সত্যজিৎ রায় এর ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-১৯)

ফেলুদা একটা হাই তুলে বলল, “হাইনা। বাপরে!একেই বলে হাইনার হাসি ! 

শ্রীবাস্তব বললেন তাঁর নাকি প্রথম প্রথম এই হাসি শুনে গা ছম ছম করত, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। 

‘আপনার বাড়িতে কাল আর কোনও উপদ্রব হয়নি তাে ? ধীরুকাকা প্রশ্ন করলেন। 

তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণেশ্রীবাস্তব হেসে বললেন, ‘নাে, নাে। নাথিং‘ 

আমরা যখন বাড়িতে ফিরলাম তখন প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে শুনতে পেলাম দূর থেকে একটা ঢাকঢােলের শব্দ আসছে । ধীরুকাকা বললেন, দেওয়ালির সময় এখানে রামলীলা হয়। এটা তারই প্রিপারেশন হচ্ছে । 

আমি বললাম রামলীলা কী রকম ? প্রায় দশটা মানুষের সমান উচু একটা রাবণ তৈরি করে তার ভিতর বারুদ বােঝাই করা হয়। তারপর দুজন ছেলেকে মেকআপটেকআপ করে রাম লক্ষ্মণ সাজায়। তারা রথে চড়ে এসে তীর দিয়ে রাবণের দিকে তাগ করে মারেআর সেই সঙ্গে রাবণের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গা থেকে তুবড়ি হাউই চরকি রংমশাল ছড়াতে ছড়াতে রাবণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সে একটা দেখবার জিনিস। 

বাড়িতে ঢুকতে বেয়ারা শ্রীবাস্তবের আসার খবরটা দিল। তারপর বলল, ‘আউর এক সাধুবাবা ভি আয়া থা। আধঘণ্টা বইঠকে চলা গিয়া।’ 

সাধুবাবা ? ধীরুকাকার ভাব দেখে বুঝলাম উনি কোনও সাধুবাবাকে এক্সপেক্ট করছিলেন না‘কোথায় বসেছিলেন ? বেয়ারা বলল, বৈঠকখানায় । আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন ? হ্যাঁ ‘আমার নাম করেছিলেন ? 

বেয়ারা তাতেও বলল হ্যাঁ। ‘তাজ্জব ব্যাপার! 

হঠাৎ কী মনে করে ধীরুকাকা ঝড়ের মতাে শােবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর গােদরেজ আলমারি খােলার শব্দ পেলাম। আর তার পরেই শুনলাম ধীরুকাকার চিৎকার— 

‘সর্বনাশ। বাবা, আমি আর ফেলুদা প্রায় একসঙ্গে হুড়মুড় করে ধীরুকাকার ঘরে ঢুকলাম। গিয়ে দেখি উনি আংটির কৌটোটা হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। 

সত্যজিৎ রায় এর ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড

কৌটোর ঢাকনা খােলা, আর তার ভিতরে আংটি নেই। ধীরুকাকা কিছুক্ষণ বােকার মতাে দাঁড়িয়ে থেকে ধপ্ করে তাঁর খাটের উপর বসে পড়লেন। 

পরদিন সকালে মনে হল যে শীতটা একটু বেড়েছে, তাই বাবা বললেন গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে নিতে। বাবার কপালে ভূকুটি আর একটা অন্যমনস্ক ভাব দেখে বুঝতে পারছিলাম যে উনি খুব ভাবছেন। ধীরুকাকাও কোথায় জানি বেরিয়ে গেছেন—-আর কাউকে কিছু বলেও যাননি। কালকের ঘটনার পর থেকেই কেবল বললেন~-শ্রীবাস্তবকে মুখ দেখাব কী করে ? বাবা অবিশ্যি অনেক সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন । বিকেল বেলা সন্ন্যাসী সেজে চোর এসে তােমার বাড়ি থেকে আংটি নিয়ে যাবে সেটা তুমি জানবে কী করে। তার চেয়ে তুমি বরং পুলিশে একটা খবর দিয়ে দাও। তুমি তাে বলছিলে ইনস্পেক্টর গরগরির সঙ্গে তােমার খুব আলাপ আছে।’ এও হতে পারে যে ধীরুকাকা হয়তাে পৃলিশে খবর দিতেই বেরিয়েছেন। | সকালে যখন চা আর জ্যামরুটি খাচ্ছি, তখন বাবা বললেন, “ভেবেছিলাম আজ তােদের রেসিডেন্সিটা দেখিয়ে আনব, কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে আজকের দিনটা যাক। তােরা দুজনে বরং কোথাও ঘুরে আসিস কাছাকাছির মধ্যে।’ 

কথাটা শুনে আমার একটু হাসিই পেয়ে গেল, কারণ ফেলুদা বলছিল ওর একটু পায়ে হেঁটে শহরটা দেখার ইচ্ছে আছে, আর আমিও মনে মনে ঠিক করেছিলাম ওর সঙ্গে যাব। আমি জানতাম শুধু শহর দেখা ছাড়াও ওর অন্য উদ্দেশ্য আছে। আমি সন্ধেবেলা থেকেই দেখছি ওর চোখের দৃষ্টিটা মাঝে মাঝে কেমন জানি তীক্ষ হয়ে উঠছে। 

সত্যজিৎ রায় এর ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড

আটটার একটু পরেই আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। গেটের কাছাকাছি এসে ফেলুদা বলল, ‘তােকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি—ব ব করলে বা বেশি প্রশ্ন করলে তােকে ফেরত পাঠিয়ে দেব। বােকা সেজে থাকবি, আর পাশে পাশে হাঁটিবি।’ 

‘কিন্তু ধীরুকাকা যদি পুলিশে খবর দেন ? ‘তাতে কী হল ? ‘ওরা যদি তােমার আগে চোর ধরে ফেলে ? ‘তাতে আর কী ? নিজের নামটা চেঞ্জ করে ফেলব। 

ধীরুকাকার বাড়িটা যে রাস্তায় সেটার নাম ফ্রেজার রােড় । বেশ নির্জন রাস্তাটা। দুদিকে গেট আর বাগান-ওয়ালা বাড়ি, তাতে শুধু যে বাঙালিরা থাকে তা নয়। ফ্রেজার রােডটা গিয়ে পড়েছে সাপলিং রােডে }. লখনৌতে একটা সুবিধে আছে রাস্তার নামগুলাে বেশ বড় বড় পাথরের ফলকে লেখা থাকে। কলকাতার মতাে খুঁজে বার করতে সময় লাগে না। 

ডালিং রােডটা যেখানে গিয়ে পার্ক রােডে মিশেছে, সেই মােড়টাতে একটা পানের দোলা দেখে ফেলুদা হেলতে দুলতে সেটার সামনে গিয়ে বলল, মিঠা পান হয় ? ‘মিঠা পান ? নেহি, বাবুজি। লেকিন মিঠা মাসাল্লা দেকে বানা দেনে সেকতা।’ ‘তাই দিজিয়ে। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বাংলা দেশ ছাড়লেই এই একটা প্রবলেম। 

সত্যজিৎ রায় এর ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড

পানটা কিনে মুখে পুরে দিয়ে ফেলুদা বলল, হ্যাঁ ভাই, আমি এ-শহরে নতুন লােক। এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনটা কোথায় বলতে পার ? 

ফেলুদা অবিশ্যি হিন্দিতে প্রশ্ন করছিল, আর লােকটাও হিন্দিতে জবাব দিয়েছিল, কিন্তু আমি বাংলাতেই লিখছি। 

দোকানদার বলল, রামকিষণ মিসির ?‘রামকৃষ্ণ মিশন। শহরে একজন বড় সাধুবাবা এসেছেন, আমি তাঁর খোঁজ করছি। শুনলাম তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে উঠেছেন। 

দোকানদার মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে কী জানি বলে বিড়ি বাঁধতে আরম্ভ করে দিল। কিন্তু দোকানের পাশেই একটা খাটিয়ায় একটা ইয়াবড় গোঁফওয়ালা নােক একটা পুরনাে মরচে ধরা বিস্কুটের টিন বাজিয়ে গান করছিল, সে হঠাৎ ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করল, কালাে গোঁফদাড়িওয়ালা কালাে চশমা পরা সাধু কি ? তাই যদি হয় তা হলে তাকে কাল সন্ধেবেলা টাঙ্গার স্ট্যান্ড কোথায় বলে দিয়েছিলাম। 

‘কোথায় টাঙ্গার স্ট্যান্ড ? ‘এখান থেকে পাঁচ মিনিট। ওই দিকে প্রথম চৌমাথাটায় গেলেই সার সার গাড়ি দাঁড়ানাে আছে দেখতে পাবেন।’ 

‘শুক্রিয়া ! 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *