শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ

কাজেই আমি বলি–সব মানুষই কবি। কেউ কেউ লিখতে পারে, কেউ পারে  তোের খুব বড়লােক হবার শখ ছিল, তাই না খােকা?শঙ্খনীল কারাগার ঠিক ধরেছি তাে? আমি তােকে বড়লােক করে দি, কেমন? রেজিষ্ট্রি করে একটা চেক পাঠাচ্ছি। দু-এক দিনের ভেতরে পেয়ে যাবি। কত টাকা আন্দাজ কর তাে? তুই যত ভাবছিস তারচে অনেক বেশি। চেক পেয়েই জানাবি। না রে, ঠাট্টা করছি না। আগের মতাে কি আর আছি? ঠাট্টা তামাশা একটুও পারি না এখন। টাকাটা আমি তােকে দিলাম খােকা।

আমার আর দেবার মতো কী আছে বল? তাের খুব ধনী হওয়ার শখ ছিল। সেই শখ মেটাতে পারছি বলে ভারি আনন্দ হচ্ছে। খুব যখন ছােট ছিলি, তখন এক বার ফুটবল কেনার শখ হল তাের। মার কাছে সাহস করে তাে কিছু চাইতি না। আমাকে এসে বললি কানে কানে। আমি টাকা পাব কোথায়?

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ

যা কষ্ট লাগল এখন পর্যন্ত বাচ্চা ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখলে বুক ব্যথায় টনটন করে। তাের নিশ্চয়ই মনে নেই সে-সব। সােনা ভাই আমার, এ টাকাটা সমস্তই তাের, যে ভাবে ইচ্ছে খরচ করিস। নিলু, রুনু, মন্টু আর বাবাকে ভাগ করে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু তাদেরকে দেওয়া আর তােকে দেওয়া একই–ভেবে দিই নি। কোথেকে পেয়েছি। তুই কি ভাবছিস আগে বল। 

 না রে, চুরি করি নি। আমাকে কেউ ভিক্ষেও দেয় নি। এ আমার নিজের টাকা। মার কথা সময় হলে তােকে বলব বলেছিলাম না? এখন বলছি, তাহলেই বুঝবি কী 

করে কী হয়েছে। বাবার সঙ্গে বিয়ের আগে তাঁর আবিদ হােসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তাঁদের একটি মেয়েও হয়েছিল। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কী জন্যে, তা তাের জানার দরকার নেই। বাবা মাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন পরপরই। বুঝতেই পারছিস আমি হচ্ছি সেই মেয়ে। খুব অবাক, না? আমার সেই বাবা ভদ্রলােক এত দিন ঢাকাতেই ছিলেন। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কিছুদিন হল বাইরে চলে গেছেন।

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ

যাবার আগে এই টাকাটা দিয়ে গেছেন আমাকে। সেই লােকটিও ভালাে ছিল রে। আসত প্রায়ই আমাদের বাসায়। দেখিস নি কোনাে দিন? নীল রঙের কোট পরত, গলায় টকটকে লালরঙা টাই। আমাকে ডাকত ‘ইমা’ বলে। গল্পের মতাে লাগে, না? 

এগার বছর বয়স থেকেই আমি জানি সব। কেমন লাগে তখন বল তাে? তােদের যিনি বাবা, আমি নিজে তাঁকে বাবা বলেই ভেবেছি, আর তিনি একটুও বুঝতে দেন নি কিছু। সেই যে একবার কলেজে আমাকে মা কালী ডাকল। গােরা সবাই দুঃখিত হলি! বাবা কী করলেন বল তাে? তিনি রাতের বেলা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন বারান্দায়। ইতস্তত করে বললেন, ‘ইয়ে মা, রাখ তাে এটা। 

‘কি বাবা?’ ‘না ইয়ে, একটা ক্রীম, খুব ভালাে, বিশ টাকা দাম! 

তাকিয়ে দেখি চ্যাপ্টা মুখের বােতল একটা। মুখের উপর লেখা Sevenday beauty programme. চোখে পানি এসে গেল আমার। সেই কৌটাটা এখনাে আছে আমার কাছে, ভারি মূল্যবান সেটি।

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ

যেন বাবা বিশ টাকায় এক কৌটা ভালােবাসা কিনে এনেছেন। জনে জন্মে এমন লােককেই বাবা হিসেবে পেতে চাই আমি। মানুষ তাে কখনাে খুব বেশি কিছু চায় না, আমি নিজেও চাই নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, না চাইতেই তাে অনেক পেয়েছি।

কিটকি ভুল করল। কী করবি বল? ভুলে যেতে বলি না। ভুলবি কেন? রুনুকে কি আমরা ভুলতে পারি, না ভােলা উচিত ? কিটকি ভারি ভালােমানুষ। মেয়েটি যেন সুখী হয়। এখনাে তাে তার বয়স হয় নি, বুঝতেও শেখে নি কিছু। কষ্ট লাগে ভেবে। 

মার কথা তাের মনে পড়ে খােকা? চেহারা মনে করতে পারিস? আমি কিন্তু পারি না। স্বপ্নেও দেখি না বহু দিন। খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। জানি, মার প্রতি তােদের সবার একটা অভিমান আছে। তােদের ধারণা, মা কাউকে ভালােবাসতে পারে নি। হয়তাে সত্যি, হয়তাে সত্যি নয়। ছােটখালা এক দিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘শিরিন, তুমি তােমার ছেলেমেয়েদের একটুও দেখতে পার না!” 

মা জবাবে হেসে বলেছেন, এদের এমন করে তৈরি করে দিচ্ছি, যাতে ভালােবাসার অভাবে কখনাে কষ্ট না পায়। 

মা বড় দুঃখী ছিল রে খােকা! মেয়েমানুষের দুঃখ তাে বলে বেড়াবার নয়, ঢেকে রাখবার, চিরদিন তিনি তাই রেখে গেছেন। তােরা জানতেও পারিস নি। এত 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *