কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। লক্ষ্য করলাম, আবার চোখ বুজে হেলান দিয়েছেন। দাঁতে কামড়ানাে জ্বলন্ত চুরুট।
কিছুক্ষণ পরে এলিয়ট রােডে কর্নেলের সানি ভিলার প্রাঙ্গণে ঢুকে গাড়ি পাের্টিকোর তলায় দাঁড় করালাম। আমার আর সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় ওঠার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কর্নেল আমাকে যেতে দিলেন না। অগত্যা গাড়ি পার্ক করে রেখে
ওঁর সঙ্গ ধরতে হলাে।
ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে চাপাস্বরে বলল, এক বুড়ােবাবু এয়েছেন। বললাম, শামশাই বেইরেছেন। ফিরতে রাত্তির হবে। উনি বললেন, যত রাত্তির হােক, নােয়েট করব। তা—
‘তিনি কি রােয়েট করছেন? ‘আজ্ঞে। ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, ‘জোর করে ঢুকে বললেন, আমি তােমার বাবামশাইয়ের বন্ধু।
কর্নেল তার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, শীগগির কফি।
ছােট্ট ওয়েটিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমের পর্দা তুলে ঢুকে উনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হ্যাল্লো রায়সায়েব! |
ঢুকে দেখি, প্রায় কর্নেলের বয়সী এবং তার মতােই দশাসই চেহারার এক অলােক সােফায় বসে আছেন। কিন্তু তাকে কেন কর্নেল রায়সায়েব বলে সম্ভাষণ ফলেন বােঝা গেল না। ভদ্রলােকের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। পাশে একটা কাপড়ের গ। চেহারায় অবশ্য বনেদী আভিজাত্যের ছাপ আছে। দেখনসই পাকা গোঁফ এবং চুলও সাদা। তবে কর্নেলের মতাে টাক নেই।
ভলােক বললেন, ‘বিকেলে হাওড়া পেঁৗছেছি। স্টেশন থেকে ফোনে লাইন লেলাম না। তার ওপর আজকাল আপনাদের কলকাতার কী অবস্থা হয়েছে! ট্যাক্সি লেতে সে এক হাঙ্গামা। সারা রাস্তা জ্যাম। ব্যস। তারপর শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -৩
শেষে যদি বা এসে পৌছুলাম, শুনি আপনি নেই। কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। ইনি অমরেন্দ্র সিংহরায়। জয়ন্ত, তুমি কি
ও রাঙাটুলি গেছ? ধানবাদ খনি এরিয়া থেকে সামান্য দূরে এক অসাধারণ।
গা। শহর বলতে পারাে, আবার গ্রামও বলতে পারাে। টিলাপাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা আর মদী–তাে রায়সায়েব! এর নাম আমার কাছে শুনে থাকবেন। জয়ন্ত চৌধুরী।
নিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
আমরা নমস্কার বিনিময় করলাম। অমরেন্দ্র বললেন, নামটা শুনে থাকব। শমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল জয়ন্তবাবু। আপনি কাগজের লােক । নিশ্চয় এ চৌধুরীকে চিনতেন। আমাদের এলাকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বটুক চৌধুরী। মা খাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিয়ে কত ভােলাপাড়। পরে ওর বডি পাওয়া যায় ড্যামের জলে।
বললাম, নাহ। চিনি না তাকে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, ‘চৌধুরীসায়েবের ভূত কি এখনও রায়সায়েবের লিড়েনি?”
অখলে অমনই গম্ভীর হয়ে গেলেন। চাপাস্বরে বললেন, ‘এবারকার ব্যাপারটা একবারে অন্যরকম। গত বছর তাে আপনি গিয়ে রহস্যটা ফাঁস করলেন। যােগেন
লেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এবার উড়াে চিঠি নয়। আপনি লামকতকটা তা–ই।
‘প্রায় প্রতি রাত্রেই এটা হচ্ছে। অদ্ভুত সব শব্দ। বুঝলেন? হলঘরের কাঠের সিঁড়িতে, কখনও ছাদে, আবার কখনও দোতলায় আমার ঘরের বারান্দায় হাঁটাচলার শব্দ। ফিসফিস কথাবার্তা। অমরেন্দ্র সিংহরায়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। ‘অথচ দেখুন, অ্যালশেসিয়ানটা ছাড়া থাকে। সে-হারামজাদার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম, যােগেনের মতাে বেচুও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। বেচুকে রাত্রে ঘরে তালা আটকে রাখলাম।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -৩
কিন্তু তবু সেই ভুতুড়ে কারবার। টর্চ বন্দুক নিয়ে বেরােই। সুনন্দা, সতু আমার সঙ্গে থাকে। ছাদে উঠে দেখি কেউ নেই। তারপর গত পরশু রাত্রে নিচের হলঘরে আর্তনাদ শুনলাম। সুনন্দা, সতু, বেচু সবাই শুনেছিল! আলাে জ্বালাই থাকে সারারাত্রি। কিন্তু সে রাত্রে তখন লােডশেডিং ছিল। হলঘরে সবাই দেখলাম কেউ নেই, কিন্তু কার্পেটে খানিকটা রক্ত পড়ে আছে।
‘কুকুরটা তখন কোথায় ছিল। ‘বাইরে। সতু হলঘরের দরজা খুলতেই লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকল।
অবাক হয়ে শুনছিলাম। বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু কর্নেল তুম্বাে মুখে শুনছেন এবং গুরুত্ব দিচ্ছেন। না বলে পারলাম না, ‘রক্ত না রঙ, পরীক্ষা করা হয়েছে?
অমরেন্দ্র সিংহরায় হাসবার চেষ্টা করে বললেন, জয়ন্তবাবু! রক্ত আর রঙের তফাত বােঝার মতাে বুদ্ধি আমার আছে। তা ছাড়া সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হলাে, কুকুরটাকে আবার বাইরে বের করে দিয়ে হলঘরের দরজা আটকে আমরা সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছি, বেচু মানে আমাদের বাড়ির সারভ্যান্ট চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ} ও নিচের একটা ঘরে থাকে। সতু টর্চের আলাে ফেলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। বেচ বলল, ওই দেখুন। একটা কালাে বেড়াল রক্ত খাচ্ছে। সত্যি তা-ই! তাড়া করতেই বেড়ালটা বেচুর ঘরে ঢুকল। সেখানে তাড়া খেয়ে খােলা জানালা গলিয়ে পালাল।
বললাম, ‘তবু কুকুরটার কোনও সাড়া পেলেন না?
নাহ।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -৩
ষষ্ঠী ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল এতক্ষণে। বাইরে বৃষ্টিটা সমানে ঝরছে। ভূতের গল্প শােনার মতাে পরিবেশ বলা চলে। ভদ্রলােকের মুখ দেখে বুঝতেই পারছিলাম না উনি বানিয়ে বলছেন কিংবা তিলকে তাল করছেন, নাকি সত্যিই এই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্য আমার এই প্রখ্যাত রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধুর কাছে ছুটে এসেছেন?
কর্নেল বললেন, কফি খান রায়সায়েব। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
কফিতে চুমুক দিয়ে অমরেন্দ্র বললেন, ‘গতরাত্রে তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু ভােরবেলা আমার ঘরের দরজা খুলে দেখি, একটা দলাপাকানাে াগজ পড়ে আছে। যা অবস্থা চলেছে, স্বভাবত কৌতুহল জাগল। কাগজটার ভুজ ঠিকঠাক করে দেখলাম কী সব ইংরেজিতে লেখা আছে। একবর্ণ বুঝলাম না সুনন্দা আর সতুকে দেখালাম। ওরাও বুঝতে পারল না। তখন তিনজনে মিলে ঠিক করলাম, আবার আপনার শরণাপন্ন হওয়া দরকার। এই দেখুন।
অমরেন্দ্র পাঞ্জাবির ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কার্নেলকে দিলেন। কাগজটার অবস্থা দেখে বােঝা গেল, ওটা সত্যি দুলপাকানাে ছিল। টেনে ঠিকঠাক করা হয়েছে। কর্নেল ভাঁজ খুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতশ
কাচ বের করলেন। পড়ার পর শুধু বললেন, ‘হুঁ। কিছু বােঝা যাচ্ছে না।
Read More