শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারাস্রোত। লােকজন চলাচল করছে না, লাইটপােস্টের বাতি নিভে আছে। অথচ দশ মিনিট আগেও যেখানে ছিলাম, সেখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই।

শঙ্খনীল কারাগারশুকনাে খটখট করছে চারদিক। কেমন অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি এসেছে, ঝুপ ঝুপ করে একটা ছােট্ট জায়গা ভিজিয়ে চলে গেছে। আর এতেই আশৈশব পরিচিত এ অঞ্চল কেমন ভৌতিক লাগছে। হাঁটতে গা ছমছম্‌ করে। 

রাত নটাও হয় নি, এর মধ্যেই রশীদের চায়ের স্টল বন্ধ হয়ে গেছে। মডার্ণ লওি ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। এক বার মনে হল হয়তাে আমার নিজের ঘড়িই বন্ধ হয়ে আছে। রাত বাড়ছে ঠিকই, টের পাচ্ছি না। কানের কাছে ঘড়ি ধরতেই ঘড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে মন্টুর গলা শােনা গেল। 

রাস্তার পাশে নাপিতের যে-সমস্ত ছােট ছােট টুলকাঠের বাক্স থাকে, তারই একটায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। আলাে ছিল না বলেই এতক্ষণ নজরে পড়ে নি। চমকে বললাম, ‘মন্টু কী হয়েছে রে? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

‘কিছু হয় নি। 

স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল হাতে নিয়ে মন্টু টুলবাক্স থেকে উঠে এল। কাদায় পানিতে মাখামাখি। ধরা গলায় বলল, ‘পা পিছলে পড়েছিলাম, স্যাণ্ডেলের ফিতে ছিড়ে গেছে। 

‘এত রাতে বাইরে কী করছিলি? ‘তােমার জন্যে বসে ছিলাম, এত দেরি করেছ কেন? 

বাসায় কিছু হয়েছে মন্টু? 

‘না, কিছু হয় নি। মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, বলেছে ভিক্ষে করে খেতে। 

মন্টু শার্টের লম্বা হাতায় চোখ মুছতে লাগল। ‘টুনুদের বাসায় ছিলাম, টুনুর মাষ্টার এসেছে। সে জন্যে এখানে বসে আছি। ‘কেউ নিতে আসে নি? 

‘রাবেয়া আপা এসে চার আনা পয়সা দিয়ে গিয়েছে, বলেছে তুমি আসলে তােমাকে নিয়ে বাসায় যেতে। 

মন্টু আমার হাত ধরল। দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে সন্ধ্যা থেকে বসে আছে বাইরে, এর ভেতর ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, বাতিটাতি নিভিয়ে লােকজন ঘুমিয়েও পড়েছে। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতরই বেশ খানিকটা নির্মমতা আছে। অথচ মাকে এ নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। বাবা রাত দশটার দিকে ঘরে ফিরে যখন সব শুনবেন, তখন তিনি আরাে চুপ হয়ে যাবেন। মুখ কালাে করে ঘুরে বেড়াবেন এবং একদিন ক্ষতিপূরণ হিসেবে চুপি চুপি হয়তাে একটি সিনেমাও দেখিয়ে আনবেন। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

“দাদা, রুনুকেও মা তালা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রাঙ্ক আছে যে ঘরটায় সেখানে। ‘রুনু কী করেছে? ‘আয়না ভেঙেছে। 

আর তুই কী করেছিলি? ‘আমি কিছু করি নি। 

ঝুনু বারান্দায় মােড়া পেতে চুপচাপ বসেছিল। আমাদের দেখে ধড়মড় করে উঠে 

দাঁড়াল।। 

“দাদা, এত দেরি করলে কেন? যা খারাপ লাগছে। “কী হয়েছে, ঝুনু?” ‘কত কি হয়েছে, তুমি রাবেয়া আপাকে জিজ্ঞেস কর।’ 

গলার শব্দ শুনে “বেয়া বেরিয়ে এল। চোখে ভয়ের ভাবভঙ্গি প্রকট হয়ে উঠেছে। চাপা গলায় বলল, ‘মার ব্যথা শুরু হয়েছে রে খােকা, বাবা তাে এখনাে আসল না, কী করি বল তাে? 

কখন থেকে? 

‘আধ ঘন্টাও হয় নি। মার কাছ থেকে চাবি এনে দরজা খুলে দেব রুনুর, সেই জন্যে গিয়েছি–দেখি এই অবস্থা। 

ভেতরের ঘরে পা দিতেই রুনু ডাকল, ‘ও দাদা, শুনে যাও। মার কী হয়েছে দাদা? 

‘কিছু হয় নি। ‘কাঁদছে কেন? ‘মার ছেলে হবে। ‘অ। দাদা তালাটা খুলে দাও, আমার ভয় লাগছে। 

একটু দাঁড়া, রাবেয়া চাবি নিয়ে আসছে। 

এখান থেকে মায়ের অস্পষ্ট কান্না শােনা যাচ্ছে। কিছু কিছু কান্না আছে, যা শুনলেই কষ্টটা সম্বন্ধে শুধু যে একটা ধারণাই হয় তাই নয়, ঠিক সেই পরিমাণ কষ্ট নিজেরও হতে থাকে। আমার সেই ধরনের কষ্ট হতে থাকল। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

রাবেয়া এসে রুনুর ঘরের তালা খুলে দিল। রাবেয়া বেচারি ভীষণ ভয় পেয়েছে। 

‘তুই এত দেরি করলি খােকা, এখন কী করি বল? ওভারশীয়ার কাকুর বউকে খবর দিয়েছি, তিনি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে আসছেন। তুই সবাইকে নিয়ে। খেতে আয়, শুধু ডালভাত। যা কাণ্ড সারা দিন ধরে, রাঁধব কখন? মার মেজাজ এত খারাপ আগে হয় নি। 

হড়বড় করে কথা শেষ করেই রাবেয়া রান্নাঘরে চলে গেল। কলঘরে যেতে হয় মার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে। চুপি চুপি পা ফেলে যাচ্ছি, মা তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, ‘খােকা। 

কি মা? ‘তাের বাবা এসেছে? 

‘আয় ভেতরে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” 

ব্যথাটা বােধহয় কমেছে। সহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মার মুখে বিন্দু বিন্দু। ঘাম আর ফ্যাকাশে ঠোট ছাড়া অসুস্থতার আর কোনাে লক্ষণ নেই। 

‘খােকা, মন্টু এসেছে? ‘এসেছে। 

আর রুনুর ঘর খুলে দিয়েছে রাবেয়া? ‘দিয়েছে।’ ‘যা, ওদের নিয়ে আয়। 

রুনু ঝুনু আর মন্টু জড়সড় হয়ে দাঁড়াল সামনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই মা বললেন, ‘কাঁদছ কেন রুনু? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

‘কাঁদছি না তাে।’ ‘বেশ, চোখ মুছে ফেল। ভাত খেয়েছ? 

‘যাও, ভাত খেয়ে ঘুমাও গিয়ে। মন্টু বলল, ‘মা, আমি বাবার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব? ‘না-না। ঘুমাও গিয়ে। রুনু মা, কাঁদছ কেন তুমি? ‘কাঁদছি না তাে।’ ‘আমার কিছু হয় নি, সবাই যাও, ঘুমিয়ে পড়। যাও, যাও। 

ঘর থেকে বেরিয়েই কেমন যেন খারাপ লাগতে লাগল আমার। আমাদের এই গরিব ঘর, বাবার অল্প মাইনের চাকরি। এর ভেল মা যেন সম্পূর্ণ বেমানান। 

বাবার সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হয় তিনি এখন ইতিহাসে এম. এ. পরীক্ষা দেবেন। আর বাবা তাঁদের বাড়িরই আশ্রিত। গ্রামের কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে চাকরি খুঁজতে এসেছেন শহরে। তাঁদের কী-যেন আত্মীয় হন। 

বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে ওঠেন দু জন। মার পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। কিছু দিন কোনাে এক স্কুলে মাষ্টারি করেছেন। সেটি ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্কে কী-একটা চাকরিও নেন। সে চাকরি ছেড়ে দেন আমার জন্মের পরপর। তারপর একে একে রুনু হল, ঝুনু হল, মন্টু হল–মা গুটিয়ে গেলেন নিজের মধ্যে। 

সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মা আমাদের গরিব ঘরে এসেছেন বলেই তাঁর সামান্য রূপের কিছু কিছু আমরা পেয়েছি। তার আশৈশব লালিত রুচির কিছুটা (ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হলেও) সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের মধ্যে। শুধু যার জন্যে ভূষিত হয়ে আছি, সেই ভালােবাসা পাই নি কেউ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *