‘তাহলে পাঁচ কাপ দি। বাবাকে এক কাপ, আমার নিজের দু কাপ। রাবেয়া চায়ের সরঞ্জাম সাজাতে লাগল। অভ্যস্ত নিপুণ হাত, দেখতে ভালাে লাগে। আমি বললাম, ‘মাসির বয়স কত রে ?
‘অনেক। আমি ছাড়া সবাই তাে তাঁর হাতে। দেখলে মনে হয় না, তাই না? ‘। মার ব্যথাটা একটু কম মনে হয়।
‘ছ’ বার মা এমন কষ্ট পেলেন! তােরা তাে সুখে আছিস, কষ্ট যা তা তাে মেয়েদেরই। পেটে ছেলে-মেয়ে আসা মানেই এক পা কবরে রাখা।
আমি বললাম, ‘কষ্টটা যদি পুরুষরাও পেত, তাহলে তুই খুশি হতি?
“জানি না।’
বলেই রাবেয়া হঠাৎ কী মনে করে হাসতে লাগল। হাসির উচ্ছ্বাসে পেয়ালার দুধ গেল উন্টে, আঁচল খসে পড়ল মেঝেয়।
অবাক হয়ে বললাম, ‘হাসির কী হয়েছে? এত হাসছিস কেন? ‘একটা গল্প মনে পড়ছে, তাই হাসছি।’
কী গল্প? ‘বাজে গল্প, তবে খুব মজার। শুনলে তুই নিজেও হাসবি। শুনবি? ‘বল।
একদল মেয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করল। তাদের বক্তব্য ছেলেমেয়ে হওয়ার ব্যথাটা শুধু মেয়েদেরই হবে কেন? এবার থেকে ছেলেদেরও হতে হবে, ব্যথার ভাগও সমান সমান। আল্লাহ্ বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর হল কি শােন। মেয়েদের এই দলটির যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর ব্যথা শুরু হল। কিন্তু কি আশ্চর্য স্বামী বেচারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনাে ব্যথা-ফ্যতা নেই। এদিকে তাদের গাড়ির ড্রাইভার ছুটির দরখাস্ত করেছে, তার নাকি হঠাৎ ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে পেটে।
তারপর?’
তারপর আবার কি? মেয়েরা বলল, আল্লাহ্ তােমার পায়ে পড়ি। ব্যথার ভাগাভাগি আর চাই না। আমাদের কষ্ট আমাদেরই থাক। তুই হাসলি না একটুও, আগে শুনেছিস নাকি?”
“তবে? ‘নােংরা গল্প, তাই হাসলাম না। ‘ওঃ।
রাবেয়া চায়ের পেয়ালা হাতে বেরিয়ে গেল। সে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে। চোখ লজ্জায় ভিজে উঠেছে। আমার খারাপ লাগতে লাগল। অন্য সময় হলে ঐ গল্পেই প্রচুর হাসতাম। আজ পারি নি। হয়তাে মায়ের কথা ভাবছিলাম বলে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি মন্টু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছে।
“কিরে মন্টু? ‘ঘুম আসছে না দাদা।
কেন? ‘রুনু ঝুনু ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার একা একা ভয় লাগছে। ‘কিসের ভয়?
রাবেয়া রান্নাঘরে ফিরে যাচ্ছিল, মন্টু ডাকল, ‘আপা, আমি চা খাব।’
‘এক ফোঁটা ছেলের রাত তিনটের সময় চা চাই। সিগারেটও লাগবে নাকি বাবুর? দিই বাবার কাছ থেকে এনে?’
‘আপা, ভালাে হবে না বলছি।
ও ঘর থেকে কাপ নিয়ে আয় একটা। দেখিস, ফেলে দিয়ে একাকার করিস ।
ভাের হয়ে আসছে, কাক ডাকছে। মুরগির ঘরে মুরগিগুলি সাড়াশব্দ দিচ্ছে, চাঁদের আলােও ফিকে হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাের হওয়া দেখছি। ভেতরের ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে এলেন, ভীত গলায় ডাকলেন, ‘খােকা।
‘তাের মাকে মনে হয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালাে। ‘কেন? হঠাৎ করে? ‘না, মানে সুহাসিনী বলল। এখন বয়স হয়েছে কিনা। তা ছাড়া— ‘তা ছাড়া কী?’ | ‘না, মানে কিছু নয়। আমার কেন যেন খারাপ লাগছে স্বপ্নটা দেখার পর। দেখলাম যেন আমি একটা ঘরে…’।
‘একটা ঘরে কী?
না না, রাতের বেলায় স্বপ্ন বলে নাকি কেউ।
বাবা থতমত খেয়ে চুপ করলেন। মায়ের সেই ভয়-ধরান চিল্কার আর শােনা যাচ্ছে না। কোথা থেকে দু’টি বেড়াল এসে ঝগড়া করছে। অবিকল শিশুদের কান্নার আওয়াজ। বাবা বললেন, ‘খােকা আমি হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিই।’
‘আপনার যেতে হবে না, আমি যাই। বরঞ্চ পাশের বাড়ি থেকে ফোন করে দিই। * না-না, ফোন করলে কাজ হবে না। আসতে দেরি করবে, বাসা চিনবে
–অনেক ঝামেলা। তুই থাক। | বাবা চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এত রাতে রিক্সাটিক্সা কিছু পাওয়া যাবে না, হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। আমি ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম। যে। শিশুটি জন্মাবে, সে এত আয়ােজন, এত প্রতীক্ষা ও যন্ত্রণার কিছুই জানছে না’, এই জাতীয় চিন্তা হতে লাগল। অন্ধকার মাতৃগর্ভের কোনাে স্মৃতি কারাের মনে থাকে না। যদি থাকত, তবে কেমন হত সে-স্মৃতি কে জানে! জন্মের সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো নােংরা।
রাবেয়া এসে দাঁড়াল আমার কাছে। নিচু গলায় বলল, ‘খােকা, বাবা কি হাসপাতালে গেছেন?
‘বাবা খুব ভয় পেয়েছেন, নারে ?
‘হু, পেয়েছেন। ‘আমারাে ভয় লাগছে খােকা। ‘ভয় কিসের? ‘আমি কিছুতেই বিয়ে করব না, দেখিস তুই। মাগাে কী কষ্ট। ‘মায়ের কাছে গিয়েছিলি রাবেয়া? ‘হ্যাঁ। ‘মা কী করছে? ‘চিৎকার করছেন না। চিৎকার করার শক্তি নেই। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ‘কী বাজে ব্যাপার!
‘মাসি কী করছে?
‘ঘুমাচ্ছে। বাজনার মতাে নাক ডাকছে। মেয়েমানুষের নাক ডাকা কী বিশ্রী। বাঁশির সরু আওয়াজের মতাে তালে তালে বাজছে। ঘেন্না লাগে।’
মসজিদ থেকে ফজরের আজান হল, ভাের হয়ে আসছে। অ্যাম্বুলেন্স এল, ছ’টার দিকে। ড্রাইভারটা মুশকো জোয়ান। সঙ্গের হেল্পার দু’টিরও গুণ্ডার মতাে চেহারা। হৈচৈ করে স্ট্রেচার বের করল তারা। সাত-সকালেই অনেক লােকজন। জড়াে হয়ে গেল। পাড়ার মেয়েদের প্রায় সবাই এসেছে। উকিল সাহেবের বউ আমাকে ইশারায় ডাকলেন, ‘খােকা, তাের মার অবস্থা নাকি খুব খারাপ? হেড ক্লার্কের বউ বললেন।
‘না, তেমন কিছু নয়।