‘বুড়াে। চোখে চশমা।
‘ওভারশীয়ার চাচার ছেলের বউ বলছিল, হাসপাতালে নাকি ছেলেমেয়েদের নম্বর দিয়ে সব এক জায়গায় রাখে। নম্বরের গণ্ডগােল হলেই এক জনের দেলে সারেক জনের কাছে যায়।
হেসে ফেললাম আমি। বললাম, ‘এই দুশ্চিন্তাতেই মরছিস? পাগল আর কি! না দাদা, সত্যি। ওর এক বন্ধুর নাকি টুকটুকে ফর্সা এক ছেলে হয়েছিল
রিলিজের সময় যে-ছেলে এনে দিল, সেটি নিগ্রোর চেয়েও কালাে।
‘হাসপাতালে যেতে না চাস, বাসায় ব্যবস্থা করা যাবে। তবে এগুলাে খুব বাজে কথা ঝুনু। | দু জনেই চুপচাপ থাকি। বুঝতে পারছি, ঝুনুর ছেলের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজেই জিজ্ঞেস করি, ‘ছেলে হলে কী নাম রাখবি, ঝুনু?
‘যাও।” ‘বল শুনি, একটা তাে ভেবেছিস মনে মনে। ‘আমি যেটা ভেবেছি, সেটা খুব বাজে–পুরনাে। ‘কী সেটি ?
‘বল না, শুনি কেমন নাম। ‘কিংশুক।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
এই বুঝি তাের পুরনাে নাম?’ “যাও দাদা, শুধু ঠাট্টা। ‘মেয়ে হলে কী রাখবি?”
মেয়ে হলে রাখব রাখী।’ ‘চমৎকার!
রাখী নামে আমার এক বন্ধু ছিল। এত ভালাে মেয়ে। এখন ডাক্তার। আমিও আমার মেয়েকে ডাক্তারি পড়াব দাদা।
‘আমার অসুখবিসুখ হলে আর চিন্তাই নেই। ভাগ্নীকে খবর দিলেই হল।’
আচ্ছা দাদা, ইরিত্রা নামটা তােমার কেমন লাগে? ‘নতুন ধরনের নাম। আধুনিক।
মন্টু বলছে ইরিত্রা রাখতে, দু’টি নামই আমার ভালাে লাগে। কী করব বল তাে দাদা।
‘দু নম্বর মেয়ের নাম ইরিত্রা রাখ।
না, দু নম্বর মেয়ের নাম রাখব রুনু।
হ্যাঁ। তাহলে রুনুর মতাে লক্ষ্মী মেয়ে হবে। একটুক্ষণ থেমে ঝুনু কাতর গলায় বলল, ‘রুনুর কথা বড়াে মনে হয় দাদা। ওকে বড়াে দেখতে ইচ্ছে করে।
রুনুকে আমারাে বড়াে দেখতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে রুনুর ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকি। পাতলা ঠোঁট চেপে হাসির ভঙ্গিমায় তােলা ছবি। বড়াে বড়াে চোখ। বাচ্চা ছেলেদের চোখের মতাে দৃষ্টি। সব মিলিয়ে কেন যেন ভারি করুণ মনে হয়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুকের ভিতর ব্যথা বােধ হয়।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
মায়ের গানের রেকর্ডটা একটা লােক এসে দিয়ে গেল। খুব যত্ন করে কাগঞেt মােড়া। রেকর্ডের লেবেলে মায়ের নাম ‘মিস শিরিন সুলতানা খুব অস্পষ্টভাবে পড়। যায়। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের ছবিটার উপর আবার লাল কালিতে কাঁচা হাতে ইংরেজিতে মায়ের নাম লেখা। হয়তাে তিনিই লিখেছিলেন।
বাসায় একটা সাড়া পড়ে গেল। ঝুনু তার ছেলে কোলে নিয়ে পুরনাে দিনের মতােই লাফাতে লাগল। বাজিয়ে শােনার মতাে গ্রামােফোন নেই দেখে শুধু কাঁদতে বাকি রাখল।
মন্টু রেকর্ড-প্লেয়ার আনতে বেরিয়ে গেল তখনি। রাবেয়া কলেজে। সেখানে কী একটা ফাংশন নাকি। মন্টু তাকেও খবর দিয়ে যাবে। বাবাকে দেখে মনে হল, তিনি আমাদের এই হৈচৈ দেখে একটু লজ্জা পাচ্ছেন। নিনুও এতটা উৎসাহের কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বাবাকে বললাম, আজ একটা উৎসবের মতাে করা যাক বাবা। খুব ঘরােয়াভাবে সন্ধ্যার পর মায়ের কথা আলােচনা হবে। তারপর ঘুমুতে যাবার আগে রেকর্ড বাজান হবে।’ বাবা সংকুচিত ভাবে বললেন, ‘এ-সবের চেয়ে তাে মিলাদটিলাদ”। ঝুনু সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে বলল, সে পরে হবে, আজ দাদা যা বলছে তাই হােক।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
বাবা জুতাে পরে ফুল আনতে চলে গেলেন। ফুলের মালায় মায়ের ছবি সাজান হবে। ঝুনু বলল, ‘বাবা, একটু ধূপ এনাে। না পেলে আগরবাতি। | আমি রেকর্ডটা লুকিয়ে ফেললাম, যাতে আগেভাগে কেউ শুনে ফেলতে না পারে। কিটকিকে টেলিফোন করলাম পাশের বাসা থেকে।
‘হ্যালাে কিটকি। আমি–
বুঝতে পারছি আপনি কে। কি ব্যাপার ? ‘খালাকে নিয়ে আয় না বাসায় এক বার। ‘কী ব্যাপার? ‘এসেই শুনবি। ‘আহা বলেন না?
একটা ছােটখাট ঘরােয়া উৎসব। কিসের উৎসব? ‘আসলেই দেখবি। ‘বলেন না ছাই!
‘মায়ের গাওয়া রেকর্ডটা বাজান হবে। তাছাড়া তাঁর স্মৃতিতে একটা ঘরােয়া আলােচনা। এই আর কি!’
‘বাহ্, সুন্দর আইডিয়া তাে। আমি আসছি।
‘আচ্চা কিটকি, মায়ের সঙ্গে তােলা খালার কোনাে ছবি আছে?’
দেখতে হবে।’ ‘যদি পাস তাে– ‘হ্যাঁ নিয়ে আসব। কখন আসতে বলছেন?’ ‘রাত আটটায়।’
সন্ধ্যাবেলা রাবেয়া রিক্সা থেকে পাংশু মুখে নামল। ভীত গলায় বলল, বাসায় কিছু হয়েছে?
‘না, কী হবে?
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আরে মন্টটা এমন গাধা, কলেজে আমার কাছে স্লিপ পাঠিয়েছে, বাসায় এসাে, খুব জরুরী। আমি তাে ভয়ে মরি। না জানি কার কি হল!’
‘না, কী আর হবে। মায়ের রেকর্ডটা দিয়ে গেছে। ‘তাই নাকি, বলবি তাে।’
বাবা দামী দু’টি জরির মালা নিয়ে এলেন। ফুলের মালা পেলাম না রে, অনেক খুঁজেছি।’ মালা দু’টি অনেক বড়াে হল! ফটোতে দিতেই ফটো ছাড়িয়ে নিচে অব্দি ঝুলতে লাগল।
বসার ঘরটা সুন্দর করে সাজান হল। চেয়ার-টেবিল সরিয়ে মেঝেতে বিছানা করা হল। ধূপ পােড়ান হল। স্মৃতি হিসেবে মায়ের পার্কার কলমটা রাখা হল। এটি ছাড়া তাঁর স্মৃতিবিজড়িত আর কিছুই ছিল না বাসায়।
ঠিক আটটায় কিটকি এল। সঙ্গে খালাও এসেছেন। বেশ কতগুলি ছবিও এনেছে কিটকি।।
উৎসবটা কিন্তু যেমন হবে ভেবেছিলাম, তার কিছুই হল না। খালার সঙ্গে ভােলা মায়ের ছােটবেলাকার ছবিগুলি দেখলাম সবাই।
মার কথা কিছু বলবার জন্যে অনুরােধ করতেই খালা তাঁর নিজের কথাই বলতে লাগলেন। ছােটবেলায় কেমন নাচতে পারতেন, কেমন অভিনয় করতে পারতেন। তাঁর করা ‘ইন্দ্রাণী’র পার্ট দেখে কোন ডাইরেক্টর তাঁকে ছবিতে নামার জন্যে ঝােলাঝুলি করেছিল–এই জাতীয় গল্প। খারাপ লাগছিল খুব। খালার থামার নাম নেই। শেষটায় কিটকি বলল, আপনি একটু রেস্ট নিন মা, আমরা খালুজানের কথা শুনি।’
বাবা থতমত খেয়ে বললেন, ‘না-না, আমি কী বলব? আমি কী বলব? তােমরা বল মা, আমি শুনি।
‘না খালুজান, আপনাকে বলতেই হবে। আমরা ছাড়ব না।’
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
বাবা বিব্রত হয়ে বললেন, ‘তােমাদের মা খুব বড়ঘরের মেয়ে ছিল। আমাকে সে নিজে ইচ্ছে করেই বিয়ে করেছিল। তখন তার খুব দুর্দিন। আমি খুব সাহস করে তাকে বললাম আমাকে বিয়ে করতে। হ্যাঁ, আমি তাকে খুব পছন্দ করতাম। সে খুব অবাক হয়েছিল আমার কথা শুনে। কিন্তু রাজি হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। না, আমি ৩; কোনাে অযত্ন করি নি। হ্যাঁ, আমার মনে হয় সে শেষ পর্যন্ত খুশিই হয়েছিল। ২-“, কী আর জানি আমি। তােমরা বরং গানটা শােন। চোখে আবার কি পড়ল। কি মুশকিল।
বাবা চোখের সেই অদৃশ্য জিনিসটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মন্টু রেকর্ড চালিয়ে দিল। পুরনাে রেকর্ড, তবু খুব সুন্দর বাজছিল। আমরা উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। অল্পবয়সী কিশােরীর মিষ্টি সুরেলা গলা। ‘এই তাে এত পথ এত যে আলাে….’। অদুত লাগছিল। ভাবতেই পারছিলাম না, আমাদের মা গান গাইছেন। ফ্রক-পরা
স্ত্রীর মতাে একটি মেয়ে হারমােনিয়ামের সামনে বসে দুলে দুলে গান গাইছে, এমন একটি চিত্র চোখে ভাসতে লাগল।
বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর চোখের সেই অদৃশ্য বস্তুটি ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুকণা হয়ে ঝরে পড়ছে মেঝেতে।।