এইসব বুড়া–বুড়ি মা বাবা নিয়ে বড় যন্ত্রণা। কাজের কাজ কিছু করে না, অসুখ বাঁধিয়ে অন্য সবের কাজের ক্ষতি করে। মজনুর খুবই মন খারাপ হল। এর মধ্যেও যা একটু আনন্দের ব্যাপার তা হচ্ছে অনেকদিন পর লীনা আপা এসেছে।
একদম কোণার দিকের একটা চেয়ারে একা–একা বসে আছে। স্টেজের উপরে আসিফ এবং পুষ্প। আসিফ নিচু গলায় পুষ্পকে কি যেন বলছে, পুষ্প মন দিয়ে শুনছে। লীনা আপা একদৃষ্টিতে ঐ দিকে তাকিয়ে আছে।
মন লীনার সামনে এসে বলল, কেমন আছেন আফা?”
‘ভালাে। তুই কেমন আছিস রে মজনু? “জ্বি ভালাে।
লীনা হাসিমুখে বলল, ‘পুষ্প কেমন পার্ট করছে রে মজনু? তাের তাে আবার সব কিছুতে নম্বর দেয়া। পুষ্প কত নম্বর?‘
‘তিন নম্বরে আছে আফা। ‘দু নম্বরে কে আছে? ‘আজমল সাব?‘ ‘তাই নাকি?
‘জ্বি। কাজটা অনুচিত হইছে আফা। আজমল সাবের মতাে লােকরে ছােড় একটা পাট দিছে।
‘ছােট হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ রােল। তার উপর ভর করেই তাে নাটক দাঁড়িয়ে আছে।
‘কথা ঠিক।
মজনুর বড় ভালাে লাগে। লীনা আপা তার সাথে হেলাফেলা করে কথা বলে না। তার কথা শুনে অন্যদের মতাে হেসে ফেলে বলে না—যা ভাগ। কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল কেন আজমল সাবের পার্ট এত ছােট। জিনিস থাকলে ছােট পাট দিয়েও আসর মাত করা যায়।
সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ
আজমল সাব যতক্ষণ স্টেজে থাকে ততক্ষণ শরীরের রক্ত গরম হয়ে থাকে। মনে হয় কি শালার দুনিয়া। লাথি মারি দুনিয়ায়।
লীনা বলল, “আজ আমাকে একটু চা দিস তাে মজনু। চা খেতে ইচ্ছা করছে।
আনতাছি আফা। হুনলাম বিদেশ যাইতাছেন?” ‘ইডিয়া যাচ্ছি, দূরে কোথাও না। তুই কার কাছে শুনলি?
বলাবলি করতেছিল। কবে যাইতেছেন আফা? পরশু। পরশু রাত ন‘টার ফ্লাইটে। তাের জন্যে কি কিছু আনতে হবে? “না আফা।‘
আনন্দে মজনুর চোখে প্রায় পানি এসেই যেত, যদি না প্রণব বাবু চেচিয়ে বলতেন, গাধা, চা কই? এক ঘন্টা আগে চা দিতে বলেছি। মজনু চা আনতে গেল। চা বানাতে—বানাতেই শুনল সেকেণ্ড সিন হচ্ছে। সে গভীর মনােযােগের সঙ্গে শুলছে। প্রতিটি ডায়লগ তার মুখস্থ।
অনেকেই যেমন গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গায়, মজনুও অভিনেতার সঙ্গে–সঙ্গে অভিনয় করে। তার বড় ভালাে লাগে। এই মুহূর্তে সে কাছে লেখকের ভূমিকা। তার মনে হচ্ছে সে খুব ভালাে করছে। মনটা তার খানিকটা খারাপও লাগছে। এত চমৎকার অভিনয়, অথচ কেউ দেখতে পারছে না। অন্তত এক জন যদি দেখত।
সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ
মজনুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হল। মােটর সাইকেল ভট ভট করতে করতে আজমল চলে এসেছে। লাস্ট সিনটা আজ তাহলে হবে। ঘুম ভেঙে আজ সে কার মুখ দেখেছিল কে জানে। বিউটি সেলুনের ছেলেটার মুখ বােধ হয়। ঐ ছেলেটার মুখ দেখলে তার দিনটা খুব ভালাে যায়।
আজমল লীনার পাশের চেয়ারে এসে বসেছে। সে সিটি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। তার বিশাল চেহারা, বিশাল গোঁফ দেখে ঠিক অনুমান করা যায়।
বড়–সড় চেহারার মানুষগুলাের গলার স্বর সাধারণত খুব কোমল হয়। আজমলের বেলায় তা হয় নি। সে কথা বললে হল কাঁপে।
লীনা বলল, আপনার মার শরীর এখন কেমন?
আজমল বলল, “ভালাে, মানে খুব না, খানিকটা ভালো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। হাঁটুতে কি একটা অপারেশন না কি হবে।
কবে হবে? ‘জানি না কবে। বউ দৌড়াদৌড়ি করছে, সে–ই জানে?
স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে আজমল ভূ কুঞ্চিত করল। লীনা হাসি মুখে বলল, ‘ভাবির সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে?
এবার কী নিয়ে ঝগড়া করলেন? ‘তার ধারণা আমি কোনাে কিছুই দেখি না। শুধু নাটক নিয়ে থাকি।
সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ
ধারণা কি ভুল?
‘অবশ্যই ভুল। নিয়মিত ক্লাস করি। প্রাইভেট টিউশানি করি, প্রতিদিন সকালে বাজার করি। এরচে বেশি কোন পুরুষটা কী করে? ঝগড়া করার জন্যে অজুহাত দরকার, এটা হচ্ছে একটা অজুহাত। ঐ যে সিংহ ছাগল ছানার গল্প। সিংহ বলল,
ব্যাটা তুই জল ঘােলা করছিস কেন?...‘
লীনা বলল, আপনি মনে হচ্ছে ভাবির উপর খুব রেগেছেন।
‘রাগব না? অফকোর্স রাগব।—ভাবি, এটাই কি নতুন মেয়ে নাকি? বাহু, অভিনয় তাে খুব ভালাে করছে। একসেলেন্ট নাম কি?
পুষ্প। মনটা খারাপ হয়ে গেল তাবি। ‘কেন?
এই মেয়েকে বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। টেলিভিশন ছোঁ মেরে নিয়ে নেবে, তারপর আসবে ফিরে পােকন। আর তা যদি নাও আসে মেয়েটির অভিনয় দেখে কোনাে এক জন ছেলে তার প্রেমে পড়বে। বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর ঐ ছেলে আর মেয়েটিকে অভিনয় করতে দেবে না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ভাবি। খুবই খারাপ। মেয়েটার কী নাম বললেন?‘
‘আমি নিজেই তাে মনে হচ্ছে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। মাই গড, দারুণ মেয়ে তাে।
লীনা খিলখিল করে হেসে ফেলল। স্টেজ থেকে বিরক্ত চোখে আসিফ তাকাচ্ছে। লীনা হাসি বন্ধ করার জন্যে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তার এই জাতীয় হাসাহাসির মূল কারণ হচ্ছে যখনই গ্রুপে কোনাে নতুন মেয়ে আসে, আজমল সবাইকে বলে বেড়ায় সে এই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে।
সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ লীনাকে নিয়ে রিকশা করে ফিরছে। জলিল সাহেব একটা পিকআপ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি লিফট দিতে চাইলেন। আসিফ রাজি হল না। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফেরার নাকি আলাদা একটা মজা আছে।
বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেছে। তবে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিজলি চমকাচ্ছে। ব্যাঙ ডাকছে। ঢাকা শহরে এখনাে ব্যাঙ আছে। এবং বৃষ্টি দেখলে এরা গলা ফুলিয়ে ডাকে—এটাই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। লীনা বলল, “ব্যাঙ ডাকছে, শুনছ?
শুনছি।
গ্রাম–গ্রাম লাগছে না?‘ ‘কিছুটা। | এত বড় শহর হয়েও ঢাকার মধ্যে গ্রাম ব্যাপারটা রয়েই গেল।”
‘হ্যা। আজিমপুরের কাছে যারা থাকে তারা শেয়ালের ডাকও শােনে। ঐদিকটায় এখনাে শেয়াল আছে।
খানাখন্দ ভরা রাস্তা। রিকশা খুব ঝাঁকুনি দিচ্ছে। আসিফ ডান হাত দিয়ে লীনাকে জড়িয়ে ধরল। লীনার গা একটু যেন কেঁপে উঠল। সে নিজে এতে খানিকটা অবাকও হল। এত দিন পরেও আসিফ তার গায়ে হাত রাখলে গা কেঁপে ওঠে। মনটা তরল ও দ্রবীভূত হয়ে যায়। কোখেকে যেন উড়ে আসে খানিকটা বিষন্নতা।
আসিফ বলল, ‘শীত লাগছে লীনা?”
পুষ্পের অভিনয় কেমন দেখলে?
‘ভালাে, খুব ভালাে। কল্পনা করা যায় না এমন ভালাে। ‘আসলেই তাই।
লীনা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘ও যে কেন এত ভালাে অভিনয় করছে তা কি তুমি জান?
আসিফ গম্ভীর গলায় বলল, ‘জানি।
বল তাে কেন?
ধাঁধা?
ধাঁধা। বলতে পারলে তােমার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।
কী পুরস্কার?
লীনা ইংরেজিতে বলল, ‘ঝড়–বৃষ্টির রাতে যে ধরনের পুরস্কারে পুরুষরা সবচে বেশি আনন্দিত হয় সেই পুরস্কার।
সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে সহজ গলায় বলল, ‘মেয়েটা খুব ভালাে অভিনয় করছে, কারণ সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। ধাঁধার জবাব কি ঠিক হয়েছে লীনা?
লীনা বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘হা ঠিক হয়েছে। ব্যাপারটা তুমি কখন টের পেলে?
প্রথম দিনেই টের পেলাম। অভিনয়ের এক পর্যায়ে তার হাত ধরতে হয়। হাত ধরেছি, হঠাৎ দেখি থরথর করে তার আঙুলগুলাে কাঁপছে।‘
‘ভয় থেকেও কাঁপতে পারে। নার্ভাসনেস থেকেও পারে।‘
‘তা পারে। তবে এতদিন হয়ে গেল অভিনয় করছে, এখনাে তার হাত ধরলে এরকম হয়।
লীনা চুপ করে রইল। আসিফ হেসে বলল, একই ব্যাপার কিন্তু তােমার বেলায়ও ঘটে। হাত ধরলে তুমিও কেঁপে ওঠ। ভূমি নিজে বােধ হয় তা জান না। নাকি জান?
লীনা গাঢ় স্বরে বলল, ‘জানি। আসিফ বলল, ‘পুষ্পের ব্যাপারে তােমার কি....
লীনা আসিফকে কথা শেষ করতে দিল না। কথার মাঝখানেই বলল, ‘আজিমপুরের দিকে সত্যি–সত্যি শেয়াল ডাকে নাকি? একদিন শেয়ালের ডাক শােনার জন্যে যেতে হয়। অনেকদিন শােনা হয় নি।
সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ
‘তুমি ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে আস, তারপর একদিন যাব।‘
আসিফ বাঁ হাতে লীনার হাত মুঠো করে ধরল। লীনার আঙুল কেঁপে উঠল। আসিফ লীনার দিকে না তাকিয়েই তরল গলায় হাসল।
পুষ্প থাকে পুরনাে ঢাকায়। | চানখাঁরপুল থেকে ভেতরের দিকে যেতে হয়। বিরাট দোতলা বাড়ি। উপরের তলা ভাড়া দেয়া। নিচের তলায় ভাগাভগি করে পুস্পরা থাকে এবং পুষ্পের বড়চাচা
থাকেন। পুষ্পের বাবা এবংবড়চাচা দু‘জনেই ওকালতি করেন। দু‘জনেরই পসার নেই। পুষ্পের বাবা এজাজুদ্দিন ওকালতি ছাড়াও হােমিওপ্যাথি করেন। হােমিওপ্যাথিতে তাঁর কিছুটা পসার আছে।
(চলবে)