কিটকির কথা প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করি তখন। যেন সে এসে বসেছে আমার পাশে। আমি বলছি, ‘কি কিটকি, এত রাতে আমার ঘরে ভয় করে না?
‘কিসের ভয়, ভূতের? আমি বুঝি আগের মতাে ছেলেমানুষ আছি? ‘না, তুই কত বড়াে হয়েছিস, সবাই বড়াে হচ্ছি আমরা। ‘হ্যাঁ, দেখেছেন আমার চুল কত লম্বা হয়েছে ? তােকে বব চুলে এর চেয়ে ভালাে দেখাত। ‘সত্যি ? ‘কচি আছে আপনার কাছে?
কী করবি?
‘বব করে ফেলি আবার। রাতে এ জাতীয় অসংলগ্ন ভাবনা ভাবি বলেই হয়তাে কিটকিকে দিনের বেলায় দেখলে লজ্জা ও সংকোচ বােধ করি। যেন একটা অপরাধ করে ধরা পড়েছি। কিটকি অবশ্যি আগের মতোই আছে। হৈচৈ করার নেশাটা একটু বেড়েছে মনে হয়। রুনু-ঝুনুর সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে। প্রায়ই এদের দু’ জনকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়।
আমার নিজের স্বভাব-চরিত্রে বেশ পরিবর্তন এসেছে। যখন ছাত্র ছিলাম, রাত জেগে পড়তে হত, আর দু’ চোখে ভিড় করত রাজ্যের ঘুম। কষ্ট করে রাত জাগা। এখন ঘুমুবার অবসর আছে, কিন্তু চেপে ধরেছে ইনসমনিয়ায়। থানার ঘড়িতে বড়াে বড়াে ঘন্টা বেজে ছােটগুলিও বাজতে শুরু করে, ঘুম আসে না এক ফোঁটা।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
বিছানায় গড়াগড়ি করি। ভাের হয়। সকালের আলাে দু চোখে পড়তেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আটটা বাজার আগেই রুনু ঝাঁকায়, ‘দাদা ওঠ, চা জুড়িয়ে পানি হয়ে গেল।”
‘হােক, তােরা খা। শরীর খারাপ, আমি আরেকটু ঘুমুই।
রুনু চলে যেতেই রাবেয়া আসে। প্রবল ঝাঁকুনিতে চমকে উঠে শুনি, ‘তিন মিনিটের মধ্যে না উঠলে দিচ্ছি মাথায় পানি ঢেলে। এক-দুই-তিন-চার- এই দিলাম, এই দিলাম–
রাবেয়াকে বিশ্বাস নেই, উঠে পড়তে হয়। বারান্দায় মুখ ধুতে ধুতেই বাবা সকালের দীর্ঘ ভ্রমণ সেরে ফিরে আসেন। খুশি খুশি গলায় বলেন, ‘তুই বড়াে লেটরাইজার। স্বাস্থ্য খারাপ হয় এতে। দেখ না আমার স্বাস্থ্য আর তাের স্বাস্থ্য মিলিয়ে।
সত্যি চমৎকার স্বাস্থ্য বাবার। রিটায়ার করার পর আরাে ওজন বেড়েছে। আমি সপ্রশংস চোখে তাকাই বাবার দিকে। বাবা হেসে হেসে বলেন, ‘এত রােগা তুই! কলেজের ছেলেরা তাের কথা শােনে?”
‘তা শােনে। রাবেয়া রান্নাঘর থেকে চাচায়, না বাবা, মােটেই শােনে না।
বাবা খুব খুশি হন। অনেকক্ষণ ধরে আপন মনে হাসেন। বেশ বদলে গেছেন তিনি। বাবা ছিলেন নিরীহ, নির্লিপ্ত মানুষ। সকালে অফিসে যাওয়া, বিকেলে ফেরা। সন্ধ্যায় একটু তাস খেলতে যাওয়া, দশটা বাজতে-না-বাজতে ঘুমিয়ে পড়া। খুবই চুপচাপ স্বভাব। আমাদের কাউকে কোনাে কারণে সামান্য ধমক দিয়েছেন, এও পর্যন্ত মনে পড়ে না। সংসারে বাবার যেন কোনাে অস্তিত্ব নেই। আমাদের নিয়ে আর মাকে নিয়েই আমাদের সংসার। বাবার ভূমিকা নেপথ্য কোলাহলের।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
কেউ আমাদের দাওয়াত করতে এলে মাকেই বলত। বাড়িওয়ালা ভাড়া নিতে এসে বলত, ‘খােকা তােমার মাকে একটু ডাক তে। অথচ বাবা হয়তো বাইরে মােড়ায় বসে মন্টুকে অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছেন।
এখন বাবা ভীষণ বদলেছেন। সবার সঙ্গে প্রচুর উৎসাহ নিয়ে আলাপ চালান। সেদিন ওভারশীয়ার কাকুর সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়ে সারা দিন কাটিয়ে এসেছেন। খবরের কাগজ রাখেন দু’টি। প্রতিটি খবর খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েন। রাজনীতি নিয়েও আলােচনা চলে।
‘খােকা, তাের কী ধারণা? আওয়ামী লীগ পপুলারিটি হারাবে? ‘আমার? না, আমার কোনাে ধারণা নেই।’
‘ভালাে করে পেপার পড়া চাই, না পড়লে কি কিছু বােঝা যায়? রাজনীতি বুঝতে হলে চোখ-কান খােলা রাখা চাই, বুঝলি? কি, বিশ্বাস হল না, না?’ হবে না কেন?
‘বিশ্বাস যদি না হয়, কাগজ-কলম নিয়ে আয়, তিন বৎসর পর পার্টির কি অবস্থা হবে লিখে দিই। সীল করে রেখে দে। তিন বৎসর পর অক্ষরের সাথে অক্ষর মিলিয়ে দেখবি।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
বাবার রূপান্তর খুব আকস্মিক। আর আকস্মিক বলেই বড় চোখে পড়ে। প্রচুর মিথ্যে কথাও বলেন বানিয়ে বানিয়ে। সেদিন যেমন শুনলাম। ওভারশীয়ার কাকুর ছেলের বউয়ের সঙ্গে গল্প করছেন পাশের ঘরে। এ ঘর থেকে সমস্ত শােনা যাচ্ছে, কাউকে যেন বলাে না মা, গতকাল রাতে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে।
“কী ব্যাপার চাচাজান? | ‘অনেক রাত তখন। আমি বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আছি। হঠাৎ ফুলের গন্ধ পেলাম। বকুল ফুলের গন্ধ। অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার যােগাড়। দেখি কি, খােকার মা হাল্কা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে আমগাছটার নিচে।
বলেন কি চাচা!’ ‘হ্যাঁরে মা, মিনিট তিনেক দেখলাম। ‘রাত কত তখন? ‘বারােটার মতাে হবে।’
গল্পটি যে সম্পূর্ণই মিথ্যা, এতে কোনাে সন্দেহ নেই। গতরাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। সারা রাতই আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে কাটিয়েছি।
অথচ যে-বাবা কোনােদিন অপ্রয়ােজনে সত্য কথাটিও বলেন নি, তিনি কেন এমন অনর্গল মিথ্যা বলে চলেন, ভেবে পাই না।
রাবেয়া এক দিন বলছিল, ‘মা মারা যাবার পর বাবা খুব ফ্রী হয়েছেন।
তার মানে ? ‘মানে আর কি, মনে হয় বাবা মার সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেন নি। ‘তুই কী সব সময় বাজে বকিস?
আহা এমনি বললাম। কে বলেছে বিশ্বাস করতে?
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
বিশ্বাস না করলে অবশ্যি চলে, কিন্তু বিশ্বাস না করাই–বা যায় কী করে? কিন্তু মার মতাে মেয়ে তেইশ বছর কী করে মুখ বুজে এইখানে কাটিয়ে দিয়েছেন ভেবে পাই না। বাবা মার সঙ্গে হাস্যকর আচরণ করতেন। যেন মনিবের মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দেয়া প্রিয় খানসামা এক জন। ভালােবাসার বিয়ে হলে এ রকম হয় না।
সেখানে অসামঞ্জস্য হয়, অশান্তি আসে, কিন্তু মূল সুরটি কখনাে কেটে যায় না। অথচ যতদূর জানি ভালােবেসেই বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। কিছুটা খালা বলেছেন, কিছু বলেছেন বাবা, রাবেয়াও বলেছে কিছু কিছু {স হয়তাে শুনেছে মার কাছ থেকেই)। সব মিলিয়ে এ ধরনের চিত্র কল্পনা করা যায়।
শিরিন সুলতানা নামের উনিশ বছরের একটি মেয়ে সূর্য ওঠার আগে ছাদে বসে হারমােনিয়ামে গলা সাধত ঘড়ির কাঁটার মতাে নিয়মে। সাতটার দিকে গানের মাষ্টার শৈলেন পােদ্দার আসতেন গান শেখাতে। তিনি আধঘন্টা থাকতেন। এই সমস্ত সময়টা আজহার হােসেন নামের একটা গরিব আশ্রিত ছেলে কান পেতে অপেক্ষা করত। ছাদের চিলেকোঠার ঘরটায়, সেখানেই সে থাকত। এক দিন মেয়েটি কী একটি গান গাইল যেন, খুব ভালাে লাগল ছেলেটির।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
বেরিয়ে এসে কুষ্ঠিতভাবে বলল, “আরেক বার গান না। মাত্র এক বার।|শিরিন সুলতানা গান তাে গানই নি, ছাদের গান বন্ধ করে দিয়েছেন তার পর থেকে। লজ্জিত ছেলেটি অপরাধী মুখে আরাে দু বছর কাটিয়ে দিল চিলেকোঠার ঘরটায়। এই দু’ বছরে শিরিন সুলতানার সঙ্গে তার একটি কথাও হয় নি। শুধু দেখা গেল, দু’ জনে বিয়ে করে দেড় শ’ টাকা ভাড়ার একটা ঘুপচি ঘরে এসে উঠেছেন।
কী করে এটা সম্ভব হল, তা আমার কাছে একটি রহস্য। রাবেয়ার কাছে জানতে চাইলে সে বলত, আমি জানি, কিন্তু বলব না।
“কেন?”