শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

এমনি। কী করবি শুনে ? ‘জানতে ইচ্ছে হয় না? “বলব তােকে একদিন। সময় হােক। সেই সময়ও হয় নি। জানাও যায় নি কিছু। অথচ খুব জানতে ইচ্ছে করে। শঙ্খনীল কারাগারফাস্ট ইয়ারের ছেলেদের সঙ্গে দুপুর বারােটায় একটা ক্লাস ছিল। একটার দিকে শেষ হল। দুপুরে রিকশা পাওয়ার আশা কম। সব রিকশাওয়ালা একসঙ্গে খেতে যায় কি না কে জানে? অল্প হাঁটতেই ঘামে শার্ট ভিজে ওঠার যােগাড়। ভীষণ রােদ। রাস্তার পিচ গলে স্যাণ্ডেলের সঙ্গে আঠার মতাে এঁটে যাচ্ছিল। ছায়ায় দাড়িয়ে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করব কি না যখন ভাবছি, তখনি মেয়েলি গলা শােনা গেল, ‘খােকা ভাই, ও খােকা ভাই। 

তাকিয়ে দেখি কিটকি। সিনেমা হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাইকে সচ-৩ করে বেশ জোরেসােরেই ডাকছে। কানে পায়রার ডিমের মতাে দুটো লাল পাথর। চুলগুলাে লম্বা বেণী হয়ে পিঠে ঝুলছে। কামিজ সালােয়ার সবই কড়া হলদে-লাল নকশাকাটা। সুন্দর দেখাচ্ছিল, মুখটা লম্বাটে, পাতলা বিস্তৃত ঠোট। আমি বললাম, ‘কিরে, তুই সিনেমা দেখবি নাকি? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

‘হু, ইয়েলাে স্কাই। 

একা এসেছিস? ‘না, আমার এক বন্ধু আসবে বলেছিল, এখনাে আসল না। দেড়টা বেজে গেছে, এখুনি শশা শুরু হবে। 

‘টিকিট কেটে ফেলেছিস? ‘হ্যাঁ। ‘দে আমার কাছে, বিক্রি করে দি একটা। তুই দেখ একা-একা। ‘আপনি দেখেন না আমার সঙ্গে, আপনার তাে কোনাে কাজ নেই। আসেননা। 

‘আরে, পাগল নাকি? বাসায় গিয়ে গােসল করব, ভাত খাব।’ 

‘আহা, এক দিন একটু দেরি হলে মরে যাবেন না। একা একা ছবি দেখতে আমার খুব খারাপ লাগে। আসেন না, দেখি। খুব ভালাে ছবি। প্লীজ বলুন, হ্যাঁ। 

কিটকির কাণ্ড দেখে হেসে ফেলতে হল। বললাম, চল দেখি, ছবি ভালাে না “লে কিন্তু মাথা ভেঙে ফেলব। 

দু’ জন সিড়ি দিয়ে উঠছি দোতলায়, কিটকি হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, দেখুন তাে, কী মুশকিল হল।’ 

‘আবার কি? 

আমার বন্ধুটা এসে পড়েছে। ঐ যে নামছে রিকসা থেকে। খাটো করে ঐ মেয়েটি নাকি? লাল ওড়না?’ 

‘ভালােই হয়েছে। দেখ তােরা দু’ জনে, আমায় ছেড়ে দে।’ 

‘না-না, আসেন এই পােস্টার বাের্ডটার আড়ালে চলে যাই। না দেখলেই চলে যাবে। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

তুই যা আড়ালে, আমাকে তাে আর চেনে না। ‘আহা, আসেন না। কোন দিকে গেছে ? ‘দোতলায় খুঁজতে গেছে হয়তাে। 

‘কেমন গাধা মেয়ে দেখেছেন? সাড়ে বারােটায় আসতে বলেছি, এসেছে দেড়টায়। 

ছবিটা সত্যি ভালাে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে গেলাম। তবে ইটালিয়ান ছবি 

যেমন হয়–করুণ রসের ছড়াছড়ি। ছবির সুপুরুষ ছেলেটি বিয়ে করেছে তার প্রেমিকার বড় বােনকে। খবর পেয়ে প্রেমিকা বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। সেটাই দেখাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ সচকিত হয়ে দেখি কিটকি নিজেই মুখে আধখানা রুমাল গুঁজে কান্নার দুরন্ত বেগ সামলাচ্ছে। চোখের পানিতে চিকচিক করছে গাল। পাশে বসা এক গােবেচারা তরুণ পর্দা ছেড়ে কিটকিকেই দেখছে। অবাক হয়ে। আমি বললাম, কি রে কিটকি, কী ব্যাপার? 

‘কিছু না। 

‘আয় আয়, ছবি দেখতে হবে না। কী মুশকিল। কান্নার কী হল! তাের তাে কিছু হয় নি। 

কিটকির হাত ধরে হল থেকে বেরিয়ে এলাম। আলােয় এসেই লজ্জা পেয়ে গেল সে। 

‘তুই একটা পাগল। বলেছে আপনাকে! আর একটা বাচ্চা খুকি। আর আপনি একটা বুড়াে। 

‘তুই ভারি ভালাে মেয়ে কিটকি। তাের কান্না দেখে আমার এত ভালাে লেগেছে। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

‘ভালাে হবে না বলছি। ‘আইসক্রীম খাবি কিটকি ? 

-না। ‘না-না, খেতেই হবে। আয়, তুই সিনেমা দেখালি–আমি আইসক্রীম খাওয়াই। 

দেখলেন তাে কুল্লে সিকিখানা সিনেমা। ‘আচ্ছা, তুই সিকিখানাই খাসা’ 

কিটকি সুন্দর করে হাসল। সবুজ রুমালে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, ছবিটা বড় ভালাে, তাই না? 

‘হ্যাঁ। ‘ইস্, সবটা যদি দেখতাম!” 

গরমে মন্দ লাগল না আইসক্রীম। বড়াে কথা, পরিবেশটি ভালাে। সুন্দর করে সাজান টেবিলে সাদা টেবিলক্লথ। বয়গুলি কেতাদুরস্ত। অসময় বলেই ভিড় নেই। কিটকি তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল, চলুন উঠি।’ 

‘বস আরেকটু, আইসক্রীম আরাে একটা নে।” ‘ছেলেমানুষ পেয়েছেন আমাকে, না?’ সবুজ রুমাল বের করে নাক ঘষল কিটকি। 

‘আমার ভীষণ নাক ঘামে, খুব বাজে। ‘না, খুব ভালাে, যাদের নাক ঘামে তারা– ‘জানি জানি, বলতে হবে না। যত সব মিথ্যে কথা। আপনি বিশ্বেস করেন? 

‘আমিও না। আচ্ছা, যে-সব মেয়েদের গালে টোল পড়ে, তাদের হাসব্যাণ্ড নাকি খুব কম বয়সে মারা যায়? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

‘কই, তাের তাে টোল পড়ে না? নাকি পড়ে? হাসি দে একটা। 

আহা, আমার জন্যে বলছি না। আপনি ভারি বাজে। ‘বাসায় যাবি কিটকি ? চল যাই। ‘না, আজ থাক। আরেক দিন যাব। 

শুক্রবারে আয়। ‘শুক্রবারে কলেজ খােলা যে, আচ্ছা, সন্ধ্যাবেলা আসব।’ 

রাতে থাকবি তাে? 

কিটকি রিকশায় উঠে হাত নাড়ল। 

রাে েতেজ কমে আসছে। চারটে বেজে গেছে প্রায়। প্রচুর ঘেমেছি। বাসায় গিয়েই 

কটা ঘ গােসল সারব। অবেলায় ভাত আর খাব না। চা-টা খেয়ে দীর্ঘ ঘুম দেব। রয়া ক’দিন ধরেই সিনেমা দেখার জন্যে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। তাকে নিয়ে এক 

দিন দেখলে হয় ইয়েলাে স্কাই’। 

বাসায় এসে দেখি, গেটে তালা ঝুলছে। তালার সঙ্গে আটকান ছােট্ট চিরকুট, ‘খােকা, সবাই মিলে ছােটখালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছি।

সন্ধ্যার আগে ফিরব না। তুইও এসে পড়া—রাবেয়া।। 

ক্লান্তি লাগছিল খুব, কোথাও গিয়ে চা-টা খেলে হত। 

এই চিঠিটি সম্ভবত তােমাকেই লেখা? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

তাকিয়ে দেখি, বেশ লম্বা নিখুঁত সাহেবি পােশাকে এক ভদ্রলােক আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কপালের দু’ পাশের চুলে পাক ধরলেও এখনাে বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা। 

‘তুমি বলেছি বলে কিছু মনে কর নি তাে, ছেলের বয়সী তুমি।’ ‘না-না, কিছু মনে করি নি আমি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। 

‘চিনবে কী করে, আমি তাে পরিচিত কেউ নই। রাবেয়া বলে এই বাড়িতে একটি মেয়ে আছে না? 

‘জ্বি, আমার বােন। 

ছােটবেলায়, সে যখন স্কুলে পড়ত, তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। 

তাকে দেখলেই আমি গাড়িতে করে লিফট দিতাম। 

‘তাই নাকি? 

“হাঁ, বড়াে ভালাে মেয়ে। অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম। কিছুদিন হল এসেছি, ভাবলাম মেয়েটিকে দেখে যাই। এসে দেখি তালাবন্ধ। তালার সঙ্গের চিঠিখানা পড়ে দেয়াশলাই কিনতে গিয়েছি, আর তুমি এসেছ।’ | ‘আপনাকে বসাই কোথায়–আসেন, চা খান এক কাপ। 

‘না। আমার ডায়াবেটিস, চা থাক। তুমি এই মেয়েটিকে এই চকোলেটগুলি দিয়ে দিও, আচ্ছা? 

ভদ্রলােক কালাে ব্যাগ খুলে চকোলেট বের করতে লাগলেন। 

‘বিদেশে থাকাকালীন প্রায়ই মনে হত, মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় নি তাে? হলে কোথায় হল ? 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

‘না, বিয়ে হয় নি এখনাে। | ‘আচ্ছা তাহলে যাই, কেমন? | রাবেয়া বেশ মেয়ে তাে। পথের লােকজনদের সঙ্গে ছােট বয়সেই কেমন খাতির জমিয়েছে।

মন খাতির যে একেবারে বিদেশ থেকে চকোলেট এনেছেন তিনি। চকোলেট-খাওয়া মেয়েটি এত বড়াে হয়েছে জানলে আর চকোলেট আনতেন না নিশ্চয়ই। রাবেয়ার এমন আরাে কয়েক জন বন্ধু আছে। এক জন ছিল আবুর মা। কী যে ভালােবাসত রাবেয়াকে! রােজ এক বার খোঁজ নেওয়া চাই। রাবেয়ার যে-বার অসুখ হল, টাইফয়েড, আবুর মা তার ঘরসংসার নিয়ে আমাদের বারান্দায় উঠে এল।

পনের দিনের মতাে ছিল অসুখ, সেই ক’দিন বুড়ি এখানেই ছিল। মা ভারি বিরক্ত হয়েছিলেন। মেয়ের অমঙ্গল হবে ভেবে তাড়িয়েও দিতে পারেন নি। হঠাৎ একদিন আবুর মা আসা বন্ধ করে দিল। হয়তাে চলে গিয়েছিল অন্য কোথাও, কিংবা মারা-টারা গিয়েছে গাড়িচাপা পড়ে। রাবেয়াকে ঠাট্টা করে সবাই আবুর মার সখী’ ডাকত। বাবা ডাকতেন ‘আবুর নানী’। রাবেয়া রাগত না মােটেই। আবুর মার সঙ্গে রাবেয়া হেসে হেসে কথা কইছে, ছবির মতাে ভাসে চোখে। 

‘ও বুড়ি, আজ কত পেয়েছ? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *