লীনা বলল, ‘আপনি ঠিকই বুঝেছেন। ‘কর্তাকে ছাড়া যেতে মন চাচ্ছে না?
লীনা চুপ করে রইল। জামান সাহেব বললেন, ‘লীনা তােমাকে আমি খােলাখুলি কিছু কথা বলি। কিছু কিছু কথা সরাসরি হওয়াই ভালাে। দেখ লীনা, তােমাদের আর্থিক অবস্থার কথা আমি ভালােভাবেই জানি। সেটা জেনে তােমার কর্তার জন্যে একটা টিকিট আমার কেনা উচিত। কিনতেও আমার কোনাে অসুবিধা নেই। কিন্তু মুশকিল কি জান? তােমাদের আত্মসম্মান বোধ অনেক বেশি। তােমরা আহত বােধ করবে।ভালাে করতে গিয়ে মন্দ করা হবে। আমি সত্যি চাই তুমি যাও আমাদের সঙ্গে। তােমার শরীর খারাপ। বেশ খারাপ। বাইরে একটু ঘুরে টুরে এলে ভালাে লাগবে।‘
লীনা কিছুই বলল না।
জামান সাহেব বললেন, ‘আসিফকে নিয়ে গেলে আরেকটা বাস্তব সমস্যা আছে, সেটাও তােমাকে খােলাখুলি বলি। তােমার মা, আই মিন আমার শাশুড়ি আসিফকে তেমন পছন্দ করেন না। এগার দিন একসঙ্গে থাকতে হবে। এর মধ্যে তিনি অনেকবার আসিফকে নিয়ে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলবেন। তােমার খুব খারাপ লাগবে।‘
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বলল, আপনিই বা হঠাৎ দল বেঁধে বাইরে যাবার ব্যাপারে এত উৎসাহী হলেন কেন?
‘খুব ক্লান্ত লাগছে। টাকা বানানাের একটা মেশিন হয়ে পড়েছি। সারাদিন হাসপাতালে থাকি। বাসায় ফিরে বিশ্রামের বদলে রাত দশটা এগারটা পর্যন্ত রুগী দেখি। জীবনটা মানুষের রােগ–শােকের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। মুক্তি চাচ্ছি। কিছু সময়ের জন্যে হলেও মুক্তি। মাঝে–মাঝে তােমাদেরকে আমার বেশ হিংসাই হয়। মনে হয় বেশ সুখেই তাে তােমরা আছ।‘
‘আপনি কি অসুখে আছেন?
‘হ্যা অসুখেই আছি। উত্তরায় বাড়ি করছি। কত রকম প্ল্যানিং; কত পরিকল্পনা। ফলের গাছ কী কী থাকবে, ফুলের গাছ কী কী থাকবে। অথচ আমি নিজে ডাক্তার, আমি খুব ভালাে করে জানি আমরা যে বেঁচে আছি এইটাই পরম আশ্চর্যের ব্যাপার। দীর্ঘ পরিকল্পনা অর্থহীন।
‘ফিলসফার হয়ে যাচ্ছেন দুলাভাই। এটা তাে ভালাে লক্ষণ না।”
ফিলসফার হতে পারলে তাে কাজই হত। হাইলি মেটেরিয়েলিস্টিক মানুষ হয়ে জন্মেছি। এ ভাবেই মরব। আমার মতাে সাকসেসফুল ডাক্তারদের এটাই হচ্ছে ডেসটিনি।‘
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
অনেক রাতে আসিফের ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার, বাইরে ঝুপঝুপ করে। বৃষ্টি পড়ছে। খােলা জানালায় বৃষ্টির ছাঁট আসছে। হাওয়ায় মশারি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আসিফ বিছানায় উঠে বসল। লীনা পাশে নেই। এটা নতুন কিছু না, প্রায় রাতেই ঘুম ভাঙলে লীনাকে পাশে দেখা যায় না। সে একাকী বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে। বাড়ির সামনের ঝাঁকড়া কাঁঠাল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজও নিশ্চয়ই তাই
আছে।
আসিফ বাতি জ্বালল না। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। লীনা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। যেন সে জানত এই মুহূর্তে আসিফ এসে তার পাশে বসবে।
কী করছ লীনা? ‘কিছু না। বৃষ্টি দেখছি। ‘ঘুম আসছে না?
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
‘ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?
দেখাব। বস আমার পাশে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে খানিকক্ষণ গল্প করি।‘ আসিফ বসতে বসতে মৃদু স্বরে বলল, একা একা বসে তুমি কী ভাব বল তাে? ‘সাধারণত কিছু ভাবি না, আজ অবশ্যি ভাবছিলাম—কাশ্মীর জায়গাটা দেখতে
কেমন হবে। নিশ্চয়ই খুব সুন্দর, তাই না?
‘সুন্দর তাে বটেই। ‘সব সুন্দর–সুন্দর জায়গাগুলাে ইন্ডিয়াতে পড়ে গেল। রাগ লাগে না তােমার? ‘লাগে।
কাশ্মীর জায়গাটা কেমন হবে ভাবতে ভাবতে কী ঠিক করলাম জান? ঠিক করলাম আমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে ঘুরেই আসব।‘
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
‘খুব ভালাে, যাও ঘুরে আস। তােমার কাছে যদি ভালাে লাগে তাহলে পরে আমরা দু’জন আবার যাব। হাউস বােট ভাড়া করে থাকব।
কাশ্মীর দেখার জন্যে আমি যাচ্ছি না কিন্তু। আমি যাচ্ছি অন্য কারণে। ‘অন্য কারণটা কি?”
‘আমি আজমীর যাব। আজমীর শরীফে গিয়ে যা চাওয়া যায় তাই না কি পাওয়া যায়। আমি ঐ জনােই যাব। যেন আমাদের এই বারের বাচ্চাটা বেঁচে থাকে।
ওর বয়স কত হল লীনা? ‘তিন মাস। তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি কিন্তু ওর হার্টবিট বুঝতে পারি।‘ ‘সত্যি । ‘হা সত্যি। তবে সব সময় না। গভীর রাতে যখন একা একা বসে থাকি তখন।
এই জন্যেই কি তুমি রাত জাগ?
আসিফ সিগারেট ধরাল। তার পাশে বসে থাকা এই মেয়েটি তার কত দিনের চেনা, অথচ গভীর রাতে সে যখন একা একা বসে থাকে তখন কেমন অচেনা হয়ে যায়।
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বলল, অনেকদিন তােমাদের রিহার্সেলে যাই না। রিহার্সেল কেমন হচ্ছে? ‘বেশি ভালাে হচ্ছে না। শাে পিছিয়ে দিয়েছে, সব কেমন টিলাঢালা হয়ে গেছে।
পল মেয়েটা কেমন করছে? ‘ভালাে করছে। ‘আমার চেয়েও ভালাে? ‘হ্যা তােমার চেয়েও ভালাে।
‘আমাকে যেমন অভিনয়ের আগে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলে, ওকেও কি দিয়েছিলে?
‘আচ্ছা ষষ্ঠ দৃশ্যে তুমি যখন পুম্পকে জড়িয়ে ধর, তখন তােমার কেমন লাগে? আসিফ অবাক হয়ে বলল, ‘এই প্রশ্ন করছ কেন?
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
এমি করছি, কিছু মনে করাে না। বৃষ্টির বেগ আরাে বাড়ছে। ঝড়ের মতাে হচ্ছে।
জামগাছের পাতায় শোঁ–শোঁ শব্দ। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছে। সমস্ত শহর অন্ধকারে ডুবে গেছে। আসিফ বলল, ‘চল শুয়ে পড়ি। লীনা বিনাবাক্যব্যয়ে উঠে এল। দুজনের কেউই বাকি রাত ঘুমুতে পারল না। আসিফ জেগে জেগে শুনল বৃষ্টির শব্দ, লীনা শুনতে চেষ্টা করল অনাগত শিশুটির হৃৎপিণ্ডের শব্দ।