আমরা ইংরেজজাতিকে কতকটা জানি, এবং আমাদের বিশ্বাস যে, প্রাচীন হিন্দুজাতিকে তার চাইতেও বেশি জানি; আমরা চিনি নে শুধু নিজেদের।
আমরা নিজেদের চেনবার কোনো চেষ্টাও করি নে, কারণ আমাদের বিশ্বাস যে, সে জানার কোনো ফল নেই; তা ছাড়া নিজেদের ভিতর জানবার মত কোনো পদার্থ আছে কি না, সে বিষয়েও অনেকের সন্দেহ আছে।
বাঙালির নিজস্ব বলে মনে কিংবা চরিত্রে যদি কোনো পদার্থ থাকে, তাকে আমরা ডরাই; তাই চোখের আড়াল করে রাখতে চাই। আমাদের ধারণা যে, বাঙালি তার বাঙালিত্ব না হারালে আর মানুষ হয় না। অবশ্য অপরের কাছে তিরস্কৃত হলে আমরা রাগ করে ঘরের ভাত (যদি থাকে ততো) বেশি করে খাই; কিন্তু উপেক্ষিত হলেই আমরা বিশেষ ক্ষুণ্ণ হই। মান এবং অভিমান এক জিনিস নয়। প্রথমটির অভাব হতেই দ্বিতীয়টি জন্মলাভ করে।
আমরা যে নিজেদের মান্য করি নে, তার স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, আমরা উন্নতি অর্থে বুঝি— হয় বতমান ইউরোপের দিকে এগনো, নয় অতীত ভারতবর্ষের দিকে পিছননা। আমরা নিজের পথ জানি নে বলে আজও মনঃস্থির করে উঠতে পারি নি যে, পর্ব এবং পশ্চিম এই দুটির মধ্যে কোন, দিক অবলম্বন করলে আমরা ঠিক গন্তব্য স্থানে গিয়ে পৌঁছব। কাজেই আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার দিকে তিন-পা এগিয়ে আবার ভারতবর্ষের দিকে দু-পা পিছিয়ে আসি, আবার অগ্রসর হই, আবার পিছ, হটি। এই কুর্নিশ করাটাই আমাদের নব-সভ্যতার ধর্ম ও কর্ম।
উক্ত ক্রিয়াটি আমাদের পক্ষে বিশেষ গৌরবসচক না হলেও মেনে নিতে হবে। যা মনে সত্য বলে জানি, সেসম্বন্ধে মনকে চোখ ঠেরে কোনো লাভ নেই। আমরা দোটানার ভিতর পড়েছি–এই সত্যটি সহজে স্বীকার করে নিলে আমাদের উন্নতির পথ পরিষ্কার হয়ে আসবে। যা আজ উভয়সংকট বলে মনে হচ্ছে, তাই আমাদের উন্নতির স্রোতকে একটি নির্দিষ্ট পথে বদ্ধ রাখবার উভয়কল বলে বুঝতে পারব। আমরা যদি চলতে চাই তো আমাদের একল-ওকল দু কল রক্ষা করেই চলতে হবে
আমরা স্পষ্ট জানি আর না-জানি, আমরা এই উভয়কল অবলম্বন করেই চলবার চেষ্টা করছি। সকল দেশেরই সকল যুগের একটি বিশেষ ধর্ম আছে। সেই যুগধর্ম অনুসারে চলতে পারলেই মানুষ সার্থকতা লাভ করে। আমাদের এ যুগে সত্যযুগও নয় কলিযুগ নয়— শুধু তরজমার যুগ। আমরা শুধু কথায় নয়, কাজেও একেলে বিদেশী এবং সেকেলে স্বদেশী সভ্যতার অনুবাদ করেই দিন কাটাই। আমাদের মুখের প্রতিবাদও ঐ একই লক্ষণাক্রান্ত। আমরা সংস্কৃতের অনুবাদ করে নূতনের প্রতিবাদ করি, এবং ইংরেজির অনুবাদ করে পুরাতনের প্রতিবাদ করি। আসলে রাজনীতি সমাজনীতি ধর্ম শিক্ষা সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই তরজমা করা ছাড়া আমাদের উপায়ান্তর নেই। সুতরাং আমাদের বর্তমান যুগটি তরজমার যুগ বলে গ্রাহ্য করে নিয়ে ঐ অনুবাদ-কাটি ষোলোআনা ভালোরকম করার উপর আমাদের পুরুষার্থ এবং কৃতিত্ব নির্ভর করছে।
পরের জিনিসকে আপনার করে নেবার নামই তরজমা। সুতরাং ও কার্য করাতে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই, এবং নিজেদের দৈনন্যর পরিচয় দেওয়া হয় মনে করেও লজ্জিত হবার কারণ নেই। কেননা, নিজের ঐশ্বর্য না থাকলে লোকে যেমন দান করতে পারে না, তেমনি নেবার যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে লোকে গ্রহণও করতে পারে না। স্মৃতির মতে, দাতা এবং গ্রহীতার পরস্পর যোগ না হলে দানক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। একথা সম্পর্ণে সত্য। মত ব্যক্তি দাতাও হতে পারে না, গ্রহীতাও হতে পারে না; কারণ দান এবং গ্রহণ উভয়ই জীবনের ধর্ম। বুদ্ধদেব যিশুখৃস্ট মহম্মদ প্রভৃতি মহাপুরুষদের নিকট কোটি-কোটি মানব ধর্মের জন্য ঋণী। কিন্তু তাঁদের দত্ত অমূল্য রত্ন তাঁদের হাত থেকে গ্রহণ করবার ক্ষমতা কেবলমাত্র তাঁদের সমকালবর্তী জনকতক মহাপুরুষেরই ছিল। এবং শিষ্যপরম্পরায় তাঁদের মত আজ লক্ষ লক্ষ লোকের ঘরের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে গর, হওয়া বেশি শক্ত, কিংবা শিষ্য হওয়া বেশি শক্ত, বলা কঠিন। যাঁদের বেদান্তশাস্ত্রের সঙ্গে স্বল্পমাত্রও পরিচয় আছে তাঁরাই জানেন যে, পরাকালে গররা কাউকে ব্রহনবিদ্যা দান করবার পূর্বে শিষ্যের সে বিদ্যা গ্রহণ করবার উপযোগিতা সম্বন্ধে কিরূপ কঠিন পরীক্ষা করতেন। উপনিষদকে গুহ্যশাস্ত্র করে রাখবার উদ্দেশ্যই এই যে, যাদের শিষ্য হবার সামথ্য নেই, এমন লোকেরা ব্রহ্মবিদ্যা নিয়ে বিদ্যে ফলাতে না পারে। একথা সম্পূর্ণ সত্য যে, শক্তিমান গর, হবার একমাত্র উপায় পূর্বে ভক্তিমান শিষ্য হওয়া। বর্তমান যুগে আমরা ভক্তি-পদার্থটি ভুলে গেছি, আমাদের মনে আছে শুধু অভক্তি ও অতিভক্তি। এ দুয়ের একটিও সাধুতার লক্ষণ নয়, তাই ইংরেজি-শিক্ষিত লোকের পক্ষে অপর কাউকে শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব।
আমরা কথায় বলি, জ্ঞানলাভ করি; কিন্তু আসলে জ্ঞান উত্তরাধিকারীসত্ত্বে কিংবা প্রসাদস্বরূপে লাভ করবার পদার্থ নয়। আমরা সজ্ঞানে জন্মলাভ করি নে, কেবল জ্ঞান অর্জন করবার ক্ষমতামাত্র নিয়ে ভূমিষ্ঠ হই। জানাব্যাপারটি মানসিক চেষ্টার অধীন, জ্ঞান একটি মানসিক ক্রিয়া মাত্র; এবং সে ক্রিয়া ইচ্ছাশক্তির একটি বিশেষ বিকাশ। মন-পদার্থটি একটি বেওয়ারিশ প্লেট নয়, যার উপর বাহ্যজগত্রপে পেনসিল শুধু হিজিবিজি কেটে যায়; অথবা ফোটোগ্রাফিক প্লেটও নয়, যা কোনোরূপ অন্তর্গঢ় রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দ্বারা বাহ্যজগতের ছায়া ধরে রাখে। যে প্রক্রিয়ার বলে আমরা জ্ঞাতব্য বিষয়কে নিজের ইচ্ছা এবং ক্ষমতা অনুসারে নিজের অন্তর্ভুত করে নিতে পারি, তারই নাম জ্ঞান। আমরা মনে-মনে যা তরজমা করে নিতে পারি, তাই আমরা যথার্থ জানি; যা পারি নে, তার শুধু নামমাত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। ঐ তরজমা করার শক্তির উপরই মানুষের মনুষ্যত্ব নির্ভর করে। সুতরাং একাগ্রভাবে তরজমা-কার্যে ব্রতী হওয়াতে আমাদের পুরুষকার বৃদ্ধি পাবে বই ক্ষীণ হবে না।
আমি পূর্বে বলেছি যে, আমরা সকলে মিলে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই, হয় ইউরোপীয় নয় আর্য সভ্যতার তরজমা করবার চেষ্টা করছি, কিন্তু ফলে আমরা তরজমা না করে শুধু নকলই করছি। নকল করার মধ্যে কোনোরূপ গৌরব বা মনুষ্যত্ব নেই। মানসিক শক্তির অভাববশতই মানুষে যখন কোনো জিনিস রপান্তরিত করে নিজের জীবনের উপযোগী করে নিতে পারে না, অথচ লোভবশত লাভ করতে চায়, তখন তার নকল করে। নকলে বাইরের পদার্থ বাইরেই থাকে, আমাদের অন্তর্ভূত হয় না; তার দ্বারা আমাদের মনের এবং চরিত্রের কান্তি পুষ্ট হয় না, ফলে মানসিক শক্তির যথেষ্ট চর্চার অভাববশত দিন-দিন সে শক্তি হ্রাস হতে থাকে। ইউরোপীয় সভ্যতা আমরা নিজেদের চারিপাশে জড়ো করেও সেটিকে অন্তরঙ্গ করতে পারি নি; তার স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, আমরা মাঝেমাঝে সেটিকে ঝেড়ে ফেলবার জন্য ছটফট করি। মানুষে যা আত্মসাৎ করতে পারে না তাই ভস্মসাৎ করতে চায়। আমরা মুখে যাই বলি নে কেন, কাজে পব-সভ্যতা নয়, পশ্চিম-সভ্যতারই নকল করি; তার কারণ ইউরোপীয় সভ্যতা আমাদের চোখের সম্মুখে সশরীরে বর্তমান, অপরপক্ষে আর্য সভ্যতার প্রেতাত্মামাত্র অবশিষ্ট। প্রেতাত্মাকে আয়ত্ত করতে হলে বহু সাধনার আবশ্যক। তাছাড়া প্রেতাত্মা নিয়ে যাঁরা কারবার করেন তাঁরা সকলেই জানেন যে, দেহমুক্ত আত্মার সম্পর্কে আসতে হলে অপর-একটি দেহতে তাকে আশ্রয় দেওয়া চাই; একটি প্রাণীর মধ্যস্থতা ব্যতীত প্রেতাত্মা আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না। আমাদের সমাজের প্রাচীন দেহ আছে বটে, কিন্তু প্রাণ নেই। শব প্রেতাত্মা কর্তৃক আবিষ্ট হলে মানুষ হয় না, বেতাল হয়। বেতাল-সিদ্ধ হবার দুরাশা খুব কম লোকেই রাখে; কাজেই শুধু মন নয়, পঞ্চেন্দ্রিয়ারা গ্রাহ্য যে ইউরোপীয় সভ্যতা আমাদের প্রত্যক্ষ রয়েছে, সাধারণত লোকে তারই অনুকরণ করে। অনুকরণ ত্যাগ করে যদি আমরা এই নব-সভ্যতার অনুবাদ করতে পারি, তাহলেই সে সভ্যতা নিজস্ব হয়ে উঠবে, এবং ঐ ক্রিয়ার সাহায্যেই আমরা নিজেদের প্রাণের পরিচয় পাব, এবং বাঙালির বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তুলব।
তরজমার আবশ্যকত্ব স্থাপনা করে এখন কি উপায়ে আমরা সেবিষয়ে কৃতকার্য হব সেসম্বন্ধে আমার দু-চারটি কথা বলবার আছে।
সাধারণত লোকের বিশ্বাস যে, কথার চাইতে কাজ শ্রেষ্ঠ। এ বিশ্বাস বৈষয়িক হিসাবে সত্য এবং আধ্যাত্মিক হিসাবে মিথ্যা। মানুষমাত্রেই নৈসর্গিক প্রবত্তির বলে সংসারযাত্রার উপযোগী সকল কার্য করতে পারে; কিন্তু তার অতিরিক্ত কর্ম-যার ফল একে নয় দশে লাভ করে, তা-করবার জন্য মনোবল আবশ্যক। সমাজে সাহিত্যে যা-কিছু মহকার্য অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মূলে মন-পদার্থটি বিদ্যমান। যা মনে ধরা পড়ে তাই প্রথমে কথায় প্রকাশ পায়, সেইকথা অবশেষে কার্যরূপে পরিণত হয়; কথার সক্ষশরীর কার্যরপ স্থূলদেহ ধারণ করে। আগে দেহটি গড়ে নিয়ে, পরে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টাটি একেবারেই বৃথা। কিন্তু আমরা রাজনীতি সমাজনীতি ধর্ম সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণের সন্ধান না করে শুধু তার দেহটি আয়ত্ত করবার চেষ্টা করায় নিত্যই ইতোনষ্টস্ততেভ্রষ্ট হচ্ছি। প্রাণ নিজের দেহ নিজের রূপ নিজেই গড়ে নেয়। নিজের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির বলেই বীজ ক্রমে বক্ষ-রূপ ধারণ করে। সুতরাং আমরা যদি ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারি, তাহলেই আমাদের সমাজ নবকবের ধারণ করবে। এই নবসভ্যতাকে মনে সম্পূর্ণরূপ পরিপাক করতে পারলেই আমাদের কান্তি পুষ্ট হবে। কিন্তু যতদিন সে সভ্যতা আমাদের মুখস্থ থাকবে কিন্তু উদরস্থ হবে না, ততদিন তার কোনো অংশই আমরা জীর্ণ করতে পারব না। আমরা যে, ইউরোপীয় সভ্যতা কথাতেও তরজমা করতে পারি নি, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই যে, আমাদের নূতন শিক্ষালব্ধ মনোভাবসকল শিক্ষিত লোকদেরই রসনা আশ্রয় করে রয়েছে, সমগ্র জাতির মনে স্থান পায় নি। আমরা ইংরেজি ভাব ভাষায় তরজমা করতে পারি নে বলেই আমাদের কথা দেশের লোকে বোঝে না, বোঝে শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত লোকে। এদেশের জনসাধারণের নেবার ক্ষমতা কিছু কম নয়, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে তারা যে কিছু, পায় না, তার একমাত্র কারণ আমাদের অন্যকে দেবার মত কিছু নেই; আমাদের নিজস্ব বলে কোনো পদার্থ নেই–আমরা পরের সোনা কানে দিয়ে অহংকারে মাটিতে পা দিই নে। অপরপক্ষে আমাদের পবিপুরুষদের দেবার মত ধন ছিল, তাই তাঁদের মনোভাব নিয়ে আজও সমগ্র জাতি ধনী হয়ে আছে। ঋষিবাক্যসকল লোকমুখে এমনি সুন্দর ভাবে তরজমা হয়ে গেছে যে, তা আর তরজমা বলে কেউ বুঝতে পারেন না। এদেশের অশিক্ষিত লোকের রচিত বাউলের গান কাউকে আর উপনিষদের ভাষায় অনুবাদ করে বোঝাতে হয় না, অথচ একই মনোভাব ভাষান্তরে বাউলের গানে এবং উপনিষদে দেখা দেয়। আত্মা যেমন এক দেহ ত্যাগ করে অপর দেহ গ্রহণ করলে পবদেহের অতিমাত্রও রক্ষা করে না, মনোভাবও যদি তেমনি এক ভাষার দেহত্যাগ করে অপর-একটি ভাষার দেহ অবলম্বন করে, তাহলেই সেটি যথার্থ অনুদিত হয়।
উপযুক্ত তরজমার গুণেই বৈদান্তিক মনোেভাবসকল হিন্দুসন্তানমাত্রেরই মনে অল্পবিস্তর জড়িয়ে আছে। এদেশে এমন লোক বোধ হয় নেই, যার মনটিকে নিংড়ে নিলে অন্তত এক ফোঁটাও গৈরিক রং না পাওয়া যায়। আর্যসভ্যতার প্রেতাত্মা উদ্ধার করবার চেষ্টাটা একেবারেই অনর্থক, কারণ তার আত্মাটি আমাদের দেহাভ্যন্তরে সষপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যদি আবশ্যক হয় ততা সেটিকে সহজেই জাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ঠিক কথাটি বলতে পারলে অপরের মনের বার আরব্য-উপন্যাসের দস্যদের ধনভাণ্ডারের বারের মত আপনি খুলে যায়। আমরা, ইংরেজি-শিক্ষিত লোকেরা, জনসাধারণের মনের দ্বার খোলবার সংকেত জানি নে, কারণ আমরা তা জানবার চেষ্টাও করি নে। যেসকল কথা আমাদের মুখের উপর আলগা হয়ে রয়েছে কিন্তু মনে প্রবেশ করে নি, সেগুলি আমাদের মুখ থেকে খসে পড়লেই যে অপরের অতরে প্রবেশ লাভ করবে, এ আশা বৃথা।
আমরা যে আমাদের শিক্ষালব্ধ ভাবগলি তরজমা করতে অকৃতকার্য হয়েছি, তার প্রমাণ তো সাহিত্যে এবং রাজনীতিতে দু বেলাই পাওয়া যায়। যেমন সংস্কৃত-নাটকের প্রাকৃত সংস্কৃত-ছায়া’র সাহায্য ব্যতীত বুঝতে পারা যায় না, তেমনি আমাদের নব-সাহিত্যের কৃত্রিম প্রাকৃত ইংরেজি-ছায়ার সাহায্য ব্যতীত বোঝা যায় না। সমাজে না হোক, সাহিত্যে ‘চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে যদি না পড়ে ধরা। কিন্তু আমাদের নব-সাহিত্যের বস্তু যে চোরাই-মাল, তা ইংরেজি-সাহিত্যের পাঠকমাত্রেরই কাছে ধরা পড়ে। আমরা ইংরেজিসাহিত্যের সোনারপো যা চুরি করি, তা গলিয়ে নিতেও শিখি নি। এই তো গেল সাহিত্যের কথা। রাজনীতি-বিষয়ে আমাদের সকল ব্যাপার যে আগাগোড়াই নকল, এবিষয়ে বোধ হয় আর দুমত নেই, সুতরাং সেসম্বন্ধে বেশি কিছু বলা নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন।
আমাদের মনে-মনে বিশ্বাস যে, ধর্ম এবং দর্শন এই দুটি জিনিস আমাদের একচেটে; এবং অন্য কোনো বিষয়ে না হোক, এই দুই বিষয়ে আমাদের সহজ কৃতিত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ইংরেজি-শিক্ষিত ভারতবাসীদের এ বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ অমূলক, তার প্রমাণস্বরূপ দেখানো যেতে পারে যে, ঐ শ্রেণীর লোকের হাতে মনুর ধর্ম রিলিজিঅন হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ ভুল তরজমার বলে ব্যবহারশাস্ত্র আধ্যাত্মিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। মশাস্ত্র এবং মোক্ষশাস্ত্রের ভেদজ্ঞান আমাদের সস্ত হয়েছে। ধমের অর্থ ধরে রাখা এবং মোক্ষের অর্থ ছেড়ে দেওয়া, সুতরাং এ দুয়ের কাজ যে এক নয়, তা শুধু ইংরেজিনবিশ আর্য-সন্তানরাই বুঝতে পারেন না।
গীতা আমাদের হাতে পড়বামাত্র তার হরিভক্তি উড়ে যায়। সেই কারণে শ্ৰীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘গীতায় ঈশ্বরবাদ’এর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নব্য পণ্ডিতসমাজে শুধু বিবাদবিসম্বাদের সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর গীতার কম ইংরেজি Work-রূপ ধারণ করে আমাদের কাছে গ্রাহ্য হয়েছে; অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের কর্ম কাণ্ডহীন হয়েই আমাদের কাছে উচ্চ বলে গণ্য হয়েছে। এই ভুল তরজমার প্রসাদেই, যে কমের উদ্দেশ্য পরের হিত এবং নিজের আত্মার উন্নতিসাধন পরলোকের অভ্যুদয়ও নয়, সেই কর্ম আজকাল ইহলোকের অ্যুদয়ের জন্য ধর্ম বলে গ্রাহ্য হয়েছে। যে কাজ মানুষে পেটের দায়ে নিত্য করে থাকে, তা করা কর্তব্য–এইটকু শেখাবার জন্য ভগবানের যে লোগায়তন দেহ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবার আবশ্যকতা ছিল না— এ সোজা কথাটাও আমরা বুঝতে পারি নে। ফলে আমাদের-কৃত গীতার অনুবাদ বক্তৃতাতেই চলে, জীবনে কোনো কাজে লাগে না।
একদিকে আমরা এদেশের প্রাচীন মতগলিকে যেমন ইংরেজি পোশাক পরিয়ে তার চেহারা বিলকুল বদলে দিই, তেমনি অপরদিকে ইউরোপীয় দর্শন-বিজ্ঞানকেও আমরা সংস্কৃতভাষার ছদ্মবেশ পরিয়ে লোকসমাজে বার করি।
নিত্যই দেখতে পাই যে, খাঁটি জমান মাল স্বদেশী বলে পাঁচজনে সাহিত্যের বাজারে কাটাতে চেষ্টা করছে। হেগেলের দর্শন শংকরের নামে বেনামি করে অনেকে কতক পরিমাণে অজ্ঞ লোকদের কাছে চালিয়েও দিয়েছেন। আমাদের মুক্তির জন্য হেগেলেরও আবশ্যক আছে, শংকরেরও আবশ্যক আছে; কিন্তু তাই বলে হেগেলের মস্তক মুণ্ডন করে তাঁকে আমাদের স্বহস্তরচিত শতগ্রন্থিময় কশ্ব পরিয়ে শংকর বলে সাহিত্যসমাজে পরিচিত করে দেওয়াতে কোনো লাভ নেই। হেগেলকে ফকির না করে যদি শংকরকে গৃহস্থ করতে পারি, তাতে আমাদের উপকার বেশি।
বিজ্ঞান সম্বন্ধেও ঐরূপ ভুল তরজমা অনেক অনর্থ ঘটিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইভলিউশনের-এর কথাটা ধরা যাক। ইভলিউশনের দোহাই না দিয়ে আমরা আজকাল কথাই কইতে পারি নে। আমরা উন্নতিশীল হই আর স্থিতিশীলই হই, আমাদের সকলপ্রকার শীলই ঐ ইভলিউশন আশ্রয় করে রয়েছে। সুতরাং ইডলিউশনের যদি আমরা ভুল অর্থ বুঝি, তাহলে আমাদের সকল কার্যই যে আরম্ভে পর্যবসিত হবে সে তো ধরা কথা। বাংলায় আমরা ইভলিউশন ‘ক্ৰমবিকাশবাদ’ ‘ক্রমোন্নতিবাদ’ ইত্যাদি শব্দে তরজমা করে থাকি। ঐরূপ তরজমার ফলে আমাদের মনে এই ধারণা জন্মে গেছে যে, মাসিকপত্রের গল্পের মত জগৎ-পদার্থটি ক্রমশ প্রকাশ্য। সৃষ্টির বইখানি আদ্যোপান্ত লেখা হয়ে গেছে, শুধু প্রকৃতির ছাপাখানা থেকে অল্প-অল্প করে বেরচ্ছে, এবং যে অংশটুকু বেরিয়েছে তার থেকেই তার রচনাপ্রণালীর ধরন আমরা জানতে পেরেছি। সে প্রণালী হচ্ছে ক্রমোন্নতি, অর্থাৎ যত দিন যাবে তত সমস্ত জগতের এবং তার অন্তভূত জীবজগতের এবং তার অন্তর্ভুত মানবসমাজের এবং তার অন্তভূত প্রতি মানবের উন্নতি অনিবার্য। প্রকৃতির ধমই হচ্ছে আমাদের উন্নতি সাধন করা। সুতরাং আমাদের তার জন্য নিজের কোনো চেষ্টার আবশ্যক নেই। আমরা শুয়েই থাকি আর ঘুমিয়ে থাকি, জাগতিক নিয়মের বলে আমাদের উন্নতি হবেই। এই কারণেই এই ক্রমোন্নতিবাদ-আকারে ইভলিউশন আমাদের স্বাভাবিক জড়তা এবং নিশ্চেষ্টতার অনকল মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া এই ‘ম’-শব্দটি আমাদের মনের উপর এমনি আধিপত্য স্থাপন করেছে যে, সেটিকে অতিক্রম করা পাপের মধ্যে গণ্য হয়ে পড়েছে। তাই আমরা নানা কাজের উপক্রমণিকা করেই সন্তুষ্ট থাকি, কোনো বিষয়েরই উপসংহার করাটা কর্তব্যের মধ্যে গণ্য করি নে; প্রস্তাবনাতেই আমাদের জীবন-নাটকের অভিনয় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসলে ইভলিউশন ক্ৰমবিকাশও নয় ক্রমোন্নতিও নয়। কোনো পদার্থকে প্রকাশ করবার শক্তি জড়প্রকৃতির নেই, এবং তার প্রধান কাজই হচ্ছে সকল উন্নতির পথে বাধা দেওয়া। ইভলিউশন জড়জগতের নিয়ম নয়, জীবজগতের ধর্ম। ইভলিউশনের মধ্যে শুধু ইচ্ছাশক্তিরই বিকাশ পরিস্ফট। ইভলিউশন-অর্থে দৈব নয়, পুরুষকার। তাই ইভলিউশনের জ্ঞান মানুষকে অলস হতে শিক্ষা দেয় না, সচেষ্ট হতে শিক্ষা দেয়। আমরা ভূল তরজমা করে ইভলিউশনকে আমাদের চরিত্রহীনতার সহায় করে এনেছি।
ইউরোপীয় সভ্যতার হয় আমরা তরজমা করতে কৃতকার্য হচ্ছি নে, নয় ভুল তরজমা করছি, তাই আমাদের সামাজিক জীবনে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না, বরং অপচয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ আমাদের বিশ্বাস যে আমরা দু পাতা ইংরেজি পড়ে নব্যব্রাহণসম্প্রদায় হয়ে উঠেছি। তাই আমরা নিজেদের শিক্ষার দৌড় কত সেবিষয়ে লক্ষ্য না করে জনসাধারণকে শিক্ষা দিবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। এ সত্য আমরা ভুলে যাই যে, ইউরোপীয় সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান থেকে যদি আমরা নতুন প্রাণ লাভ করে থাকতুম তাহলে জনসাধারণের মধ্যে আমরা নবপ্রাণের সঞ্চারও করতে পারতুম। আমরা অধ্যয়ন করে যা লাভ করেছি তা অধ্যাপনার দ্বারা দেশসুদ্ধ লোককে দিতে পারতুম। আমরা আমাদের Cultureকে Nationalise করতে পারি নি বলেই গবর্নমেন্টকে পরামর্শ দিচ্ছি যে আইনের দ্বারা বাধ্য করে জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়া হোক। মান্যবর শ্রীযুক্ত গোপালকৃষ্ণ গোখলে মে হজগটির মুখপাত্র হয়েছেন, তার মূলে ইউরোপের নকল ছাড়া আর কোনো মনোভাব নেই। তাই গবর্নমেন্টকে ভজাবার জন্য দিবারাত্রি খালি বিলেতি নজিরই দেখানো হচ্ছে। শিক্ষা-শব্দের অর্থ শুধু লিখতে ও পড়তে শেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবর্নমেন্টই স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের লিখতে পড়তে শিখিয়েছেন। সুতরাং গবর্নমেন্টকে গ্রামে গ্রামে স্কুল স্থাপন করে রাজ্যিসদ্ধ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেই হবে, এই হচ্ছে আমাদের হাল রাজনৈতিক আবদার। যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের নব-শিক্ষা মজ্জাগত করতে না পারব ততদিন জনসাধারণকে পড়তে শিখিয়ে তাদের যে কি বিশেষ উপকার করা হবে তা ঠিক বোঝা যায় না। আমরা আজ পর্যন্ত ছোটছেলেদের উপযুক্ত একখানিও পাঠ্য পুস্তক রচনা করতে পারি নি। পড়তে শিখলে এবং পড়বার অবসর থাকলে এবং বই কেনবার সংগতি থাকলে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাপ্রাপ্ত চাষার ছেলেরা সেই রামায়ণ-মহাভারতই পড়বেআমাদের নব-শিক্ষার ভাগ তারা কিছু পাবে না। রামায়ণ-মহাভারতের কথা যে বইয়ে পড়ার চাইতে মুখে শোনা অনেক বেশি শিক্ষাপ্রদ, তা নব্যশিক্ষিত ভারতবাসী ছাড়া আর কেউ অস্বীকার করবেন না। মুখের বাক্যে প্রাণ আছে, লেখার ধনিহীন বাক্য আধমরা। সে যাই হোক, আমাদের দেশের লৌকিক শিক্ষার জ্ঞান যদি আমাদের থাকত এবং সেই শিক্ষার প্রতি অযথা অবজ্ঞা যদি আমাদের মনে না স্থান পেত, তাহলে না-ভেবেচিন্তে, লোকশিক্ষার দোহাই দিয়ে, সেই চিরাগত লৌকিক শিক্ষা নষ্ট করতে আমরা উদ্যত হতুম না। সংস্কৃতসাহিত্যের সঙ্গে যাঁর পরিচয় আছে তিনিই জানেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা লোকাচার, লৌকিক ধর্ম, লৌকিক ন্যায় এবং লৌকিক বিদ্যাকে কিরপ মান্য করতেন। কেবলমাত্র বর্ণপরিচয় হলেই লোকে শিক্ষিত হয় না; কিন্তু ঐ পরিচয় লাভ করতে গিয়ে যে বণধর্ম হারানো অসম্ভব নয়, তা সকলেই জানেন। মাসিক পাঁচটাকা বেতনের গুর-নামক গোরর দ্বারা তাড়িত হওয়া অপেক্ষা চাষার ছেলের পক্ষে গোর-তাড়ানো শ্রেয়। ‘ক’-অক্ষর যেকোনো লোকের পক্ষেই গোমাংস হওয়া উচিত নয়, একথা আমরা সকলেই মানি। কিন্তু ‘ক’-অক্ষর যে আমাদের রক্তমাংস হওয়া উচিত, এ ধারণা সকলের নেই। কেবল স্বাক্ষর করতে শেখার চাইতে নিরক্ষর থাকাও ভালো, কারণ পৃথিবীতে আঙুলের ছাপ রেখে যাওয়াতেই মানবজীবনের সার্থকতা। আমাদের আহার পরিচ্ছদ গৃহ মন্দির–সব জিনিসেই আমাদের নিরক্ষর লোকদের আঙুলের ছাপ রয়েছে। শুধু আমবা শিক্ষিতসম্প্রদায়ই ভারতমাতাকে পরিষ্কার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যাচ্ছি। পতিতের উদ্ধারকার্যটি খুব ভালো; ওর একমাত্র দোষ এই যে, যাঁরা পরকে উদ্ধার করবার জন্য ব্যস্ত তাঁরা নিজেদের উদ্ধার সম্বন্ধে সম্পর্কে উদাসীন। আমরা যতদিন শুধু ইংরেজির নীচে স্বাক্ষর দিয়েই ক্ষান্ত থাকব, কিন্তু সাহিত্যে আমাদের আঙুলের ছাপ ফুটবে না, ততদিন আমরা নিজেরাই যথার্থ শিক্ষিত হব না, পরকে শিক্ষা দেওয়া তো দুরের কথা। আমি জানি যে, আমাদের জাতিকে খাড়া করবার জন্য অসংখ্য সংস্কারের দরকার আছে। কিন্তু আর যে-কোনো সংস্করণের আবশ্যক থাক না কেন, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের হাজার হাজার বটতলার সংস্করণের আবশ্যক নেই।
যেমন আমরা অতীতে বিদেশীয়তা স্বদেশীরকমে অভ্যাস করেছি, তেমনি আমাদের ভবিষ্যতে স্বদেশীয়তা বিদেশী নিয়মে চর্চা করতে হবে। আমরা সাহেব হয়েছিল বাঙালি ভাবে। সে ব্যাপারটার মধ্যে আমাদের স্বাভাবিক ঢিলেমি এবং এলোমেলো ভাবেরই শুধু পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা দল বেধে বিধিব্যবস্থাপক সাহেব হই নি। প্রতিজনেই নিজের খুশি কিংবা সুবিধা-অনুসারে নিজের চরিত্র এবং ক্ষমতার উপযোগী হঠাৎ-সাহেব হয়ে উঠেছি। ইগবগ-সমাজে আমরা সবাই স্বাধীন, সবাই প্রধান। স্বদেশী আচার-ব্যবহার ছাড়বার সময় আমরা পুরুষেরা পহিলা সমিতি করি নি, এখন ফিরে ধরবার ইচ্ছেয় আমরা মহিলা-সমিতি পর্যন্ত গঠন করেছি। এই যথেষ্ট প্রমাণ যে, আমাদের নতুন ভাব কার্যে পরিণত করতে হলে ভাবনা-চিন্তা চাই; কি রাখব, কি ছাড়ব, তার বিচার চাই; পাঁচজনে একত্র হয়ে কি করতে পারব এবং কি করা উচিত, তার একটা মীমাংসা করা চাই; এক কথায়, ইংরেজ যে উপায়ে কৃতকার্য হয়েছে সেই উপায়-একটা পদ্ধতি অবলম্বন করা চাই। সমাজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার ভিতর নিয়ম নেই। ঝোঁকের মাথায় রোখের সহিত কাজ করতে গেলে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হওয়াই দরকার। কিন্তু সমাজে থাকতে কিংবা ফিরতে হলে সকলেরই মানসিক গতি একই কেন্দ্রের অভিমুখী হওয়া চাই, এক নিয়মে অনেককে ধরা দেওয়া চাই। আমাদের বিদেশীয়তার ভিতর হিসাব ছিল না, স্বদেশীয়তার ভিতর হিসাব চাই। যে পরিবর্তনের জন্য আমরা উৎসুক হয়েছি, তার বিষয় হচ্ছে প্রধানত বাহ্যবস্তু। কিন্তু সেই পরিবর্তন সসাধ্য করতে হলে মনকে অনেকটা খাটাতে হবে। সমাজে থাকতে হলে বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ কোনো চর্চা করবার দরকার নেই, প্রচলিত নিয়মের নির্বিচারে দাসত্ব স্বীকার করলেই হল; ছাড়তে হলেও দরকার নেই—নির্বিচারে নিয়ম লঙ্ঘন করলেই হল। কিন্তু ফিরতে হলে মানুষ হওয়া চাই; কারণ যে ফেরে, সে নিজের জ্ঞান এবং বুদ্ধির যারা কর্তব্য স্থির করে নিয়ে স্বেচ্ছায় ফেরে। আমরা বাঙালি-সাহেবই হই, আর খাঁটি বাঙালিই হই, আমরা সকলেই এক পথের পথিক হয়েছিলুম; কেউ-বা বিপথে বেশি দূর এগিয়েছি, কেউ-বা কিছু পিছিয়ে আছি। আমাদের সমাজ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই বর্ণচোরা বাঙালি-সাহেব। আমাদের হিন্দুসমাজে শখলা অতীতে গঠিত হয়েছিল, আজকালকার দিনে নতুন অবস্থায় কতকাংশে তা সকলেরই পক্ষে শখল মনে হয়। আমরা জনকতক শুধু উচ্ছল হয়েছি, বাদবাকি সকলে সমাজকে বিশখল করে ফেলেছেন। সুতরাং সকলে মিলেই ঘদেশীয় আচারব্যবহারে ফিরে যাবার জন্য ব্যগ্র হয়েছি। সকলেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, সুতরাং যে পরিমাণে সাধ্য এবং উচিত সেই পরিমাণে ফিরব, তার বেশি নয়। জাতীয় জীবনের বিশেষ কোনো লক্ষ্য ছিল না বলে এতদিন আমরা গা ঢেলে দিয়ে স্রোতে ভাসছিল, তার ভিতর কোনো আয়াস, কোনো চেষ্টা ছিল না; এখন গমনের একটা ঠিকানা পাওয়া গেছে, সুতরাং সাঁতার কাটতে হবে। শুধু এলোমেলোভাবে, অতিবেগে হাত-পা ছুড়লে চলবে না; তাতে পাঁচজনে হাসবে, দশজনে ‘বাহবা কি বাহবা, কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ’ বলবে, কিন্তু আমরা লাভের মধ্যে শীঘ্রই এলিয়ে পড়ব এবং নাকানিচোবানি খাব।
পূর্বেই বলেছি যে, আমরা বাঙালিমাত্রেই ঐ একই বিলেতি ক্ষরে মাথা মুড়িয়েছি। শুধু কারো মাথায় কাকপক্ষ অবশিষ্ট, কারো মাথায়-বা শুধু টিকি; যাঁর যেটকু অবশিষ্ট আছে, তিনি সেইটেই স্বদেশীয়তার ধজাম্বরপ আস্ফালন করেন। এ ব্যাপারে আমাদের ইগবগ-দলের মন ভারি করবার কোনো কারণ নেই। ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আমাদের জাতি যদি কোনো স্থায়ী সফল লাভ করে থাকে তো সে মনে, আর যা যা ক্ষণস্থায়ী কুফল লাভ করেছে, সে বাহ্য আচারব্যবহারে। মোটামুটি ধরতে গেলে এ ব্যাপারের লাভলোকসানের হিসাবটা ঐরূপ দাঁড়ায়। সেই আচার-ব্যবহারের বিজাতীয়তা আমাদের মধ্যে যেমন স্পষ্ট এবং জাজল্যমান হয়ে উঠেছে, এমন আর অন্য কোনো শ্রেণীর লোকের মধ্যে হয় নি। সকলেই অল্পবিস্তর বিলেতি মধু পান করেছেন, কিন্তু পুরো নেশা শুধু আমাদেরই ধরেছে। বিদেশী বন্ধুর বড়ো বস্তা আমরা মাথায় বহন করছি, অপরে পটলিপাঁটলা নিয়ে চলেছে। আমরা যদি আমাদের মাথার সে ভার নামাতে পারি, তা হলে অপরের পক্ষে তাদের মাথার সে ভার ঝেড়ে ফেলা কঠিন হবে না। এই ঘদেশীয়তার কথা শুধু দেশের কথা নয়, এ ঘরেরও কথা। বাঙালি যখন নিজের সমাজ ছাড়ে, তখন সেইসঙ্গে নিজের স্বভাব ছাড়ে না। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে; অর্থাৎ সেখানেও অপরের পায়ের চাপ না পেলে তার দিন চলে না। আমাদেরও স্বভাব তাই। নিজের সমাজের চাপ থেকে বেরিয়ে এসে বিদেশী সমাজের পায়ের চাপ আমরা পিঠে তুলে নিই। বাঙালিজাতকে পিটে গড়া হয় নি। আমরা ঢালাই হতে ভালোবাসি। এক ছাঁচ থেকে বেরোলে আমরা অন্য ছাঁচে না পড়লে ঠাণ্ডা হই নে। অনুকরণ আমাদের স্বাভাবিক। এবং অনুকরণে যেহেতু শুধু উপকরণ সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু কিছুই আত্মসাৎ করা যায় না, সেই কারণে আমরা বিলেতি সভ্যতার উপকরণে আমাদের দৈনিক জীবন নিতান্ত ভারাক্রান্ত করে তুলেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো অস্থি-মজ্জায় অনুভব করেছেন যে, বিলেতি সভ্যতার কুলিগিরির মজুরি পোষায় না। কিন্তু দু-একজন ছাড়া মুখ ফুটে সে কথা বলতে বড়ো কেউ সাহসী হন নি। দেশীয় সমাজের রীতিনীতির অধীনতার মধ্যে, কার্যের না হোক, চিন্তার স্বাধীনতা আছে। যার মন আছে, তার সামাজিক আচার-ব্যবহার সঘধে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার এবং মতামত ব্যক্ত করবার অধিকার আছে; কিন্তু বিলাতের অনুকরণে যে বাঙালি ঘর বাঁধে, তার একল-ওকল দুলে যায়। আমাদের মধ্যে যার মন যত ঢিলে, তার সাহেবিয়ানার আঁটাআঁটি তত বেশি। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণ কোথায় যে বুঝতে পারে না, সে তার সর্বাঙ্গে হাতড়ে বেড়ায়। আমরা অনেকে একটা খোরপোশর বন্দোবস্ত করতে বিলেত যাই, সুতরাং বিলেতি সভ্যতার যে শুধু খাওয়া-পরার অংশটা আয়ত্ত করতে চেষ্টা করব, এর আর আশ্চর্য কি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, যে আরামের লোভে আমরা সর্বস্ব খোয়াতে বসি, সেই আরামই আমাদের জোটে না; দেশীয় সমাজের চালচলন শৈশব হতে অভ্যস্ত বলে সেদিকে মন দিতে হয় না, ঠিক ঠিক জিনিসটে অবলীলাক্রমে করে যাই; কিন্তু বিদেশী চালচলন সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই একটা বয়সে কেচেগণ্ডষ করতে হয়। একটু বয়েস হলে একটি বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করা যেমন কষ্টসাধ্য, একটি বিদেশী সমাজের হাজারো-এক খুঁটিনাটি আচার-ব্যবহার আয়ত্ত করাও তেমনি কঠিন। বিলেতি সভ্যতার সম্মুখে বাঙালি-সাহেবের আচল টানতে টানতে প্রাণ যায়। খানায়-পোশাকে যাঁরা সভ্যতা খোঁজেন, তাঁদের খানার-পোশাকের কায়দা-কানুন কস্ত করতে নাস্তানাবুদ খানেখারাপ হতে হয়। যাঁরা মাছিমারা নকল করতে চান, তাঁদের নিত্য দেখতে পাই, অক্ষরের পর অক্ষর ধরে বিদেশী হালচাল অভ্যেস করতে প্রাণান্ত-পরিচ্ছেদ হচ্ছে। অন্যকে বানান করে পড়তে শুনলে মায়াও করে, বিরক্তিও ধরে। সাধারণ ইবঙ্গের প্রতিও আমাদের ঐ মনোভাব। কাবো কারো বা বিলেতি সভ্যতার বর্ণপরিচয় হয়েছে, কিন্তু অর্থবোধ হয় নি। এতদ্দেশীয় মুসলমান মহিলার কোরানপাঠের মতো তাঁদের সভ্যতাচর্চার পরিশ্রমটা বৃথা যায়।
সংস্কারবশত হিন্দুসমাজের প্রতি যাঁদের প্রাণের টান আছে, অথচ শিক্ষাবশত যাঁরা সংস্কারমাত্রেরই অধীন নন, যাঁদের ধারণা যে ইউরোপের শিষ্য হওয়া এবং দাস হওয়ার ভিতর আকাশপাতাল প্রভেদ, যাঁরা বিলেতি আচার-ব্যবহার কতকপরিমাণে অবলম্বন করেন–হয় বুদ্ধির দ্বারা পরীক্ষা করে, নয় জীবনে পরীক্ষা করবার উদ্দেশ্যে—এক কথায় যাঁরা শ্যাম এবং কুল, দুইই রাখবার চেষ্টা করেন, তাঁরা আহেল বিলেতি ইগবগদের মতে কেন্দ্রভ্রষ্ট। বাদ-বাকি যাঁরা নিজের নিজের ব্যাবসা ব্যতীত অপর কোনো বিষয়ে কিঞ্চিন্মাত্র মনোপ্রয়োগ করাটা বুদ্ধিবৃত্তির বাজে-খরচ মনে করেন, তাঁরাই বুদ্ধিমান। কেন্দ্রভ্রষ্ট?-কোথাকার কোন সমাজের, কোন, কেন্দ্রভ্রষ্ট? এ প্রশ্ন করলে সকল বুদ্ধিমানই নিরুত্তর। পড়ানো-কাকাতুয়ার কপচানো বলির মতো যদি তাঁদের কথা নিরর্থক না হয়, যদি তাঁদের বক্তব্যের ভিতর মনের কার্য কিছু প্রচ্ছন্ন থাকে তো সে মনোভাব এই—তাঁরা প্রত্যেকেই এক-একটি কেন্দ্র, তাঁদের কাছ থেকে যে যতটা তফাত, সে ততটা কেচুত, ততটা উন্মার্গগামী। বিলেতফেরত-পাড়ায় প্রতি গৃহ একটি সৌরজগৎ; হয় কতা নয় গহিণী সেই জগতের কেন্দ্র; পরিবারের আর-সকলে গ্রহ-উপগ্রহের মতো তারই চারি পাশে পাক খায়, এখানে-সেখানে দু-একটি ধমকেতুও দেখা দেয়। আমাদের কারো গহ, হিন্দুগহের একটি পরিবতিত যুগপৎ পরিবর্ধিত ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মাত্র; কারোবা গৃহ বিলেতি গহের একটি নিকৃষ্ট ফোটোগ্রাফ মাত্র। আমরা কেউ-বা বিদেশীয়তাব দু-চার সিঁড়ি ভেঙেছি, কেউ-বা একলফে বিলেতি সভ্যতার মন্দিরের চড়ার উপরিথিত ত্রিশালের উপর গিয়ে চড়ে বসেছি।।
সাহেবিয়ানার প্রচণ্ড নেশায় বঙ্গসন্তানকে যে কতদূর বে-এক্তিয়ার করে ফেলতে পারে, তার প্রমাণ ধর্মতলার রঙ্গমন্দিরে ধর্মমন্দিরের প্রতিষ্ঠাথে করণ যাচাল বিদেশীয় পণ্ঠপোষকতায় ব্লো Tablcaux হ্বিভা Vivants অভিধেয় বিচিত্র চিত্র-অভিনয়। নেশা ধরা পড়ে দুই জিনিসে অবিক্ষেপে এবং বাক্যবিপর্যয়ে। এ ব্যাপারে দুই লক্ষণেরই সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। ঐ দশ-কাব্যের পিছনে একটি দর্শন আছে, একটি কবিত্ব আছে; সেই কবিত্বপর্ণ দর্শন কিংবা দার্শনিক কবিত্বের প্রকাশ নিউ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে। উক্ত ব্যাপারের সপক্ষে নিউ ইন্ডিয়ার মতামত, ইন্ডিয়া না হোক নিউ বটে। জস্টিস অনকল মোজির জীবনীর ভাষা যেমন নতুন, এর ভাবও তেমনি নতুন; এবং উভয় রচনাই এক উপায়ে সিদ্ধ হয়েছে। ইংরেজি ফরাসি লাটিন গ্রীক এবং ইটালিয়ান নানা ছোটো-বড়ো বাছা-বাছা বাক্য ও পদের অসংগত সমাবেশে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের জীবনীলেখকের রচনা ভাষার রাজ্যে যেমন এক অপূর্ব কীর্তি, জীবতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব ইতিহাস পরাণ ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সকল শাস্যের ছোটো-বড়ো নানা বাছা-বাছা শব্দ এবং বাক্যের অসংগত সমাবেশে সম্পাদক মহাশয়ের রচনা চিতার রাজ্যে তেমনি এক অপরকীর্তি। লেখক কিছুই বাদ দেন নি-চিত্রকলাও নয়, নত্যকলাও নয়। কলাবিদ্যার কতকটা জ্ঞান অনেকটা চার উপর নির্ভর করে, কিন্তু অসমসাহসী লেখকের পক্ষে ঠিক তার উলটো। দাম্ভিকতার বলে অজ্ঞতা বিজ্ঞতার সিংহাসনে অধিরোহণ করতে পারে। কলাবিদ্যার শুধু শেষাংশ দেখাবার চেষ্টা করে অনেকে, তাঁরা যে শুধু তার প্রথমাংশ জানেন, এই প্রমাণ করেন। এ বিশ্ব ভগবানের লীলাখেলা হতে পারে, কিন্তু সমাজের সৃষ্টি স্থিতি এবং উন্নতি মানুষের লীলাখেলার ফল নয়। এই প্রবধে উক্ত ব্যাপারের অবতারণা করবার একটু বিশেষ সার্থকতা আছে। আমাদের নকল সভ্যতা এর উধে আর উঠতে পারে না। আমাদের দোলের ঐ শেষসীমা, পেণ্ডুলমকে ঐখান হতেই ফিরতে হবে, এবং কার্যত ফিরতে আরম্ভ করেছে। ঘরে বিদেশী অনাচারের ঠেলা এবং বাইরে বিদেশী অত্যাচারের চাপ, এই দুয়ের ভিতর পড়ে যাঁরা কিঞ্চিৎ বেদনা অনুভব করছিলেন, তাঁদের অনেকেরই আজ চৈতন্য হয়েছে। ঐ ঘটনায় আমাদের মধ্যে অনেক অন্যমনস্ক লোকেরও মনে পড়ে গেছে যে, আমাদের একটা সমাজ ব’লে কোনো জিনিস নেই। আমরা ঝরাপাতার দল, হাওয়ায় আমাদের কখনো-বা একত্র জড় করে, কখনো-বা ছড়িয়ে দেয়। গাছের অসংখ্য পাতা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র হলেও তাদের সকলের ভিতর নাড়ির এবং রক্তের বন্ধন আছে; তাদের একের প্রাণের মূলও যেখানে, অপরের প্রাণের মূলও সেখানে দেশের মাটিতে। কিন্তু আজ আমাদের অনেকেরই চোখ ফটেছে। আমরা নিজের নিজের সংকীর্ণ সমাজ ত্যাগ করলেও হিন্দুসমাজ আমাদের ত্যাগ করে নি। আমরা নিজেরা শুধু সেই বহৎ সমাজের মধ্যে আর-একটি সংকীর্ণ সমাজ গড়তে চেষ্টা করেছিলুম, সৌভাগ্যক্রমে তাতে কৃতকার্য হই নি। আজকাল ভারতবাসীর দেহে নতুন প্রাণ এসেছে; হিন্দুসমাজ একটি সবহৎ স্বদেশী সমাজে পরিণত হচ্ছে, জাতের ভাব দূর হয়ে জাতীয় ভাব উপস্থিত হয়েছে, আমরা পরস্পরের পার্থক্য ভুলে গিয়ে স্বদেশীর সঙ্গে বিদেশীর পার্থক্য অনুভব করতে আরম্ভ করেছি। এ অবস্থায় আমাদের স্বদেশীয়তায় ফেরার অর্থ আমরা যে বরাবর স্বদেশ ও জাতির অন্তর্ভুত হয়েই আছি, সেই বিষয়ে পণ্টজ্ঞান জন্মাননা। আমরা যে-সমাজে ফিরছি, সে-সমাজ পূর্বে ছিল না, আজও পর্ণাবয়বপ্রাপ্ত হয় নি, ভবিষ্যতে তার রূপ যে কি হবে, তাও আমরা আজ ঠিক ধরতে পারি নে। তার স্বরূপ জানবারও কোনো আবশ্যক নেই; শুধু এই জানি যে, আমাদের জাতির মূলশতি উদবোধিত হয়েছে। সেই শক্তি আমাদের সকলেরই প্রাণে জাগরুক হয়ে উঠেছে, যে শক্তির কার্য হচ্ছে আমাদের সমগ্র জাতির অপরূপ শ্ৰী এবং উন্নতি সাধন করা। জড়পদার্থ নিয়ে একটা কিছু গড়তে হলে আগে হতেই একটা প্ল্যান এবং এসটিমেট করতে হয়; কিন্তু প্রাণ নিজের আকৃতি নিজে গড়ে নেয়, বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপও ক্রমে পষ্ট হয়ে আসে। প্রকৃতি যে ফুল ফোঁটাবে, মানুষ তার সাহায্য করতে পারে কিংবা বাধা দিতে পারে, কিন্তু তাতে স্বকপোলকপিত বর্ণ গন্ধ আকার এনে দিতে পারে না। কাগজের ফুল রচনায় আমাদের যে স্বাধীনতা আছে, গাছের ফল ভালো করে ফোঁটানোতে সে স্বাধীনতা নেই। আমাদের স্বদেশী সমাজের অক্ষয়-বটে নতুন পাতা দেখা দিয়েছে, আমাদের কর্তব্য এখন তার গোঁড়ায় প্রচুর সার এবং জল জোগাননা, আর চার পাশের জঞ্জাল ও জঙ্গল দূর করা। আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক-সকল স্বদেশী সমাজ অবলম্বন করেও আমাদের স্বাতন্য রক্ষা করব, কিন্তু সে তার শাখাপ্রশাখা হয়ে, পরগাছা হয়ে নয়। সুতরাং আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশী না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। আমাদের তন মন ধন দেশের পায়ে বিকতে হবে, বিদেশের পায়ে নয়। আমাদের এই ধারণাটকু জন্মানো উচিত যে, আমাদের কেউ নিজের শক্তি বিক্ষিপ্ত করে ফেলবার অধিকারী নন; সকলের শক্তি একত্র করে, সংহত করে, স্বদেশের জাতির উন্নতির কার্যে প্রয়োগ করতে হবে। অল্প হোক, বিস্তর হোক, আমাদের প্রত্যেকের আত্মশক্তি যাতে ব্যর্থ না হয়, যাতে তা সামাজিক গতির সহায়ভূত হয়, তার জন্য প্রথমত দিকনির্ণয় করা দরকার। তার পর, কোথায় কি উপায়ে নিজশক্তি প্রয়োগ করতে পারি, তার হিসাব জানতে হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার বক্তব্য দেখতে পাচ্ছি ক্ৰমে ফলাও এবং গুরতর হয়ে আসছে। এই স্থানেই সুতরাং আমাকে মনের রাশ টেনে ধরতে হবে। এ প্রবন্ধে আমার কতকগুলো সাদাসিধে ছোটোখাটো দৈনিক আচার-ব্যবহারের আলোচনা করবার অভিপ্রায় আছে। কিন্তু হঠাৎ দেখছি ধান ভানতে শিবের গীত শর করে দিয়েছি। এখন ভূমিকা ছেড়ে জমিতে নামাই আমার পক্ষে কর্তব্য। আয়একটি কথা বলেই আমি প্রকৃত প্রস্তাব আরম্ভ করব। সে কথাটি হচ্ছে এই, ভারতবর্ষের লন্ত সভ্যতা উদ্ধার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়; আজকের দিনে নিজের দেশে আপনার ভিতর যে নতুন সভ্যতার বীজের সন্ধান পেয়েছি, তাকেই পত্র-পল্পফল-মণ্ডিত মহাবকে পরিণত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। স্বদেশের জ্ঞান লাভ করতে গিয়ে ঘ-কালের জ্ঞান যেন না হারাই। আমাদের নূতন সভ্যতা যে পেই ধারণ করুক-না কেন, মাটির গুণে তাকে স্বদেশী হতেই হবে। জীবনীশক্তির ক্ষতি পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয়। বীজ থেকে বক্ষ একটা ধারাবাহিক পরিবর্তনের সমষ্টি মাত্র। আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজ, ভূত সমাজও হবে না, অদ্ভুত সমাজও হবে না। ইংরেজিয়ানার মোহে আমরা অতত্বের চর্চা করছিলুম, কিন্তু ভূতে না পেলে যে অদ্ভুতত্ব বর্জন করা যায় না, এমন নয়। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের জাতির ভিতর প্রাণ আছে। বর্তমান অশান্তি শুধু নতুন জীবনের চাঞ্চল্য, মত্যর অব্যবহিতপব বিকারের ছটফটানি নয়। যে সমাজে প্রাণ আছে, সে সমাজে প্রাণের যে প্রধান লক্ষণ-বাইরের অবস্থার উপযোগী আত্মপরিবর্তন সে লক্ষণ প্রচুর পরিমাণে দেখা যাবে। এ জগৎ গম, ধাতু হতে উৎপন্ন, এমন গুণী আমরা কেউ নই যে জগতের ধাত বদলে দিতে পারি। স্বদেশীভাবের মূল হতে অনেক আশার ফল ফটবে, কিন্তু ফল ধরবে না। দেশের মাটি ভালোবাসি বলে যে, মাটি নিতে হবে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে, শেষটা মাটি হতে হবে, এ ভুল যেন কেউ না করেন। আমরা আজ যখন জীবনের পথে অগ্রসর হতে চলেছি, তখন এইটে মনে রাখতে হবে যে, দেশের মাটি আমাদের পদক্ষেপের পক্ষে ভগবান দত্ত অটল নির্ভর। অতীতের যে আগুন নিবেছে, যার এখন ভস্মমাত্র অবশিষ্ট আছে তাতে অতি ভক্তিভরে বাতাস দিলেও শুধু ছাই উড়িয়ে সমাজের চোখে ফেলব। কিন্তু আমাদের জাতির প্রাণে যেখানে আজও আগুন আছে, সেখানেই ফ; দিতে হবে, পাখা করতে হবে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, কোথায় শুধু ছাই আর কোথায় ছাই-ঢাকা আগন আছে কি করে জানব? তার উত্তর, যদি পশু করে আগন না চিনতে পারতো পাঁজি-পথির সাহায্যে তা পারবে না। অতঃপর ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, আমাদের এগোতে হবে। বড়োগোছের একটা লাফ মারবার পরে মান কিঞ্চিৎ পিছ, হটে পাল্লা নেয়; আমাদের সমাজ এখন পাল্লা নিচ্ছে। সরীসপের মতো সমাজও ক্রমাগত দেহকে আকুঞ্চন-প্রসারণ করে অগ্রসর হয়। কি উপায়ে কতদূর পর্যন্ত আমাদের সামাজিক দেহের আজ আকুঞ্চন করা কর্তব্য, সেই সম্বন্ধে গোটাকতক কথা বলতে উদ্যত হয়েছি।
২.
বিবাহিত জীবনের পরিণাম সম্বন্ধে পাঞ্জাবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে –
ভুল গেয়া রাগরঙ্গ, ভুল গেয়া ইয়কড়ি,
ইয়াদ রহা আজ খালি তেল নুন লকড়ি।
ইংলন্ডের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্বন্ধ আজকাল কতকটা ঐ ভাবের দাঁড়িয়েছে। আমরা শিক্ষিত ভারতবাসীরা এতদিন প্রভুর চিত্ত আকর্ষণ করবার জন্য কতই-না হাবভাব লীলাখেলার চর্চা করেছি। ওনার মনোমত কেশবিন্যাস বেশবিন্যাস বাগবিন্যাসের চাতুরী অভ্যাস করেছি। আত্মহারা হয়ে ইউরোপের আত্মীয় হতে যত্ন ও পরিশ্রমের এটি করি নি। এত করেও যখন মন পেলাম না, তখন মান-অভিমানের পালা শুরু করলুম। ফল তাতে উলটো হল–দাম্পত্য প্রণয়ের দাবি করাতে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়েছে। তাই আজ তেল নুন লকড়ির কথাই আমাদের মনে প্রাধান্য লাভ করেছে। মানবজাতিকে আমরা যে যেই ভাবে দেখি-না কেন, মানবজীবনে সকলেই তেল নন লকড়ির গুরত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। দেহকে আত্মার কারাগারই মনে করি, আর আত্মার মন্দিরই মনে করি, এ পৃথিবীতে দেহমনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের ভিত্তির উপর ব্যক্তিগত ও জাতিগত জীবন গড়তে হবে। ইহলোকেব সত্যকে মিথ্যা জ্ঞান করলে শুধু পরলোকপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হিন্দুশাঘের মতে অন্ন প্রাণ। সুতরাং অন্নচিন্তাই প্রাণীমাত্রেরই আদিম চিতা। এই অন্নচিন্তা হতে উদ্ধার না পেলে অন্য চিতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তেল নন লকড়ির অধীনতাপাশ মোচন না করতে পারলে মনের এবং আত্মার পুরো স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। মেটিরিয়াল প্রসপারিটি সভ্যতার চরম লক্ষ্য নয়, কিন্তু একটি বিশিষ্ট উপায়। তেল নুন লকড়ির অধীনতা হতে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় –তেল নন লকড়ির সংস্থান করা। আমাদের আজ হঠাৎ চৈতন্য হয়েছে যে, ভারতবাসীর সে সংস্থান নেই। আমরা শুকিয়ে যাচ্ছি, কেননা দেশের রস বিদেশে টেনে নিচ্ছে। নিজ দেশের রস নিজ দেহের রক্তে কিরূপে পরিণত করতে পারি, সেই আমাদের প্রধান সমস্যা। আমরা যদি ভুলে গিয়ে না থাকি, তা হলে আমাদের ‘রাগরঙ্গ ইয়কড়ি’ ভুলে যেতে হবে, আর আমাদের মনে যদি না থাকে, তা হলে মনে রাখতে হবে শুধু ‘তেল নন লকড়ি’। রাকিন সমস্ত জীবন ধরে ইংলণ্ডকে এই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, ইকনমিকস-এই গ্রীক শব্দের আদিম অর্থ হাউসহোন্ড ম্যানেজমেন্ট, অর্থাৎ গেরস্থালি। প্রতি গহে যদি লক্ষ্মী না থাকেন, তা হলে সমগ্রজাতি লক্ষ্মীছাড়া হবে। ঘর যদি অগোছাল রাখ, তা হলে হাটে-বাজারে যতই কেনা-বেচা কর-না কেন, তাতে নিজে কিংবা জাতি যথার্থ স্ত্রী এবং সখ লাভে সমর্থ হবে না। এ মতের মধ্যে এইটকু খাঁটি সত্য নিহিত আছে যে, দশে মিলে জাতীয় সমন্ধিলাভের যে সমবেত চেষ্টা করি, তার সফল আমরা ঘরে ঘরে স্বেচ্ছাচারিতায় নিষ্ফল করে দিতে পারি। আমরা যদি সকলে একত্র হয়ে বাইরে এক দিকে টানি, আর প্রতি লোক ঘরে এসে তার উলটো টান টানি-তা হলে ঘর বার দুই নষ্ট হবে। আমি গ্রাফিনের শিষ্যস্বরূপে এই কথা প্রচার করতে উদ্যত হয়েছি যে, সুগৃহিণীর প্রথম এবং প্রধান কাজ গহের সম্মার্জনা করা।
৩.
আমরা যে গহে বাস করি, সে যে কোন দেশীয় বলা কঠিন। বাংলার বাইরে, কি স্বদেশে কি বিদেশে, কোথাও তার জুড়ি দেখতে পাই নে। গৃহ যেমন সমাজের মূল, তেমনি আবার শহরেরও বুনিয়াদ। গৃহ হতে পল্লি, পল্লি হতে নগর, নগর হতে শহর-ক্রমবিকাশের এই নিয়ম। রোম প্যারিস প্রভৃতি বনেদি শহরের আকি, টেকচরেতেই তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ। ঐ আর্কিটেকচরের প্রসাদেই নাগরিকগুণ বর্তমানে অতীতের সঙ্গে ঘর করে, অতীতের সুখ দুঃখ আশা ভরসা সফলতা ও বিফলতা, গৌরব ও লজ্জা অলক্ষিতে তাদের মন অধিকার করে নেয়; প্রত্যেকেই নিজের আত্মার ভিতর বহত্তর জাতীয় আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে। তাদের পক্ষে স্বজাতীয়তার ও ঘদেশীয়তার কাছে নিজেদের ধরা দেওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক; তা হতে মুক্তি পাওয়াই আয়াসসাধ্য। আমাদের ভিতর মহদতঃকরণ বাকিরা যেমন অহংজ্ঞান খর্ব করে স্বজাতির পায়ে আত্মসমর্পণ করাটা জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন, তেমনি ইউরোপের মহদন্তঃকরণ ব্যক্তিরাও স্বজাতিজ্ঞান খর্ব করে মানবজাতির পায়ে আত্মসমর্পণ করাটা জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন। আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে ন্যাশনালিজম, তাদের উচ্চ সাধনার বিষয় হচ্ছে ইনটারন্যাশনালিজম। সে যাই হোক, কলিকাতার মতো ভুইফোঁড় শহরে শ্রীহীন অর্থহীন কিভূতকিমাকার ভুইফোঁড় গহে বাস করে আমাদের পক্ষে স্বদেশী ভাব রক্ষা করাটা সহজ নয়। চকমেলানো বাড়ি হালফ্যাশানে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। একটি সবা গোছের ঘর, তার এপাশে দুটি, ওপাশে দুটি–এই পাঁচ কামরা নিয়ে আমাদের গহ। মধ্যের ঘরটি হচ্ছে বাইরের ঘর, এবং উভয় পাবের বহির্দিকের ঘর-কটি হচ্ছে অন্দর। বাসস্থানের এই উলটোপালটা ভাবের সঙ্গে আমাদের সামাজিক জীবনের বরাবর যোগ রয়ে গেছে। আমাদের গ্রীষ্মের দেশে ঘরে হাওয়াও চাই ছায়াও চাই, একসঙ্গে দুই পাওয়া অসম্ভব বলে এ দেশের গৃহ দু ভাগে বিভক্ত হওয়া দরকার। এক অংশ বায়ুর পক্ষে যথেষ্ট ভোলা, অপর অংশ সূর্যের পক্ষে যথেষ্ট রন্ধ। পৃথিবীর সর্বত্রই পঞ্চভূত মিলে মানুষের গৃহনির্মাণের হিসাব বাতলে দেয়। প্রকৃতিই এ দেশের গৃহ সদর এবং অন্দরে ভাগ করতে শিখিয়েছিলেন। এবং আমাদের সমাজের গঠনও গহের গঠনের অনেকটা অনুসরণ করেছে। এই কারণে গ্রীষ্মপ্রধান দেশেই অবরোধ একটি সামাজিক প্রথা। আমার বিশ্বাস, এই কড়া রোদ এবং চড়া আলোর দেশে অসম্পশ্যা হবার লোভেই রমণীজাতি স্বেচ্ছায় অন্তঃপুরবাসিনী হয়েছেন। যেখানে গহে শ্রীপুরুষের স্বতন্ত্র রাজ্যের সীমা নির্দিষ্ট নেই, সেখানে সমাজেও শ্রীপুরুষের সাম্য অর্থে ঐক্য—এই ভুল বিশ্বাস জন্মলাভ করে। ইংরেজিয়ানার প্রসাদে আমাদের বাসগৃহের সদর অন্দর ভেস্তে যাবার প্রধান ফল এই যে, আমাদের স্ত্রীপুরুষ উভয়েই গহে অনেকটা সংকুচিত ভাবে বাস করে। আমাদের ড্রয়িংরুম পাড়াপড়শীর বৈঠকখানা হতে পারে, এবং বাড়ির কোনো অংশই মেয়েদের দুর্গে নয়। এ দেশটি যে বিদেশ, সেটা সর্বদা মনে জাগরুক রাখবার জন্য ইংরেজ দেশীয় সমাজ হতে আলগোছ হয়ে থাকেন, নইলে ভয় পাছে জাতিরক্ষা না হয়। আমরা তাঁদের অনুকরণে বাসা বাঁধলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্ব-সমাজ হতে দূর হয়ে পড়ি। মোটামুটি আমার বক্তব্য কথা এই, মানুষমাত্রেরই দেশের সঙ্গে প্রধান যোগ গৃহ দিয়ে; স্বদেশীয়তার গোঁড়াপত্তন ঐখানেই, গৃহ্যসূত্র হতেই মানবধর্মশাস্ত্রের উৎপত্তি। গহের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে গহীর রুপান্তরও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও আমি কাউকে বাড়িবদলানোর পরামর্শ দিয়ে লোকসমাজে নিজেকে বিষয়বুদ্ধিহীন বলে প্রমাণ করতে রাজি নই। এ বিষয়ে আমার ভবিষ্যতের আশার একমাত্র ভরসা-একটা বড়োগোছের ভূমিকম্প।
গৃহে প্রবেশ করেই এক অপূর্ব দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। আমরা দেখতে পাই যে, বিদেশী বস্তু আমাদের গৃহ আক্রমণ করেছে, এবং তার অন্তরতম প্রদেশ পর্যন্ত অধিকার করে বসে আছে। সাহেবিয়ানার খাতিরে আমাদের গৃহসজ্জা অসম্ভবরকম জটিল হয়ে পড়েছে। আসবাবের ভিড় ঠেলে ঘরে ঢোকাই মুশকিল, চলে-ফিরে বেড়াবার স্বাধীনতা তো একেবারেই নেই। এই জটিলতার মধ্যে সকলকেই কুটিল গতি অবলম্বন করতে হয়। প্রথমেই মনে হয় যে, এ ঘর বাসের জন্য নয়, ব্যবহারের জন্য নয়—সাজাবার জন্য, দেখাবার জন্য, গহস্বামীর ধন এবং শিক্ষার পরিচয় দেবার একটা প্রদর্শনী মাত্র, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মিলনের অপ্রশস্ত ক্ষেত্র। আমাদের নূতন ধরনের গৃহসজ্জার বর্ণনা করবার কোনো দরকার নেই, কারণ তা সকলেরই নিকট সুপরিচিত। চেয়ার টেবিল কোচ টিপয় পিয়ানো আয়না, ছিটের পরদা, ব্রাসেলসের কারপেট, চীনের পুতুল, ওলিয়োগ্রাফের ছবি-এই আমাদের নূতন সভ্যতার উপকরণ এবং নিদর্শন। গৃহস্থের অবস্থা অনুসারে এই-সকল উপকরণ হয় লাজারস এবং অসল্যর, নয় বৌবাজারের বিক্রিওয়ালার দোকান হতে সংগ্রহ করা হয়। যিনি ধনী, তাঁর গৃহ হঠাৎ দেখতে দোকান বলে ভুল হয়। আর যিনি লক্ষ্মীর কৃপায় বঞ্চিত, তাঁর গৃহ হঠাৎ দেখতে যুদ্ধক্ষেত্রের হাঁসপাতাল বলে ভ্রম হয়; আসবাবপত্র সব যেন লড়াই থেকে ফিরে এসে, হয় মেরামত, নয় দেহত্যাগের জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো চৌকির হাত নেই, কোনো টিপয়ের পা নেই, কোনো টেবিলের পক্ষাঘাত হয়েছে; পরদার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে গেছে, কৌচের নাড়িভুড়ি নিগত হয়ে পড়েছে, চীনের পুতুলের ধড় আছে কিন্তু মণ্ড নেই, পারিস পালেস্তারার ভিনাসের নাসিকা লণ্ড, ওলিয়োগ্রাফ-সুন্দরীর মুখে মেচেতা পড়েছে, আয়নার গা দিয়ে পারা ফটে বেরিয়েছে, পিয়ানো দন্তহীন এবং হারমোনিয়ম বাসরোগগ্রস্ত। এ অবস্থাতেও আমরা এই-সকল অব্যবহার্য দর্য আবর্জনা দূর করে তার পরিবর্তে ফরাশ বিছিয়ে বসি না কেন?–কারণ ইংরেজের কাছে আমরা শিখেছি যে দৈন্য পাপ নয়, কিন্তু স্বদেশীয়তা অসভ্যতা।
আমাদের এই নবসভ্যতার আজবঘরে স্বর্গীয় পিতামহগুণ যদি দৈবাৎ এসে উপস্থিত হন, তা হলে নিঃসন্দেহ সব দেখেশুনে তাঁদের চক্ষুশির হয়ে যাবে। অবাক হয়ে তারা ঊর্ধ্বনেত্রে চেয়ে থাকবেন, নির্বাক হয়ে আমরাও অধোবদনে বসে থাকব। উভয় পক্ষে কোনো বোঝা-পড়া হওয়া অসম্ভব। অপরিচিত অশন-বসন আসন-ভূষণের ভিতরে কিরূপে জাতি রক্ষা হয়, তা তারা বুঝতে পারবেন না; কৈফিয়ত চাইলে আমাদের মধ্যে যাঁর কিছু বলবার আছে তিনি সম্ভবত এই উত্তর দেবেন যে, ‘জাতি শব্দের অর্থ আপনাদের নিকট সংকীর্ণ ছিল, আমাদের নিকট তা প্রশস্ততর হয়েছে; রক্ষা অর্থে আপনারা বুঝতেন শুধু স্থিতি, আমরা বুঝি উন্নতি; আপনাদের গর, ছিল মন, আমাদের গর, হার্বাট স্পেনসার; আমাদের নূতন চাল আপনাদের হিসাবে জাতিরক্ষার প্রতিকল, কিন্তু আমাদের হিসাবে অনুকূল।’ এ কথা যদি সত্য, যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তা হলে আমার আপত্তির কোনো কারণ নেই; কেননা যে প্রথা অবলম্বন করলে ব্রাহ্মণ-শদ্রের, এমন-কি, হিন্দুমসলমানের মধ্যে আচার-ব্যবহারের চিরবিরোধ থেকে যাবে, আমার পক্ষে সে প্রথার পক্ষপাতী হওয়া অসম্ভব। যে সামাজিক শাসন জাতীয় জীবনের প্রসারতা লাভের বিরোধী, আমি তার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু আমাদের সমাজকে যে ইউরোপের পশ্চাধাবন করতেই হবে তার কোনো প্রমাণ নেই। গতিমাত্রেরই একটি স্বতন্ত্র প্রধানভূমি আছে, একটি দিক নির্দিষ্ট আছে, যা তার পূর্বাবস্থার দ্বারা নিয়মিত। উন্নতির অর্থ আকাশে ওড়া নয়। কোন দেশে জন্মগ্রহণ করি সেটা যেমন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়, তেমনি কোন সমাজে জন্মগ্রহণ করি সেও আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। পরিবর্তন যেমন কালসাপেক্ষ, পরিবর্ধন তেমনি দেশ ও পাত্র -সাপেক্ষ। আমাদের প্রত্যেকেরই দেহ ও মনের মূলে পূর্বপুরুষরা বিরাজ করছেন, এবং আমাদের জাতীয় সভ্যতা অর্থাৎ সামাজিকতার মূলে পূর্বে পরিষদের সমাজ বিরাজ করছে। বংশপরম্পরা হেরিডিটি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো উন্নতি অসম্ভব। যে গহে পূর্বপুরুষদের স্থান হয় না, সে গহে ভোগবিলাসের চরিতার্থতা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মানব জীবনের সার্থকতা লাভ হয় না। স্মৃতি যেমন প্রতি মানবের অহংজ্ঞানের মূলপূর্বাপরের যোগসূত্র-বরূপ স্মৃতির অস্তিত্ব না থাকলে, আত্মোন্নতি দূরে থাকুক, কেহই আত্মার সন্ধানও পেতেন না—তেমনি অতীতের স্মৃতি জাতীয় অহংজ্ঞানেরও মূল। অতীতের জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনো জাতি জাতীয় আত্মার সন্ধান পায় না, জাতীয় আত্মোন্নতি দূরে থাকুক। সামাজিক জীবের পক্ষে অতীতের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে পিতা-পিতামহ ইত্যাদি, এবং ক্ষেত্র হচ্ছে বাস্তু। সেই বাস্তুজ্ঞানরহিত হলে আমাদের বস্তুজ্ঞানশূন্য হওয়া সহজ হয়ে পড়ে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তর্ক তুলে ইশবগ-নামক খেটে-খাওয়াদূলের লোককে বিরক্ত করবার কোনো সার্থকতা নেই। এরা বিজ্ঞানের দোহাই দেন আলোচনা বন্ধ করবার জন্য, আরম্ভ করবার জন্য নয়। হার্বাট স্পেনসার এদের গর, কিন্তু শিক্ষাগর, নন, দীক্ষাগুর। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকদের কাছে এরা কিছুই শিক্ষালাভ করেন নি, শুধু দুটি-একটি বীজমল গ্রহণ করেছেন, যথা সভ্যতা উন্নতি ইত্যাদি। অন্যান্য তান্ত্রিকদের মতো এই তান্ত্রিকদেরও নিকটে বীজমন্ত্র যত দুবোধ, সম্ভবত যত অপশন্য, তত তার মাহাত্ম। ইউরোপীয় সভ্যতা এরা জ্ঞানের দ্বারা পেতে চান না, ভক্তির দ্বারা পেতে চান। দাস্যভাব-সখ্যভাবের চর্চাই এরা মুক্তির একমাত্র উপায় স্থির করেছেন। আমরা এদের যে অবস্থাটাকে দুর্দশা বলে মনে করি, সেটি শুধু ইউরোপভক্তির দশা মাত্র।
যাঁরা তর্ক করতে প্রস্তুত, তাঁরা তর্কে হার মানতেও প্রস্তুত; কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অধিকাংশ ইঙ্গবঙ্গের মনোভাব এই যে, নগদ দামে নাহয় ধার করে দোনা কৌচ মেজ কিনব, এর মধ্যে আবার দর্শন-বিজ্ঞান কোথায়? নিজের কি আবশ্যক এবং নিজের কি মনোমত, সেটা ঠিক করতে সমাজতত্ত্ব আলোচনা করবার দরকার নেই। সুতরাং সাহেবিয়ানার সপক্ষে এরা হয় সুবিধা, নাহয় সুচির দোহাই দেন। যখন বিউটির দোহাই চলে না, তখন ইউটিলিটির দোহাই দেন; যখন ইউটিলিটির দোহাই চলে না, তখন বিউটির দোহাই দেন। যখন এ শ্রেণীর লোকেরা বিজাতীয় আচার-ব্যবহারের ইউটিলিটির ব্যাখ্যান শুর করেন, তখন মনে হয় এরা জন স্টুয়ার্ট মিলের কৃষ্ণপক্ষীয় সন্তান; আর যখন এরা বিলাতি ছিট, বিলাতি কারপেটের বিউটির ব্যাখ্যান শর করেন তখন মনে হয় অস্কার ওয়াইল,ডের মাসতুতো ভাই। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ এদের জিজ্ঞাসা করে যে, জেল কিংবা পাগলাগারদের অধিবাসী না হয়েও চুলের অবস্থা ওরকম কেন, এরা হেসে উত্তর করবেন আমরা কবি নই, কাজের লোক। এদের বিশ্বাস দো-অসিলা কুকুরের ল্যাজের মতো ইবঙ্গের চুল যত গোঁড়াঘেঁষে কাটা যায়, তার তেজ তত বৃদ্ধি হয়, তত রোখ বাড়ে। এবং এই বিশ্বাস Mill মিলের মতানুযায়ী। এদের রুচি সম্বন্ধেও এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সুতরাং ইংরেজি আসবাবের আবশ্যকতা এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা আবশ্যক।
বিদেশী রকমে ঘর সাজানোতে যে আমাদের কি পর্যন্ত অর্থের শ্রাদ্ধ হয়, তা তো সকলেই জানেন। অধিকাংশ ইঙ্গবঙ্গের পক্ষে ঠাট বজায় রাখতেই প্রাণান্তপরিচ্ছেদ হতে হয়। ধার-করা সভ্যতা রক্ষা করতে শুধু ধার বাড়ে। আমাদের এই দারিদ্রপীড়িত দেশে অনাবশ্যক বহব্যয়সাধ্য আচার-ব্যবহারের অভ্যাস করা আহাম্মকি তো বটেই, সম্ভবত অন্যায়ও; ক্ষমতার বহির্ভূত চাল বাড়ানো, গৃহ হতে লক্ষ্মীকে বিদায় করবার প্রশস্ত উপায়। তা ছাড়া বিদেশীর অনুকরণে বিদেশী কতুতে যদি গৃহ পণ করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, দেশের ধনে যদি বিদেশীর পকেট পূর্ণ করতে হয়, তা হলে হিতাহিতজ্ঞানসম্পন্ন ভদ্রসন্তানের পক্ষে সে অনুকরণ সর্বতোভাবে বর্জনীয়। ইউরোপে সাধারণ লোকের একটা ভুল ধারণা আছে যে, খাওয়া-পরার মাত্রা যত বাড়ানো যায়, জাতীয় উন্নতির পথ ততটা পরিষ্কার হয়। যদি আমার এত না হলে দিন চলে না এমন হয়, তা হলে তত সংগ্রহ করবার জন্য পরিশ্রম স্বীকার করতে হবে; এবং যে জাতি যত অধিক শ্রম স্বীকার করতে বাধ্য, সে জাতি তত উন্নত, তত সৌভাগ্যবান। কিন্তু ফলে কি দেখতে পাওয়া যায়? ইউরোপবাসীরা এই বাহুল্যচর্চার দ্বারা জীবন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত করে ফেলেছে বলে কর্মক্ষেত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এশিয়াবাসীদের নিকট সর্বত্রই হার মানছে। এই কারণেই দক্ষিণ-আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা প্রভৃতি দেশে চীনে জাপানী হিন্দুস্থানী শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে নানা গহিত বিধিব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়াবাসীরা খাওয়া-পরাটা দেহধারণের জন্য আবশ্যক মনে করে, মনের সুখের জন্য নয়; সেইজন্য তারা পরিশ্রমের অনুরূপ পুরস্কার লাভ করলেই সন্তুষ্ট থাকে। এই সন্তোষ আমাদের জাতিরক্ষার, জাতীয় উন্নতির প্রধান সহায়। আমরা যদি আমাদের পরিশ্রমের ফলের ন্যায্য প্রাপ্য অংশ লাভ করতুম, আমরা যদি বঞ্চিত প্রতারিত না হতুম, তা হলে দেশে অন্নের জন্য এত হাহাকার উঠত না। আমাদের এ দোষে কেউ ‘দোষী করবেন না যে, আমরা যথেষ্ট পরিশ্রম করি নে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের পরিশ্রমের ফল অপরে ভোগ করে। আমাদের দেশে আজকাল শিক্ষিত লোকেরবিশেষত ইঙ্গবগ সম্প্রদায়ের মনোভাব এই যে, স্ট্যান্ডার্ড অব লাইফ বাড়ানো সভ্যতার একটি অঙ্গ। এ সর্বনেশে ধারণা তাঁদের মন থেকে যত শীঘ্ন দর হয় ততই দেশের পক্ষে মঙ্গল। উপরোক্ত যুক্তি ছাড়া জীবনযাত্রার উপযোগ ইউরোপীয় সরঞ্জামের সপক্ষে আর কোনো যুক্তি শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে অনেকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলে থাকেন, “আমার খুশি। আমাদের দেশের রাজা সমাজের অধিনায়ক নন। বিদেশী বিধর্মী রাজা এ দেশে কখনো সামাজিক দলপতি হতে পারেন না, সুতরাং আমাদের সমাজে এখন অরাজকতা প্রবেশ করেছে। যে সমাজে শান্ত আছে কিন্তু শাসন মানাবার কোনো উপায় নেই, সেখানে শাসন না মেনে যে কাজে কোনো বাইরের শান্তি নেই সে কার্যে যথেচ্ছাচারী হয়ে এরা যে নিজেদের বিশেষরুপে নিভীক স্বাধীনচেতা এবং পুরুষশাদল বলে প্রমাণ করেন, তার আর সন্দেহ কি। অবশ্য এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, এদের খুশি প্রভুদের খুশির সঙ্গে অক্ষরে-অক্ষরে মিলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। সে তো হবারই কথা। এরাও সভ্য, তাঁরাও সভ্য, সুতরাং পরস্পরের মিল-সে শুধু সেয়ানায় সেয়ানার কোলাকুলি। যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, চেয়ার টেবিল কোচ মেজ ইত্যাদি দেহ আত্মা রিবা মনের উন্নতির কিরূপে এবং কতদূর সাহায্য করে, তা হলে আমি তার কাছে চিরবাধিত থাকব, কারণ সত্যের খাতিরে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, চৌকি কোঁচ অনেকটা আরামের জিনিস এবং আমরা অনেকেই অভ্যস্ত আরামভোগে বঞ্চিত হতে নিতান্ত কুণ্ঠিত। আমাদের সকলেরই পৃষ্ঠদণ্ড কিঞ্চিৎ কমজোর এবং ঈষৎ বক, সুতরাং আমরা পষ্ঠের একটা আশ্রয়ের জন্য সকলেই আকাক্ষী। এবং আরাম-চৌকি এখন আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যোগশাস্ত্রে বলে, সকলপ্রকার আত্মোন্নতির মূলে সরল পদণ্ড বর্তমান। সুতরাং যোগের প্রথম সাধনা হচ্ছে আসন অভ্যাস করা, পৃষ্ঠদণ্ড ঋজ করা। দাসজাতির দেহভঙ্গি মীলোকের মতে, সম্মুখ দিকে ঈষৎ আনমিত-অতিপ্রবদ্ধ যৌবনভারে নয়, অতি অভ্যস্ত সেলাম এবং নমস্কার-চর্চা বশত। আমাদের জাতীয় কুলকুণ্ডলিনী যদি জাগ্রত করতে হয় তা হলে আমাদের পিঠের দাঁড়া খাড়া করতে হবে, অনেক অভ্যস্ত আরাম ত্যাগ করতে হবে। সুতরাং একমাত্র দৈহিক আরামের খাতিরে বিদেশী আসবাবের প্রচার এবং অবাধন সমর্থন করা যায় না। সকলেই জানেন যে, জাপান ইউরোপের কাছে যা শিখেছে আমরা তা শিখি নি; কিন্তু খুব কম লোকেই জানেন যে, ইউরোপের কাছে আমরা যা শিখেছি জাপান তা শেখে নি। ফলে ইউরোপের সঙ্গে কারবারে জাপান নিজের শক্তি সঞ্চয় করেছে, ইউরোপের সঙ্গে কারবারে আমরা শুধু শক্তির অপচয় করেছি। এই কারণেই আমাদের জাপানের কাছে এই শিক্ষালাভ করতে হবে যে, ইউরোপীয় সভ্যতার কি আমাদের গ্রহণ করা উচিত এবং কি আমাদের বর্জন করা উচিত। এই বিষয়ে জ্ঞানলাভ করাটাই আমাদের সর্বপ্রধান দরকার, এবং জাপান ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ আমাদের গুরু হতে পারে না, কারণ জাপান শুধু এ কঠিন সমস্যার মীমাংসা করেছে। খাওয়া-পরা-থাকা-শোওয়া সম্বন্ধে জাপান স্বদেশের সনাতন প্রথা ত্যাগ করে নি। বিলেতি আসবাব জাপানের ঘরে স্থান পায় নি। আজও সমগ্র জাপান মাদুরের উপর বীরাসনে আসীন।(১)
৪.
বিলেতি জিনিসের আবশ্যকতা সম্বন্ধে বিচার শেষ করে, এখন তার সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা আবশ্যক। আমাদের দেশে যে ছেলের কিছু হবার নয় তাকে আর্টকুলে পাঠানো হয়; এবং ঐ একই কারণে যুক্তি যখন অন্য কোনো দাঁড়াবার স্থান না পায় তখন তা আর্টের নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ধর্ম সম্বনে আলোচনায় ‘আমি বিশ্বাস করি’ এ কথার উপর যেমন আর কোনো কথা চলে না, আর্ট সম্বন্ধে আলোচনায় ‘আমার চোখে সুন্দর লাগে’ এ কথার উপরও তেমনি আর কোনো কথা চলে না। সৌন্দর্য অনুভূতির বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়। ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে তার প্রমাণ দেওয়া যায় না। অতএব যিনি আট জিনিসটা অপরকে যত কম বোঝাতে পারেন, নিজে তিনি তত বেশি বোঝেন। ধর্ম সম্বন্ধে বিশ্বাস অথ হলেও সম্ভবত লোক ধর্মজ্ঞ হতে পারে, কিন্তু রূপ সম্বন্ধে অন্ধ হয়ে লোকে সৌন্দর্যজ্ঞ হতে পারে না। কারণ সৌন্দর্য প্রকাশ। সৌন্দর্যের পরিচয় এবং অস্তিত্ব উভয়ই কেবলমাত্র প্রকাশের উপর নির্ভর করে। সেই পদার্থকে আমরা সুন্দর বলি, যার স্বরূপ পর্ণেব্যক্ত হয়েছে। রূপ হচ্ছে বিশ্বেরভাষা এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির শেষ কথা। প্রকৃতিও বোয় কিছু করেন না, মানুষেও বিনা উদ্দেশ্যে কোনো পদার্থে হাত দেয় না। যা মানবজীবনের পক্ষে আবশ্যকীয়, মানুষে তাই হাতে গড়ে; সেই গঠনকার্যের সার্থকতা এবং কৃতার্থতার নামই আর্ট। নিরর্থক দ্রব্য সুন্দর হয় না। আবশ্যকতার বিরহে সৌন্দর্য শুকিয়ে মারা যায়। সুতরাং যে জাতির পক্ষে যে-সকল জিনিস জীবনযাত্রার জন্যে আবশ্যকীয় নয়, সে জাতির পক্ষে সে-সকল জিনিসের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন। আর্ট একটি সৃষ্টিপ্রকরণ, একটি ক্রিয়া মাত্র, সুতরাং আর্টের প্রাণ কর্তার হাতে এবং মনে, ভোতার চোখে এবং কানে নয়। আর্টের সন্ধান তার স্রষ্টার কাছে মেলে, দর্শক কিংবা শ্রোতার কাছে নয়। সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার ভিতর যেটকু আনন্দ প্রাণ ও ক্ষমতা আছে, সেইটক অনুভব করার নাম সৌন্দর্য ভোগ করা। এ কথা যদি সত্য হয়, তা হলে যে আর্টিস্টের সঙ্গে আমাদের চরিত্রের, ধর্ম এবং জ্ঞানের, রীতি এবং নীতির মিল আছে, আমরা অনেক পরিমাণে যার সখদুঃখের ভাগী, যার সঙ্গে আমরা একই বাহ্যপ্রকৃতির ভিতর একই সমাজের অন্তর্ভূত হয়ে বাস করি, তার আর্টই আমাদের পক্ষে যথার্থ আর্ট। বিদেশী এবং বিজাতীয় আর্টের আদর কেবল কাপনিক মাত্র। এই কারণেই আমাদের অনেকেরই পক্ষে বিদেশী আর্টের চর্চাটা লাঞ্ছনা মাত্র হয়ে পড়ে। আমরা প্রথমে বিদেশব দোকানদারের দ্বারা প্রবঞ্চিত হই, পরে নিজেদের মনকে প্রবঞ্চিত করি। আমাদের কাছে রূপের পরিচয় রপিয়া দিয়ে। আমরা ছবি চিনি নে, তব কিনি নাম দেখে এবং দাম দেখে। ইউরোপে যারা শিব গড়তে বাদর গড়ে, তাদেরই হস্তরচিত বিগ্রহ আমরা সংগ্রহ করে সখী না হই, খুশি থাকি। আট সম্বন্ধে ইউরোপের গোলামচোর হওয়ার লজ্জা পাওয়া দুরে যাক, আমাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
আমার মতের বিরুদ্ধে সহজেই এই আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে যে, আমরা যদি ইউরোপীয় আর্টের মর্যাদা না বুঝতে পারি, তা হলে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মর্যাদা বোঝা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং ইউরোপীয় সাহিত্যবিজ্ঞান-চর্চাও আমাদের ত্যাগ করা কর্তব্য। এ আপত্তির উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, বিভিন্ন দেশের লোকের ভিতর পার্থক্য যতই থাকুক, মানুষে মানুষে প্রবৃত্তির বাসনার মনোভাবের মিলও যথেষ্ট আছে। সাহিত্যের বিষয় হচ্ছে প্রধানত মানবপ্রকৃতি; সুতরাং উচ্চশ্রেণীর সাহিত্য দেশকাল-অতিরিক্ত মানবহৃদয়ের চিরন্তন অথচ চিরনবীন ডাকসকল নিয়ে কারবার করে। এই হেতু সকল দেশের উচ্চ আগের সাহিত্যে বিমানবের সমান অধিকার আছে। কিন্তু ইউরোপীয় সাহিত্যে যে অংশটুকু আর্ট, সে অংশ আমরা ঠিক ধরতে পারি নে। বিদেশী লেখকের লেখনীর পরিচয় আমরা অনেকেই পাই না। সে যাই হোক, সাহিত্যে এবং আর্টে, কাব্যে এবং কলায় প্রধান পার্থক্য এই যে, কাব্যের উস্করণ অন্তর্জগৎ হতে আসে, কলার উপকরণ বাহ্যজগৎ হতে আসে। মনোজগতে দেশভেদ নেই, এশিয়া ইউরোপ নেই, এক কথায়, মনোজগতের ভূগোল নেই। কিন্তু বাহ্যজগতে ঠিক তার উলটো। এক দেশের ভৌতিক গঠন অপর দেশ হতে বিভিন্ন। দেশভেদে বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শরসের জাতিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। সেইজন্যই কাব্য অপেক্ষা কলার ক্ষেত্র সংকীর্ণ। এই উপকরণের বিশেষত্ব হতে প্রতি দেশের শিল্পকলার বিশেষত্ব জন্মলাভ করে। আর্ট সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয়তা অসম্ভব; সুতরাং এ ক্ষেত্রে স্বদেশের অধীনতাপাশ মোচন করবার জো নেই। বিজ্ঞানের বিষয়ও কস্তুজগৎ; কিন্তু বিজ্ঞান বিশ্বজনীন, কেননা বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বস্তুজগতের বিশেষত্ব বাদ দিয়ে তার সামান্য ক্রিয়াগুলির সন্ধান নেওয়া। আর্টের সম্পর্ক বসুজগতের শুধু বিশেষ্য ও বিশেষণের সঙ্গে। বিজ্ঞানের অভিপ্রায় বিশ্বকে এক করে আনা, আর্টের কার্য নিত্য বৈচিত্র্য সাধন। বিজ্ঞানের লক্ষ্য মূলের দিকে, আর্টের লক্ষ্য ফলের দিকে। বিজ্ঞানের দেশ নেই, আর্টের আছে। এই-সকল কারণে নিউটন এবং ডারউইন আমাদের জ্ঞাতি, শেকসপীয়ার এবং মিলটন আমাদের কুটুম্ব, কিন্তু রাফায়েল এবং বীঠোফেন আমাদের পর। এইজন্যই জাপান ইউরোপের বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছে, কিন্তু নিজের আর্ট ছাড়ে নি। আমাদের মধ্যে যদি কেহ ইউরোপের উচ্চাঙ্গের আর্টের যথার্থ মর্ম গ্রহণ করতে পারেন, তিনি অবশ্য ভক্তির পাত্র। পৃথিবীর যে দেশের যা-কিছু শ্ৰেষ্ঠকাতি আছে, তার সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করা মানবের মুক্তির একটি প্রকৃষ্ট উপায়। কিন্তু যখন প্রায়ই দেখতে পাই যে, যিনি বরগ্রামের গা’ থেকে ‘পার প্রতে ধরতে পারেন না, তিনিই বীঠোফেনের প্রধান সমজদার; এবং যিনি রঙটা নীল কিংবা সবুজ বিশেষ ঠাওর করেও বলতে অপারগ তিনিই টিশিয়ানের চিত্রে মুখ, তখন যজাতির ভবিষ্যতের বিষয় একটু হতাশ হয়ে পড়তে হয়। সে যাই হোক, উপখিত প্রবধে যে-সকল বস্তুর আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছি—যথা ছিটের পরদা, ব্রসলসের কারপেট, চীনের পুতুল, কাচের ফলদানি, কি স্বদেশী কি বিদেশী সকল প্রকার আর্টের অভাবেই তাদের বিশেষত্ব। বিলাতের সচরাচর গহ-ব্যহাব বস্তুগুলি প্রায়ই কদাকার এবং কুৎসিত। এর দুটি কারণ আছে। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞানের ন্যায় আর্টেরও বিষয় বাহ্যজগৎ। যা ইন্দ্রিয়গোচর নয়, তা বিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, আর্টেরও বিষয় হতে পারে না। ইন্দ্রিয় যে উপকরণ সংগ্রহ করে, মন তাই নিয়ে কারিগরি করে। এই বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ-ময় জগতে যে ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ে মন সুখলাভ করে শুধু তাই আর্টের উপকরণ। কতুর সেই সখদায়ক গুণের নাম এসথেটিকাল কোয়ালিটি, অর্থাৎ ‘রুপ’; এবং মনের সেই সুখলাভ করবার ক্ষমতার নাম এসথেটিক ফাঁকালটি, অর্থাৎ ‘পজ্ঞান। ইংরেজ বিশেষ খোসাপুরু জাত। ভগবান, ইংরেজকে নিতান্ত স্থূলভাবে গড়েছেন; তার দেহ প্ৰল, প্রকৃতি স্কুল, ইন্দ্রিয়ও তাদৃশ সক্ষম নয়। বস্তুমাত্রেই ইংরেজের হাতে ধরা পড়ে, কিন্তু রূপমাত্রেই ইংরেজের চোখে কিংবা কানে ধরা পড়ে না। সচরাচর শিক্ষিত ইংরেজের চেয়ে আমাদের দেশের সচরাচর রগরেজের চোখ রঙ সম্বন্ধে অনেক বেশি পরিমার্জিত। এই কারণেই বিলাতের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যজাতসকল নয়নের তৃপ্তিকর নয়। এই গোঁড়ায়গলদ থাকবার দরুন, ইংরেজের হাতগড়া জিনিস প্রায়ই আটিসটিক হয় না। ইউরোপের অন্যান্য জাতিসকল এ বিষয়ে ইংরেজের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হলেও অপর আর-একটি কারণে ইউরোপের আর্টের আজকাল হীনাবস্থা। ইউরোপে এখন বিজ্ঞানের যুগ। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞান বিশ্বকে একভাবে দেখে, আর্ট আর-একভাবে দেখে। বিজ্ঞানের চেষ্টা সোনামঠোকে ধলোমঠো করা, আর্টের চেষ্টা ধলোমঠোকে সোনামঠো করা। বিজ্ঞান আজকাল ইউরোপীয় মানবের মনের উপর অযথা প্রতিপত্তিলাভ করেছে, কেননা বিজ্ঞান এখন মানুষের হাতে আলাদিনের প্রদীপ। সে প্রদীপের সাহায্যে যে শুধু অসীম ঐশ্বর্য লাভ করা যায় তাই নয়, আলোকও লাভ করা যায়। সে আলোকে শুধু প্রকাশ করে বিশ্বের কায়া, বাদবাকি সব ছায়ায় পড়ে যায়, যথা—মন প্রাণ ইত্যাদি। সেই বিজ্ঞানের আলোকে আমরা যদি একমাত্র আলোক বলে ভ্রম করি, তা হলে মানবজীবনের প্রকৃত অর্থ, চরম লক্ষ্য এবং অচ্যুত আনন্দ হতে আমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ি। বিবকে শুধু জড়ভাবে দেখলে মনেরও জড়তা এসে পড়ে। কেবলমাত্র পরমাণুর স্পন্দনে হৃদয় স্পন্দিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ধর্মের সখী হয়েই কলাবিদ্যা পৃথিবীতে দেখা দেয়। সে সখ্যবধন ছিন্ন করে আর্টকে জীবন্ত রাখা কঠিন। বৈজ্ঞানিক জীবতত্ত্বের মতে মানবের আদিম চেষ্টা নিজের এবং জাতীয় জীবন রক্ষা করা। নিজে বেচে থাকা এবং সন্তান উৎপাদন করা, এই দুটি জীবজগতের মূল নিয়ম। এই দুটি আদিম দৈহিক প্রবত্তির চরিতার্থতা সাধন যদি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তা হলে ‘আবশ্যকতা’র অর্থ অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। যা দেহের জন্য আবশ্যক তাই যথার্থ আবশ্যকীয় বলে গণ্য হয়, আর যা মনের জন্য আত্মার জন্য আবশ্যক, তা আবশ্যকীয় বলে মনে হয় না। ইউরোপে ইউটিলিটির এই সংকীর্ণ অর্থ গ্রাহ্য হবার দরুন ইউটিলিটি এবং বিউটির বিচ্ছেদ জমেছে। ইউরোপের আবশ্যকীয় জিনিস কদর্য এবং সুন্দর জিনিস অনাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এই কারণে আর্ট এখন ইউরোপে ত্রিশঙ্কুর মতো শূন্যে ঝলছে। আহার বিহার এখন ইউরোপের প্রধান কাজ হয়ে ওঠার দরন, যে আর্টিস্ট আর্টকে জীবনের ভিতর নিয়ে আসতে চান তিনি আটকে পূর্বোক্ত প্রবত্তিদ্বয়ের দাসী করে তোলেন। এই কারণেই ইউরোপে এখন নগ্ন শ্রীমতির এত ছড়াছড়ি। শতকরা একজনে যদি ঐরূপ মুতিতে সৌন্দর্য খোঁজেন, অবশিষ্ট নিরানব্বই জনে তার নগ্নতা দেখেই খুশি থাকেন। এ অবস্থায় আট যে শুধু ভোগবিলাসের অঙ্গ হয়ে উঠবে, তার আর আশ্চর্য কি। ইউরোপের পক্ষে কি ভালো কি মন্দ, তা ইউরোপ স্থির করবে। কিন্তু এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে, আমাদের জাতির পক্ষে বিলাসের প্রবত্তি আর বাড়ানো ইচ্ছনীয় নয়। ইউরোপের যথার্থ আর্ট আমাদের অধিকাংশ লোকের পক্ষে আয়ত্ত করা অসম্ভব, কিন্তু ইউরোপীয় সভ্যতার ভোগের অংশটা আমরা সহজেই অভ্যাস করতে পারি। আমার প্রথম কথাও যা, শেষ কথাও তাই। আর্টকে ভোন্তর দিক থেকে দেখা দুরবিনের উলটো দিক থেকে দেখার তুল্য, দুষ্টব্য পদার্থ আরো দুরে চলে যায়। কর্তার দিক থেকে দেখাটাই ঠিক দেখা। আমরা নিজে যা রচনা করেছি, তারই মর্ম তারই মর্যাদা আমরা প্রকৃষ্টপে বুঝতে পারি। আমাদের স্বদেশের কীর্তি থেকেই আমাদের স্বজাতির কৃতিত্বের পরিচয় পাই। আমরা জাতীয় আত্মসম্মানের চর্চা করব বলে চিৎকার করছি, কিন্তু জাতীয় কৃতিত্বের যদি জ্ঞান না থাকে, তবে জাতীয় আত্মসম্মান কিসের উপর দাঁড় করাব, বোঝা কঠিন। জাতীয় আর্ট যে শ্রেণীরই থোক, তার চর্চায় আমাদের জাতীয় কর্তৃত্ব-বুদ্ধি বিকশিত হয়ে উঠবে। এই পরম লাভ। সলভ এবং সহজপ্রাপ্য বিলাতি জিনিসের পক্ষে আবশ্যকতার দোহাই চলতে পারে, কিন্তু আর্টের দোহাই একেবারেই চলে না। বিলাতি-ছিটগ্রস্ত না হলে বিলাতি-ছিটভক্ত হওয়া যায় না। আর যিনি আদর করে দুয়োরে বিলাতি পর্দা ঝোলান তাঁর পর্দানশিন হওয়া উচিত।
৫
সভ্যজাতির পক্ষে দেশের কথা অনেকটা বেশের কথা। পরিচ্ছদের ঐক্য সামাজিক ঐক্যের লক্ষণও বটে, কারণও বটে। আমরা প্রতিবাসীকে প্রতিবেশী বলেই জানি। হিন্দুরা সমাজের সঙ্গে সঙ্গে বস্তু ত্যাগ করেন। সন্ন্যাসের প্রথম দীক্ষা ডোরকৌপীন ধারণ। আমাদেরও বিদেশীয়তার প্রথম সংস্কার কোট-পেণ্টলন ধারণ। বিলেতের বেশ যে ভারতবাসীর পক্ষে সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অনুপযোগী, সে কথা বলাই বাহুল্য। কথাটা এতই সাদা যে, যিনি তা বুঝতে পারেন না, তাঁর ঔষধ মধ্যমনারায়ণ তৈল, যুক্তি নয়। দেহকে কষ্ট দিলেই যদি মনের উৎকর্ষ লাভ করা যেত, তা হলেও নয় এই বোতাম-কলসের অধীনতা এবং বন্ধন একরকম কায়ক্লেশে সহ্য করা যেত। কিন্তু সখ শরীরকে ব্যস্ত করবার মাহাত্ম্য প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ। যিনিই ‘কলার’ ব্যবহার করেছেন, তিনিই কোনো-না-কোনো সময়ে রাগে দুঃখে এবং ক্ষোভে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে–
ভূষণ ব’লে কিনব না আর
পরের ঘরে গলার ফাঁসি।
ইউরোপ যে আমাদের বুকে পাষাণ চাপিয়ে দিয়েছে এবং হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ি পরিয়েছে, তার নিদর্শনস্বরূপ আমরা কামিজের প্লেট ও কাফ এবং বুটজুতা ধারণ করি। আমাদের স্বদেশী বেশের প্রধান দোষ যে, তা যন্ত্রণাদায়ক নয়। বিলাতি সম্প্রদায়ের অনেকেরই বিশ্বাস যে, অহর্নিশি গলদঘর্ম হওয়াতেই সভ্যমানব-জীবনের চরম সার্থকতা। সহজ বুদ্ধিতে যা দোষ বলে মনে হয়, বিলাতি সভ্যতার প্রতি অতিভক্তিপরায়ণ লোকের নিকট সেইটিই গুণ। ইংরেজি পোশাক যে নয়নের সুখকর নয়, এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু ভকদের মতে সেই সৌন্দর্যের অভাবেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। ঐ প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, ও বেশ পযোচিত বেশ। আমাদের পৌরুষের একান্ত অভাববশত পুরুষ সাজবার ইচ্ছাটা অত্যন্ত বলবতী। কাজেই আমরা ইংরেজের অনুকরণে অন্য-সব রঙ ত্যাগ করে কাপড়ে ছাইপাঁশ মাটির রঙ চাপিয়েছি। আমাদের ধারণা, সবচেয়ে সভ্য এবং সবচেয়ে পরষালি রঙ হচ্ছে কালো রঙ। সুতরাং আমাদের নূতন সভ্যতা শুভ্রবসন ত্যাগ করে কৃষ্ণচ্ছদ অবলম্বন করেছে। শ্বেতবর্ণ আলোকের রঙ, সকল বর্ণের সমাবেশে তার উৎপত্তি; আর কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকারের রঙ, সকল বর্ণের অভাবে তার উৎপত্তি। আমরা করজোড়ে ইউবোপীয় সভ্যতার কাছে প্রার্থনা করেছি যে আমাদিগকে আলোক হইতে অন্ধকারে লইয়া যাও এবং আমাদের সে প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে। আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার খিদমতগারির পুরস্কারস্বরূপ হ্যাট-নামক কিম্ভূতকিমাকার এক চিজ শিরোপা লাভ করেছি, তাই আমরা আনন্দে শিরোধার্য করে নিয়েছি। কিন্তু ইংরেজি পোশাক আমাদের পক্ষে শুধু যে অসুখকর এবং দৃষ্টিকট, তা নয়। বেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ লোকের মনের পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী। পুরোহিতের বেশ ধারণ করলে মানুষকে হয় ভণ্ড নয় ধার্মিক হতে হয়। সাহেবি কাপড়ের সঙ্গে মনেও সাহেবিয়ানার ছোপ ধরে। হ্যাট-কোট ধারণ করলেই বঙ্গসন্তান ইংরেজি এবং হিন্দি এই দুই ভাষার উপর অধিকার লাভ করবার পূর্বেই অত্যাচার করতে শর করেন। গলায় ‘টাই’ বাঁধলেই যে সকলকেই ইউরোপীয় সভ্যতার নিকট গললনীকৃতবাস হতে হবে, এ কথা আমি মানি নে। যে মনে নস, সে উত্তরীয়কেও গলববরপ ব্যবহার করে থাকে। তবে ‘টাই’ যে মনকে সাহেবিয়ানার অনকল করে নিয়ে আসে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইউরোপের মোহ কাটাতে হলে ইউরোপীয় বসন বয়কট করাই শ্রেয়। ইউরোপবাসীর বেশে এবং এশিয়াবাসীর বেশে একটা মূলগত প্রভেদ আছে। ইউরোপের বেশের উদ্দেশ্য দেহকে বাঁধা, আমাদের উদ্দেশ্য দেহকে ঢাকা। আমাদের চেষ্টা দেহকে কানো, ওদের চেষ্টা দেহকে ফলানো। আমাদের অভিপ্রায় লজ্জা নিবারণ করা, ওদের অভিপ্রায় শীত নিবারণ করা; তাই আমরা যেখানে ঢিলে দিই, ওরা সেখানে কষে। ইংরেজরা মধ্যে মধ্যে রমণীর বেশকে কবিতার সঙ্গে তুলনা করেন। ইংরেজরমণীর বেশের ভিতর একটা ছন্দ আছে, তার গতি বিলাসিনীদের দেহভঙ্গি অনুসরণ করে; সে ছন্দের ঝোঁক উন্নত-অবনত অংশের উপরই পড়ে। লজ্জা আমাদের দেশে নারীর হদয় অবলম্বন করে থাকে, ওদের দেশে চরণে শরণ গ্রহণ করে। আমাদের মহাসৌভাগ্য এই যে, ভারতরমণী স্বদেশী লজ্জা পরিহার করে বিদেশী সজ্জা গ্রহণ করেন নি। শ্রীজাতি সর্বত্রই স্থিতিশীল, আমরা পুরুষরা গতিশীল বলেই দুর্গতি বিশেষরূপে আমাদেরই হয়েছে। যদি ইংরেজি বেশ উপযোগিতা সৌন্দর্য ইত্যাদি সকল বিষয়েই স্বদেশী বেশের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হত, তা হলেও বিদেশী বেশ অবলম্বন অনুমোদন করা যেত না। ইংরেজি বেশের আর-একটি বিশেষ দোষ এই যে, ও পদার্থে দেহ মণ্ডিত করবামাত্রই অধিকাংশ লোকের মস্তিষ্কের গোলযোগ উপস্থিত হয়। অতিশয় বুদ্ধিমান লোকেও বেশের পক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে অতিশয় নির্বোধের মতো তর্ক করেন। এ বিষয়ে যে-সকল যুক্তি সচরাচর শোনা যায়, সে-সকল এতই অকিঞ্চিৎকর যে বিচারযোগ্য নয়। যাঁরা বেশ পরিবর্তন করেন তাঁরা তর্কের দ্বারা যুক্তির দ্বারা নিজেরাই সাফাই হতে চান, অপরকে ভজাতে চান না। তাঁদের অভিপ্রায়, ফাঁকি দিয়ে নিজেরা সভ্য হওয়া, স্বজাতিকে সভ্য করা নয়। তাঁদের বিশ্বাস, এ সমাজের এ জাতির কিছু হবার নয়, সুতরাং সমাজ ছাড়াই তাঁদের মতে একমাত্র মুক্তির উপায়। এ মনোভাব যে স্বদেশীয়তার কতদূর অনুকূল, তা সকলেই বুঝতে পারেন। কেবলমাত্র সমাজত্যাগে কি করে মুক্তিলাভ হতে পারে? এ প্রশ্ন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তার উত্তর হচ্ছে, এরা যে চিরকালই স্বদেশী সমাজের অন্তস্থ বণ হয়ে থাকবেন এরূপ এদের অভিপ্রায় নয়; এদের চরম লক্ষ্য হচ্ছে ইংরেজি সমাজে লীন হয়ে যাওয়া। এদের আশা ছিল যে, ক্ৰমে গগাযমুনার মতো সাদায়-কালোয় একদিন মিশে যাবে। কিন্তু আজ বোধ হয় এদের সকলেই বুঝতে পেরেছেন যে, সে আশা মিছে। আমরা সকলেই এ সত্যটি আবিষ্কার করেছি যে, প্রয়াগ পৌঁছবার পূর্বেই আমাদের কাশী প্রাপ্তি হবে।
৬.
আহার সম্বন্ধে বেশি কিছু বলবার দরকার নেই। অপরের বেশ যত সহজে অবলম্বন করা যায়, অপরের খাদ্য তত শীঘ্র জীর্ণ করা যায় না। বিদেশীয় সভ্যতা আমাদের পিঠে যত সয়, পেটে তত সয় না। আমাদের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা দেশে আহার্যদ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করবার কোনোই দরকার নেই। তবে যদি কেহ এমন থাকেন যে, বিদেশী মাছ-তরকারি না খেলে তাঁর প্রাণ বাঁচে না, তা হলে তাঁর প্রাণ বাঁচাবার কোনো দরকার নেই; আর যদি বেচে থাকাটা নিতান্ত দরকার মনে করেন, তা হলে স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে বাস করাটাই তাঁর পক্ষে শ্রেয়।
আহার সম্বন্ধে বিধিনিষেধ-সংবলিত পঞ্জিকাশাকে গঞ্জিকাশাস্য বলে গণ্য করে অমান্য করলেই যে তৎপরিবর্তে কেল নারের কাটালগের চর্চা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিদেশীয়তা প্রধানত আহারের পদ্ধতিতেই আমরা অবলম্বন করেছি। বিলাতি বসন পরে স্বদেশী আসনে বসা এবং স্বদেশী বাসনে খাওয়া চলে না।
ঐ পোশাকের টানেই চেয়ার আসে, সেইসঙ্গে টেবিল আসে, এবং সেইসঙ্গে চীনের কিংবা টিনের বাসন নিয়ে আসে। এর পর আর হাতে খাওয়া চলে না; কারণ হাতে খেলে হাত মুখ দুইই প্রক্ষালন করতে হয়, কিন্তু ছুরিকাটা ব্যবহার করলে শুধু আঙুলের ডগা ধুলেও চলে, না ধলেও চলে। এক কথায় বলতে গেলে, খানায় পোশাকে ‘অঙ্গ-অগী’র সম্বন্ধ বিরাজ করে। আহারের বিষয় উত্থাপন কবে পানের বিষয় নীরব থাকলে অনেকে মনে করতে পারেন যে, প্রবন্ধটি অঙ্গহীন হয়ে রইল; অতএব এ সম্বন্ধেও দু-এক কথা বলা আবশ্যক। পানের বিষয় হচ্ছে-হয় ধম নাহয় তেজ মরৎ এবং সলিলের সন্নিপাতে যে পদার্থের সৃষ্টি হয়, তাই। গাঁজা গলী এবং চরসের পরিবর্তে ভদ্রসমাজে যদি তামাকের প্রচলন বধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে তো সে দুঃখের বিষয় নয়। সুরাপান বেদবিহিত এবং আয়ুর্বেদনিষিদ্ধ। ‘প্রবৃত্তিরেষা নরাণাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা’ এ মনুর বচন। এবং শাস্ত্রমতে যেখানে স্মৃতিতে এবং শ্রুতিতে বিরোধ দেখা যায়, সে খলে শ্ৰতি মান্য। রসিকতা ছেড়ে দিলেও সুরাপানের দোষগুণ বিচার করা এ প্রবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। পানদোষ নীতির কথা, রীতির কথা নয়। সুরাপান একটি ব্যসন, ফ্যাশন নয়। পানাসক্ত লোক পানের প্রতিই আসক্ত, ইংরেজিয়ানার প্রতি নয়। মোহ এবং মদ দুটি স্বতন্ত্র রিপ। আমার উদ্দেশ্য ইউরোপের মোহ নষ্ট করা, তার বেশি কিছু নয়। মানবজাতিকে সুশীল সচ্চরিত্র করবার ভার সমাজনীতি এবং ধর্মপ্রচারকদের উপর ন্যস্ত রয়েছে।
৭.
আমার শেষ বক্তব্য এই, কেহ যেন মনে না করেন যে, কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের নিন্দা করবার জন্যই আমি এ-সকল কথার অবতারণা করেছি। যে-সকল ইউরোপীয় হালচাল আমি এ দেশের পক্ষে অনাবশ্যক এবং অবাঞ্ছনীয় মনে করি, সে-সকল কম-বেশি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রবেশলাভ করেছে। আমি নিজে উপরোক্ত সকল দোষে দোষী। আমার সকল সমালোচনাই আমার নিজের গায়ে লাগে। দৈনিক জীবনে আমরা নকলেই অভ্যস্ত, আচার-ব্যবহারের অধীন। ভুল করেছি এই জ্ঞান জন্মানে মাত্র সেই ভুল তৎক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করতে পারলে ব্যবহারের অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময়সাপেক্ষ।
ফাল্গুন ১৩১২
——
(১) জাপানের অভ্যুদয়ের কারণ যাঁরা জানতে চান তাঁদের আমি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থগুলি পড়তে অনুরোধ করি : K. Okakura Deals Of The East এবং The Awakening Of Japan; Y. Okakuraর Spirit Of Japan; Nitobeর Bushido; Lafcadio Hearnএর Kokora প্ৰ্মুখ গ্রন্থবলী। যদি কারো এত বই পড়বার সময় এবং সুবিধা না থাকে এবং ফরাসি ভাষা জানা থাকে, তা হলে তাঁকে আমি Felicien Challayeর Au Japan নামক গ্রন্থ পড়তে অনুরোধ করি। লেখক গুটি পঞ্চাশ পাতায় আসল কথা অতি পরিষ্কার করে বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা করেছেন।
আমাদের সমাজে নূতন-পুরাতনের বিরোধটা সম্প্রতি যে বিশেষ টনটনে হয়ে উঠেছে, এরূপ ধারণা আমার নয়। আমার বিশ্বাস, জীবনে আমরা সকলেই একপথের পথিক, এবং সে পথ হচ্ছে নতুন পথ। আমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রভেদ এই যে, কেউ-বা পুরাতনের কাছ থেকে বেশি সরে এসেছি, কেউ-বা কম। আমাদের মধ্যে আসল বিরোধ হচ্ছে মত নিয়ে। মনোজগতে আমরা নানা পন্থী। আমাদের মুখের কথায় ও কাজে যে সব সময়ে মিল থাকে, তাও নয়।
এমন-কি, অনেক সময়ে দেখা যায় যে যাদের সামাজিক ব্যবহারে সম্পূর্ণ ঐক্য আছে, তাদের মধ্যেও সামাজিক মতামতে সম্পূর্ণ অনৈক্য থাকে, অন্তত মুখে। সুতরাং নূতন-পুরাতনে যদি কোথায়ও বিবাদ থাকে তো সে সাহিত্যে, সমাজে নয়।
এ বাদানুবাদ ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে, তাই শ্রীযুক্ত বিপিনচন্দ্র পাল এই পরম্পরবিরোধী মতদ্বয়ের সামঞ্জস্য করে দিতে উদ্যত হয়েছেন।(১) তিনি নূতন ও পুরাতনের মধ্যে একটি মধ্যপথ আবিষ্কার করেছেন, যেটি অবলম্বন করলে নূতন ও পুরাতন হাত-ধরাধরি করে উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে পারবে-যে পথে দাঁড়ালে নতুন ও পুরাতন পরস্পরের পাণিগ্রহণ করতে বাধ্য হবে এবং উভয়ে মনের মিলে সুখে থাকবে; সে পথের পরিচয় নেওয়াটা অবশ্য নিতান্ত আবশ্যক। যারা এ পথও জানে, ও পথও জানে কিন্তু দুঃখের বিষয় মরে আছে, তারা হয়তো একটা নিষ্কণ্টক মধ্যপথ পেলে বেঁচে উঠবে।
.
২.
ঘটকালি করতে হলে ইনিয়ে-বিনিয়ে-বানিয়ে নানা কথা বলাই হচ্ছে মামুলি দস্তুর। সুতরাং নূতনের সঙ্গে পুরাতনের সম্বন্ধ করতে গিয়ে বিপিনবাবুও নানা কথার অবতারণা করতে বাধ্য হয়েছেন। তার অনেক ছোটোখাটো কথা সত্য, আর কতক বড়ো বড়ো কথা নতুন। তবে তাঁর কথার ভিতর যা সত্য তা নতুন নয়, আর যা নতুন তা সত্য কি না তা পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক।
বিপিনবাবু প্রথমে আমাদের সমাজে নূতন ও পুরাতনের বিরোধের কারণ নির্ণয় করে পরে তার সময়ের উপায়-নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে আমরা ইংরাজি শিখিয়া, য়ুরোপের সভ্যতা ও সাধনার বাহিরটা দেখিয়া…ঘর ছাড়িয়া বাহিরের দিকে ছুটিয়াছিলাম।
এই ছোটাটাই হচ্ছে নূতন এবং পুরাতনের সঙ্গে বিচ্ছেদের এইখানেই সূত্ৰপাত। আবার আমরা ঘরে ফিরে এসেছি। অতএব এখন মিলনের কাল উপস্থিত হয়েছে। গত-শতাব্দীতে দেশসুদ্ধ লোকের মন যে এক-লক্ষ্যে সমুদ্র লঙ্ঘন করে বিলাতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল এবং এ শতাব্দীতে সে মন যে আবার উলটো লাফে দেশে ফিরে এসেছে, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমাদের মনের দিক থেকে দেখতে গেলে উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীতে যে বিশেষ কোনো প্রভেদ আছে তা নয়, যদি থাকে তো সে উনিশ-বিশ। আজকালকার দিনে ইউরোপীয় শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাব ঢের বেশি লোকের মনে ঢের বেশি পরিমাণে স্থান লাভ করেছে। বরং এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বহু, ইউরোপীয় মনোভাব দেশের মনে এত বসে গেছে যে, সে ভাব দেশী কি বিদেশী তাও আমরা ঠাওর করতে পারি নে। উদাহরণস্বরূপে দেখানো যেতে পারে যে, একটি বিশেষজাতীয় মনোভাব, যার ক থেকে ক্ষ পর্যন্ত প্রতি অক্ষর বিদেশী, তাকে আমরা বলি স্বদেশী।
ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরের দিকটা দেখে অবশ্য জনকতক সেদিকে ছুটেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অতি সামান্য এবং তাঁদের ঘরে ফিরে না আসাতে দেশের কোনো ক্ষতি নেই, বরং তাঁদের ফেরাতে বিপদ আছে। বিপিনবাবু বলেন–
একদিন আমরা বেড়া ভাগিয়া ঘর ছাড়িয়া পলাইয়াছিলাম, আজ বাড়ি খাইয়া, ফিরিয়া আসিয়াছি। সত্য কথাটা তাহা নয়।
কিন্তু এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। আমাদের মধ্যে যারা ইউরোপের সভ্যতার বাহ্যচাকচিক্যে অন্ধ হয়ে বেড়া ভেঙে ছুটেছিল তারাই আবার বাড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরেছে। পাঁচনই তাদের পক্ষে জ্ঞানাঞ্জনশলাকার কাজ করেছে। কেননা, ও-জাতির অন্ধতা সারাবার সংগত বিধান এই—‘নেত্ররোগে সমুৎপন্নে কর্ণং ছিত্ত্বা’ দেগে দেওয়া।
বিপিনবাবু বলেন–
কেহ কেহ মনে করেন, একদিন যেমন আমরা স্বদেশের যাহা-কিছু, তাহাকেই হীনচক্ষে দেখিতাম, আজ বুঝি সেইরূপ বিচারবিবেচনা-বিরহিত হইয়াই, স্বদেশের যাহা-কিছু, তাহাকেই ভাল বলিয়া ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছি।
বিপিনবাবুর মতে এরূপ মনে করা ভুল। কিন্তু এরূপ শ্রেণীর লোক আমাদের সমাজে যে মোটেই বিরল নয়, সে কথা নারায়ণ(২) পত্রে ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ শীল স্পষ্টাক্ষরে লিখে দিয়েছেন। তাঁর মতে—
য়ুরোপের জনসাধারণে যেমন আপনাদের অসাধারণ অভ্যুদয় দেখিয়া, য়ুরোপের বাহিরে যে প্রকৃত মানুষ বা শ্রেষ্ঠতর সভ্যতা আছে বা ছিল বলিয়া ভাবিতে পারে না; আমাদের এই অভ্যুদয় নাই বলিয়াই যেন আরও বেশী করিয়া কিয়ৎপরিমাণে এই প্রত্যক্ষ হীনতার অপমান ও বেদনার উপশম করিবার জন্যই, সেইরূপ আমরাও নিজেদের সনাতন সভ্যতা ও সাধনার অত্যধিক গৌরব করিয়া, জগতের অপরাপর সভ্যতা ও সাধনাকে হীনতর বলিয়া ভাবিয়া থাকি।
ডাক্তার শীল বলেন—
[এরূপ বিচার] স্বজাতিপক্ষপাতিত্ব-দোষে দুষ্ট, [অতএব] সত্যভ্রষ্ট।
আমাদের পক্ষে এরূপ মনোভাবের প্রশ্রয় দেওয়াতে যে সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করা হয়, সে বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই। কেননা, ইউরোপের জনসাধারণের জাতীয় অহংকার জাতীয় অভ্যুদয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত; আমাদের জাতীয় অহংকার জাতীয় হীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত; ইউরোপের অহংকার তার কৃতিত্বের সহায়, আমাদের অহংকার আমাদের অকর্মণ্যতার পষ্ঠপোষক। সুতরাং এ শ্রেণীর লোকের বারা নতুন ও পুরাতনের বিরোধের যে সমবয় হবে, এরূপ আশা করা বাধ্য। যাঁরা মদ ছেড়ে আফিং ধরেন তাঁরা যদি কোনো-কিছুর সমন্বয় করতে পারেন তো সে হচ্ছে এই দুই নেশার। মদ আর আফিং এই দুটি জড়িতে চালাতে পারে সমাজে এমন লোকের অভাব নেই।
আসল কথা, নবশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে হাজারে নশো নিরানব্বই জন কস্মিনকালে প্রাচীন সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন নি। অদ্যাবধি তাঁরা কেবলমাত্র অশনে বসনে ব্যসনে ও ফ্যাশনে সামাজিক নিয়ম অতিক্রম করে আসছেন; কেননা, এ-সকল নিয়ম লঘন করবার দরুন তাঁদের কোনোরূপ সামাজিক শাস্তিভোগ করতে হয় না। পুরাতন সমাজধর্মের অবিরোধে নূতনকামের সেবা করাতে সমাজ কোনোরূপ বাধা দেয় না, কাজেই শিক্ষিত লোকেরা ঘরে ঘরে নিজের চরকায় বিলেতি তেল দেওয়াটাই তাঁদের জীবনের ব্রত করে তুলেছেন। এ শ্রেণীর লোকেরা দায়ে পড়ে সমাজের যে-সকল পরোনো নিয়ম মেনে চলেন, অপরের গায়ে পড়ে তারই নতুন ব্যাখ্যা দেন। এরা নতুন-পুরাতনের বিরোধভঞ্জন করেন নি; যদি কোনোকিছুর সমন্বয় করে থাকেন তো সে হচ্ছে সামাজিক সুবিধার সঙ্গে ব্যক্তিগত আরামের সময়।
পুরাতনের সঙ্গে নূতনের বিরোধের সৃষ্টি সেই দু-দশ জনে করেছেন, যাঁরা সমাজের মরচে-ধরা চরকায় কোনোরূপ তৈল প্রদান করবার চেষ্টা করেছেন—সে তেল দেশীই হোক, আর বিদেশীই হোক। এর প্রমাণ রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দয়ানন্দ স্বামী, কেশবচন্দ্র সেন ইত্যাদি। এর প্রথম তিনজন সমাজের দেহে যে স্নেহ প্রয়োগ করেছিলেন, সেটি খাঁটি দেশী এবং সংস্কৃত। অথচ এরা সকলেই সমাজদ্রোহী বলে গণ্য।
সমাজসংস্কার, অর্থাৎ পুরাতনকে নূতন করে তোলবার চেষ্টাতেই এ দেশে নন-পতনে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।
বিপিনবাবুর মুখের কথায় যদি এই বিরোধের সময় হয়ে যায়, তা হলে আমরা সকলেই আশীর্বাদ করব, যে তার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
.
৩.
দুটি পরস্পরবিরোধী পক্ষের মধ্যস্থতা করতে হলে নিরপেক্ষ হওয়া দরকার, অথচ একপক্ষ-না-একপক্ষের প্রতি টান থাকা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। বিপিনবাবুও এই সহজ মানবধর্ম অতিক্রম করতে পারেন নি। তার নানান উলটাপালটা কথার ভিতর থেকে তাঁর নূতনের বিরুদ্ধে নন ঝাঁজ ও পুরাতনের প্রতি নূতন ঝোঁক ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ তাঁর একটি কথার উল্লেখ করছি।
সকলেই জানেন যে, পুরাতন সংস্কারের নাম শুনতে পারে না; কারণ সুপ্তকে জাগ্রত করবার জন্য নূতনকে পতনের গায়ে হাত দিতে হয়–তাও আবার মোলায়েমভাবে নয়, কড়াভারে। বিপিনবাবু তাই সংস্কারকের উপর গায়ের বা ঝেড়ে নিজেকে ধরা দিয়েছেন। এর থেকেই বোঝা যায় যে, পালমহাশয়, যারা সমাজকে বদল করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে, আর যারা সমাজ অটল করতে চায় তাদের পক্ষে।
বিপিনবাবু বলেন–
দুনিয়াটা সংস্কারকের সৃষ্টিও নয়, আর সংস্কারকের হাত পাকাইবার জন্য সৃষ্টও হয় নাই।
দুনিয়াটা বে কি কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমরা জানি নে, তার কারণ সৃষ্টিকর্তা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ও-কাজ করেন নি। তবে তিনি যে পাল মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সৃষ্টি করেছেন, এমনও তো মনে হয় না। কারণ, দুনিয়া আর যে জন্যই সৃষ্ট হোক, বক্তৃতাকারের গলা-সাধবার জন্য হয় নি। সৃষ্টির পূর্বের খবর আমরাও জানি নে, বিপিনবাবুও জানেন না; কিন্তু জগতের সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক তা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি। ম্লেচ্ছ ভাষায় যাকে দুনিয়া বলে, হিন্দুদর্শনের ভাষায় তার নাম ‘ইদং’। ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ শীল নারায়ণ পত্রে সেই ইদংএর নিম্নলিখিত পরিচয় দিয়েছেন–
ইদংকে যে জানে, যে ইদংএর জ্ঞাতা ও ভোক্তা, আপনার কর্মের দ্বারা যে ইদংকে পরিচালিত ও পরিবর্তিত করিতে পারে বলিয়া, যাহাকে এই ইদংএর সম্পর্কে কৰ্ত্তাও বলা যায়—সেই মানুষ অহং পদবাচ্য।
অর্থাৎ মানুষ দুনিয়ার জ্ঞাতা ও কর্তা। শুধু তাই নয়, মানুষ ইদংএর কতা বলেই তার জ্ঞাতা। মনোবিজ্ঞানের মূল সত্য এই যে, বহির্জগতের সঙ্গে মানুষের যদি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার কারবার না থাকত তা হলে তার কোনোরূপ জ্ঞান আমাদের মনে জন্মাত না। মানুষের সঙ্গে দুনিয়ার মূলসম্পর্ক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে। আমাদের ক্রিয়ার বিষয় না হলে দুনিয়া আমাদের জ্ঞানের বিষয়ও হত না, অর্থাৎ তার কোনো অস্তিত্ব থাকত না। এবং সে ক্রিয়াফল হচ্ছে ইদংএর পরিচালন ও পরিবর্তন, আজকালকার ভাষায় যাকে বলে সংস্কার। সৃষ্টির গূঢ়তত্ত্ব না জানলেও মানুষে এ কথা জানে যে, তার জীবনের নিত্য কাজ হচ্ছে সৃষ্টপদার্থের সংস্কার করা। মানুষ যখন লাঙলের সাহায্যে ঘাস তুলে ফেলে ধান বোনে তখন সে পৃথিবীর সংস্কার করে। মানুষের জীবনে এক কৃষি ব্যতীত অপর কোনো কাজ নেই। এই দুনিয়ার জমিতে সোনা ফলাবার চেষ্টাতেই মানুষ তার মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়। ঋষির কাজও কৃষিকাজ, শুধু সে কৃষির ক্ষেত্র ইদং নয় অহং। সুতরাং সংস্কারকদের উপর বক্র দৃষ্টিপাত করে বিপিনবাবু দৃষ্টির পরিচয় দেন নি, পরিচয় দিয়েছেন শুধু বক্রতার।
শাস্ত্রে বলে যে, ক্রিয়াফল চারপ্রকার–উৎপত্তি প্রাপ্তি বিকার ও সংস্কার। কি ধর্ম কি সমাজ, কি রাজ্য, যার সংস্কারে হাত দেন তারই বিকার ঘটান, এমন লোকের অভাব যে বাংলায় নেই, সম্প্রতি তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই উপাদান নিয়ে কেউ গড়েন শিব, কেউ-বা বাঁদর। এ অবশ্য মহা আক্ষেপের বিষয়; কিন্তু তার থেকে এ প্রমাণ হয় না যে, দেশসুদ্ধ লোকের মাটির সুমুখে হাতজোড় করে বসে থাকতে হবে।
.
৪.
বিপিনবার মতে নূতনে-পুরাতনে মিলনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে নূতন; কারণ নূতনই হচ্ছে মূল বিবাদী। সুতরাং নূতনকে বাগ মানাতে হলে তাকে কিঞ্চিৎ আক্কেল দেওয়া দরকার।
নূতন তার গোঁ ছাড়তে চায় না, কেননা সে চায় উন্নতি। কিন্তু সে ভুলে যায় যে, জাগতিক নিয়মানুসারে উন্নতির পথ সিধে নয়, প্যাঁচালো। উন্নতি যে পদেপদে অবনতিসাপেক্ষ তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। বিপিনবাবু এই বৈজ্ঞানিক সত্যটির বক্ষ্যমাণ রূপ ব্যাখ্যা করেছেন–
তালগাছের মতন মানুষের মন বা মানবসমাজ একটা সরলরেখার ন্যায় ঊর্ধ্বদিকে উন্নতির পথে চলে না। …কিন্তু ঐ তালগাছে কোন সতেজ ব্রততী যেমন তাহকে বেড়িয়া বেড়িয়া উপরের দিকে উঠে, সেইরুপই মানুষের মন ও মানবের সমাজ ক্রমোন্নতির পথে চলিয়া থাকে। একটা লম্বা সরল খুটীর গায়ে নীচ হইতে উপর পর্যন্ত একগাছা দড়ি জড়াইতে হইলে যেমন তাহাকে ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া নিতে হয়, মানুষের মনের ও মানবসমাজের ক্রমবিকাশের পশ্বও কতকটা তারই মতন। এই গতির ঝোঁকটা সর্বদাই উন্নতির দিকে থাকিলেও, প্রতি তরেই, উপরে উঠিবার জন্যই, একটু করিয়া নীচেও নামিয়া আসিতে হয়। ইংরাজিতে এরূপ তির্যকগতির একটা বিশিষ্ট নাম আছে, ইহাকে পাইরাল মোষ (Spiral Motion) বলে। সমাজবিকাশের ক্রমও এইরূপ স্পাইর্যাল, একান্ত সরল নহে। …আপনার গতি-বেগের অবিচ্ছিন্নতা রক্ষা করিয়া এক স্তর হইতে অন্য স্তরে যাইতে হইলেই ঐ উর্ধ্বমুখী তির্যকগতির পথ অনুসরণ করিতে হয়।
বিপিনবাবুর আবিষ্কৃত এই উন্নতিতত্ত্ব যে নূতন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু সত্য কি না তাই হচ্ছে বিচার্য।
বিপিনবাবু বলেন যে, রজ্জুতে সর্পজ্ঞান সত্যজ্ঞান নয়, ভ্রম। এ কথা সৰ্ববাদীসম্মত। কিন্তু রজ্জুতে মতাজ্ঞান যে সত্যজ্ঞান, এরূপ বিশ্বাস করবার কারণ কি। রজ্জু জড়পদার্থ, এবং সতেজ ব্রততী সজীব পদার্থ। দড়ি বেচারার আপনার ‘গতিবেগ’ বলে কোনোরূপ গুণ কি দোষ নেই। ও-বস্তুকে ইচ্ছে করলে নীচে থেকে জড়িয়ে উপরে তুলতে পার, উপর থেকে জড়িয়ে নীচে নামাতে পার, লম্বা করে ফেলতে পার, তাল-পাকিয়ে রাখতে পার। রজ্জু উন্নতি অবনতি তির্যকগতি কি সরলগতি-কোনোরূপ গতির ধার ধারে না। বিপিনবাবু এ ক্ষেত্রে রজ্জুর যে ব্যবহার করেছেন তা জ্ঞানের গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার পর বিপিনবাবু এ সত্যই-বা কোন বিজ্ঞান থেকে উদ্ধার করলেন যে, মানুষের মন ও মানবসমাজ উদ্ভিদজাতীয়? সাইকলজি এবং সোশিয়লজি যে বটানির অন্তর্ভূত, এ কথা তো কোনো কেতাবে-কোরানে লেখে না। তর্কের খাতিরে এই অদ্ভুত উদ্ভিদতত্ত্ব মেনে নিলেও সকল সন্দেহের নিরাকরণ হয় না। মনে স্বতই এই প্রশ্নের উদয় হয় যে, মানুষের মন ও মানবসমাজ উদ্ভিদ হলেও ঐ দুই পদার্থ যে লতাজাতীয়, এবং বক্ষজাতীয় নয়, তারই-বা প্রমাণ কোথায়। গাছের মতো সোজাভাবে সরলরেখায় মাথাঝাড়া দিয়ে ওঠা যে মানবধর্ম নয়, কোন যুক্তি কোন প্রমাণের বলে বিপিনবাবু এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তা আমাদের জানানো উচিত ছিল; কেননা পালমহাশয়ের আন্তবাক, আমরা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে গ্রাহ্য করতে বাধ্য নই। উকি যে যুক্তি নয়, এ জ্ঞান বিপিনবাবুর থাকা উচিত। উত্তরে হয়তো তিনি বলবেন যে, উগতিমাত্রেই তির্যকগতি-এই হচ্ছে জাগতিক নিয়ম। ঊর্ধ্বগতিমাত্ৰকেই যে কর আকার ধারণ করতে হবে, জড়জগতের এমন কোনো বিধিনির্দিষ্ট নিয়ম আছে কি না জানি নে। যদি থাকে তো মানুষের মতিগতি যে সেই একই নিয়মের অধীন এ কথা তিনিই বলতে পারেন, যিনি জীবে জড় এম করেন।
আপনার গতিবেগের অবিচ্ছিন্নতা রক্ষা করিয়া এক স্তর হইতে অন্য তর যাইতে হইলেই ঐ উদ্ধর্মখী তির্যকগতির পথ অনুসরণ করিতে হয়।
বিপিনবাবুর এই মত যে সম্পূর্ণ ভুল তা তাঁর প্রদর্শিত উদাহরণ থেকেই প্রমাণ করা যায়। ‘তালগাছ যে সরলরেখার ন্যায় ঊদ্ধদিকে উঠে’-তার থেকে এই প্রমাণ হয় যে, যে নিজের জোরে ওঠে সে সিধেভাবেই ওঠে; আর যে পরকে আশ্রয় করে ওঠে সেই পেঁচিয়ে ওঠে, যথা, তরুর আশ্রিত লতা।
দশ ছত্র রচনার ভিতর ডাইনামিকস বটানি সোশিয়লজি সাইকলজি প্রতি নানা শাস্ত্রের নানা সূত্রের এহেন জড়াপটকি বাধানো যে সম্ভব, এ জ্ঞান আমার ছিল না। সম্ভবত পালমহাশয় যে নূতন দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরেছেন, সেই দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে যে, স্বর্গের সিঁড়ি গোল সিঁড়ি। যদি তাই হয়, তা হলে এ কথাও মানতে হবে যে, পাতালের সিঁড়িও গোল; কারণ ওঠা-নামার জাগতিক নিয়ম অবশ্যই এক। সুতরাং ঘুরপাক খাওয়ার অর্থ ওঠাও হতে পারে, নামাও হতে পারে। এ অবস্থায় উন্নতিশীলের দল যদি কুটিল পথে না চলে সরল পথে চলতে চান, তা হলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না।
.
৫.
বিপিনবাবু যে তাঁর প্রবন্ধের বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে নানারূপ পরস্পর-বিরোধী বাক্য একত্র করতে কুণ্ঠিত হন নি তার কারণ তিনি ইউরোপীয় দর্শন হতে এমন-এক সত্য উদ্ধার করেছেন, যার সাহায্যে সকল বিরোধের সমন্বয় হয়। হেগেলের থিসিস অ্যান্টিথিসিস এবং সিনথেসিস, এই বিপদের ভিতর যখন ত্রিলোক ধরা পড়ে, তখন তার অন্তর্ভূত সকল লোক যে ধরা পড়বে তার আর আশ্চর্য কি। হেগেলের মতে লজিকের নিয়ম এই যে, ‘ভাব’ (Being) এবং ‘অভাব’ (Non-Being) এই দুটি পরস্পরবিরোধী-এবং এই দুয়ের সমন্বয়ে যা দাঁড়ায় তাই হচ্ছে ‘স্বভাব’ (Beconting)। মানুষের মনের সকল ক্রিয়া এই নিয়মের অধীন, সুতরাং সৃষ্টিপ্রকরণও এই একই নিয়মের অধীন, কেননা এ জগৎ চৈতন্যের লীলা। অর্থাৎ তার লজিক এবং ভগবানের লজিক যে একই বস্তু, সে বিষয়ে হেগেলের মনে কোনোরূপ দ্বিধা ছিল না। তার কারণ হেগেলের বিশ্বাস ছিল যে, তিনি ভগবানের শুধু অবতার নন–স্বয়ং ভগবান। হেগেলের এই ঘরের খবর তাঁর সপ্রতিভ শিষ্য কবি হেনরি হাইনের (Henri Heine) গুরুমারাবিদ্যের গুণে ফাঁস হয়ে গেছে। বিপিনবাবুরও বোধ হয় বিশ্বাস যে, হেগেলের কথা হচ্ছে দর্শনের শেষকথা। সে যাই হোক, হেগেলের এই পশ্চিম-মীমাংসার বলে বিপিনবাবু, নুতন ও পুরাতনের সমন্বয় করতে চান। তিনি অবশ্য শুধু সূত্র পরিয়ে দিয়েছেন, তার প্রয়োগ করতে হবে আমাদের।
.
৬.
হেগেলের মত একে নতুন তার উপর বিদেশী; সুতরাং পাছে তা গ্রাহ্য করতে আমরা ইতস্তত করি এই আশঙ্কায় তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, হেগেলও যা, বেদান্তও তাই, সাংখ্যও তাই।
সমন্বয় অর্থে বিপিনবাবু কি বোঝেন, তার পরিচয় তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর মতে–
সমন্বয় মাত্রেই যে-বিরোধের নিষ্পত্তি করিতে যায়, তার বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষেরই দাবী-দাওয়া কিছু কাটিয়া হাটিয়া, একটা মধ্যপথ ধরিয়া তাঁহার ন্যায্য মীমাংসা করিয়া দেয়।
অর্থাৎ থিসিসকে কিছু ছাড়তে এবং অ্যান্টিথিসিসকে কিছু ছাড়তে হবে, তবে সিনথেসিস ডিক্রি পাবে। তাঁর দর্শনের এ ব্যাখ্যা শুনে সম্ভবত হেগেলের চক্ষুস্থির হয়ে যেত; কেননা তাঁর সিনথেসিস, কোনোরূপ রফাছাড়ের ফল নয়। তাতে থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস দুটিই পুরামাত্রায় বিদ্যমান; কেবল দুয়ে মিলিত হয়ে একটি নূতন মূর্তি ধারণ করে। সিনথেসিসের বিশ্লেষণ করেই থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস পাওয়া যায়। এর আধখানা এবং ওর আধখানা জোড়া দিয়ে অর্ধনারীশ্বর গড়া হেগেলের পদ্ধতি নয়।
তার পর মীমাংসা অর্থে যদি রফাছাড়ের নিষ্পত্তি হয় তা হলে বলতেই হবে যে, বিপিনবাবুর মীমাংসার সঙ্গে ব্যাস-জৈমিনির মীমাংসার কোনোই সম্পর্ক নেই। বেদান্তের মীমাংসা আর যাই হোক, আপস-মীমাংসা নয়। বেদান্তদর্শন নিজের দাবির এক-পয়সাও ছাড়ে নি, কোনো বিরোধী মতের দাবির এক-পয়সাও মানে নি। উত্তর-মীমাংসাতে অবশ্য সময়ের কথা আছে, কিন্তু সে সময়ের অর্থ যে কি, তা শংকর অতি পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন
এ সূত্ৰ বেদান্তবাক্যরূপ কুসুম গাঁথিবার সূত্র, অনুমান বা যুক্তি গাঁথিবার নহে ইহাতে নানাস্থানস্থ বেদান্তবাক্য-সকল আহৃত হইয়া মীমাংসিত হইবে।
এবং শংকরের মতে মীমাংসার অর্থ ‘অবিরোধী তর্কের সহিত বেদান্ত বাক্যসমূহের বিচার’। এ বিচারের উদ্দেশ্য এই প্রমাণ করা যে, বেদান্ত-বাক্যসমূহ পরস্পরবিরোধী নয়। হেগেলের পশ্চিম-মীমাংসার সহিত ব্যাসের উত্তর-মীমাংসার কোনো মিল নেই; না মতে, না পদ্ধতিতে। ব্রহ্মসূত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় পরব্রহ্ম, হেগেলের প্রতিপাদ্য বিষয় অপরব্রহ্ম। নিরুক্তের মতে ভাববিকার ছয়প্রকার, যথা: সৃষ্টি স্থিতি হ্রাস বৃদ্ধি বিপর্যয় ও লয়। শংকর হ্রাস বৃদ্ধি ও বিপর্যয়কে গণনার মধ্যে আনেন নি, কেননা তাঁর মতে এ তিনটি হচ্ছে স্থিতিকালের ভাববিকার। অপর পক্ষে এই তিনটি ভাবই হচ্ছে হেগেলের অবলম্বন, কেননা তাঁর অ্যাবসলিউট হচ্ছে ইটর্নল্ বিকামিং। সুতরাং হেগেলের ব্রহ্ম শুধু অপরব্রহ্ম নন, তিনি ঐতিহাসিক ব্রহ্ম—অর্থাৎ ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ক্রমবিকাশ হচ্ছে। হেগেলের মতে তার সমসাময়িক ব্রহ্ম প্রুশিয়া-রাজ্যে বিগ্রহবান হয়েছিলেন। শংকর যে-জ্ঞানের উল্লেখ করেছেন, সে-জ্ঞান মানসিক ক্রিয়া নয়; অপর পক্ষে হেগেলের জ্ঞান ক্রিয়ারই যুগপৎ কর্তা ও কর্ম।
বেদান্তের মতে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবার উপায় যুক্তি নয়; অপর পক্ষে হেগেলের মতে যুক্তির উপরেই ব্রহ্মের অস্তিত্ব নির্ভর করে। থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিসের সুতোয় সততায় গেরো দিয়েই এক-একটি ব্রহ্মমহর্ত পাওয়া যায়। বেদান্তের ব্রহ্ম স্থির-বর্তমান, হেগেলের ব্রহ্ম চির-বর্ধমান-অর্থাৎ একটি স্ট্যাটিক অপরটি ডাইনামিক। আসল কথা এই যে, বেদান্ত যদি থিসিস হয়, তা হলে হেগেল তার অ্যান্টিথিসিস-এ দুই মতের অভেদ জ্ঞান শুধু অজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব।
.
৭.
বিপিনবাবুর হাতে পড়ে শুধু বাদরায়ণ নয়, কপিলও হেগেলে লীন হয়ে গেছেন।
বিপিনবাবু আবিষ্কার করেছেন যে, যার নাম থিসিস অ্যান্টিথিসিস এবং সিনথেসিস, তারই নাম তমঃ রজঃ ও সত্ত্ব। কেননা তার মতে থিসিসের বাংলা হচ্ছে স্থিতি, অ্যান্টিথিসিসের বাংলা বিরোধ, এবং সিনথেসিসের বাংলা সমন্বয়। এ অনুবাদ অবশ্য গায়ের জোরে করা। কেননা, থিসিস যদি স্থিতি হয় তা হলে অ্যান্টিথিসিস অ-স্থিতি (গতি) এবং সিনথেসিস সংস্থিতি। সে যাই হোক, সাংখ্যের ত্রিগুণের সঙ্গে অবশ্য হেগেলের ত্রিসূত্রের কোনো মিল নেই; কেননা সাংখ্যের মতে এই ত্রিগুণের সমন্বয়ে জগতের লয় হয়, সৃষ্টি হয় না। সত্ত্ব রজঃ তমের মিলন নয়, বিচ্ছেদই হচ্ছে সৃষ্টির কারণ; অপর পক্ষে হেগেলের মতে থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিসের মিলনের ফলে জগৎ সৃষ্ট হয়। বিপিনবাবুর ন্যায় পর্ব পশ্চিম সকল দর্শনের সমন্বয়কারের কাছে অবশ্য এ-সকল পার্থক্য তুচ্ছ এবং অকিঞ্চিৎকর; অতএব সর্বথা উপেক্ষণীয়।
তমঃ ও রজের মিলনে যে বহু জন্মলাভ করে, তা হেগেলের সিনথেসিস হতে পারে, কিন্তু তা সাংখ্যের সত্ত্ব নয়। এ কথা দুটি-একটি উদাহরণের সাহায্যে সহজেই প্রমাণ করা যেতে পারে। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের মন ও মানবসমাজের উন্নতির পদ্ধতি। বিপিনবাবুর উদভাবিত কপিল-হেগেল-দর্শন-অনুসারে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়–
তামসিক মন=সুপ্ত
রাজসিক মন =জাগ্রত
সাত্ত্বিক মন=ঝিমন্ত
তামসিক সমাজ=মৃত
রাজসিক সমাজ=জীবিত
সাত্ত্বিক সমাজ=জীবন্মৃত
অর্থাৎ সমন্বয়ের ফলে রজোগুণের উন্নতি নয়, অবনতি হয়। সগুণ যে তমোগ এবং রজোগণের মাঝামাঝি একটি পদার্থ এ কথা সাংখ্যাচার্যেরা অবগত নন, কেননা তারা হেগেল পড়েন নি। উক্ত দর্শনের মতে সত্ত্বগুণ রজোগুণের অতিরিক্ত, অন্তর্ভুত নয়। সাত্ত্বিক ভাব যে বিরোধের ভাব নয়, তার কারণ রজোগুণ যখন তমোগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয় তখনই তা সত্ত্বগণে পরিণত হয়। হেগেলের মত অবশ্য সাংখ্যমতের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাংখ্যকে উলটে ফেললে যা হয়, তারই নাম হেগেল-দর্শন। সাংখ্যমতে সক্ষম অনলোমরুমে স্বল হয়, হেগেল-মতে ঐ একই পদ্ধতিতে প্রল সক্ষম হয়। সাংখ্যের প্রকৃতি হেগেলের পুষ। সাংখ্যের মতে সৃষ্টিতে প্রকৃতি বিকারগ্রস্ত হন, হেগেলের মতে পুরুষ সাকার হন।
বিপিনবাবু দেশী-বিলাতি-দর্শনের সমন্বয় করে যে মীমাংসা করেছেন সে হচ্ছে অপুর্ব মীমাংসা; কেননা, কি স্বদেশে, কি বিদেশে, ইতিপূর্বে এরূপ অন্তর্ভূত মীমাংসা আর কেউ করেন নি।
নূতন-পুরাতনের সমন্বয়ের এই যদি নমুনা হয় তা হলে নূতন ও পুরাতন উভয়েই সমন্বয়কারকে বলবে—ছেড়ে দে বাবা, লড়ে বাঁচি।
বিপিনবাবু, যাকে সমন্বয় বলেন, বাংলা ভাষায় তার নাম খিচুড়ি।
সমাজদেবতার নিকটে পালমহাশয় যে খিচুড়িভোগ নিবেদন করে দিয়েছেন, যিনি তার প্রসাদ পাবেন তার যে কৃষ্ণতি হবে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই।
আসল কথা এই যে, দর্শনবিজ্ঞানের মোটা কথার আশ্রয় নেওয়ার অর্থ হচ্ছে কোনো বিশেষ সমস্যার মীমাংসা করা নয়, তার কাছ থেকে পলায়ন করা। দর্শন কি বিজ্ঞান যে আজ পর্যন্ত এমন-কোনো সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করেন নি যার সাহায্যে কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশেষ মীমাংসা করা যায়, তার কারণ সকল বিশেষ বস্তুর বিশেষত্ব বাদ দিয়েই সর্বসাধারণে গিয়ে পৌছোনা যায়। বিশ্বকে নিঃস্ব করেই দার্শনিকেরা বিশ্বতত্ত্ব লাভ করেন। সোনা ফেলে আঁচলে গিট দেওয়াই দার্শনিকদের চিরকেলে অভ্যাস। এ উপায়ে সম্ভবত ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ হতে পারে, কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান লাভ হয় না। সমাজের উন্নতি দেশকালপাত্র-সাপেক্ষ, সুতরাং দেশকালের অতীত কিংবা সর্বদেশে সর্বকালে সমান বলবৎ কোনো সত্যের দ্বারা সে উন্নতি সাধন করবার চেষ্টা বৃথা। ফিজিক্স কিংবা মেটাফিজিক্সএর তত্ত্ব সমাজতত্ত্ব নয়, এবং এ দুই তত্ত্ব যে পৃথক জাতীয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিপিনবাবুর আবিষ্কৃত ঊর্ধ্বগতির দৃষ্টান্ত থেকেই দেখানো যেতে পারে। এমন-কোনো জাগতিক নিয়ম নেই যে, মানুষের চেষ্টা ব্যতিরেকেও তার উন্নতি হবে। হ্রাস বৃদ্ধি ও বিপর্যয়, এ তিনই জীবনের ধর্ম; সুতরাং সমাজের উন্নতি ও অবনতি মানুষের দ্বারাই সাধিত হয়। মানবের ইচ্ছাশক্তিই মানবের উন্নতির মূল কারণ। তা ছাড়া মানবের উন্নতি যে ক্রমোন্নতি হতে বাধ্য, এমন-কোনো নিয়মের পরিচয় ইতিহাস দেয় না। বরং ইতিহাস এই সত্যের পরিচয় দেয় যে, বিপর্যয়ের ফলেই মানব অনেক সময়ে মহা উন্নতি লাভ করেছে। যে-সব মহাপুরুষকে আমরা ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করি, যথা বুদ্ধদেব যিশুখৃস্ট মহম্মদ চৈতন্য প্রভুতি এরা মানুষের মনকে বিপর্যস্ত করেই মানবসমাজকে উন্নত করেছেন; এরা পাইরাল, মোশনএর ধার ধারতেন না কিংবা স্থিতি ও গতির মধ্যে দূতীগিরি করে তাদের মিলন ঘটানো নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করেন নি।
মানুষের মনকে যদি গেরোবাজের মতো আকাশে ডিগবাজি খেতে খেতে উঠতে হত, এবং মানবসমাজকে যদি লোটনের মতো মাটিতে লুটতে লুটতে এগোতে হত, তা হলে এ দুয়ের বেশিক্ষণ সে কাজ করতে হত না, দু দণ্ডেই তাদের ঘাড় লটকে পড়ত। সুতরাং কি মন কি সমাজ, কোনোটিকেই পাকচক্রের ভিতর ফেলবার আবশ্যকতা নেই। বিপিনবাবুর বক্তব্য যদি এই হয় যে, পৃথিবীতে অবাধগতি বলে কোনো জিনিস নেই, তা হলে আমরা বলি—এ সত্য শিশুতেও জানে যে পদে পদে বাধা অতিক্রম করেই অগ্রসর হতে হয়। তাই বলে স্থিতি-গতির সমন্বয় করে চলার অর্থ যে শুধু হামাগুড়ি দেওয়া, এ কথা শিশুতেও মানে না। অধোগতি অপেক্ষা উন্নতির পথে যে অধিকতর বাধা অতিক্রম করতে হয়, এ তো সর্বলোকবিদিত। কিন্তু এর থেকে এ প্রমাণ হয় না যে, স্থিতির বিরুদ্ধে গতি নামক ‘বিরোধটি জাগিয়ে’ রাখা মূর্খতা এবং সেটিকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াটাই জ্ঞানীর কর্তব্য। জড়ের সঙ্গে যোঝাযুঝি করেই জীবন স্ফূর্তি লাভ করে। সুতরাং পুরাতন যে-পরিমাণে জড়, সেই পরিমাণে নবজীবনকে তার সঙ্গে লড়তে হবে। যে সমাজের যত অধিক জীবনীশক্তি আছে, সে সমাজে স্থিতিতে ও গতিতে জড়ে ও জীবে তত বেশি বিরোধের পরিচয় পাওয়া যাবে। নূতন-পুরাতনের এই বিরোধের ফলে যা ভেঙে পড়ে তার চাইতে যা গড়ে ওঠে, সমাজের পক্ষে তার মূল্য ঢের বেশি। কোনো নূতনের বরের ঘরের পিসি ও পুরাতনের কনের ঘরের মাসির মধ্যস্থতায় এ দুই পক্ষের ভিতর যে চিরশান্তি স্থাপিত হবে, এ আশা দুরাশা মাত্র।
আমি পূর্বে বলেছি যে, নূতন-পুরাতনে যদি কোথায়ও বিবাদ থাকে তো সে সাহিত্যে, সমাজে নয়। আমার বিশ্বাস যদি অন্যরূপ হত, তা হলে আমি বিপিনবাবুর কথার প্রতিবাদ করতুম না। তার কারণ, প্রথমত আমি সমাজসংস্কারব্যাপারে অব্যবসায়ী। অতএব এ ব্যাপারে কোন ক্ষেত্রে আক্রমণ করতে হয় এবং কোন ক্ষেত্রে পৃঠভঙ্গ দিতে হয় এবং কোনটি বিগ্রহের এবং কোনটি সন্ধির যুগ তা আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত, বিপিনবাবুর উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসারে নূতন-পুরাতনের জমাখরচ করলে সামাজিক হিসাবে পাওয়া যায় শুধু শূন্য। সুতরাং কি নূতন, কি পুরাতন, কোনো পক্ষই ও-উপায়ে কোনো সামাজিক সমস্যার মীমাংসা করবার চেষ্টামাত্রও করবেন না। তৃতীয়ত, ডাক্তার শীলের মতে–
সহস্র বৎসরাবধি এই দেশ ঠিক সেই জায়গায়ই বসিয়া আছে; তার আর কোনও বিকাশ হয় নাই।
যে সমাজ হাজার বৎসর এক স্থানে এক ভাবে বসে আছে তার আসন টলাবার শক্তি আমাদের মতো সাহিত্যিকের শরীরে নেই। বিপিনবাবুর মতামত কর্মকাণ্ডের নয়, জ্ঞানকাণ্ডের বস্তু বলেই এ বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছি। তাঁর বর্ণিত সময়ের কোনো সার্থকতা সমাজে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সাহিত্যে নেই। সামাজিক ক্রিয়াকর্মে দুধের সঙ্গে জলের সমন্বয়-প্ৰচলন দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যে জলোদুধের আমদানি আমরা বিনা আপত্তিতে গ্রাহ্য করতে পারি নে। কারণ ও-বস্তু অন্তরাত্মার পখকে মুখরোচকও নয়, স্বাস্থ্যকরও নয়। অথচ সরস্বতীর মন্দিরে কিঞ্চিৎ আর কিঞ্চিৎ মদের সমন্বয় যে জ্ঞানামৃত বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, তার প্রমাণ তো হাতে-হাতেই পাওয়া যাচ্ছে। সাহিত্যের এই পাঞ্চ্ পান করে আমাদের সমাজের আজ মাথা ঘুরছে। এই ঘুরুনির চোটে অনেকে চোখে এত ঝাপসা দেখেন যে, কোন বস্তু নূতন আর কোন বস্তু পুরাতন, কোনটি স্বদেশী আর কোনটি বিদেশী-তাও তারা চিনতে পারেন না। এ অবস্থায় বাঙালির প্রথম দরকার সমাজে নূতন-পুরাতনের সময় নয়, মনে নূতন-পুরাতনের বিচ্ছেদ ঘটানো। আমাদের শিক্ষা যাকে এক সঙ্গে গুলে ঘুলিয়ে দিচ্ছে, আমাদের সাহিত্যের কাজ হওয়া উচিত তাই বিশ্লেষণ করে পরিষ্কার করা।
পৌষ ১৩২১
————-
১. “নূতনে পুরাতনে”, ‘নারায়ণ’, অগ্রহায়ণ ১৩২১।
২. “হিন্দুর প্রকৃত হিন্দুত্ব”, অগ্রহায়ণ ১৩২১।
বর্তমান যুদ্ধের কার্যকারণ সম্বন্ধে ইউরোপে যদি কোনো বাজে কথা কিংবা অসংগত কথা বলা হয় তাতে আশ্চর্য হবার কোনো কারণ নেই, কেননা মানুষে যখন যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, মনে যখন রাগ ও দ্বেষই প্রাধান্য লাভ করে তখন তার পক্ষে বাক্যের সংযম কতক পরিমাণে হারানো স্বাভাবিক।
ঘরে ডাকাত পড়লে তার সঙ্গে মিষ্ট এবং শিষ্ট আলাপ করা সম্ভবত দেবতার পক্ষে স্বাভাবিক, মানুষের পক্ষে নয়; এবং ইউরোপের লোক দেবতা নয়, মানুষ।
কিন্তু এই যুদ্ধে ব্যাপারটি আমাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে বিচার করবার বিশেষ কোনো বাধা নেই। আমরা ও-জালে জড়িয়ে পড়ি নি; এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারের যা-কিছু যোগ আছে সে শুধু তারের–নাড়ির নয়।
ইউরোপে সুরাসুর মিলে যে ভবসমুদ্র মন্থন করেছেন তার ফলে অমৃতই উঠুক আর হলাহলই উঠক, তার ভাগ আমরাও পাব; কিন্তু সে ভবিষ্যতে। সে বস্তু পান করবার পূর্বেই আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম হবার কোনো কারণ নেই। বরং এই অবসরে আমরা যদি ব্যাপারটি ঠিক ভাবে দেখতে ও বুঝতে শিখি তা হলে এর ভবিষ্যৎ ফলাফলের জন্য আমরা অনেকটা প্রস্তুত থাকব।
এই সমরানলে যে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে সে কথা সত্য। কিন্তু বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার অর্থ যে কি, সে বিষয়ে দেখতে পাই অনেকের তেমন স্পষ্ট ধারণা নেই। এমন-কি, কেউ কেউ এই উপলক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
আমার মতে ইউরোপের প্রতি অবজ্ঞার কথা আমাদের মুখে শোভা পায় না। এ অবশ্য রুচির কথা; সুতরাং এ ক্ষেত্রে মতভেদের যথেষ্ট অবসর আছে। মনোভাব প্রকাশ না করলেই যে, সে ভাব মন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায় তা অবশ্য নয়। অথচ এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য যে, আমরা মুখে কি বলি, তার চাইতে আমরা মনে কি ভাবি তার মূল্য আমাদের কাছে ঢের বেশি; কেননা সত্যের জ্ঞান না হলে মানুষে সত্য কথা বলতে পারে না।
প্রথমত কি স্বদেশী, কি বিদেশী, কি নবীন, কি প্রাচীন কোনো সভ্যতাকেই এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
একটি বিপুল মানবসমাজের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ওরকম এক-তরফা ডিক্রি দেওয়ার নাম বিচার নয়। বহু মানবে বহু দিন ধরে কায়মনোবাক্যে যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে তার ভিতর যে মনুষ্যত্ব নেই, এ কথা বলতে শুধু তিনিই অধিকারী যিনি মানুষ নন। অপর পক্ষে চরম-সভ্যতা বলে কোনো পদার্থ মানুষে আজ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে নি এবং কখনো পারবে না। কেননা, পৃথিবী যেদিন স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে সেদিন মানুষের দেহমনের আর কোনো কার্য থাকবে না, কাজেই মানুষ তখন চিরনিদ্রা উপভোগ করতে বাধ্য হবে। অন্তত পৃথিবীতে এমন কোনো সত্যতা
আজ পর্যন্ত হয় নি যা একেবারে নির্গুণ কিংবা একেবারে নির্দোষ। কোনো একটি বিশেষ সভ্যতার বিচার করবার জন্য তার দোষগণের পরিচয় নেওয়া আবশ্যক, মনকে খাটানো দরকার। যখন আমরা আলস্যে অভিভূত হয়ে হাই তুল তখনই আমরা তুড়ি দিই, সুতরাং আমরা যখন তুড়ি দিয়ে কোনো জিনিস উড়িয়ে দিতে চাই তখন আমরা মানসিক আলস্য ব্যতীত অন্য কোনো গুণের পরিচয় দিই না। এ সত্য অবশ্য চিরপরিচিত; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, পৃথিবীতে যা চিরপরিচিত তাই চির-উপেক্ষিত।
.
২.
ইউরোপের বর্তমান সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, যে মনোভাবের উপর সে সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত এই মহাসমর হচ্ছে তার স্বাভাবিক পরিণতি; কেননা এ যুগে ইউরোপ ধর্মপ্রাণ নয়, কর্মপ্রাণ। সে দেশে আজ আত্মার অপেক্ষা বিষয়ের, মনের অপেক্ষা ধনের মাহাত্ম ঢের বেশি। শিল্প-বাণিজ্যের পরিমাণ-অনুসারেই এ যুগে ইউরোপের জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের পরিমাপ করা হয় এবং সে দেশের লোকের বিশ্বাস যে, মানবের ভ্রাতৃভাব নয় ভ্রাতৃবিরোধই হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভ্যুদয়ের একমাত্র উপায়। অতএব এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউরোপের আজ একশো বৎসরের কর্মফল।
এ অভিযোগের মূলে যে কতকটা সত্য আছে তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু কতটা, তাই হচ্ছে বিচার্য।
আমরা মানবসভ্যতাকে সচরাচর দুই ভাগে বিভক্ত করি; প্রাচীন ও নবীন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন-কোনো বর্তমান সভ্যতা নেই যা অনেক অংশে প্রাচীন নয়। যেমন আমাদের বর্তমান সভ্যতা কিংবা অসভ্যতা এক অংশে প্রাচীন হিন্দু, এবং আর-এক অংশে নব্য ইউরোপীয়, তেমনি ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা আট-আনা নতুন হলেও আট-আনা পুরনো। সুতরাং এই যুদ্ধের জন্য ইউরোপের নবমনোভাবকে সম্পূর্ণ দায়ী করা যেতে পারে না, বরং তার পূর্বসংস্কারকেই এর জন্য দোষী করা অসংগত হবে না।
মানুষে-মানুষে কাটাকাটি-মারামারি করা যদি অসভ্যতার লক্ষণ হয় তা হলে বলতে হবে ইউরোপের বর্তমান যুগের অপেক্ষা মধ্যযুগ টের বেশি অসভ্য ছিল। সে যুগে যুদ্ধপার্বন বারো মাসে তেরো বার হত এবং সে কালের মতে ও-কার্যটি নিত্যকর্মের মধ্যে গণ্য ছিল। মধ্যযুগকে ইউরোপীয়েরা কৃষ্ণযুগ বলেন, কিন্তু আসলে সেটি রক্তযুগ। আমরা আমাদের বর্তমান মনোভাববশতই যুদ্ধকাৰ্যটি হেয় মনে করি, প্রাচীন মনোভাব থাকলে শ্রেয় মনে করতুম। ইউরোপের নবযুগ অবশ্য এক হিসাবে যন্ত্রযুগ, কিন্তু তাই বলে মধ্যযুগ যে মন্ত্রযুগ ছিল, তা নয়। যে হিসাবে মধ্যযুগ ধর্মপ্রাণ ছিল সে হিসাবে নবযুগ ধর্মপ্রাণ নয়। সে হিসাবটি যে কি, তা একটু পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক।
বৌদ্ধধর্মের মতো খৃস্টধর্মেরও ত্রিরত্ন আছে–সে হচ্ছে খৃস্ট ধর্ম ও সংঘ; এবং খৃস্টিয়ান মাত্রেই নামমাত্র এই তিনের শরণ গ্রহণ করেন। কিন্তু যুগভেদে এই তিনের মধ্যে এক-একটি রত্ন সর্বাপেক্ষা মহামূল্য হয়ে ওঠে।
প্রথম যুগে (Primitive Christianity) খৃস্টিয়ানের পক্ষে খৃস্টই ছিল শরণ্য। মধ্যযুগে খৃস্টের স্থান খৃস্টসংঘ অধিকার করেন এবং ইউরোপের মনোরাজ্যে একাধিপত্য স্থাপন করেন; সে সংঘ সে আধিপত্যের ভাগ খৃস্টকেও দেন নি, ধর্মকেও দেন নি। প্রায় একহাজার বৎসর ধরে খৃস্টসংঘ মানবের বুদ্ধি ও আত্মাকে সমান অভিভূত করে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, সাংসারিক হিসাবেও এই সংঘ ইউরোপের রাজরাজেশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। এই সংঘ মানুষের তনু মন ধনের উপর এই অসীম প্রভুত্ব অক্ষম রাখবার জন্য ধর্মের নামে কত যে অধর্মযুদ্ধের প্রবর্তন করেছেন তার প্রমাণ মধ্যযুগের ইতিহাসের পাতায় পাতায় পাওয়া যায়।
এই সংঘের ধর্ম ও খৃস্টধর্ম এক বস্তু নয়। সুতরাং এই সংঘের দাসত্ব হতে মুক্তিলাভ করে ইউরোপের যে ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে এ কথা বলা চলে না। বরং পূর্বের অপেক্ষা বর্তমানে ইউরোপীয়দের যে ধর্মবুদ্ধি (Conscience) অধিক জাগ্রত হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ ইউরোপের সকল আইনকানুনে সকল সমাজব্যবস্থায় পাওয়া যায়।
মধ্যযুগের অন্ধ কারাগার আপনি ভেঙে পড়ে নি; মানবমনের একটির পর আর-একটি তিনটি প্রবল ধাক্কায় তার পাষাণপ্রাচীর বিদীর্ণ হয়েছে; সে তিন হচ্ছে ইতালির রেনেসাঁস, জর্মানির রিফরমেশন এবং ফ্রান্সের রেভলিউশন।
গ্রীস ও রোমের প্রাচীন সভ্যতার স্পর্শে ইতলি যেদিন নবজীবন লাভ করলে সেইদিন ইউরোপে নবসভ্যতার সূত্রপাত হল। এই প্রাচীন সাহিত্যের আবিষ্কারের সঙ্গে মানুষ নিজের শক্তি ও বাহিরের সৌন্দর্য আবিষ্কার করলে। মানুষ বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে নিজের চোখ দিয়ে দেখতে এবং নিজের বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে শিখলে। মানুষের পক্ষে তার এই নব-আবিস্কৃত অন্তর্নিহিত শক্তির চর্চাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠল। যে প্রকৃতিকে ইউরোপীয়েরা হাজার বত্সর ধরে বিমাতা মনে করে আসছিল, তাকে তারা সেবাদাসীতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়ে উঠল। এই নবজীবন শিল্পে বিজ্ঞানে কাব্যে ইতিহাসে বিকশিত হয়ে উঠল। এক কথায় নবজীবন লাভ করে মানুষের চোখ-কান ফুটল এবং হাত-পায়ের খিল খুলে গেল।
এর পরবর্তী যুগে জর্মানি বাইবেলের আবিষ্কারের সঙ্গে নিজের আত্মারও আবিষ্কার করলে; মানুষে এই সত্যের পরিচয় পেলে যে, ধর্মের মূল তার নিজের অন্তরে, ধর্মযাজকের মুখে নয়। খৃস্টের ধর্মের পরিচয় লাভ করে মানুষে খৃস্টসংঘের সংস্কারের জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। জর্মানির এই নবসংস্কারের গুণে ইউরোপের মানবশক্তি আবার অন্তর্মুখী হল। মানুষ আত্মদর্শনের জন্য লালায়িত হয়ে উঠল।
এই রেনেসাঁসের ফলে ইউরোপে মানুষের কর্মবুদ্ধি এবং এই রিফরমেশনের ফলে তার ধর্মবুদ্ধি মুক্তিলাভ করলে; কিন্তু তার সামাজিক জীবনের বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটল না।
তার পর ফ্রান্সের বিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় মানব মধ্যযুগের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করে জীবনেও স্বাধীনতা লাভ করলে। সুতরাং ইউরোপের নবযুগের সভ্যতায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব ফিরে পেলে, হারাল না। যে মনোভাবের উপর এ সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত তা শান্তির পক্ষে অনুকূল বই প্রতিকুল নয়। সামাজিক স্বাধীনতা যে সামাজিক মৈত্রীর প্রতিবন্ধক নয়, তার প্রমাণ এই ধেই পাওয়া যায়। আজ দেখা যাচ্ছে যে, ইউরোপের এক-একটি জাতি যেন এক-একটি ব্যক্তিস্বরূপ হয়ে উঠেছে; মধ্যযুগে এরূপ একজাতীয়তার ভাব মানুষের কল্পনারও অতীত ছিল।
.
৩.
আমি পূর্বে বলেছি যে, কোনো যুগের কোনো সভ্যতা একেবারে নির্দোষ কিংবা একেবারে নির্গুণ নয়। ইউরোপের মধ্যযুগের সপক্ষে যে কিছু বলবার নেই, তা নয়। অন্ধকারেরও একটা অটল সৌন্দর্য আছে এবং তার অন্তরেও গুপ্তশক্তি নিহিত থাকে। যে ফল দিনে ফোটে, রাত্রে তার জন্ম হয়—এ কথা আমরা সকলেই জানি। সুতরাং নবযুগে যে-সকল মনোভাব প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তার অনেক গলির বীজ মধ্যযুগে বপন করা হয়েছিল। কিন্তু নবযুগের আলোক না পেলে সে-সকল বীজ বড়োজোর অঙ্কুরিত হত, তার বেশি নয়।
ইউরোপের নবসভ্যতার আলোক সুর্যের আলো নয় যে, তা কেউ নেবাতে পারে না। এ আলো প্রদীপের আলো, আকাশ থেকে পড়ে নি, মানুষে নিজহাতে রচনা করেছে; সুতরাং ইউরোপের নিশাচররা এ আলো নেবাবার বহু চেষ্টা করেছে। মধ্যযুগের সঙ্গে পদে-পদে লড়াই করে নবযুগকে অগ্রসর হতে হয়েছে। রিফমেশনকে আত্মরক্ষার জন্য প্রায় দেড়শো বছর অবিরাম যুদ্ধ করতে হয়েছে। ফরাসিবিপ্লব আত্মরক্ষার জন্য যে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়, তা ইউরোপময় ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা সাম্য ও মৈত্রী’র মন্ত্রে দীক্ষিত নেপোলিয়ন সমগ্র ইউরোপকে প্রায় নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। স্বাধীনতার অবতার পরের স্বাধীনতা অপহরণ করা, মৈত্রীর অবতার পরের শত্রুতা করা এবং সাম্যের অবতার যে ইউরোপের একেশ্বর হওয়া তাঁর জীবনের ব্রত করে তুলেছিলেন, এ কথা মনে করলে মানবসভ্যতা সঙ্গে হতাশ হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমরা আজ একশো বছর পরে নেপোলিয়নের এই বিরাট দস্যুতার বিচার করে দেখতে পাই যে, তার সুফল হয়েছে এই যে, ফরাসি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমগ্র ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; আর তার কুফল হয়েছে এই যে, সেইসঙ্গে নেপোলিয়নের মিলিটারিজমও সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের প্রবল সংঘর্ষে যে অমৃত ও হলাহল উত্থিত হয়েছে, ইউরোপের সকল জাতির দেহ ও মনে তার অল্পবিস্তর প্রভাব স্পষ্ট লক্ষিত হয়।
বর্তমান যুগের সর্বপ্রধান সমস্যাই এই যে, কি উপায়ে সভ্যসমাজের দেহ এই বিষমুক্ত করা যেতে পারে।
.
৪.
এ সমস্যা অতি গুরুতর সমস্যা। কেননা, এক পক্ষে যেমন ইউরোপের সভ্যজাতিদের মনে যুদ্ধ করবার প্রবৃত্তি কমে এসেছে, অপর পক্ষে তাদের জীবনে পরস্পর যুদ্ধ করবার নূতন কারণেরও সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে ইউরোপের মুখে শান্তিবচন এবং হাতে অস্ত্র।
সকলেই জানেন যে, শিল্প ও বাণিজ্যই হচ্ছে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রধান আশ্রয়স্থল। শিল্পবাণিজ্যের সাহায্যে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করার অর্থ হচ্ছে নিজের পরিশ্রমে জীবিকা অর্জন করা; আর যুদ্ধের দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করার অর্থ হচ্ছে পরের পরিশ্রমের ফল উপভোগ করা। এ দুটি মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। এই কারণেই সকল দেশে সকল যুগেই দেখা যায় যে, ক্ষত্রিয় বৈশ্যকে অবজ্ঞা করে এবং বৈশ্য ক্ষত্রিয়কে ভয় করে। যে জাতির অধিকাংশ লোক শিল্পবাণিজ্যে ব্যাপৃত, সে জাতির যুদ্ধে প্রবৃত্ত না থাকাই স্বাভাবিক।
তার পর, শিল্পবাণিজ্যের পক্ষে যুদ্ধের ন্যায় ক্ষতিকর ব্যাপার আর নেই। যুদ্ধ যে মানুষের সকল কাজকর্ম সকল বেচাকেনা একদিনেই বন্ধ করে দেয়, তার প্রমাণ তো আজ হাতে-হাতেই পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং, যুদ্ধ জিনিসটি ইউরোপীয়দের স্বার্থের বিরোধী। আর-এক কথা, হার্বাট স্পেনসর প্রমুখ দার্শনিকেরা আশা করেছিলেন যে, বর্তমান ইউরোপের বৈশ্যসভ্যতা পৃথিবীতে চিরশান্তি স্থাপন করবে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, বাণিজ্যের যোগ পৃথিবীর সকল জাতির সখ্যসূত্রে পরিণত হবে। এই অন্নবস্ত্রেরে অবাধ আদানপ্রদানের ফলে প্রতি জাতির কাছেই বসুধা কুটুম্ব হয়ে উঠবে। এই কারণে এই শ্রেণীর দার্শনিকদের মতে ক্ষত্রিয়যুগের অপেক্ষা বৈশ্যযুগের সভ্যতা মানব-ইতিহাসের উন্নত স্তরের সভ্যতা। হার্বার্ট স্পেনসরের এই আশা যে কবিকল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়, তার প্রমাণ আজ পাওয়া যাচ্ছে। আজ দেখা যাচ্ছে যে, আগে যেমন রাজ্য নিয়ে রাজায়-রাজায় লড়াই করত, আজ তেমনি বাণিজ্য নিয়ে জাতিতে-জাতিতে লড়াই করছে এবং এ লড়াই অতি ভীষণ এবং অতি নিষ্ঠুর। কারণ আগে মানুষ হাতে যুদ্ধ করত, এখন কলে যুদ্ধ করে। এই কারণেই বর্তমান যুদ্ধ নিতান্ত অমানুষী ব্যাপার, কেননা বাহুবলের ভিতর মনুষ্যত্ব আছে কিন্তু যন্ত্রবলের ভিতর নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, বৈশ্যসভ্যতা যুদ্ধের অনুকূল নয়, কেননা যুধ বৈশ্যধর্মের প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
.
৫.
ইংলণ্ড এবং ফ্রান্স যে আত্মরক্ষা ব্যতীত অপর কোনো কারণে যুদ্ধ করাটা অকর্তব্য মনে করে সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনো বৈধ কারণ নেই। ইউরোপের নবযুগের নবসভ্যতার যথার্থ উত্তরাধিকারী হচ্ছে এই দুটি দেশ। ইংরেজ ও ফরারি উভয়েই ক্ষত্রিয়যুগ উত্তীর্ণ হয়ে বৈশ্যযুগে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং এদের দেহে রণসজ্জা থাকলেও মনে খাঁটি মিলিটারিজম নেই। অপর পক্ষে জর্মানি হচ্ছে যুদ্ধপ্রাণ; মিলিটারিজম জর্মানির যুগপৎ ধর্ম ও কর্ম। বর্তমান জর্মানির এরূপ মনোভাবের জন্য দায়ী জর্মানির পূর্বইতিহাস।
প্রায় আটশত বৎসর ধরে ইউরোপে জর্মানজাতির কোনোরূপ প্রভুত্ব ছিল না, তার কারণ জর্মানরা এই দীর্ঘকালের ভিতর একটি জর্মানরাজ্য কিংবা একটি জর্মানজাতি গড়ে তুলতে পারে নি। যে কালে ইংলণ্ড ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ স্বাতন্ত্র্য এবং স্বরাজ্য লাভ করেছিল, সে কালে জর্মানি শত শত পরস্পরবিরোধী খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ কতকটা জর্মানির কপালের দোষে, কতকটা তার বুদ্ধির দোষে। জর্মানি সমগ্র ইউরোপের সম্রাট হবার দুরাশা হৃদয়ে পোষণ করত বলে স্বদেশেও একরাট হতে পারে নি।
কোনো কোনো বৌদ্ধদেশে দুটি করে রাজা থাকেন; একজন প্রকৃতিপুঞ্জের আত্মার প্রভু, আর-এক জন দেহের। মধ্যযুগের প্রথম ভাগে সমগ্র ইউরোপীয় মানবকে এইরূপ দুই ছত্রের অধীন করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। পোপ ইউরোপের ধর্মরাজের পদ এবং জর্মানরাজ দেবরাজের পদ অধিকার করে বসেছিলেন। ইউরোপ একটি মহাদেশ এবং ইউরোপীয়েরা নানা বিভিন্ন জাতীয়, সুতরাং ঐহিক কিংবা পারত্রিক কোনো বিষয়ে একজাতি হওয়া যে তাদের পক্ষে অসম্ভব, এ কথা পোপও স্বীকার করেন নি, জর্মান-সম্রাটও স্বীকার করেন নি। জর্মানজাতি যে ইউরোপের অন্যান্য জাতি হতে মনে ও চরিত্রে পধক, এ সত্য উপেক্ষা করবার ফলে জর্মানি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল। স্বদেশ এবং জাতির উপর কোনোরূপ একাধিপত্য না থাকলেও জর্মান-সম্রাট তাঁর সম্রাট-পদবী এবং সাম্রাজ্যের আশা ত্যাগ করতে পারলেন না, এবং স্বজাতিকে নিয়ে একটি স্বরাজ্য গঠন করবার চেষ্টামাত্রও করলেন না। এই কারণে জর্মানজাতির পূর্বে কোনোরূপ রাষ্ট্রশক্তি ছিল না। অথচ জর্মানজাতির ভিতর কি দেহের কি বুদ্ধির কি চরিত্রের কোনোরূপ বলের যে অভাব ছিল না—জর্মান কাব্যে দর্শনে শিপে সংগীতে ধর্মে ও কর্মে তার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে জর্মানির মহাপরিষেরা লৌকিকরাজ্যের আশা ত্যাগ করে চিন্তারাজ্য অধিকার করাই নিজেদের কর্তব্য বলে মেনে নিলেন। সম্ভবত জর্মানজাতির ইতিহাস অদ্যাবধি ঐ একই পথ অনুসরণ করে চলত, যদি নেপোলিয়ন জর্মানজাতিকে আকাশ থেকে টেনে মাটিতে ফেলে পদদলিত না করতেন। ১৮০৬ খৃস্টাব্দে জেনার যুদ্ধে পরাজিত এবং লাঞ্ছিত হবার পর জর্মান মাত্রেরই এ জ্ঞান জন্মাল যে, জর্মানির খণ্ডরাজ্য-সকলকে একত্র করে একটি যুক্তরাজ্যে পরিণত না করতে পারলে জর্মানজাতির পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অসংখ্য দার্শনিক বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক অধ্যাপক প্রভৃতি চিরজীবন প্রাণপণে চেষ্টা করেও এ ব্রত উদযাপন করতে পারেন নি; কিন্তু আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বিসমার্ক দুটি যুদ্ধের সাহায্যে জর্মানজাতির প্রাণের আশা ফলে পরিণত করেছিলেন। বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে পরাভূত করে উত্তর-জর্মানির এবং ফ্রান্সকে পরাভূত করে দক্ষিণ-জর্মানির যোগসাধন করেন। বিসমার্ক বলতেন যে, রক্ত ও লৌহের রসান দিয়ে তিনি ভাঙা জর্মানিকে জোড়া দিয়েছেন। সুতরাং যুদ্ধের দ্বারা যে রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, যুদ্ধের দ্বারাই তার রক্ষা এবং সুখের দ্বারাই তার উন্নতি সাধন করতে হবে–এই হচ্ছে নবজর্মানির দৃঢ়ধারণা।
যুদ্ধকার্য অপ্রিয় হলেও আত্মরক্ষার্থ যে তা করা কর্তব্য এ বিষয়ে ইংরেজ ফরাসি প্রভৃতি ইউরোপের অগ্রগণ্য জাতির মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। জর্মানদের সঙ্গে আর-সকলের প্রভেদ এইখানে যে, জর্মানির কর্তৃপক্ষদের মতে জাতীয় উন্নতির পথ পরিষ্কার করবারও একমাত্র উপায় হচ্ছে তরবারি।
জর্মানির যোদ্ধাদলের মুখপাত্র জেনারেল বেয়ারনহার্ডি অতি স্পষ্টাক্ষরে দুনিয়ার লোককে জর্মান রাষ্ট্রনীতির মূলকথা জানিয়ে দিয়েছেন। সে কথা এই—
জর্মানজাতি গত ত্রিশ-চল্লিশ বৎসরের মধ্যে শিল্পবাণিজ্যে যে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে তার থেকেই প্রমাণ হয় যে, কি বাহুবলে, কি বুদ্ধিবলে সে জাতির সমকক্ষ দ্বিতীয় জাতি পৃথিবীতে নেই। জর্মানির শ্রীবৃধি তার বাণিজ্যবিস্তারের উপর নির্ভর করে। যদিচ ভবের হাটে কেনাবেচার জন্য জর্মানজাতিই হচ্ছে জ্যেষ্ঠ অধিকারী তবুও এ ক্ষেত্রে সকলের শেষে উপস্থিত হওয়ার দরুন সে আজ সর্বকনিষ্ঠ, কেননা পৃথিবীর সকল হাটবাজার আজ অপরের সম্পত্তি। পরের হাটে কেনাবেচা করার অর্থ পরভাগ্যোপজীবী হওয়া; সুতরাং এ পৃথিবীতে আত্মপ্রতিষ্ঠা করবার জন্য জর্মানি অপরের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নিতে বাধ্য। যুদ্ধ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ে জর্মানির পক্ষে তার জাতীয় স্বার্থসাধন করা অসম্ভব। অতএব মিলিটারিজম হচ্ছে নবজর্মানির একমাত্র ধর্ম।
জেনারেল বেয়ারনহার্ডি যে স্পষ্টবাদী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দস্যুতাকে ধর্ম বলে প্রচার করতে লোকে সহজেই কুণ্ঠিত হয়। ওরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে হলে অপর দেশের লোকে অনেক বড়ো বড়ো নীতির কথায় তাকে চাপা দেয়।
কিন্তু জর্মান-রাজমন্ত্রী কিংবা জর্মান-রাজসেনাপতির পক্ষে এ বিষয়ে কোনোরূপ কপটতা করবার প্রয়োজন নেই। জর্মানির রাজগুরুপুরোহিতেরা যে নবশাস্ত্র রচনা করেছেন, জর্মানির রাজ-পুরুষদের রাজনীতি সেই শাস্ত্রসংগত।
জর্মান বৈজ্ঞানিকদের মতে ডারউইনের আবিষ্কৃত ইভলিউশনের নির্গলিতার্থ হচ্ছে—জোর যার মুলুক তার। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করলে মানুষে শুধু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। জীবনটা যখন একটা মারামারি-কাটাকাটি ব্যাপার, তখন যে মারতে প্রস্তুত নয় তাকে মরতে প্রস্তুত হতে হবে—এই হচ্ছে বিধির নিয়ম। ইভলিউশনের এই ব্যাখ্যা, নীটশে-নামক একটি প্রতিভাশালী লেখক সমগ্র জর্মানজাতিকে গ্রাহ্য করিয়েছেন। নীটশের মতে দয়া মমতা পরদুঃখকাতরতা প্রতি মনোভাব মানসিক রোগ ব্যতীত আর কিছুই নয়, কেননা এ-সকল মনোভাবের প্রশ্রয় দেওয়াতে মানুষের প্রকৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে; এবং দুর্বলতাই হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র পাপ এবং সবলতাই একমাত্র পণ্য; শক্তিই হচ্ছে একাধারে সত্য শিব ও সুন্দর। ইউরোপীয় মানব যে এই সহজ সত্য ভুলে গেছল তার কারণ ইউরোপ খৃস্টধর্ম নামক রোগে জর্জরিত। খৃস্টধর্ম যে এশিয়ায় জন্মলাভ করেছে তার কারণ, এশিয়াবাসীরা দাসের জাতি, সুতরাং তাদের সকল ধর্মকর্ম দাসমনোভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই এশিয়ার ক্যানসার ইউরোপের দেহ হতে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে অস্ত্রচিকিৎসা ব্যতীত উপায়ান্তর নাই। ইউরোপের নবযুগের সাম্য মৈত্রী প্রভৃতি মনোভাব ঐ প্রাচীন রোগের নূতন উপসর্গ মাত্র। সুতরাং ফরাসি ইংরেজ প্রভৃতি যে-সকল জাতির দেহে এই-সকল রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তাদের উচ্ছেদ করা জর্মান ক্ষত্রিয়দের পক্ষে একান্ত কর্তব্য। নীটশের এই মত জর্মান জাতির মনে যে বসে গেছে, তার কারণ নীটশে কালি-কলমে লেখেন নি, তার প্রতি অক্ষর বাটালি দিয়ে খোদা।
জর্মান-পণ্ডিতদের মত, কেবলমাত্র জাতীয় স্বার্থের জন্য নয়, লোকহিতের জন্যও, জর্মানির পক্ষে দিগ্বিজয় করা আবশ্যক। জেনারেল বেয়ারনহার্ডি বলেন–
জর্মান লেবার এবং জর্মান আইডিয়লিজমের প্রচার ব্যতীত মানবজাতির উদ্ধার হবে না। সুতরাং যেমন তরবারির সাহায্যে পৃথিবীসুদ্ধ লোককে জর্মান মাল গ্রাহ্য করাতে হবে, তেমনি ঐ একই উপায়ে জর্মান-তত্ত্বকথাও গ্রাহ্য করাতে হবে। এই হচ্ছে জর্মানির বিধিনির্দিষ্ট কর্ম।
এ স্থলে জর্মান-আইডিয়ালিজমের অর্থ কাণ্ট প্রভৃতির দর্শন নয়; কেননা, বেয়ারনহার্ডি কাণ্ট প্রমুখ দার্শনিকদের অতি অবজ্ঞার চক্ষে দেখেন। বেয়ারনহার্ডির মতে এই-সকল বাহ্যজ্ঞানশুন্য বিষয়বুদ্ধিহীন দার্শনিকদের অমার্জনীয় অপরাধ এই যে, তারা বিশ্বমানবের কাছে শান্তির বারতা ঘোষণা করেছিলেন। জর্মানি আজ তাই তার নব-আইডিয়ালিজম, প্রচার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। আধ্যাত্মিক জগতের নব্যপীদের সার কথা এই যে, বৈশ্যসভ্যতায় মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে। বৈশ্যযুগে মানুষ আরামপ্রিয় ও ভোগবিলাসী হয়ে পড়ে। মানুষ বিষয়প্রাণ হলে তার মনের শক্তি ও আত্মার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা যে আত্মার অপেক্ষা দেহকে প্রাধান্য দেয় তার বিশিষ্ট প্রমাণ এই যে, মানবজীবনকে যতদূর সম্ভব নিরাপদ করে তোলাই এ সভ্যতার লক্ষ্য। ভয় না থাকলে ভক্তি থাকে না, অথচ বর্তমান সভ্যতা জনসাধারণকে রাজভয় দস্য,ভয় ও মৃত্যুভয় এই ত্রিবিধ ভয় থেকে মুক্ত করেছে। অন্নবস্ত্রের সংস্থান করা অবশ্য জীবনধারণের জন্য আবশ্যক, কিন্তু অর্থকেই জীবনের সার পদার্থ করে তুললে মানুষ অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। সুতরাং মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করবার জন্য সামাজিক জীবন আবার বিপদসংকুল করে তোলা দরকার। এ যুগে এক যুদ্ধ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ে সে উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। অতএব ইউরোপীয় সমাজকে পুনর্বার ক্ষত্রিয় শাসনাধীন করা আবশ্যক; কেননা বৈশ্যবধি যুদ্ধের প্রতিকল। এবং ইউরোপের রাজনীতি ক্ষাত্রধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষমতা একমাত্র জর্মানির আছে; কেননা জর্মানির বৈশ্যশূদ্রের আজও কোনোরূপ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই। সুতরাং অর্ধরাজ্যের উচ্ছেদ করে পৃথিবীতে ধর্মরাজ্যের সংস্থাপন করবার ভার জর্মানির হাতে পড়েছে। এই কারণে যুদ্ধ করা জর্মানির পক্ষে সর্বপ্রথম কর্তব্য। জর্মানির নব-মিলিটারিজমের প্ররোচনাই এই যুদ্ধের সাক্ষাৎকারণ।
এই বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মিলিটারিজম ইউরোপের বর্তমান সভ্যতার অনুবাদ নয়, প্রতিবাদ মাত্র। জর্মানির পরশ্রীকাতরতাই এর যথার্থ মূল, এবং এ মূল জর্মানির প্রাচীন ইতিহাস থেকে রস সঞ্চয় করেছে। জর্মানির বর্তমান উচ্চ আশার ভাষা নতুন হলেও তার ভাব পুরাতন। মধ্যযুগে জর্মানি একবার ইউরোপের সার্বভৌম চক্রবতীত্ব-পদ লাভ করবার চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়েছিল; আশা করি এবারেও হবে। জর্মানজাতির যথেষ্ট বাহুবল বুদ্ধিবল ও চরিত্রবল আছে, কিন্তু বিসমার্কের হাতে-গড়া জর্মান-সাম্রাজ্যের অন্তরে নৈতিক বল নেই; সুতরাং জর্মানির দিগ্বিজয়ের আশা দুরাশা মাত্র। এ যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, ইউরোপের বর্তমান সভ্যতাকে এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে না; কারণ মিলিটারিজম সে সভ্যতার গৃহশত্রু।
ইউরোপের সকল জাতির দেহেই এই মিলিটারিজম অল্পবিস্তর স্থান লাভ করেছে; একমাত্র জর্মানি তা পূর্ণমাত্রায় অঙ্গীকার করেছে। যা অপর সকল জাতির অন্তরে বাষ্পাকারে বিরাজ করছে জর্মানিতে তা জমে বরফ হয়ে গেছে। সুতরাং এই সমরানলে বরফের এই কাঠিন্যের অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে। যদি এই অগ্নিতে মিলিটারিজম ভস্মসাৎ হয় তা হলে যে কেবল অপরজাতি-সকলের মঙ্গল হবে শুধু তাই নয়, জর্মানিও পরিবর্ধিত না হোক, সংশোধিত হবে। যে জাতি মানবাত্মার সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যে দেশে কাণ্ট হেগেল গ্যেটে শিলার বীঠোভেন মোজার্ট জন্মলাভ করেছে, সে জাতির কাছে ইউরোপীয় সভ্যতা চিরঋণী। এই মিলিটারিজমের মোহমুক্ত হলে সে জাতি আবার মানবসভ্যতার প্রবল সহায় হবে।
মিলিটারিজম হেয় বলে বর্তমান বৈশ্যসভ্যতাই যে শ্রেয় এ কথা আমি বলতে পারি নে। কোনো সভ্যতাই নিরাবিল ও নিষ্কলুষ নয়, বৈশ্যসভ্যতাও নয়। তবে কোনো বর্তমান সভ্যতার দোষগুণ বিচার করতে হলে তার অতীতের প্রতি যেরূপ দৃষ্টি রাখা চাই, তার ভবিষ্যতের প্রতিও তদ্রূপ দৃষ্টি রাখা চাই। বর্তমান যে, অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিস্থলমাত্র এ কথা ভোলা উচিত নয়। বর্তমানের যে-সকল দোষ স্পষ্ট লক্ষিত হচ্ছে ভবিষ্যতে তার নিরাকরণ হবার আশা আছে কি না, এ সভ্যতা স্বীয় শক্তিতে স্বীয় রোগমুক্ত হতে পারবে কি না, এই হচ্ছে আসল জিজ্ঞাস্য। আমার বিশ্বাস, বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার সে শক্তি আছে। সে যাই হোক, বৈশ্যসভ্যতার রোগ সারাবার বৈধ উপায় হচ্ছে মন্ত্রৌষধির প্রয়োগ–জর্মানির অস্ত্রচিকিৎসা নয়।