সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, পারছি। 

তিনি বললেন, জাস্ট একটা এক্সপেরিয়েন্সের জন্যেপারা যাবে? আমি বললাম, অবশ্যইএটা কোনাে ব্যাপারই না

সাজঘরআসিফ বলল, আপনি কি কোনাে ব্যবস্থা করলেন? 

ফরহাদ সাহেব বললেন, আমি কী করলাম শােন, অফিসে এসে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলামআমার মেঝাে মেয়ে সুমিওর বয়স সতেরচোখের সামনে একটা ছবি ভেসে উঠল, যেন সুমি এই লােকটার কোমর জড়িয়ে হাটেলের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেমাথায় আগুন লেগে গেলকী করলাম জান

কী করলেন? ভদ্রলােকের স্ত্রীকে টেলিফোনে সমস্ত ব্যাপারটা বললাম। 

তারপর? তারপরের কথা কিছু জানি নাআপনার বিল? আপনার বিলের কী হল? ‘ঐসব এখন জানতে চাওয়া কি অর্থহীন না?‘ 

ফরহাদ সাহেব খাবার মুখে দিচ্ছেনতাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঘাস চিবুচ্ছেনঅনেক কষ্টে কুৎসিত কিছু গিলে ফেলার চেষ্টা করছেনখানিকক্ষণ 

পর-পর পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। 

আসিফ। 

মনটা খুব অস্থির। কোনাে কিছুই ভালাে লাগে নাঅফিসে বসে সারাদিন শুধু ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাইনাটকফাটক দেখলে মনটা ভালাে হবে নাকি বল তাে? ভালাে কিছু কি হচ্ছে

আসিফ জবাব দিল না। 

ফরহাদ সাহেব বললেন, রিয়েল ওয়ার্লড থেকে আনরিয়েল ওয়ার্লডে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ঢুকতে ইচ্ছা করেটিপু সুলতান, সিরাজদ্দৌলা এইসব নাটক কি আজকাল হয়, আসিফ

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

মফস্বলের দিকে হয়‘ 

‘তােমরা কর না কেন? ফ্যান্টাসি ধরনের জিনিস দেখতে ইচ্ছা করেমশিয়ে লালী, নানা ফারাবিশ, ভেরি ইন্টারেস্টিং, তাই না? তারপর একটা মেয়ে ছিল না? যে বললআমার বাপুজী জৌতিষ চর্চা করেনটিপু সুলতান বলল, কে তােমার বাপুজী, কি তার পরিচয়?মেয়েটি বলল, বাপুজীকে আপনার প্রয়ােজন নেই, প্রয়ােজন তাঁর গণনায়। 

আসিফ বলল, ‘দুলাভাই আপনার মনে হয় খানিকটা নেশা হয়ে গেছে। 

ফরহাদ সাহেব সঙ্গেসঙ্গে বললেন, ‘হ্যা হয়েছেআমি নিজেই বুঝতে পারছিঅভ্যাস নেইতার উপর গরমটাও পড়েছে প্রচণ্ডঅল্পতেই..... চল উঠে পড়ি। 

আপনি তাে কিছুই খেলেন না। 

ইচ্ছা করছে নাটেস্টলেস সব খাবারমনে হচ্ছে মানুষের বমি খাচ্ছিভালাে কথা, বমির ইংরেজি কি জান না কি? কয়েকদিন ধরেই ভাবছি কাউকে জিজ্ঞেস করব মনে থাকে না। 

গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব আরাে ঝিম মেরে গেলেনআসিফ বলল, দুলাভাই আপনি কি গাড়ি চালাবেন

ইয়েসভয় নেই, এক্সিডেন্ট করব নাস্টিয়ারিং হুইল ধরামাত্র আমি সােবার হয়ে যাইতাছাড়া ধর এক্সিডেন্ট যদি করেই ফেলি, তেমন কী আর হবে

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব সত্যিসত্যি সােবার হয়ে গেলেনসহজভাবে গাড়ি চালাতে লাগলেনহাসিমুখে বললেন, ভয় কমেছে?” 

কমেছেআসিফ, তােমার জন্যে আমি একটা ব্যবস্থা করে দেবচিন্তা করবে নাআমাকে খানিকটা সময় দাওধর মাস খানিক। 

থ্যাংকস দুলাভাইকোথায় যাবে বল, তােমাকে নামিয়ে দিই” 

যে কোন এক জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবেআমার বিশেষ কোথাও যাবার প্রােগ্রাম নেই। 

ফরহাদ সাহেব গাড়ি পার্ক করলেনআসিফ নেমে পড়লফরহাদ সাহেব বললেন, এক সেকেন্ডের জন্যে দাঁড়াওতােমার সঙ্গে কিছু মিথ্যা কথা বলা হয়েছেসত্যি কথাটা বলে ফেলি। 

কোন বিষয়ে?” 

‘আমি লােকের স্ত্রীকে টেলিফোন করি নিভদ্রলােক যেমন চেয়েছেন সেই মতাে ব্যবস্থা হয়েছেগত পরশু আমি বিল পেয়েছিযাই, কেমন

ফরহাদ সাহেব গাড়ি নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেলেনরাস্তায় যানবাহনের জটলা, কিন্তু তাঁর গাড়ি দ্রুত চলছেআসিফ লাল রঙের গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইল। 

একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুতআসিফ নিজের আত্মীয়স্বজন কারাের সঙ্গেই কেমন যেন সহজ হতে পারে নাঅদৃশ্য একটা পর্দা থেকেই যায়অথচ এই মানুষটিকে খুবই আপন মনে হয়। যদিও আসিফের বােনের সঙ্গে এই লােকটির তেমন অন্তরঙ্গতা বিয়ের এত বছরেও তৈরি হয় নিকুৎসিত সব ঝগড়া হয়। 

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

অন্য বােনদের সঙ্গে তাদের স্বামীদের ভাবটাব কেমন আসিফ জানে না। অন্যদের সঙ্গে যোগাযােগ নেই বললেই য়। মা বেঁচে থাকতে খানিকটা যােগাযােগ ছিলমা পালা করে একেক মেয়ের বাসায় থাকতেনঈদ উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে দেখা 

করতে গিয়ে বােনদের সঙ্গে দেখা হতবােনরা কড়া কড়া কথা শােনাত, যার মূল ভাব একটিইআসিফ ভয়াবহ একটা চরিত্রআসিফের মেজো বােন একটি কথা প্রায় সরাসরি বলে, বাবা এত সকাল সকাল মরে গেল শুধু মাত্র আসিফের কারণেআসিফ বাবাকে কষ্ট দেয়ার জন্যেই ইচ্ছা করেই পড়াশােনা ছেড়ে দিলনয়ত যে ছেলে ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ডিসট্রিক্টে ফাষ্ট হয়, সে কী করে ম্যাট্রিক প্রথমবারে ফেল 

করে দ্বিতীয়বারে থার্ড ডিভিশনে পাশ করে, আই,তে কম্পার্টমেন্টাল পায়। বাবা মরে গেল এই দুঃখে‘ 

যে কোনাে কথাই অনেকবার শুনলে সেটাকে সত্যি মনে হয়রেসকোর্সের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই মুহুর্তে আসিফের মনে হচ্ছে মেজো আপার কথা সত্যি হলেও হতে পারেবৈশাখ মাসের দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে সে খানিকটা বিষন্ন বােধ করলতার মনে হল সব মানুষের অন্তত একবার করে হলেও জীবন গােড়া থেকে শুরু করার সুযােগ থাকলে ভালাে হতবড় ধরনের ভূলগুলাের একটি অন্তত শােধরান যেত। 

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

তার সবচেয়ে বড় ভুল কোনটা? নাটক? আর লীনা? লীনাও কি তার মতাে বড় কোনাে ভুল করেছে? একবার তাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়

আসিফ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললপ্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছেআশেপাশে পানি খাবার কোনাে ব্যবস্থা নেইঢাকা শহরের নানান জায়গায় এখন চমৎকার ফোয়ারা। এই সব ফোয়ারার পানি কি খাওয়া যায়? প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারার পানি একবার এক তৃষ্ণার্ত বৃদ্ধকে খুব আগ্রহ করে খেতে দেখেছিলবৃদ্ধের চেহারা বেশ সম্রান্ত

হাতে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিরে লােকদের মতাে চামড়ার ব্যাগসে এই ব্যাগ পাশে রেখে ফোয়ারার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে বেশ আয়ােজন করে পানি খেলদৃশ্যটা আসিফের এতই মজা লাগল যে সে এগিয়ে গেলবৃদ্ধ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে আসিফকে বললেন, সরকার পানি খাওনের ভালাে ব্যবস্থা করছেখুবই উত্তম ব্যবস্থা। 

আসিফের ইচ্ছা করছে এই রকম কোনাে একটা ফোয়ারার কাছে গিয়ে বৃদ্ধের মতাে হাতমুখ ধুয়ে খুব আয়ােজন করে খানিকটা পানি খায়লােকজন পাগল ভাববে নিশ্চয়ইভাবুকমাঝেমাঝে পাগল হতে ইচ্ছা করে। 

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

সে সত্যিসত্যি হেঁটে হেঁটে প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারাটার কাছে এলফোয়ারা বন্ধশুকিয়ে খট খট করছেকিছু জিজ্ঞেস না করতেই একজন বলল, সন্ধ্যার সময় লাল নীল বাতি জ্বালাইয়া ছাড়েসন্ধ্যা পর্যন্ত সে কি অপেক্ষা করবে? অপেক্ষা করলে কেমন হয়

আসিফ নিজের পাগলামীতে নিজেই হেসে ফেলল। 

ঝুম বৃষ্টি পড়ছে।মজনু চুলায় কেতলি চাপিয়ে বিরক্ত মুখে বৃষ্টি দেখছেবৃষ্টি মানেই যন্ত্রণা। চা বেশি লাগবেদু’বারের জায়গায় তিনবার কেতলি বসাতে হবে। তিনবারের মতাে চা পাতা নেই। চা পাতা আনতে যেতে হবেরিহার্সেলের সময় বাইরে যেতে তার ভালাে লাগে। 

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত না দেখলে মজা কোথায়? তা ছাড়া বৃষ্টির সময় সবাই আসেও নারিহার্সেল ঠিকমতাে হয় নাআগে আগে শেষ হয়ে যায়রিহার্সেল বাদ দিয়ে গােল হয়ে বসে গল্পগুজব করেআগে কাজ, পরে গল্পগুজবএই জিনিসটা এরা বােঝে নাছাগলের দল। 

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

কেতলিতে চায়ের পাতা ফেলে মজএকটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললমনে হচ্ছেলাস্ট সিনটা আজও হবে নালাস্ট সিনটাই সবচে মারাত্মকপ্রায় দিনই এই সিন হচ্ছে নাআজমল সাহেব আসে নাতাঁর নাকি মায়ের অসুখলাস্ট সিনের মেইন একটর হচ্ছে আজমল হুদামজনুর মতে আজমল সাব হচ্ছে এই টিমের দুই নম্বর একটরএক নম্বর আসিফ সাবএই দুই জন না থাকলে টিম কানাতবে নতুন মেয়ে পুষ্প মন্দ না

লীনা আপার কাছাকাছিকিংবা কে জানে লীনা আপার চেয়েও বােধ হয়ভালােতবে লীনা আপা ডায়লগ দেবার সময় শুরুর সব কথাতেই কি সুন্দর করে হাসে, এই মেয়ে সেটা করে নাএই মেয়ে একটু বেশি গম্ভীরএই গাম্ভীর্যটাও ভালাে লাগেহাসিটাও ভালাে লাগেকে জানে কোনটা বেশি ভালাে। 

মজনু ভেতরে উঁকি দিলউঁকি দেবার মূল কারণ আজমল হুদা এসেছে কিনা তা দেখা। 

আসে নি।তার মায়ের অসুখ বােধ হয় আরাে বেড়েছে

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-১৫): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *