শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

নিনুটার কাণ্ড দেখেশুনে অবাক হয়েছি। সেদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?

শঙ্খনীল কারাগারছেলেরা এক প্রফেসরকে মেরে ফেলেছে। আপামনি বলেছে ক্লাসে।’ 

‘তাতে তাের কী হয়েছে? 

‘দাদাকে যদি মেরে ফেলে, সেও তাে প্রফেসর।’ 

শুনে আমি হেসে বাঁচি না। ওর যত টান দাদার জন্যে। 

হতাশা আর বিষন্নতায় যখন সম্পূর্ণ ডুবেছি, তখনি কিটকির চিঠি পেলাম। ‘দেশে ফিরছি কবে বলতে পারছি না। প্লেনের টিকিট পেলেই। বদলে গেছিস কিটকি। ‘লম্বা হয়েছি, না? ‘হু, আর রােগাও হয়েছিস। ‘আপনিও বদলেছেন, কি বিশ্রী গোঁফ রেখেছেন। ‘বিশ্রী ? ‘হা, বিশ্রী আর জঘন্য, দেখলেই সুড়সুড়ি লাগে। ‘ম্যানিলার কথা বলা। ‘সে তত চিঠিতেই বলেছি। ‘মুখে শুনি। 

রাবেয়া ট্রেতে চা সাজিয়ে আনল। কিটকি হাসতে হাসতে বলল, ‘রাবেয়া আপা আগের মতােই আছেন। 

না রে, স্বাস্থ্য ভালাে হয়েছে, এই দেখ হাতে কত জোর।’ ‘উহু, উহু, আমার ঘাড় ভেঙে ফেলেছেন। বােন ফ্রাকচার হয়েছে নির্ঘাৎ। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

বােন ফ্রাকচার হয় নি, হার্ট জখম হয়েছে কিনা বল। রাবেয়া হাসতে হাসতে চলে গেল। কিটকি বলল, ‘রুনুর কথা বলেন। ‘না, রুনুর কথা থাক। ‘মন্টুর নাকি একটা কবিতার বই বেরিয়েছে? ‘হ্যা, কিছু কিংশুক’ নাম। তােমাকে নিশ্চয়ই দেবে এক কপি। ‘কেমন হয়েছে? ‘আমি কবিতার কী বুঝি, তবে সবাই ভালাে বলেছে। 

আপনার প্রফেসরির কী খবর? 

খবর নেই কোনাে। বেতন বেড়েছে। ব্যাঙ্কে কিছু জমেছে। খরচ-পত্তর তাে বিশেষ তেমন কিছু নেই।’ 

রাবেয়া আপা শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলেন না? না।’ 

রাবেয়া করতে চাইল না, বাবা খুব চেষ্টা করেছিলেন। কিটকি অনেকক্ষণ থাকল বাসায়। দুপুরে আমাদের সঙ্গে ভাত খেল। বিকেলে চা খেয়ে চলে গেল। কিটকিকে অন্যরকম লাগছিল। ছেলেমানুষী যা ছিল ধুয়ে মুছে গেছে। ভারি সুন্দর হয়েছে দেখতে। চোখ ফেরান যায় না, এমন। 

| সারা সন্ধ্যা কিটকির কথা ভাবলাম। ছােটবেলা কিটকি আমার জন্যে এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করত। এখনাে করে কিনা কে জানে! তাকে সরাসরি কিছু বলার মতাে সাহস আমার নেই, কিন্তু বড়ড়া জানতে ইচ্ছে করে। রাত দশটার দিকে রাবেয়া আমার ঘরে এল। ‘কি রে, জেগে আছিস? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

রাবেয়া চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে খাটে বসল। চিরুনি কামড়ে ধরে বেণী পাকাতে লাগল। 

‘খুব লম্বা চুল তাে তাের। ‘ই একটা বেণী কেটে নিয়ে যে কেউ ফাঁস নিতে পারবে।’ ‘প্রেমের ফাঁস, বল। ‘কিটকিকে দেখে খুব রস হয়েছে, না? মন পেয়েছিস কিটকির? ‘রমণীর মন সহস্র বৎসরেরও সখা সাধনার ধন। 

তাের সাধনাই-বা কম কি? পাঁচ বছর অনেক লম্বা সময়। 

রাবেয়া চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। তার পর বলল, ‘খােকা তোের কাছে একটা কাজে এসেছি।’ 

কি কাজ? ‘আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দে, কিছু পড়াশােনা করি।’ 

এত দিন পর হঠাৎ? ‘এমনি ইচ্ছে হল। আর একটা মাষ্টার রেখে দিস, কিছু তাে ছাই মনেও নেই ‘আচ্ছা দেব। আবার ছেড়ে দিবি না তাে? ‘না, ছাড়ব না।’ 

ঝুনুর ছেলে হবে। যাতে কেউ গিয়ে তাকে নিয়ে আসে, সে জন্যে সে সবার কাছে চিঠি লিখেছে। তারা আসতে দেবে কিনা কে জানে! মােটেই ভালাে ব্যবহার করছে 

তারা। রুনু মারা যাবার পরও আসতে দেয় নি। তবু বাবা যাচ্ছেন আনতে। সঙ্গে রাবেয়াও যাবে। যদি ঝুনু আসে, তবে বেশ হয়। অনেক দিন দেখি না ওকে। খুব দেখতে ইচ্ছে করে।। 

রাবেয়া কলেজে ভর্তি হয়েছে। উৎসাহ নিয়ে রাত জেগে পড়ে। ছুটির দিনগুলি ছাড়া তাকে পাওয়াই যায় না। রােববারে ফুর্তি হয় এই কারণেই। সবাই রােববারের জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করি। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

মন্টু এক দৈনিক পত্রিকা-অফিসের সহ-সম্পাদক হয়েছে। বেশ ভালাে বেতন। বি. এ. টাও পাশ করে নি, কিন্তু বেশ গুছিয়ে ফেলেছে। অবাক হওয়ারই কথা। তার দ্বিতীয় বই ‘শুধু ভালােবাসা’ সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছে। মন্টু এখন নামী ব্যক্তি। অনেকেই তার কাছে আসে। মন্টু তাে বাসাতে থাকে কমই, বাবা গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। এ ব্যাপারে বাবার উৎসাহ প্রায় সীমাহীন। কোন পত্রিকায় কী লিখল, তা তিনি অসীম ধৈর্য নিয়ে খোঁজ রাখেন। সযত্নে পেপার-কাটিং জমিয়ে রাখেন। মন্টুর কাছেই শুনেছি, এক দিন বাবা নাকি কোন বই-এর দোকানে ঢুকে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনার এখানে “কিছু কিংশুক” কবিতার বইটি আছে? 

দোকানী জবাব দিয়েছে, ‘না নেই। ‘তাহলে “শুধু ভালােবাসা” বইটি আছে? ‘না, সেটাও নেই।’ 

বাবা রেগে গিয়ে বলেছেন, ভালাে ভালাে বই-ই নেই, আপনারা কেমন। দোকানদার ? 

মন্টুর সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলাপ করতেও তার খুব উৎসাহ। মন্টু এ ব্যাপারে অত্যন্ত লাজুক বলেই তিনি সুযােগ পান না। 

সত্য-মিথ্যা জানি না, শুনেছি বাবা ওভারশীয়ার কাকুর বড়াে ছেলের বউকে প্রায়ই মন্টুর কবিতা আবৃত্তি করে শােনান। এই মেয়েটিকে বাবা খুব পছন্দ করেন। মেয়েটির চেহারা অনেকটা রুনুর মতাে। পেছন থেকে দেখলে রুনু বলে ভ্রম হয়। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

নিনুও অনেক বড়াে হয়েছে। সেদিন তাকে নিয়ে রাস্তায় বেরােতেই দু’টি ছেলে শিস দিল। নিনুকে বললাম, ‘নিনু কোনাে বদ ছেলে তােমাকে চিঠি-ফিঠি লিখলে না পড়ে আমাকে দিয়ে দেবে, আচ্ছা?’ নিনু লজ্জায় লাল হয়ে ঘাড় নেড়েছে। 

 সেদিন রবিবার। সবার বাসায় থাকার কথা, কিন্তু বাসায় নেই কেউ। বাবা আর রাবেয়া গেছে ঝুনুকে আনতে, মন্টু তার পত্রিকা-অফিসে। পত্রিকা-অফিসের কাজ নাকি পুলিশের কাজের মতাে। ছুটির কোনাে হাঙ্গামাই নেই। বাসায় আমি আর নি। আমি ভেতরে বসে কাগজ পড়ছি, নিনু বলল, ‘দাদা, এক জন ভদ্রলােক এসেছেন। 

‘কী রকম ভদ্রলােক? ‘বুড়াে। চোখে চশমা। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *