হাঞ্চ ব্যাক অব মীরপুর পিঠ সােজা করে মতিঝিলের ট্রাভেল এজেন্সি সুরমা ট্রাভেলস–এ ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গে আসিফ। বিশাল অফিস। দু’জন স্টেনো বা রিসিপশনিস্ট ধরনের মেয়ে বসা। এক জনের দিকে তাকান যায় না।
মৈনাক পর্বত। তবে অন্যজন রূপবতী। মৈনাক পর্বত মধুর গলায় বলল, “আপনাদের জন্যে কী করতে পারি?”
বজলু সাহেব বললেন, ‘কেরামত আছে? ‘জি আছেন। এখন একটু ব্যস্ত। ‘আমিও ব্যস্ত। আপনি দয়া করে বলুন, ভৈরবের বজলু। | মৈনাক পর্বত বিরক্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল। বজলু আসিফকে নিচু গলায় বললেন, ‘তুমি এখানেই বসে থাক। আমি একা যাই। দরকার হলে তােমাকে ডাকব।‘
আসিফ বলল, দরকার হবে বলে মনে করছেন?
অবশই হবে। কেরামত আমার কথা ফেলবে না। ওর সেই ক্ষমন্তাও নেই। এস এম হলে লিটারেলি আমিই ওকে পেলেছি।‘
পুরানাে কথা কেউ মনে রাখে না বজলু ভাই। দেখা যাক। আগেই ডিসহার্টেড হচ্ছ কেন?
বজলু এসেছেন আসিফের চাকরির ব্যাপারে। এসেছেন খুবই উৎসাহ নিয়ে। তাঁর ধারণা এই মুহূর্তেই একটা কিছু হবে। আসতে আসতে বলেছিলেন, ‘তােমার চাকরি কোনাে ব্যাপারই না। যে কোনাে অফিসের এক জন বসকে ধরে এনে নাটক একটা দেখিয়ে দিলেই ব্যাটেল ইজ ওন।
আসিফ কোনাে প্রতিবাদ করে নি। যদিও বলতে চেয়েছিল নাটকের ক্ষেত্রে এটা কখনাে হয় না। খেলােয়াড়দের ব্যাপারে হয়। ভালাে ফুটবল প্লেয়ার, ক্রিকেট প্লেয়ারদের ডেকে ডেকে চাকরি দেয়। এরা অফিসের শােভা। কিন্তু নাটক করা লােককে কে রাখবে?
মৈনাক পর্বত বজলু সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেল। আসিফ বসে রইল। সুন্দরী মেয়েটি বলল, আপনি চা খাবেন?
“জ্বি খাব। | মেয়েটি কেমন যেন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। কোনাে একটা নাটক কি সে দেখেছে? অসম্ভব কিছু তাে নয়। দেখতেও তাে পারে। সুন্দরী মেয়েটি নিজেই চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে এল। মিষ্টি গলায় বলল, “আপনি কি মাধবীর ভাই?
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
“জ্বি না।‘ | মেয়েটির সব আগ্রহ শেষ। সে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ল টেলিফোন নিয়ে। সম্ভবত চা এনে দেয়ায় নিজের উপরই সে এখন রাগ করছে।
কেরামত যতটা আন্তরিকতা দেখাবে বলে বজলু ভেবেছিলেন, সে তার চেয়েও বেশি দেখাল। জড়িয়ে ধরে নাচানাচি করল খানিকক্ষণ। গদগদ গলায় বলল, ‘স্লৈবের বজলু যে তুমি তা বুঝতে পারি নি দোস্ত। বিশ্বাস করা এই টাকা ছুঁয়ে বলছি। ব্যবসায়ী কখনাে টাকা দুয়ে মিথ্যা কথা বলে না।
ব্যবসা কেমন চলছে? ‘টুকটাক। ফাজিলের দেশ। ফাজিলের দেশে ব্যবসা করে সুখ নেই। ‘তুই তাে মনে হচ্ছে সুখে আছিস।‘ ‘টাকা আছে। মনে শান্তি নাইরে দোস্ত। কী জনাে এসেছিস বল। ‘চাকরি দিতে হবে একটা।‘ ‘এটা ছাড়া আর কিছু বলার থাকলে বল।” ‘আর কিছু বলার নেই।‘
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
কেরামত গম্ভীর হয়ে গেল! বজলু সিগারেট ধরালেন। এই ঘরের এয়ার কন্ডিশনার অনেক নিচে সেট করা। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে ফ্রিজের ভেতর তিনি বসে আছেন। কেরামত বলল, ‘চাকরি কার ?
‘আমার গ্রুপের এক জন।‘ ‘তাের আবার কিসের গ্রুপ। ‘নাটকেন্দ্র গ্রুপ।
ও আচ্ছা, এখনাে নাটক নিয়ে আছিস? ভালাে। শিল্প–সাহিত্যের কোনাে খবর রাখি না। আমার বউ বলছিল মহিলা সমিতিতে ভালল–ভালাে নাটক হয়। সে একদিন দেখে আসল—কমেডি ধরনের কিছু হবে। রাতে ঘুমুতে গিয়েও একটু পরপর হেসে ওঠে।‘
বজলু বললেন, ‘আসল কথা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাের ক্যান্ডিডেটের যােগ্যতা কি? মানে নাটক ছাড়া আর কী জানে?
‘বি, এ পাশ। গ্রুতে ব্যাংকে চাকরি করত, তারপর ইস্টার্ন ট্রান্সপাের্টে কিছুদিন ছিল। জীবন বীমাতে কিছুদিন কাজ করেছে।‘
‘অচল মাল গছাতে চাচ্ছিস।‘
সাজঘর: হুমায়ূন আহমেদ
বজলু সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘আসিফের মতাে ছেলেকে চাকরির জন্যে মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতে হচ্ছে এইটাই হচ্ছে আফসােসের ব্যাপার। বিলেত আমেরিকা হলে এই ছেলে টাকার উপর শুয়ে থাকত।
কেরামত বলল, ‘কষ্ট করে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে এই ছেলেকে বিলেত আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেই হয়।
বজলু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
কেরামত বলল, ‘ঠাট্টা করলাম রে দোস্ত। তােকে সত্যি কথা বলি বিজনেসের অবস্থা খুবই টাইট। তবু তুই এসেছিস সেই খাতিরে আমি যা করতে পারি সেটা হচ্ছে টাইপিস্টের একটা চাকরি দিতে পারি। তবে টাইপ জানতে হবে।
বজলু উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তবু বললেন, ‘তাের এখানে হবে না বুঝলাম। উঠি।
কেরামত বলল, ‘রাগ করে উঠে যাচ্ছিস তা বুঝতে পারছি। উপায় নেই দোস্ত। আমার জায়গায় তুই থাকলে তুইও ঠিক এই কথাই বলতি। পুরনাে দিনের খাতিরে এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যা। আমি মানুষটা খারাপ হতে পারি আমার অফিসের চা কিন্তু ভালাে।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
বজলু চা খেলেন না। অফিস থেকে বের হবা মাত্র তাঁর পিঠ আবার কুঁজো হয়ে
গেল। তবে বেশ শক্ত গলায় বললেন, তুমি কোন চিন্তা করবে না। আমি একটা ব্যবস্থা করব। অবশ্যই করব। চল কোথাও বসে চা–টা কিছু খাওয়া যাক।
আসিফ বলল, আমি একটু পুরানা পল্টনের দিকে যাব। এগারটার মধ্যে না গেলে কাজ হবে না। চা থাক।
‘চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপার?
আচ্ছা যাও। তবে শােন, বিকেলে রিহার্সেলে আসার সময় কয়েক কপি বায়ােডাটা নিয়ে আসবে।
দেয়ার মতাে বায়ােডাটা তাে কিছু নেই।‘
যা আছে তাই আন না। আমার এক খালু আছেন খুবই হাই লেভেলের লােক। মন্ত্রী লেভেলের লােকদের সঙ্গে যােগাযােগ। তাঁকে দিয়েই কার্য উদ্ধার করতে হবে। তুমি একেবারেই চিন্তা করবে না।
সাজঘর
‘জি আচ্ছা।‘
লীনার শরীর এখন কেমন? ‘ভালাে।
‘ভেরি গুড। আমি দেখতে যাব। আজই যাব। রিহার্সেলের পর চলে যাব। রাতে খাব তােমাদের সাথে।
“জি আচ্ছা। ‘শােন আসিফ, টাকা পয়সা কিছু লাগবে?
এই মুহূর্তে না।
‘কোননারকম সংকোচ করবে না। তােমার মতাে মানুষকে এটা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কী আফসােস বল তাে।
আসিফ হেসে ফেলল।
‘হাসবে না, বুঝলে? এটা হাসির কোনাে ব্যাপার না। এটা হচ্ছে একটা গ্রেট ট্র্যাজেডি।
সাজঘর : হুমায়ূন আহমেদ
আসিফের তেমন কোথাও যাবার কথা ছিল না। বজলু সাহেবের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়াই তার প্রথম উদ্দেশ্য। বজলু কাউকে ধরলে সহজে ছাড়েন না। আসিফ এখন কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বাসায় ফিরে যাওয়া যায়। খালি বাসায় ফিরে গিয়েই বা কী হবে? লীনা আছে স্কুলে। আজ আবার স্কুলে কিসের যেন পরীক্ষা। ছুটি হবে বিকেল পাঁচটায়।
ছুটির জন্যে দরখাস্ত করেছিল—নামঞ্জুর হয়েছে। স্কুলের চাকরিটা লীনার ছেড়েই দিতে হবে। ভয়াবহ দিন সামনে। আসিফ হাঁটতে–হাঁটতে ভাবছে এইসব নিয়ে গুছিয়ে একটা নাটক লিখতে পারলে বেশ হত। তবে এই নাটক দর্শক নিত না। নাটকের বক্তব্য যাই হােক, তার মধ্যে বিনােদন থাকতে হবে। রিলিফ থাকতে হবে। পিকাসাের যে ছবি, তারও বিনােদনের একটি দিক আছে।