ঝুনু আর নিনুকে নিয়ে গল্প করে বেচারা সময় কাটায়।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে পড়ল। বাবার দু’ জন ফুফু এলেন, তাঁর চাচাত ভাইও ছেলে-মেয়ে নিয়ে এলেন। বাড়ি লােকজনে গমগম করতে লাগল। মন্টু
কোথেকে একটি রেকর্ডপ্লেয়ার এনেছে। সেখানে তারস্বরে রাত-দিন আশুনিক গান হচ্ছে। ফুফুর ছেলেমেয়ে ক’টির হল্লায় কান পাত যাচ্ছে না, আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও যােগ দিয়েছে তাদের সঙ্গে। পাড়ার ছেলেরা নিজেরাই বাঁশ কেটে ম্যারাপ বাঁধার যােগাড় করছে। বেশ লাগছে। উৎসবের নেশা-ধরান আমেজ। কলেজ। থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে নিলাম।
তিন দিন পর বিয়ে। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। দুপুরের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কিসের যেন হিসেব কষছি। রাবেয়া পাশেই বসে। রুনু, ঝুনু আর ফুফুর দু’ মেয়ে লুডু খেলছে বসে বসে। বাবা গেছেন নানার বাড়ি। নিনুটা এল এমন সময়। হাসিমুখে বলল, “দাদা, তােমাকে ডাকে। কে? ‘নতুন দুলাভাই ইঞ্জিনীয়ার সাহেব।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
রুনু লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। রাবেয়া বলে বসে, ‘আহা, বেচারার আর তর সইছে না। আমি স্যাণ্ডেল পায়ে নিচে নামি। বসার ঘরে মনসুর মুখ নিচু করে বসে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
কী ব্যাপার ভাই? কিছু বলবে?
ঝুনু দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিতে লাগল। মনসুর বলল, আপনি যদি একটু বাইরে আসেন, খুব জরুরী।
আমি চমকে উঠলাম। কিছু কি হয়েছে এর মধ্যে? ‘ঘরে না, আসেন ঐ চায়ের দোকানটায় বসি।
মনুসুরের মুখ শুকনাে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। অপ্ৰকৃতস্থের মতাে চাউনি। চায়ের দোকানে বসে সে কাশতে লাগল। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার, খুলে বল।
এই চিঠিটা পড়েন একটু।
গােটা গােটা অক্ষরে লেখা। আধপাতার একটা চিঠি। সবুজ নামে একটি ছেলেকে লেখা। সবুজের সঙ্গে সে সিনেমায় যেতে পারবে না। বাসার সবাই সন্দেহ করবে। রুনুই লিখেছে মাস তিনেক আগে। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
‘কই পেয়েছ এই চিঠি?’ ‘সবুজ কাল রাতে আমাকে দিয়ে গিয়েছে।
কথা বলতে আমার সময় লাগল। আর বলবই-বা কী? শুকনাে গলায় বললাম, আমাকে কী করতে বল ? বিয়ে ভেঙে দিতে চাও? ‘না–মানে এত আয়ােজন, এত কিছু, মানে– “তুমি কি রুনুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাও? ‘না-না, কী বলব আমি? “তবে?
‘আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ঝুনুকে আমি বিয়ে করতে পারি।’ ‘সে কী করে হয়! সব করা হয়েছে রুনুর নামে। আজ হঠাৎ করে…’ ‘আপনি ভালাে করে ভেবে দেখুন, তা হলে সব রক্ষা হয়।’