শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

দেখে আসুন না গিয়ে। 

‘এই যাচ্ছি বলে তিনি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। হেড ক্লার্কের বউও এসেছেন, তাঁর সঙ্গে একটি সুন্দর মতাে মেয়ে। শঙ্খনীল কারাগারকমবয়সী কয়েক জন ছেলেমেয়ে দেখি হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মন্টু ভীষণ ভয় পেয়েছে, আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে সে যে কাঁপছে, তা বুঝতে পারছি। রুনু আর ঝুনুকে দেখছি না। রাবেয়া উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একা একা। 

মন্টু বলল, “দাদা, তােমাকে ডাকছে। ‘ওভারশীয়ার কাকু। 

মন্টুর হাত ধরে ওপাশে গেলাম। হয়তাে হাজারাে কথা জিজ্ঞেস করবেন। পুরুষ মানুষের মেয়েলি কৌতূহলে বড়াে খারাপ লাগে। ওভারশীয়ার কাকু খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। 

আমাকে দেখে বললেন, ‘খােকা, তােমাকে একটু ডাকছিলাম। 

কী জন্যে চাচা? 

‘না, মানে তেমন কিছু নয়, ঘুম থেকে উঠেই অ্যাম্বুলেন্স দেখে… মানে। ইয়ে… ধর তাে খােকা। মাসের শেষ, কতরকম দরকার হয়, লজ্জা করাে না সােনা, রাখ। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

কথা বলবার অবসর না দিয়ে চাচা সরে গেলেন। ঐদিকটায় হৈচৈ হচ্ছে। স্ট্রেচারে করে মাকে তুলছে গাড়িতে, ছুটে গেলাম। 

‘বাবা, সঙ্গে কে যাচ্ছে? ‘আমি আর তাের সুহাসিনী মাসি।’ রাবেয়াকে নিয়ে যান। 

না না, ও ছেলেমানুষ। খােকা, তাের ছােটখালাকে খবর দিস। | গাড়ি স্টার্ট নিতেই বাবা আবার ডাকলেন, খােকা, ও খােকা, তাের মা ডাকছে, আয় একটু। 

গাড়ির ভেতর আবছা অন্ধকার। গলা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে মা পড়ে আছেন। সারা শরীর কেঁপে উঠছে এক-এক বার। মা নরম স্বরে বললেন, খােকা, আয় এদিকে। 

অস্পষ্ট আলােয় চোখে পড়ল যন্ত্রণায় তাঁর ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। অদ্ভুত ফর্সা মুখের অদৃশ্য নীল শিরা কালাে হয়ে ফুলে উঠছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সারা মুখে। 

‘মা, কী জন্যে ডেকেছেন? কী? 

মা কোনাে কথা বললেন না। বাবা বললেন, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে, খােকা তুই নেমে যা। 

‘আমিও সঙ্গে যাই বাবা?’ ‘না-না, তুই থাক। বাসায় ওরা একা। নেমে যা, নেমে যা। 

মাসি গলা বাড়িয়ে বললেন, ‘পানের কৌটা ফেলে এসেছি, কেউ আসে তাে সঙ্গে দিয়ে দিও।’ 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

গাড়ি ছেড়ে দিল। মন্টু গাড়ির পেছনে পেছনে বড়াে রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফিরে এল। রুনু-ঝুনুকে নিয়ে আমি বসে রইলাম বারান্দায়। জন্ম বড়াে বাজে ব্যাপার। মৃতার চেয়েও করুণ। 

বুকের উপর চেপে থাকা বিষন্নতা দেখতে দেখতে কেটে গেল। আবহাওয়া তরল হয়ে এল ঘন্টাখানেকের মধ্যে। ছােট খালা এলেন নয়টায় তাঁর মস্ত কালাে রঙের গাড়িতে করে, সঙ্গে মেয়ে কিটকি। রাবেয়া ঢাউস এক কেটলি চায়ের পানি চড়িয়ে দিল। রুনু ঝুনু স্কুলে যেতে হবে না শুনে আনন্দে লাফাতে লাগল। 

 সারা রাত নিঘুম থাকায় মাথা ব্যথা করছিল। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ইউনিভার্সিটিতে এক দফা যেতে হবে। স্যার কাল খোঁজ করেছিলেন, পান নি। আতিক কি জন্যে যেন তার বাসায় যেতে বলেছে। খুব নাকি জরুরী। চার্লি চ্যাপলিনের ‘দি কিড’ ছবিটি চলছে গুলিস্তানে। আজ দেখব কাল দেখব করে দেখা ‘য় নি। দু’ দিনের ভেতর দেখতে হবে। সামনের হপ্তায় কী একটা বাজে ছবি যেন। 

‘কিরে খােকা, শুয়ে? 

মৃদু সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে খালা ঢুকলেন। খালার সঙ্গে মায়ের চেহারার খুব মিল। তবে খালা মােটাসােটা, মা ভীষণ রােগা। খালা পাশের চেয়ারে বসলেন, ‘জ্বর নাকি রে? 

‘জ্বি না, এই শুয়েছি একটু। ‘দেখি? খালা মাথায় হাত রাখলেন। ‘না, মােটেও জ্বর নেই। ডাক্তারের বউ হাফ-ডাক্তার হয় জান তাে? ‘জানি। জ্বরটর নয়, এমনি শুয়ে আছি।’ 

‘খারাপ লাগছে? তা তাে লাগবেই, বুড়াে বয়সে মায়েদের যদি মেটারনিটিতে যেতে হয়। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি চুপ করে রইলাম। দরজার আড়াল থেকে কিটকি উকি দিল। খালা ঢাকলেন, ‘আয় ভেতরে।’ 

টিকি লজ্জিতভাবে ঢুকল। যখন অন্য কেউ থাকে না তখন আমার সঙ্গে কিটকির ব্যবহার খুব সহজ ও আন্তরিক। বাইরের কেউ থাকলেই কিটকি সংকোচ ও লজ্জায় চোখ তুলে তাকায় না। শৈশবের একটি ছােট্ট ঘটনা থেকেই কিটকির এমন হয়েছে। 

সে তখন খুব ছােট, ছ’-সাত বৎসর বয়স হবে। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। বাসায়। রুনু-ঝুনুর সঙ্গে সারা দুপুর হৈচৈ করে খেলল। মা যখন সবাইকে খেতে ডাকলেন, তখন তার হঠাৎ কী খেয়াল হল কি জানি, মাকে গিয়ে বলল, ‘খালা, আমি আপনাকে একটা কথা বলব, কাউকে বলবেন না তাে?’ 

“না মা, বলব না।” ‘আল্লার কসম বলুন। ‘আল্লার কসম। 

তা হলে মাথা নিচু করুন, আমি কানে কানে বলি।’ 

মা মাথা নিচু করলেন এবং কিটকি ফিসফিস করে বলল, বড়াে হয়ে আমি খােকা ভাইকে বিয়ে করব। আপনি কাউকে বলবেন না তাে? 

 মা কিটকির কথা রাখেন নি। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে বলে দিয়েছেন। যদিও সুদূর শৈশবের ঘটনা, তবু স্থানে-অস্থানে এই প্রসঙ্গ তুলে বেচারিকে প্রচুর লজ্জা দেওয়া হয়। মা তাে কিটকির সঙ্গে দেখা হলে এক বার হলেও বলবেন, “আমার বউমেয়েকে কেউ দেখি যত্ন করছে না? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

কিটকি তার মায়ের পাশে বসল। সে আজ হলুদ রঙের কামিজ পরেছে, লম্বা বেণীতে মস্ত বড়াে বড়াে দু’টি হলুদ ফিতের ফুল। অল্প হাসল কিটকি। আমি 

বললাম, কি কিটকি, আজ কলেজ নেই ? 

‘আছে, যাব না।’ ‘কেন?’ ‘এমনি। কলেজ ভীষণ বােরিং। তা ছাড়া খালার অসুখ। 

থাকবি আজ সারা দিন? ‘হা। আজ রাতে আপনাকে ভূতের গল্প বলতে হবে।’ ‘ভূতের গল্প শুনে কাঁদবি না তাে আবার? ‘ইস, কাঁদব? ছােটবেলায় কবে কেদেছিলাম, এখনাে সেই কথা।’ ‘ছােটবেলা তাে তুই আরাে কত কি করেছিস।’ ‘ভালাে হবে না কিন্তু। 

বলতে বলতে কিটকি লজ্জায় মাথা নিচু করল। খালা বললেন, ‘আমি হাসপাতালে যাই থােকা। কিটকি, তুই যাবি আমার সঙ্গে? 

“না মা, আমি থাকি এখানে। 

খালা চলে যেতেই রাবেয়া চায়ের ট্রে হাতে ঢুকল। বেশ মেয়ে রাবেয়া। এর ভেতর সে গােসল সেরে নিয়ে চুল বেঁধেছে। রানা শেষ করেছে, এক দফা চা খাইয়ে আবার চা এনেছে। রাবেয়া হাসতে হাসতে বলল, কি কিটকি? না-না ভিটকি বেগম, এই ঘরে কী করছ? পূর্বরাগ নাকি? সিনেমার মতাে শুরু করলে যে?’ 

‘যান আপা, আপনি তো ভারি ইয়ে…মা ডাকলেন তাই।

বেশ বেশ, তা এমন গলদা চিংড়ির মতাে লাল হয়ে গেছ যে! গরমে না হৃদয়ের উত্তাপে? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

‘যান আপা, ভাল্লাগে না। ‘নিন, নিন, ভিটকি বেগম–চা নিন। ‘কি সব সময় ভিটকি ডাকেন, জঘন্য লাগে।’ ‘কিটকির কি কোনাে মানে আছে? তাই ভিটকি ডাকি। ‘যেন ভিটকির কত মানে আছে। 

‘আছেই ভাে। ভিটকি হচ্ছে ভেটকি মাছের স্ত্রীলিঙ্গ। অর্থাৎ তুই একটি গভীর জলের ভেটকি ফিশ, বুঝলি ? 

বেশ, আমি গভীর জলের মাছ। না, চা খাব না।’ 

কাঁদো কাঁদো মুখে উঠে দাঁড়াল কিটকি। কাউকে কিছু বলার অবসর না দিয়ে ঝড়ের মতাে বেরিয়ে গেল। রাবেয়া হেসে উঠল হাে হাে করে। বলল, বড়াে ভালাে মেয়ে। 

একটু অহংকার আছে, তবে মনটা ভালাে। “তাই নাকি?” 

‘হ্যাঁ, আমার ভীষণ ভালাে লাগে। আর আমার মনে হয় কি জানিস? 

কী মনে হয়? ‘মনে হয় মেয়েটির শৈশবে তাের দিকে যে টান ছিল, তা যে এখনাে আছে তাই নয়–চাঁদের কলার মতাে বাড়ছে। 

‘তাের যত বাজে কথা 

রাবেয়া বলল, মেয়েটির কথা ছেড়ে দিই, তাের যে যােল আনার উপর দু’ আনা, আঠারাে আনা টান তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। কান-টান লাল করে 

একেবারে টমেটো হয়ে গেছিস, আচ্ছা গাধা তাে তুই!’

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *