রিহার্সেলে রােজ বালিকা বধূর মতাে সেজে আসবে। এতে সাহায্য হয়। ঘরােয়া ধরনের শাড়ি পরবে, চুলগুলাে খােলা রাখবে। একটু পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফেলবে।
কাঁচের চুড়ি আছে তােমার? হাতে বেশ কিছু কাঁচের চুড়ি পরে নিও। কথা বলার সময় হাত নাড়বে; চুড়ির ঝনঝন শব্দ হবে—এতে খুব সাহায্য হবে।‘
‘জ্বি আচ্ছা।
এখন যাও নাটকটা একটু পড়। ছােট্ট দৃশ্য। দু’তিনবার পড়লেই মনে এসে যাবে। তােমার ভয়টা একটু কমেছে, না ভয় এখনাে আছে?
‘এখনাে আছে।
থাকবে না।
দৃশ্যটা আসলেই ছােট। এই দৃশ্যেও লেখকের স্ত্রী লেখকের সঙ্গে রসিকতা করতে থাকে। লেখক ক্রমেই রেগে যেতে থাকে। এক সময় রাগ অসম্ভব বেড়ে যায়। সে তার স্ত্রীর গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যে লেখক হতভম্ব হয়ে যান।
গভীর বিস্ময় ও গভীর বেদনা নিয়ে লেখকের স্ত্রী লেখকের দিকে তাকান। লেখক এসে জড়িয়ে ধরেন তাঁর স্ত্রীকে। দু‘হাতে স্ত্রীর মুখ তুলে চুমু খান তাঁর ঠোটে। পুস্পের কেমন জানি লাগছে। সত্যি কি চুমু খাবে? সত্যি জড়িয়ে ধরবে? পুষ্পের গা কাঁপছে, খুব অস্থির–অস্থির লাগছে। তার ইচ্ছা করছে সে চেচিয়ে বলে—আমি এই দৃশ্য করব আবার করতেও ইচ্ছা করছে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
স্বামীর প্রতি তার খুব রাগ লাগছে, আবার খুব মমতাও লাগছে। এ রকম এক জন লেখক স্বামী যদি তার হত তাহলে বেশ হত। তার ভাগ্যে কি আর এ রকম কেউ আসবে? হয়ত এলেবেলে ধরনের কারাে সঙ্গে বিয়ে হবে। রাত জেগে গল্প করার বদলে সে হয়ত ভোঁস–ভোঁস করে ঘুমুবে। ঘুমের ঘােরে
ভারী একটা পা তুলে দেবে তার গায়ে।
আসিফ মঞ্চে এসে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, ‘এস শুরু করা যাক।বলেই সে বদলে গেল। পুষ্প মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল এই লােকটা নিমিষের মধ্যে কি করে যেন বদলে গিয়ে লেখক হয়ে গেল। লেখক এবং তার স্বামী। খুবই নিকটের কেউ।
লেখক। অসাধারণ একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে জরী। অসাধারণ উপন্যাসের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এটা শুরু হবে। একটা শহর। মনে করা যাক—এই ঢাকা শহর। এর উপর ঝড় আসছে, প্রাবন আসছে, মহামারী আসছে। শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। কেমন হবে বল তাে?
জরী : খুব ভালাে হবে। লেখক : একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রথমে ঝড়, ভারপর বন্যা,
তারপর..
জরী : একটা ভূমিকম্প দিয়ে দাও। লেখক : রাইট, ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
জরী : বিরাট একটা ভূমিকম্প হােক। সেই ভূমিকম্পে পুরাে ঢাকা শহর তলিয়ে যাক।
লেখক : ঠাট্টা করছ?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
জরী : না, ঠাট্টা করছি না। একদিন দেখা যাবে যেখানে ঢাকা শহর ছিল, সেখানে বিরাট একটা হ্রদ।
লেখক : কী বলছ তুমি!
জরী : আমরা সেই হ্রদের পাশে ছােট্ট একটা কুঁড়ে ঘর বানাব। আমাদের একটা নৌকা থাকবে। নৌকায় করে আমরা হ্রদে ঘুরব।
লেখক প্রচণ্ড রাগে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। পরমুহূর্তেই স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলছেন।
লেখক : প্লিজ, জরী প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ভুল করে ফেলেছি।
অভিনয় শেষ হয়েছে। আসিফ এখনাে পুম্পকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হাতের বাঁধন এতটুকুও আলগা না করে সে বলল, ‘মজনু গ্লাসে করে পানি আন তাে, মেয়েটা ফেইন্ট হয়ে গেছে।‘
আসিফ খুব সাবধানে পুষ্পকে টেবিলে শুইয়ে দিয়ে সহজ গলায় বলল, ‘বজল ভাই, খুব বড় মাপের এক জন অভিনেত্রী পেয়ে গেলেন। আপনার উচিত আমাকে মিষ্টি খাওয়ানাে।
বজলু ভাই মানিব্যাগ বের করে সত্যি–সত্যি এক শ’ টাকার একটা নােট বের করলেন মিষ্টির জন্যে।
পুষ্প টেবিলে উঠে বসে ঘাের লাগা চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে। আসিফের দিকে চোখ পড়তেই আসিফ বলল, তুমি যে কত ভালাে করেছ তুমি নিজেও জান না।
পুষ্প কিছু বুঝতে পারছে না। সব কিছু তার কেমন জানি এলােমেলাে হয়ে গেছে। এই জায়গাটা কী? তাদের বাসা? নাকি অন্য কোনাে জায়গা?
সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ
হাশমত আলি বিকেলে বাজার করে ফিরেছে। সস্তায় পেয়েছে দুটো বিশাল সাইজের ইলিশ। বৈশাখ মাসের শুরু ইলিশ মাছে স্বাদ এসে গেছে। এই সময়ে এত সস্তায় ইলিশ পাওয়ার কথা না। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে।
বারান্দায় মাছ কাটা হচ্ছে। বুটিটা বেশ ধারাল—কচকচ করে কেটে যাচ্ছে। দেখতে ভালাে লাগছে। খুকিকে কোলে নিয়ে হাশমত আলি মুগ্ধ চোখে মাছ কোটা দেখছে। তার জীবনের এটা একটা আনন্দঘন মুহূর্ত।
লীনা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাশমত বলল, ‘ভাবি মাছ দেখলেন? পেটটা কেমন গােল। এর স্বাদই অন্যরকম। রাতে আমাদের সঙ্গে খাবেন ভাবি, মনে থাকে যেন।
লীলা বলল, আমি তাে খেতে পারব না। আপনার ভাইকে খাইয়ে দেবেন। আমি একটু মার বাসায় যাচ্ছি।
‘তাহলে এনি–এমি এক টুকরা মাছ খান। বেনু ভেজে দেবে।
না ভাই থাক। ‘এক মিনিট লাগবে। ইলিশ মাছ ভাজা হতে এক মিনিটের বেশি লাগে না। ‘আমার ইচ্ছা করছে না। শরীরটা ভালাে না। ফ্রিজে থাকুক। একসময় খাব।‘. *ফ্রেস জিনিস তাে আর পাচ্ছেন না ভাবি। | ‘ফ্রেস জিনিস তাে সব সময়ই আপনার কাছ থেকে পাচ্ছি, তাই না? হাশমত সাহেব।‘
‘জ্বি ভাবি।
সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ
আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল—আপনি কি একটু বসার ঘরে আসবেন? বেনুর সামনে বলতে কেমন জানি সংকোচ বােধ করছি।
বেনু বিস্মিত হয়ে তাকাল। হাশমত আলি নিঃশব্দে উঠে এল বসার ঘরে। অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার ভাবি?
‘এ মাসের বাড়ি ভাড়াটা কি আপনি দিয়ে দেবেন? একটু সমস্যা হচ্ছে। আমি দিন দশেকের মধ্যে
এটা কোনাে ব্যাপারই না ভাবি। এটা নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না। এই মাস কেন? দরকার হলে ছ’ মাসের ভাড়া দিয়ে রাখব। আপনি আমাকে ভাবেন কী?
লীনা খুব কৃতজ্ঞ বােধ করছে। হাশমত আলিকে এই কথাটা কী করে বলবে এটা ভাবতে তার মাথা ধরে গিয়েছিল। এখন মাথা ধরাটা নিমিষের মধ্যে চলে গেছে।
হাশমত আলি বলল, কথাটা বেনুর সামনে না বলে ভালাে করেছেন। টাকা–পয়সার কোনাে কথায় মেয়েছেলে থাকা উচিত না।
লীনা হেসে বলল, আমি নিজেও তাে মেয়েছেলে।
‘কী যে বলেন ভাবি, কোথায় আপনি আর কোথায় বেনু। আকাশ আর পাতাল ফারাক।
লীনা বলল, আপনার ভাই এলে বলবেন আমি মার কাছে গিয়েছি। রাতেই ফিরব। সে যেন খেয়ে নেয়।
সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ
‘জি আচ্ছা বলব। আপনি একটা ছাতা নিয়ে যান ভাবি। দিনের অবস্থা ভালাে না। ঝড়–বৃষ্টি হতে পারে।
‘ছাতা লাগবে না।”
‘লাগবে না বলছেন কি? অবশ্যই লাগবে। লেডিস ছাতা ঘরে আছে। ব্রান্ড নিউ। জাপানি।’
হাশমত নিজেই লেডিস ছাতা বের করে আনল।
লীনার বাবা ওয়াদুদুর রহমান সাহেব চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর বাড়ি তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। ঝিকাতলায় তাঁর জমি কেনা ছিল। রিটায়ার করবার সঙ্গে সঙ্গে যুবকের উৎসাহে ঝাপিয়ে পড়লেন। তাঁর সার্বক্ষণিক ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে বাড়ি।
চমৎকার দখিনদুয়ারি বাড়ি। ইস্টার্ন রীতি অনুযায়ী বিরাট বারান্দা থাকবে, আবার ওয়েস্টার্ন ধরনে প্রতিটি ঘরে থাকবে বিল্ট ইন কাবার্ড। লােকজন বাথরুম বানানােয় কিপটেমি করে, তিনি করবেন না। বাথরুমে ঢুকেই যেন খােলামেলা ভাব হয়। প্রতিটি বাথরুমে থাকবে ঝকঝকে বাথটাব। দরজা–জানালা হবে সিজন করা বার্মা টিকের। আজকাল কী সব কাঠ দিয়ে দরজা–জানালা করে, গরম কালে। ক্যাচক্যাচ শব্দ হয়।
সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব প্রতিটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনলেন। মিস্তিরিরা সিমেন্ট বালি মিশিয়ে মশলা তৈরি করে, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। ইট বিছিয়ে দেয়াল তৈরি হয় তিনি গভীর আগ্রহে দেখেন, মাঝে–মাঝে নির্দেশ দেন—ঐ ইটটা বদলে দাও বসির মিয়া। ইটটা বাঁকা।
বসির মিয়া বদলাতে চায় না। তিনি বড়ই বিরক্ত হন।
‘আহা বদলাতে বললাম না? ইটের কি অভাব হয়েছে যে একটা ক্রিপলড ইট দিতে হবে। চেঞ্জ ইট।
রিটায়ার করার পরও হয়ত ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের কুড়ি বছরের মতাে আয়ু ছিল, সেই আয়ু বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে তিনি খরচ করে ফেললেন। ছাদ ঢালাইয়ের পর দিন স্ট্রোকে মারা গেলেন।
কারাে জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। যথাসময় বাড়ি শেষ হল। দোতলা করা গেল । একতলা বানাতেই সঞ্চিত প্রতিটি পয়সা শেষ হয়ে গেল। লীনার মা সুলতানা বেগম একতলা বাড়ির দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। বাকিটা ভাড়া দিয়েছেন তাঁর ডাক্তার জামাইকে।
এই ডাক্তার জামাই বাড়িটাকে মােটামুটি একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে। রােজ বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এখানে রুগী দেখা হয়। ভদ্রলােকের ভালাে পসার হয়েছে। রুগীতে সারাক্ষণ বাড়ি ভর্তি থাকে। সুলতানার গা শিরশির করে, কিন্তু জামাইকে কিছু বলতে পারেন না।
(চলবে)