সাজঘর (পর্ব-১৪): হুমায়ূন আহমেদ

হাঞ্চ ব্যাক অব মীরপুর পিঠ সােজা করে মতিঝিলের ট্রাভেল এজেন্সি সুরমা ট্রাভেলসঢুকলেনতাঁর সঙ্গে আসিফবিশাল অফিসদুজন স্টেনো বা রিসিপশনিস্ট ধরনের মেয়ে বসাএক জনের দিকে তাকান যায় নাসাজঘর

মৈনাক পর্বততবে অন্যজন রূপবতীমৈনাক পর্বত মধুর গলায় বলল, আপনাদের জন্যে কী করতে পারি?” 

বজলু সাহেব বললেন, কেরামত আছে? জি আছেনএখন একটু ব্যস্তআমিও ব্যস্তআপনি দয়া করে বলুন, ভৈরবের বজলু| মৈনাক পর্বত বিরক্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেলবজলু আসিফকে নিচু গলায় বললেন, তুমি এখানেই বসে থাকআমি একা যাইদরকার হলে তােমাকে ডাকব‘ 

আসিফ বলল, দরকার হবে বলে মনে করছেন

অবশই হবেকেরামত আমার কথা ফেলবে নাওর সেই ক্ষমন্তাও নেইএস এম হলে লিটারেলি আমিই ওকে পেলেছি‘ 

পুরানাে কথা কেউ মনে রাখে না বজলু ভাইদেখা যাকআগেই ডিসহার্টেড হচ্ছ কেন

বজলু এসেছেন আসিফের চাকরির ব্যাপারেএসেছেন খুবই উৎসাহ নিয়েতাঁর ধারণা এই মুহূর্তেই একটা কিছু হবেআসতে আসতে বলেছিলেন, তােমার চাকরি কোনাে ব্যাপারই নাযে কোনাে অফিসের এক জন বসকে ধরে এনে নাটক একটা দেখিয়ে দিলেই ব্যাটেল ইজ ওন। 

আসিফ কোনাে প্রতিবাদ করে নিযদিও বলতে চেয়েছিল নাটকের ক্ষেত্রে এটা কখনাে হয় নাখেলােয়াড়দের ব্যাপারে হয়ভালাে ফুটবল প্লেয়ার, ক্রিকেট প্লেয়ারদের ডেকে ডেকে চাকরি দেয়এরা অফিসের শােভা। কিন্তু নাটক করা লােককে কে রাখবে

মৈনাক পর্বত বজলু সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলআসিফ বসে রইলসুন্দরী মেয়েটি বলল, আপনি চা খাবেন

জ্বি খাব| মেয়েটি কেমন যেন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেকোনাে একটা নাটক কি সে দেখেছে? অসম্ভব কিছু তাে নয়দেখতেও তাে পারেসুন্দরী মেয়েটি নিজেই চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে এলমিষ্টি গলায় বলল, আপনি কি মাধবীর ভাই

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

জ্বি না| মেয়েটির সব আগ্রহ শেষসে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ল টেলিফোন নিয়েসম্ভবত চা এনে দেয়ায় নিজের উপরই সে এখন রাগ করছে। 

কেরামত যতটা আন্তরিকতা দেখাবে বলে বজলু ভেবেছিলেন, সে তার চেয়েও বেশি দেখালজড়িয়ে ধরে নাচানাচি করল খানিকক্ষণগদগদ গলায় বলল, স্লৈবের বজলু যে তুমি তা বুঝতে পারি নি দোস্তবিশ্বাস করা এই টাকা ছুঁয়ে বলছিব্যবসায়ী কখনাে টাকা দুয়ে মিথ্যা কথা বলে না। 

ব্যবসা কেমন চলছে? টুকটাকফাজিলের দেশফাজিলের দেশে ব্যবসা করে সুখ নেইতুই তাে মনে হচ্ছে সুখে আছিসটাকা আছেমনে শান্তি নাইরে দোস্তকী জনাে এসেছিস বলচাকরি দিতে হবে একটাএটা ছাড়া আর কিছু বলার থাকলে বলআর কিছু বলার নেই

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

কেরামত গম্ভীর হয়ে গেল! বজলু সিগারেট ধরালেনএই ঘরের এয়ার কন্ডিশনার অনেক নিচে সেট করাবেশ ঠাণ্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে ফ্রিজের ভেতর তিনি বসে আছেনকেরামত বলল, চাকরি কার

আমার গ্রুপের এক জনতাের আবার কিসের গ্রুপনাটকেন্দ্র গ্রুপ। 

আচ্ছা, এখনাে নাটক নিয়ে আছিস? ভালােশিল্পসাহিত্যের কোনাে খবর রাখি নাআমার বউ বলছিল মহিলা সমিতিতে ভাললভালাে নাটক হয়সে একদিন দেখে আসলকমেডি ধরনের কিছু হবেরাতে ঘুমুতে গিয়েও একটু পরপর হেসে ওঠে‘ 

বজলু বললেন, আসল কথা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিতাের ক্যান্ডিডেটের যােগ্যতা কি? মানে নাটক ছাড়া আর কী জানে

বি, পাশগ্রুতে ব্যাংকে চাকরি করত, তারপর ইস্টার্ন ট্রান্সপাের্টে কিছুদিন ছিলজীবন বীমাতে কিছুদিন কাজ করেছে‘ 

অচল মাল গছাতে চাচ্ছিস

সাজঘর: হুমায়ূন আহমেদ

বজলু সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আসিফের মতাে ছেলেকে চাকরির জন্যে মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতে হচ্ছে এইটাই হচ্ছে আফসােসের ব্যাপারবিলেত আমেরিকা হলে এই ছেলে টাকার উপর শুয়ে থাকত। 

কেরামত বলল, কষ্ট করে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে এই ছেলেকে বিলেত আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেই হয়। 

বজলু গম্ভীর হয়ে গেলেন। 

কেরামত বলল, ঠাট্টা করলাম রে দোস্ততােকে সত্যি কথা বলি বিজনেসের অবস্থা খুবই টাইতবু তুই এসেছিস সেই খাতিরে আমি যা করতে পারি সেটা হচ্ছে টাইপিস্টের একটা চাকরি দিতে পারিতবে টাইপ জানতে হবে। 

বজলু উঠে দাঁড়ালেনতাঁর কথা বলতে ইচ্ছা করছে নাতবু বললেন, তাের এখানে হবে না বুঝলামউঠি। 

কেরামত বলল, রাগ করে উঠে যাচ্ছিস তা বুঝতে পারছিউপায় নেই দোস্তআমার জায়গায় তুই থাকলে তুইও ঠিক এই কথাই বলতিপুরনাে দিনের খাতিরে এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাআমি মানুষটা খারাপ হতে পারি আমার অফিসের চা কিন্তু ভালাে

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

বজলু চা খেলেন নাঅফিস থেকে বের হবা মাত্র তাঁর পিঠ আবার কুঁজো হয়ে 

গেলতবে বেশ শক্ত গলায় বললেন, তুমি কোন চিন্তা করবে নাআমি একটা ব্যবস্থা করবঅবশ্যই করবচল কোথাও বসে চাটা কিছু খাওয়া যাক। 

আসিফ বলল, আমি একটু পুরানা পল্টনের দিকে যাবএগারটার মধ্যে না গেলে কাজ হবে নাচা থাক। 

চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপার

আচ্ছা যাওতবে শােন, বিকেলে রিহার্সেলে আসার সময় কয়েক কপি বায়ােডাটা নিয়ে আসবে। 

দেয়ার মতাে বায়ােডাটা তাে কিছু নেই‘ 

যা আছে তাই আন না। আমার এক খালু আছেন খুবই হাই লেভেলের লােকমন্ত্রী লেভেলের লােকদের সঙ্গে যােগাযােগতাঁকে দিয়েই কার্য উদ্ধার করতে হবেতুমি একেবারেই চিন্তা করবে না। 

সাজঘর

জি আচ্ছা‘ 

লীনার শরীর এখন কেমন? ভালাে। 

ভেরি গুডআমি দেখতে যাবআজই যাবরিহার্সেলের পর চলে যাব। রাতে খাব তােমাদের সাথে। 

জি আচ্ছাশােন আসিফ, টাকা পয়সা কিছু লাগবে

এই মুহূর্তে না। 

কোননারকম সংকোচ করবে নাতােমার মতাে মানুষকে এটা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কী আফসােস বল তাে। 

আসিফ হেসে ফেলল। 

হাসবে না, বুঝলে? এটা হাসির কোনাে ব্যাপার নাএটা হচ্ছে একটা গ্রেট ট্র্যাজেডি

সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ

আসিফের তেমন কোথাও যাবার কথা ছিল নাবজলু সাহেবের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়াই তার প্রথম উদ্দেশ্যবজলু কাউকে ধরলে সহজে ছাড়েন নাআসিফ এখন কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে নাবাসায় ফিরে যাওয়া যায়। খালি বাসায় ফিরে গিয়েই বা কী হবে? লীনা আছে স্কুলেআজ আবার স্কুলে কিসের যেন পরীক্ষাছুটি হবে বিকেল পাঁচটায়

ছুটির জন্যে দরখাস্ত করেছিলনামঞ্জুর হয়েছেস্কুলের চাকরিটা লীনার ছেড়েই দিতে হবেভয়াবহ দিন সামনেআসিফ হাঁটতেহাঁটতে ভাবছে এইসব নিয়ে গুছিয়ে একটা নাটক লিখতে পারলে বেশ হততবে এই নাটক দর্শক নিত নানাটকের বক্তব্য যাই হােক, তার মধ্যে বিনােদন থাকতে হবেরিলিফ থাকতে হবেপিকাসাের যে ছবি, তারও বিনােদনের একটি দিক আছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *