সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ

রিহার্সেলে রােজ বালিকা বধূর মতাে সেজে আসবেএতে সাহায্য হয়ঘরােয়া ধরনের শাড়ি পরবে, চুলগুলাে খােলা রাখবেএকটু পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফেলবে

সাজঘরকাঁচের চুড়ি আছে তােমার? হাতে বেশ কিছু কাঁচের চুড়ি পরে নিওকথা বলার সময় হাত নাড়বে; চুড়ির ঝনঝন শব্দ হবেএতে খুব সাহায্য হবে‘ 

জ্বি আচ্ছা। 

এখন যাও নাটকটা একটু পড়ছােট্ট দৃশ্যদুতিনবার পড়লেই মনে এসে যাবেতােমার ভয়টা একটু কমেছে, না ভয় এখনাে আছে

এখনাে আছে। 

থাকবে না। 

দৃশ্যটা আসলেই ছােটএই দৃশ্যেও লেখকের স্ত্রী লেখকের সঙ্গে রসিকতা করতে থাকেলেখক ক্রমেই রেগে যেতে থাকেএক সময় রাগ অসম্ভব বেড়ে যায়সে তার স্ত্রীর গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যে লেখক হতভম্ব হয়ে যান

গভীর বিস্ময় গভীর বেদনা নিয়ে লেখকের স্ত্রী লেখকের দিকে তাকানলেখক এসে জড়িয়ে ধরেন তাঁর স্ত্রীকেদুহাতে স্ত্রীর মুখ তুলে চুমু খান তাঁর ঠোটেপুস্পের কেমন জানি লাগছেসত্যি কি চুমু খাবে? সত্যি জড়িয়ে ধরবে? পুষ্পের গা কাঁপছে, খুব অস্থিরঅস্থির লাগছেতার ইচ্ছা করছে সে চেচিয়ে বলেআমি এই দৃশ্য করব আবার করতেও ইচ্ছা করছে

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

স্বামীর প্রতি তার খুব রাগ লাগছে, আবার খুব মমতাও লাগছেরকম এক জন লেখক স্বামী যদি তার হত তাহলে বেশ হততার ভাগ্যে কি আর রকম কেউ আসবে? হয়ত এলেবেলে ধরনের কারাে সঙ্গে বিয়ে হবেরাত জেগে গল্প করার বদলে সে হয়ত ভোঁসভোঁস করে ঘুমুবেঘুমের ঘােরে 

ভারী একটা পা তুলে দেবে তার গায়ে। 

আসিফ মঞ্চে এসে দাঁড়ালসহজ স্বরে বলল, এস শুরু করা যাকবলেই সে বদলে গেলপুষ্প মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল এই লােকটা নিমিষের মধ্যে কি করে যেন বদলে গিয়ে লেখক হয়ে গেললেখক এবং তার স্বামীখুবই নিকটের কেউ। 

লেখকঅসাধারণ একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে জরীঅসাধারণ উপন্যাসের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এটা শুরু হবেএকটা শহরমনে করা যাকএই ঢাকা শহর। এর উপর ঝড় আসছে, প্রাবন আসছে, মহামারী আসছেশুধু মৃত্যু আর মৃত্যুকেমন হবে বল তাে

জরী : খুব ভালাে হবেলেখক : একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রথমে ঝড়, ভারপর বন্যা

তারপর.

জরী : একটা ভূমিকম্প দিয়ে দাওলেখক : রাইট, ভূমিকম্পভূমিকম্পের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। 

জরী : বিরাট একটা ভূমিকম্প হােকসেই ভূমিকম্পে পুরাে ঢাকা শহর তলিয়ে যাক। 

লেখক : ঠাট্টা করছ

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

জরী : না, ঠাট্টা করছি নাএকদিন দেখা যাবে যেখানে ঢাকা শহর ছিল, সেখানে বিরাট একটা হ্রদ। 

লেখক : কী বলছ তুমি

জরী : আমরা সেই হ্রদের পাশে ছােট্ট একটা কুঁড়ে ঘর বানাবআমাদের একটা নৌকা থাকবেনৌকায় করে আমরা হ্রদে ঘুরব। 

লেখক প্রচণ্ড রাগে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিলেনপরমুহূর্তেই স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলছেন। 

লেখক : প্লিজ, জরী প্লিজআমার ভুল হয়ে গেছেআমি ভুল করে ফেলেছি। 

অভিনয় শেষ হয়েছেআসিফ এখনাে পুম্পকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেহাতের বাঁধন এতটুকুও আলগা না করে সে বলল, মজনু গ্লাসে করে পানি আন তাে, মেয়েটা ফেইন্ট হয়ে গেছে‘ 

আসিফ খুব সাবধানে পুষ্পকে টেবিলে শুইয়ে দিয়ে সহজ গলায় বলল, বজল ভাই, খুব বড় মাপের এক জন অভিনেত্রী পেয়ে গেলেনআপনার উচিত আমাকে মিষ্টি খাওয়ানাে। 

বজলু ভাই মানিব্যাগ বের করে সত্যিসত্যি এক ’ টাকার একটা নােট বের করলেন মিষ্টির জন্যে। 

পুষ্প টেবিলে উঠে বসে ঘাের লাগা চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেআসিফের দিকে চোখ পড়তেই আসিফ বলল, তুমি যে কত ভালাে করেছ তুমি নিজেও জান না। 

পুষ্প কিছু বুঝতে পারছে নাসব কিছু তার কেমন জানি এলােমেলাে হয়ে গেছেএই জায়গাটা কী? তাদের বাসা? নাকি অন্য কোনাে জায়গা

সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ

হাশমত আলি বিকেলে বাজার করে ফিরেছেসস্তায় পেয়েছে দুটো বিশাল সাইজের ইলিশবৈশাখ মাসের শুরু ইলিশ মাছে স্বাদ এসে গেছেএই সময়ে এত সস্তায় ইলিশ পাওয়ার কথা নাভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে। 

বারান্দায় মাছ কাটা হচ্ছেবুটিটা বেশ ধারালকচকচ করে কেটে যাচ্ছেদেখতে ভালাে লাগছেখুকিকে কোলে নিয়ে হাশমত আলি মুগ্ধ চোখে মাছ কোটা দেখছেতার জীবনের এটা একটা আনন্দঘন মুহূর্ত। 

লীনা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালহাশমত বলল, ভাবি মাছ দেখলেন? পেটটা কেমন গােলএর স্বাদই অন্যরকমরাতে আমাদের সঙ্গে খাবেন ভাবি, মনে থাকে যেন। 

লীলা বলল, আমি তাে খেতে পারব নাআপনার ভাইকে খাইয়ে দেবেনআমি একটু মার বাসায় যাচ্ছি। 

তাহলে এনিএমি এক টুকরা মাছ খানবেনু ভেজে দেবে। 

না ভাই থাকএক মিনিট লাগবেইলিশ মাছ ভাজা হতে এক মিনিটের বেশি লাগে নাআমার ইচ্ছা করছে নাশরীরটা ভালাে নাফ্রিজে থাকুকএকসময় খাব. *ফ্রেস জিনিস তাে আর পাচ্ছেন না ভাবি| ফ্রেস জিনিস তাে সব সময়ই আপনার কাছ থেকে পাচ্ছি, তাই না? হাশমত সাহেব‘ 

জ্বি ভাবি। 

সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ

আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিলআপনি কি একটু বসার ঘরে আসবেন? বেনুর সামনে বলতে কেমন জানি সংকোচ বােধ করছি। 

বেনু বিস্মিত হয়ে তাকালহাশমত আলি নিঃশব্দে উঠে এল বসার ঘরেঅবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার ভাবি

মাসের বাড়ি ভাড়াটা কি আপনি দিয়ে দেবেন? একটু সমস্যা হচ্ছেআমি দিন দশেকের মধ্যে 

এটা কোনাে ব্যাপারই না ভাবিএটা নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন নাএই মাস কেন? দরকার লে মাসের ভাড়া দিয়ে রাখবআপনি আমাকে ভাবেন কী

লীনা খুব কৃতজ্ঞ বােধ করছেহাশমত আলিকে এই কথাটা কী করে বলবে এটা ভাবতে তার মাথা ধরে গিয়েছিলএখন মাথা ধরাটা নিমিষের মধ্যে চলে গেছে। 

হাশমত আলি বলল, কথাটা বেনুর সামনে না বলে ভালাে করেছেনটাকাপয়সার কোনাে কথায় মেয়েছেলে থাকা উচিত না। 

লীনা হেসে বলল, আমি নিজেও তাে মেয়েছেলে। 

কী যে বলেন ভাবি, কোথায় আপনি আর কোথায় বেনুআকাশ আর পাতাল ফারাক। 

লীনা বলল, আপনার ভাই এলে বলবেন আমি মার কাছে গিয়েছিরাতেই ফিরব। সে যেন খেয়ে নেয়। 

সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ

‘জি আচ্ছা বলবআপনি একটা ছাতা নিয়ে যান ভাবিদিনের অবস্থা ভালাে নাঝড়বৃষ্টি হতে পারে। 

ছাতা লাগবে না” 

লাগবে না বলছেন কি? অবশ্যই লাগবে। লেডিস ছাতা ঘরে আছেব্রান্ড নিউজাপানি।’ 

হাশমত নিজেই লেডিস ছাতা বের করে আনল। 

লীনার বাবা ওয়াদুদুর রহমান সাহেব চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর বাড়ি তৈরিতে হাত দিয়েছিলেনঝিকাতলায় তাঁর জমি কেনা ছিলরিটায়ার করবার সঙ্গে সঙ্গে যুবকের উৎসাহে ঝাপিয়ে পড়লেনতাঁর সার্বক্ষণিক ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে বাড়ি

চমৎকার দখিনদুয়ারি বাড়িইস্টার্ন রীতি অনুযায়ী বিরাট বারান্দা থাকবে, আবার ওয়েস্টার্ন ধরনে প্রতিটি ঘরে থাকবে বিল্ট ইন কাবার্ডলােকজন বাথরুম বানানােয় কিপটেমি করে, তিনি করবেন নাবাথরুমে ঢুকেই যেন খােলামেলা ভাব হয়প্রতিটি বাথরুমে থাকবে ঝকঝকে বাথটাবদরজাজানালা হবে সিজন করা বার্মা টিকেরআজকাল কী সব কাঠ দিয়ে দরজাজানালা করে, গরম কালেক্যাচক্যাচ শব্দ হয়। 

সাজঘর (পর্ব-১১): হুমায়ূন আহমেদ

ওয়াদুদুর রহমান সাহেব প্রতিটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনলেনমিস্তিরিরা সিমেন্ট বালি মিশিয়ে মশলা তৈরি করে, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকেনইট বিছিয়ে দেয়াল তৈরি হয় তিনি গভীর আগ্রহে দেখেন, মাঝেমাঝে নির্দেশ দেন—ঐ ইটটা বদলে দাও বসির মিয়াইটটা বাঁকা। 

বসির মিয়া বদলাতে চায় নাতিনি বড়ই বিরক্ত হন। 

আহা বদলাতে বললাম না? ইটের কি অভাব হয়েছে যে একটা ক্রিপলড ইট দিতে হবেচেঞ্জ ইট

রিটায়ার করার পরও হয়ত ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের কুড়ি বছরের মতাে আয়ু ছিল, সেই আয়ু বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে তিনি খরচ করে ফেললেনছাদ ঢালাইয়ের পর দিন স্ট্রোকে মারা গেলেন। 

কারাে জন্যেই কিছু থেমে থাকে নাযথাসময় বাড়ি শেষ হল। দোতলা করা গেল একতলা বানাতেই সঞ্চিত প্রতিটি পয়সা শেষ হয়ে গেললীনার মা সুলতানা বেগম একতলা বাড়ির দুটো ঘর নিয়ে থাকেনবাকিটা ভাড়া দিয়েছেন তাঁর ডাক্তার জামাইকে।

এই ডাক্তার জামাই বাড়িটাকে মােটামুটি একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে। রােজ বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এখানে রুগী দেখা হয়ভদ্রলােকের ভালাে পসার হয়েছেরুগীতে সারাক্ষণ বাড়ি ভর্তি থাকে। সুলতানার গা শিরশির করে, কিন্তু জামাইকে কিছু বলতে পারেন না

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-১০): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *