আমি বললাম, “পারছি।
তিনি বললেন, ‘জাস্ট একটা এক্সপেরিয়েন্সের জন্যে। পারা যাবে? আমি বললাম, ‘অবশ্যই। এটা কোনাে ব্যাপারই না।
আসিফ বলল, আপনি কি কোনাে ব্যবস্থা করলেন?
ফরহাদ সাহেব বললেন, ‘আমি কী করলাম শােন, অফিসে এসে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার মেঝাে মেয়ে সুমি—ওর বয়স সতের। চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে উঠল, যেন সুমি এই লােকটার কোমর জড়িয়ে হাটেলের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। মাথায় আগুন লেগে গেল। কী করলাম জান?
কী করলেন? ‘ভদ্রলােকের স্ত্রীকে টেলিফোনে সমস্ত ব্যাপারটা বললাম।
তারপর? তারপরের কথা কিছু জানি না। ‘আপনার বিল? আপনার বিলের কী হল? ‘ঐসব এখন জানতে চাওয়া কি অর্থহীন না?‘
ফরহাদ সাহেব খাবার মুখে দিচ্ছেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঘাস চিবুচ্ছেন। অনেক কষ্টে কুৎসিত কিছু গিলে ফেলার চেষ্টা করছেন। খানিকক্ষণ
পর-পর পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন।
‘আসিফ।
‘মনটা খুব অস্থির। কোনাে কিছুই ভালাে লাগে না। অফিসে বসে সারাদিন শুধু ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাই। নাটক–ফাটক দেখলে মনটা ভালাে হবে নাকি বল তাে? ভালাে কিছু কি হচ্ছে?
আসিফ জবাব দিল না।
ফরহাদ সাহেব বললেন, রিয়েল ওয়ার্লড থেকে আনরিয়েল ওয়ার্লডে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ঢুকতে ইচ্ছা করে। টিপু সুলতান, সিরাজদ্দৌলা এইসব নাটক কি আজকাল হয়, আসিফ?
সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ
‘মফস্বলের দিকে হয়।‘
‘তােমরা কর না কেন? ফ্যান্টাসি ধরনের জিনিস দেখতে ইচ্ছা করে। মশিয়ে লালী, নানা ফারাবিশ, ভেরি ইন্টারেস্টিং, তাই না? তারপর একটা মেয়ে ছিল না? যে বলল—আমার বাপুজী জৌতিষ চর্চা করেন। টিপু সুলতান বলল, ‘কে তােমার বাপুজী, কি তার পরিচয়?‘ মেয়েটি বলল, ‘বাপুজীকে আপনার প্রয়ােজন নেই, প্রয়ােজন তাঁর গণনায়।
আসিফ বলল, ‘দুলাভাই আপনার মনে হয় খানিকটা নেশা হয়ে গেছে।
ফরহাদ সাহেব সঙ্গে–সঙ্গে বললেন, ‘হ্যা হয়েছে। আমি নিজেই বুঝতে পারছি। অভ্যাস নেই। তার উপর গরমটাও পড়েছে প্রচণ্ড। অল্পতেই..... চল উঠে পড়ি।
‘আপনি তাে কিছুই খেলেন না।
‘ইচ্ছা করছে না। টেস্টলেস সব খাবার। মনে হচ্ছে মানুষের বমি খাচ্ছি। ভালাে কথা, বমির ইংরেজি কি জান না কি? কয়েকদিন ধরেই ভাবছি কাউকে জিজ্ঞেস করব মনে থাকে না।
গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব আরাে ঝিম মেরে গেলেন। আসিফ বলল, ‘দুলাভাই আপনি কি গাড়ি চালাবেন?
‘ইয়েস। ভয় নেই, এক্সিডেন্ট করব না। স্টিয়ারিং হুইল ধরামাত্র আমি সােবার হয়ে যাই। তাছাড়া ধর এক্সিডেন্ট যদি করেই ফেলি, তেমন কী আর হবে?
সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ
গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব সত্যি–সত্যি সােবার হয়ে গেলেন। সহজভাবে গাড়ি চালাতে লাগলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘ভয় কমেছে?”
‘কমেছে।‘ ‘আসিফ, তােমার জন্যে আমি একটা ব্যবস্থা করে দেব। চিন্তা করবে না। আমাকে খানিকটা সময় দাও—ধর মাস খানিক।
থ্যাংকস দুলাভাই।‘ ‘কোথায় যাবে বল, তােমাকে নামিয়ে দিই।”
যে কোন এক জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে। আমার বিশেষ কোথাও যাবার প্রােগ্রাম নেই।
ফরহাদ সাহেব গাড়ি পার্ক করলেন। আসিফ নেমে পড়ল। ফরহাদ সাহেব বললেন, ‘এক সেকেন্ডের জন্যে দাঁড়াও। তােমার সঙ্গে কিছু মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। সত্যি কথাটা বলে ফেলি।
‘কোন বিষয়ে?”
‘আমি ঐ লােকের স্ত্রীকে টেলিফোন করি নি। ভদ্রলােক যেমন চেয়েছেন সেই মতাে ব্যবস্থা হয়েছে। গত পরশু আমি বিল পেয়েছি। যাই, কেমন?
ফরহাদ সাহেব গাড়ি নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেলেন। রাস্তায় যানবাহনের জটলা, কিন্তু তাঁর গাড়ি দ্রুত চলছে। আসিফ লাল রঙের গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইল।
একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আসিফ নিজের আত্মীয়–স্বজন কারাের সঙ্গেই কেমন যেন সহজ হতে পারে না। অদৃশ্য একটা পর্দা থেকেই যায়। অথচ এই মানুষটিকে খুবই আপন মনে হয়। যদিও আসিফের বােনের সঙ্গে এই লােকটির তেমন অন্তরঙ্গতা বিয়ের এত বছরেও তৈরি হয় নি। কুৎসিত সব ঝগড়া হয়।
সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ
অন্য বােনদের সঙ্গে তাদের স্বামীদের ভাব–টাব কেমন আসিফ জানে না। অন্যদের সঙ্গে যোগাযােগ নেই বললেই হয়। মা বেঁচে থাকতে খানিকটা যােগাযােগ ছিল। মা পালা করে একেক মেয়ের বাসায় থাকতেন। ঈদ উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে দেখা
করতে গিয়ে বােনদের সঙ্গে দেখা হত। বােনরা কড়া কড়া কথা শােনাত, যার মূল ভাব একটিই–আসিফ ভয়াবহ একটা চরিত্র। আসিফের মেজো বােন একটি কথা প্রায় সরাসরি বলে, ‘বাবা এত সকাল সকাল মরে গেল শুধু মাত্র আসিফের কারণে। আসিফ বাবাকে কষ্ট দেয়ার জন্যেই ইচ্ছা করেই পড়াশােনা ছেড়ে দিল। নয়ত যে ছেলে ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ডিসট্রিক্টে ফাষ্ট হয়, সে কী করে ম্যাট্রিক প্রথমবারে ফেল
করে দ্বিতীয়বারে থার্ড ডিভিশনে পাশ করে, আই,এ তে কম্পার্টমেন্টাল পায়। বাবা মরে গেল এই দুঃখে।‘
যে কোনাে কথাই অনেকবার শুনলে সেটাকে সত্যি মনে হয়। রেসকোর্সের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই মুহুর্তে আসিফের মনে হচ্ছে মেজো আপার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। বৈশাখ মাসের দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে সে খানিকটা বিষন্ন বােধ করল। তার মনে হল সব মানুষের অন্তত একবার করে হলেও জীবন গােড়া থেকে শুরু করার সুযােগ থাকলে ভালাে হত। বড় ধরনের ভূলগুলাের একটি অন্তত শােধরান যেত।
সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ
তার সবচেয়ে বড় ভুল কোনটা? নাটক? আর লীনা? লীনাও কি তার মতাে বড় কোনাে ভুল করেছে? একবার তাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?
আসিফ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে। আশেপাশে পানি খাবার কোনাে ব্যবস্থা নেই। ঢাকা শহরের নানান জায়গায় এখন চমৎকার ফোয়ারা। এই সব ফোয়ারার পানি কি খাওয়া যায়? প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারার পানি একবার এক তৃষ্ণার্ত বৃদ্ধকে খুব আগ্রহ করে খেতে দেখেছিল। বৃদ্ধের চেহারা বেশ সম্রান্ত।
হাতে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিরে লােকদের মতাে চামড়ার ব্যাগ। সে এই ব্যাগ পাশে রেখে ফোয়ারার পানিতে হাত–মুখ ধুয়ে বেশ আয়ােজন করে পানি খেল। দৃশ্যটা আসিফের এতই মজা লাগল যে সে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে আসিফকে বললেন, ‘সরকার পানি খাওনের ভালাে ব্যবস্থা করছে। খুবই উত্তম ব্যবস্থা।
আসিফের ইচ্ছা করছে এই রকম কোনাে একটা ফোয়ারার কাছে গিয়ে ঐ বৃদ্ধের মতাে হাত–মুখ ধুয়ে খুব আয়ােজন করে খানিকটা পানি খায়। লােকজন পাগল ভাববে নিশ্চয়ই। ভাবুক। মাঝে–মাঝে পাগল হতে ইচ্ছা করে।
সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ
সে সত্যি–সত্যি হেঁটে হেঁটে প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারাটার কাছে এল। ফোয়ারা বন্ধ। শুকিয়ে খট খট করছে। কিছু জিজ্ঞেস না করতেই একজন বলল, ‘সন্ধ্যার সময় লাল নীল বাতি জ্বালাইয়া ছাড়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে কি অপেক্ষা করবে? অপেক্ষা করলে কেমন হয়?
আসিফ নিজের পাগলামীতে নিজেই হেসে ফেলল।
ঝুম বৃষ্টি পড়ছে।মজনু চুলায় কেতলি চাপিয়ে বিরক্ত মুখে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মানেই যন্ত্রণা। চা বেশি লাগবে। দু’বারের জায়গায় তিনবার কেতলি বসাতে হবে। তিনবারের মতাে চা পাতা নেই। চা পাতা আনতে যেতে হবে। রিহার্সেলের সময় বাইরে যেতে তার ভালাে লাগে।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত না দেখলে মজা কোথায়? তা ছাড়া বৃষ্টির সময় সবাই আসেও না। রিহার্সেল ঠিকমতাে হয় না। আগে আগে শেষ হয়ে যায়। রিহার্সেল বাদ দিয়ে গােল হয়ে বসে গল্পগুজব করে। আগে কাজ, পরে গল্পগুজব। এই জিনিসটা এরা বােঝে না। ছাগলের দল।
সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ
কেতলিতে চায়ের পাতা ফেলে মজন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে। লাস্ট সিনটা আজও হবে না। লাস্ট সিনটাই সবচে মারাত্মক। প্রায় দিনই এই সিন হচ্ছে না। আজমল সাহেব আসে না। তাঁর নাকি মায়ের অসুখ। লাস্ট সিনের মেইন একটর হচ্ছে আজমল হুদা। মজনুর মতে আজমল সাব হচ্ছে এই টিমের দুই নম্বর একটর। এক নম্বর আসিফ সাব। এই দুই জন না থাকলে টিম কানা। তবে নতুন মেয়ে পুষ্প মন্দ না।
লীনা আপার কাছাকাছি। কিংবা কে জানে লীনা আপার চেয়েও বােধ হয়। ভালাে। তবে লীনা আপা ডায়লগ দেবার সময় শুরুর সব কথাতেই কি সুন্দর করে হাসে, এই মেয়ে সেটা করে না। এই মেয়ে একটু বেশি গম্ভীর। এই গাম্ভীর্যটাও ভালাে লাগে। হাসিটাও ভালাে লাগে। কে জানে কোনটা বেশি ভালাে।
মজনু ভেতরে উঁকি দিল। উঁকি দেবার মূল কারণ আজমল হুদা এসেছে কিনা তা দেখা।
আসে নি।তার মায়ের অসুখ বােধ হয় আরাে বেড়েছে।
(চলবে)