শিকারী গাছ-সুকুমার রায়

শিকারী গাছ-সুকুমার রায়

উপযুক্তরকম জল মাটি বাতাস আর সূর্যের আলো পাইলেই গাছেরা বেশ খুশী থাকে, আর তাহাতেই তাহাদের রীতিমত শরীর পুষ্টি হয় আমরা ত বরাবর এইরকমই দেখই এবং শুনি। তাহারা যে আবার পোকা মাকড় খাইতে চায়, শিকার ধরিবার জন্য নানারকম অদ্ভুত ফাঁদ খাটাইয়া রাখে এবং বাগে পাইলে পাখিটা ইঁদুরটা পর্যন্ত হজম করিয়া ফেলে, এ কথাটা চট্‌ করিয়া বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া দেখা গিয়াছে যে পৃথিবীর নানা জায়গায় নানা জাতীয় গাছ এই শিকারী বিদ্যা শিখিয়াছে। তাহারা যে সখ করিয়া পোকা খাওয়া অভ্যাস করিয়াছে তাহা নয়, ঠেলায় পড়িয়াই ঐরূপ করিতে বাধ্য হইয়াছে। অনেক শিকারী গাছের বাস এমন স্যাঁতসেতে জায়গায় এবং সেই সকল জায়গা গাছের পক্ষে এত অস্বাস্থ্যকর যে সেখানে তাহারা তাহাদের শরীর রক্ষার উপযোগী মাল-মসলা ভাল করিয়া জোগাড় করিতে পারে না। এরূপ অবস্থায়, দু একটা পোকা, মাছি বা ফড়িং যদি তাহারা খাইতে না পারিত তবে তাহাদের বাঁচিয়া থাকাই মুস্কিল হইত।
আগেই বলিয়াছি, শিকারী গাছ নানারকমের আছে। ইহাদের শিকার ধরিবার জায়গাও নানারকম। কোন কোন গাছের পাতায় মাছি বা পোকা বসিলে পাতাগুলি আস্তে আস্তে গুটাইয়া যায়। মাছি বেচারা কিছুই জানে না, নিশ্চিন্ত মনে পাতার রস খাইতেছিল, হঠাৎ দেখে চারিদিকে ঘেরা, তাহার মধ্যে সে বন্দী! পাতার গায়ে লোমের মতো সরু সরু কাঁটা, তাহারই মুখে আঠার মতো রস লাগান থাকে; সেই রসে আটকাইয়া শিকারের পালাইবার আরও অসুবিধা হয়। শুধু তাহাই নহে, পাতা গুটাইয়া গেলে পরে সেই সকল কাঁটার মুখ হইতে একরকম তীব্র হজমি রস বাহির হয়, তখন পোকাটা যতই ছট্‌ফট্‌ করে, ততই আরও বেশি করিয়া রস বাহির হয়। তাহাতেই শিকার মরিয়া শেষে হজম হইয়া যায়। তারপর আপনা হইতেই আবার পাতা খুলিয়া যায়। জলের মধ্যে একরকম গাছ থাকে, তাহার সাদা ফুল; জলের ধারে একধরনের খুব রংচঙে গাছ থাকে, তাহার পাতাগুলির চেহারা কতকটা কদম ফুল গোছের। আর একরকমের গাছ থাকে, তাহাতে ঠিক যেন মোচার খোলের মতো পাতা সাজান। এই সবগুলি এক প্রকারের শিকারী গাছ এবং ইহাদের শিকার ধরিবার কায়দাও প্রায় একরকম। মনে কর একটা মস্ত পোকা ওই কদম ফুলের মতো গাছটিতে উঠিয়াছে। আর একটু পরেই গাছের পাতাগুলি গুটাইয়া মাঝখানে আসিয়া মিলিবে—একটি ফুটন্ত ফুল মুড়িয়া আবার কুঁড়ি হইয়া গেলে যেমন হয়, সেইরূপ! তখন পোকা বেচারার আর পালাইবার পথ থাকিবে না।
আর একরকমের অদ্ভুত গাছ আছে, এক একটা পাতার আগায় গোলাপী রঙের কি একটা জিনিস, তার চারদিকে কাঁটা। এই জিনিসগুলি Fly-Trap (মাছি-মারা ফাঁদ)। এক একটা ফাঁদ যেন মাখখানে কব্জা দিয়া আটকান, বইয়ের মতো খোলে আবার বন্ধ হয়। কোন পোকা হয়ত পাতায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কোন বিপদের চিহ্ন নাই; ঘুরিতে ঘুরিতে সে ওই ফাঁদের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত। হয়ত দূরে থাকিয়া তাহার ঐ রংটা খুব পছন্দ হইয়াছিল—তাই সে দেখিতে আসিল ব্যাপারখানা কি। কিন্তু সে জানে না যে ফাঁদের গায়ে সরু সুতার মতো কি লাগান রহিয়াছে, তাহাতে ছুঁইলেই ফাঁদ বন্ধ হইয়া যায়! সে যেমন একটি সুতায় পা অথবা ডানা লাগাইয়াছে অমনি—খট্‌! ফাঁদ ছুটিয়া একেবারে বেমালুম বন্ধ হইয়া গেল। এখানে আর আঠার দরকার নাই, কারণ ফাঁদটি রীতিমত মজবুত এবং খুব চট্‌পট্‌ কাজ সারে। আর একরকম শিকারী গাছ আছে, তাহাদের শিকার ধরিবার জন্য থলি বা চোঙা থাকে। এই থলি বা চোঙার মধ্যে পোকা বেশ সহজেই ঢুকিতে পারে কিন্তু বাহির হওয়া তত সহজ নয়। ইহাদের ভিতর সরু সরু কাঁটা থাকে—সেগুলির মুখ সব নীচের দিকে, আর তার গায়ে মোমের মতো একরকম কি মাখান থাকে, তাহাতে পোকাগুলি বেশ সহজেই সুড়্‌ সুড়্‌ করিয়া পিছলাইয়া নামিতে পারে। কিন্তু উপরে উঠিবার সময় ত আর পিছলাইয়া উঠা যায় না—তা ছাড়া কাঁটার খোঁচাও যথেষ্ট খাইতে হয়। এইসকল থলির তলায় প্রায়ই জল জমিয়া থাকে, পোকা যখন বার বার পালাইবার চেষ্টা করিয়া হয়রান হইয়া পড়ে, তখন সে ওই জলের মধ্যে পড়িয়া মারা যায়। এইসকল গাছে পোকাকে ফাঁকি দিবার এতরকম উপায় থাকে যে ভাবিলে অবাক হইতে হয়। কোনটার মুখে ঢাকনি থাকে; সে ঢাকনির উপর হইতে চাপ দিলে খুলিয়া যায়! কিন্তু ভিতর হইতে ঠেলিলে খোলে না। প্রায় সবগুলিরই মুখের কাছে খুব সুন্দর রঙিন কাজ আর তার চারিদিকে মধু। সেই মধু খাইতে খাইতে পোকা ভিতরের দিকে ঢুকিতে থাকে—যত খায় তত মিষ্টি! শেষে এক জায়গায় গিয়া দেখে তাহার পরে আর মধু নাই—তখন সে ফিরিতে চায়! কিন্তু ফিরিতে আর পারে না। কোন কোন থলির ভিতরে খানিকটা জায়গা স্বচ্ছ মতন—ঠিক যেন সার্‌সি। পোকাগুলি মনে করে এই পলাইবার পথ—আর ক্রমাগত সে সারসির গায়ে উড়িয়া উড়িয়া হয়রান হইয়া পড়ে। কখন কখন এমনও হয় কোন ছোট পাখি বা ইঁদুর হয়ত জল খাইতে আসিয়া ফাঁদের মধ্যে পড়িয়া যায় এবং আর বাহির হইতে না পারিয়া প্রাণ হারায়!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *