শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

‘সব দিক রক্ষার তেমন দরকার নেই। একটা মেয়ে একটা চিঠি লিখে ফেলেছে। এই বয়সে খুব অস্বাভাবিক নয় সেটা। শঙ্খনীল কারাগার‘সবুজ আমাকে আরাে বলেছে ‘কী বলেছে? 

না, সে আমি আপনাকে বলতে পারব না। ‘সে তাে মিথ্যা কথাও বলতে পারে। ‘আপনি বরঞ্চ ঝুনুর সঙ্গে 

‘আমি তাহলে রুনুর সঙ্গে একটা কথা বলি।’ ‘না। রুনুকে আর কী বলবে? যা বলবার আমিই বলব। 

আমি রুনুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। আসন্ন উৎসবের আনন, তার চোখে-মুখে। সমস্ত ব্যাপারটার জন্যে রুনুকেই দায়ী করা উচিত। কিন্তু কিছুতেই তা পারছি না। রুনুকে আমি বড়াে ভালােবাসি। এ ঘটনাটা তাকে এক্ষুণি জানান উচিত। কিন্তু কী করে বলব, ভেবে বুক ভেঙে গেল। রাবেয়াকেই জানালাম প্রথম। রাবেয়া প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল। শেষটায় কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। রাবেয়া বড়াে শক্ত ধাঁচের মেয়ে, চোখে পানি দেখেছি খুব কম। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

রাবেয়া বলল, ‘তুই রুনুকে সমস্ত বল। ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে যা। বাবাকে আমি বলব।’ 

রুনুকে এক চাইনীজ রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলাম। ফ্যামিলি কেবিনে তার মুখােমুখি বসে আমার গভীর বেদনা বােধ হচ্ছিল। রুনুই প্রথম কথা বলল, “দাদা, 

তুমি কি কিছু বলবে? না শেষ বারের মতাে ভালাে খাওয়াবে? 

“না রে, কিছু কথা আছে। ‘বুঝতে পারছি, তুমি কী বলবে।’ ‘বল ত? ‘তুমি কিটকির কথা কিছু বলবে, তাই না? 

‘না। কিটকির কথা নয়। আচ্ছা রুনু ধর–তাের বিয়েটা যদি ভেঙে যায় কোনাে কারণে? মনে কর বিয়েটা হল না। 

এসব বলছ কেন দাদা, কী হয়েছে? ‘তুই সবুজ নামে কোনাে ছেলেকে চিঠি লিখেছিলি? রুনু বড়াে বড়াে চোখে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে 

বলল, ‘হ্যাঁ, লিখেছিলাম। তার জন্য কিছু হয়েছে? 

‘হ্যাঁ, মনসুর তােকে বিয়ে করতে চাইছে না। ‘কী বলে সে?’ 

সে বুনুকে বিয়ে করতে রাজি। রুনু চেষ্টা করল খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে। কিন্তু মানুষের মন ভেঙে গেলে সে আর যাই পারুক, স্বাভাবিক হতে পারে না। খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে রুনু সিনেমার কথা তুলল, কোন বন্ধু এক কবিকে বিয়ে করে রােজ রাতে। এক গাদা আধুনিক কবিতা শুনছে, সেকথা খুব হেসে হেসে বলতে চেষ্ট করল, ঝুনু কেন যে এত মােটা হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল। এবং এক সময় ‘খাবারটা এত ঝাল’ বলে রুমাল বের করে চোখ মুছতে লাগল। আমি চুপ করে বসে রইলাম। রুনু ধরা গলায় বলল, ‘দাদা, তুমি মন খারাপ করাে না। তােমার মন খারাপ দেখলে আমি সত্যি কেদে ফেলব। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি বললাম, কোথাও বেড়াতে যাবি রুনু? 

কোথায়? ‘সীতাকুন্ড যাবি? চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে দূরের সমুদ্র খুব সুন্দর দেখা যায়। রুনু কাতর গলায় বলল, ‘যাব দাদা, কবে নিয়ে যাবে? ‘চল, কালই যাই। ‘না, ঝুনুর বিয়ের পর চল।। ‘ঝুনুর সঙ্গে এই ছেলের বিয়ে আমি হতে দেব না। ‘তুমি বুঝতে পারছ না দাদা– ‘খুব বুঝছি। ‘বিয়ে হলে ঝুনু খুশি হবে। ‘হােক খুশি, এই নিয়ে আমি আর কোনাে কিছু বলতে চাই না রুনু। 

রুনুকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। তখন সন্ধ্যা উৎরে গেছে। রাতের নিয়ন আলাে জ্বলে গেছে দোকানপাটে। ঝকঝক করছে আলাে। রুনু খুব ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে লাগল। আমি তাকে কী আর বলি। 

বারােই আশ্বিন ঝুনুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল মনসুরের। 

বাবা আর রাবেয়ার প্রবল মতের সামনে টিকতে পারলাম না। বনু বেশ অবাক হয়েছিল। তাকে কিছু বলা হয় নি, তবে সে যে আচ করতে পেরেছে—তা বােঝা যাচ্ছিল। ঝুনু যতটা আপত্তি করবে মনে করেছিলাম, ততটা করে নি দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। আত্মীয়স্বজনরা কী বুঝল কে জানে, বিশেষ উচ্চবাচ্য করল না। শুধু মন্টু বিয়ের আগের দিন বাসা ছেড়ে চলে গেল। তার নাকি কোথায় যাওয়া অত্যন্ত প্রয়ােজন, বিয়ের পর ফিরবে। বাবা স্থবির আলস্যে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানতে লাগলেন। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

বিয়েতে রুনুটা আহ্লাদ করল সবচেয়ে বেশি। গান গেয়ে গল্প বলে আসর জমিয়ে রাখল। তার জন্যে ফুফুর ফাজিল মেয়েটা পর্যন্ত ঢং করার সুযােগ পেল না। আসর ভাঙল অনেক রাতে। ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েরা আড়ি পেতেছে বাসরঘরে। বরযাত্রীরা হৈচৈ করে করে তাস খেলছে। সারা দিনের পরিশ্রমে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে রুনুর ঘরে এসে দাঁড়ালাম। টেবিল ল্যাম্পে শেড দিয়ে রেখেছে। ঘরে আড়াআড়িভাবে একটা লম্বা ছায়া পড়েছে। আমার। রুনুর মুখ দেখা যাচ্ছে না। এলােমেলাে হয়ে পড়ে থাকা তার অবসন্ন শরীর চুপচাপ পড়ে আছে। আমি নিঃশব্দে বসলাম রুনুর পাশে। রুনু চমকে উঠে বলল, ‘কে? ও, দাদা। কখন এসেছ? কী হয়েছে? 

‘না, কিছু হয় নি। ভাবলাম তাের সঙ্গে একটু গল্প করি।’ 

রুনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ করেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগল, তােমার গা ছুঁয়ে বলছি দাদা, আমার একটুও খারাপ লাগছে না। আমি বেশ আছি।’ 

‘সবুজকে বিয়ে করবি রুনু? ‘না। ছিঃ !’ 

না কেন?’ ‘না-কক্ষনাে না, ওটা একটা বদমাশ।’ 

তবে যে চিঠি লিখেছিলি? এমনি, তামাসা করতে, ও যে লিখত খালি খালি। ‘আয় রুন, বাইরে হাঁটি একটু, দেখ কি জোছন।’ 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

রুনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যি অপরূপ জোছনায় সব যেন ভেসে যাচ্ছে। চারদিক চিকচিক করছে নরম আলােয়। আপনাতেই মনের ভেতর একটা বিষন্নতা জমা হয়। আমি বললাম, ‘এটা কী মাস বল তাে রুনু। 

‘অক্টোবর মাস। ‘বাংলা বল।’ ‘বাংলাটা জানি না। ফাল্গুন? 

‘না, আশ্বিন। আশ্বিন মাসে সবচেয়ে সুন্দর জোছনা হয়। আয়, বাইরে গিয়ে দেখি।’ 

ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই মন জুড়িয়ে গেল। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। ফুটফুটে জোছনা চারদিকে। সব কেমন যেন স্বপ্নের মতাে মনে হয়। বড়াে ভালাে লাগে। | ‘ওটা কে দাদা? ঐ যে চেয়ারে বসে? 

তাকিয়ে দেখি কে যেন ইজিচেয়ারে মূর্তির মতাে বসে আছে। একটা হাত অবসন্নভাবে ঝুলছে। অন্য হাতটি বুকের উপর রাখা। বসে থাকার সমস্ত ভঙ্গিটাই কেমন দীন-হীন, কেমন দুঃখী। আমি বললাম, ও হচ্ছে রাবেয়া। চিনতে পারছিস 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *