সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

এইসব বুড়াবুড়ি মা বাবা নিয়ে বড় যন্ত্রণাকাজের কাজ কিছু করে না, অসুখ বাঁধিয়ে অন্য সবের কাজের ক্ষতি করেমজনুর খুবই মন খারাপ হলএর মধ্যেও যা একটু আনন্দের ব্যাপার তা হচ্ছে অনেকদিন পর লীনা আপা এসেছে

সাজঘরএকদম কোণার দিকের একটা চেয়ারে একাএকা বসে আছেস্টেজের উপরে আসিফ এবং পুষ্পআসিফ নিচু গলায় পুষ্পকে কি যেন বলছে, পুষ্প মন দিয়ে শুনছেলীনা আপা একদৃষ্টিতে দিকে তাকিয়ে আছে। 

মন লীনার সামনে এসে বলল, কেমন আছেন আফা?” 

ভালােতুই কেমন আছিস রে মজনু? জ্বি ভালাে। 

লীনা হাসিমুখে বলল, পুষ্প কেমন পার্ট করছে রে মজনু? তাের তাে আবার সব কিছুতে নম্বর দেয়াপুষ্প কত নম্বর?‘ 

তিন নম্বরে আছে আফাদু নম্বরে কে আছে? আজমল সাব?তাই নাকি

জ্বিকাজটা অনুচিত হইছে আফাআজমল সাবের মতাে লােকরে ছােড় একটা পাট দিছে। 

ছােট হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ রােলতার উপর ভর করেই তাে নাটক দাঁড়িয়ে আছে। 

কথা ঠিক। 

মজনুর বড় ভালাে লাগেলীনা আপা তার সাথে হেলাফেলা করে কথা বলে নাতার কথা শুনে অন্যদের মতাে হেসে ফেলে বলে নাযা ভাগকি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল কেন আজমল সাবের পার্ট এত ছােটজিনিস থাকলে ছােট পাট দিয়েও আসর মাত করা যায়। 

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

আজমল সাব যতক্ষণ স্টেজে থাকে ততক্ষণ শরীরের রক্ত গরম হয়ে থাকেমনে হয় কি শালার দুনিয়ালাথি মারি দুনিয়ায়। 

লীনা বলল, আজ আমাকে একটু চা দিস তাে মজনুচা খেতে ইচ্ছা করছে। 

আনতাছি আফাহুনলাম বিদেশ যাইতাছেন?ইডিয়া যাচ্ছি, দূরে কোথাও নাতুই কার কাছে শুনলি

বলাবলি করতেছিলকবে যাইতেছেন আফা? পরশুপরশু রাত টার ফ্লাইটে। তাের জন্যে কি কিছু আনতে হবে? না আফা‘ 

আনন্দে মজনুর চোখে প্রায় পানি এসেই যেত, যদি না প্রণব বাবু চেচিয়ে বলতেন, গাধা, চা কই? এক ঘন্টা আগে চা দিতে বলেছিমজনু চা আনতে গেলচা বানাতেবানাতেই শুনল সেকেণ্ড সিন হচ্ছেসে গভীর মনােযােগের সঙ্গে শুলছেপ্রতিটি ডায়লগ তার মুখস্থ।

অনেকেই যেমন গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গায়, মজনুও অভিনেতার সঙ্গেসঙ্গে অভিনয় করেতার বড় ভালাে লাগেএই মুহূর্তে সে কাছে লেখকের ভূমিকা। তার মনে হচ্ছে সে খুব ভালাে করছেমনটা তার খানিকটা খারাপও লাগছেএত চমৎকার অভিনয়, অথচ কেউ দেখতে পারছে নাঅন্তত এক জন যদি দেখত। 

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

মজনুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হলমােটর সাইকেল ভট ভট করতে করতে আজমল চলে এসেছেলাস্ট সিনটা আজ তাহলে হবেঘুম ভেঙে আজ সে কার মুখ দেখেছিল কে জানেবিউটি সেলুনের ছেলেটার মুখ বােধ হয়ছেলেটার মুখ দেখলে তার দিনটা খুব ভালাে যায়। 

আজমল লীনার পাশের চেয়ারে এসে বসেছেসে সিটি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপকতার বিশাল চেহারা, বিশাল গোঁফ দেখে ঠিক অনুমান করা যায়

বড়সড় চেহারার মানুষগুলাের গলার স্বর সাধারণত খুব কোমল হয়আজমলের বেলায় তা হয় নিসে কথা বললে হল কাঁপে। 

লীনা বলল, আপনার মার রীর এখন কেমন

আজমল বলল, ভালাে, মানে খুব না, খানিকটা ভালো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিহাঁটুতে কি একটা অপারেশন না কি হবে। 

কবে হবে? জানি না কবেবউ দৌড়াদৌড়ি করছে, সেজানে

স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে আজমল ভূ কুঞ্চিত করললীনা হাসি মুখে বলল, ভাবির সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে

এবার কী নিয়ে ঝগড়া করলেন? তার ধারণা আমি কোনাে কিছুই দেখি নাশুধু নাটক নিয়ে থাকি। 

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

ধারণা কি ভুল

অবশ্যই ভুলনিয়মিত ক্লাস করিপ্রাইভেট টিউশানি করি, প্রতিদিন সকালে বাজার করিএরচে বেশি কোন পুরুষটা কী করে? ঝগড়া করার জন্যে অজুহাত দরকার, এটা হচ্ছে একটা অজুহাতযে সিংহ ছাগল ছানার গল্পসিংহ বলল

ব্যাটা তুই জল ঘােলা করছিস কেন?...‘ 

লীনা বলল, আপনি মনে হচ্ছে ভাবির উপর খুব রেগেছেন। 

রাগব না? অফকোর্স রাগবভাবি, এটাই কি নতুন মেয়ে নাকি? বাহু, অভিনয় তাে খুব ভালাে করছেএকসেলেন্ট নাম কি

পুষ্পমনটা খারাপ হয়ে গেল তাবি‘কেন? 

এই মেয়েকে বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। টেলিভিশন ছোঁ মেরে নিয়ে নেবে, তারপর আসবে ফিরে পােকনআর তা যদি নাও আসে মেয়েটির অভিনয় দেখে কোনাে এক জন ছেলে তার প্রেমে পড়বেবিয়ে হয়ে যাবেবিয়ের পর ছেলে আর মেয়েটিকে অভিনয় করতে দেবে নামনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ভাবিখুবই খারাপমেয়েটার কী নাম বললেন?‘ 

আমি নিজেই তাে মনে হচ্ছে প্রেমে পড়ে যাচ্ছিমাই গড, দারুণ মেয়ে তাে। 

লীনা খিলখিল করে হেসে ফেললস্টেজ থেকে বিরক্ত চোখে আসিফ তাকাচ্ছেলীনা হাসি বন্ধ করার জন্যে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বারান্দায় চলে গেলতার এই জাতীয় হাসাহাসির মূল কারণ হচ্ছে যখনই গ্রুপে কোনাে নতুন মেয়ে আসে, আজমল সবাইকে বলে বেড়ায় সে এই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে। 

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ লীনাকে নিয়ে রিকশা করে ফিরছেজলিল সাহেব একটা পিকআপ নিয়ে এসেছিলেনতিনি লিফট দিতে চাইলেনআসিফ রাজি হল না। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফেরার নাকি আলাদা একটা মজা আছে। 

বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেছেতবে আকাশে মেঘের ঘনঘটাবিজলি চমকাচ্ছেব্যাঙ ডাকছেঢাকা শহরে এখনাে ব্যাঙ আছেএবং বৃষ্টি দেখলে এরা গলা ফুলিয়ে ডাকেএটাই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনালীনা বলল, “ব্যাঙ ডাকছে, শুনছ

শুনছি। 

গ্রামগ্রাম লাগছে না?কিছুটা| এত বড় শহর হয়েও ঢাকার মধ্যে গ্রাম ব্যাপারটা রয়েই গেল” 

হ্যা। আজিমপুরের কাছে যারা থাকে তারা শেয়ালের ডাকও শােনেঐদিকটায় এখনাে শেয়াল আছে। 

খানাখন্দ ভরা রাস্তারিকশা খুব ঝাঁকুনি দিচ্ছেআসিফ ডান হাত দিয়ে লীনাকে জড়িয়ে ধরললীনার গা একটু যেন কেঁপে উঠলসে নিজে এতে খানিকটা অবাকও হলএত দিন পরেও আসিফ তার গায়ে হাত রাখলে গা কেঁপে ওঠে। মনটা তরল দ্রবীভূত হয়ে যায়কোখেকে যেন উড়ে আসে খানিকটা বিষন্নতা। 

আসিফ বলল, শীত লাগছে লীনা?” 

পুষ্পের অভিনয় কেমন দেখলে

ভালাে, খুব ভালােকল্পনা করা যায় না এমন ভালাে‘আসলেই তাই। 

লীনা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, যে কেন এত ভালাে অভিনয় করছে তা কি তুমি জান

আসিফ গম্ভীর গলায় বলল, জানি। 

বল তাে কেন

ধাঁধা

 ধাঁধাবলতে পারলে তােমার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। 

কী পুরস্কার

লীনা ইংরেজিতে বলল, ঝড়বৃষ্টির রাতে যে ধরনের পুরস্কারে পুরুষরা সবচে বেশি আনন্দিত হয় সেই পুরস্কার। 

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে সহজ গলায় বলল, মেয়েটা খুব ভালাে অভিনয় করছে, কারণ সে আমার প্রেমে পড়ে গেছেধাঁধার জবাব কি ঠিক হয়েছে লীনা

লীনা বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘হা ঠিক হয়েছেব্যাপারটা তুমি কখন টের পেলে

প্রথম দিনেই টের পেলামঅভিনয়ের এক পর্যায়ে তার হাত ধরতে হয়হাত ধরেছি, হঠাৎ দেখি থরথর করে তার আঙুলগুলাে কাঁপছে‘ 

ভয় থেকেও কাঁপতে পারেনার্ভাসনেস থেকেও পারে‘ 

তা পারেতবে এতদিন হয়ে গেল অভিনয় করছে, এখনাে তার হাত ধরলে এরকম হয়। 

লীনা চুপ করে রইলআসিফ হেসে বলল, একই ব্যাপার কিন্তু তােমার বেলায়ও ঘটেহাত ধরলে তুমিও কেঁপে ওঠভূমি নিজে বােধ হয় তা জান নানাকি জান

লীনা গাঢ় স্বরে বলল, ‘জানি। আসিফ বলল, পুষ্পের ব্যাপারে তােমার কি...

লীনা আসিফকে কথা শেষ করতে দিল নাকথার মাঝখানেই বলল, আজিমপুরের দিকে সত্যিসত্যি শেয়াল ডাকে নাকি? একদিন শেয়ালের ডাক শােনার জন্যে যেতে হয়অনেকদিন শােনা হয় নি। 

সাজঘর (পর্ব-১৭): হুমায়ূন আহমেদ

তুমি ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে আস, তারপর একদিন যাব‘ 

আসিফ বাঁ হাতে লীনার হাত মুঠো করে ধরললীনার আঙুল কেঁপে উঠলআসিফ লীনার দিকে না তাকিয়েই তরল গলায় হাসল। 

পুষ্প থাকে পুরনাে ঢাকায়| চানখাঁরপুল থেকে ভেতরের দিকে যেতে হয়বিরাট দোতলা বাড়িউপরের তলা ভাড়া দেয়ানিচের তলায় ভাগাভগি করে পুস্পরা থাকে এবং পুষ্পের বড়চাচা 

থাকেন। পুষ্পের বাবা এবংবড়চাচা দুজনেই ওকালতি করেনদুজনেরই পসার নেইপুষ্পের বাবা এজাজুদ্দিন ওকালতি ছাড়াও হােমিওপ্যাথি করেনহােমিওপ্যাথিতে তাঁর কিছুটা পসার আছে

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-১৬): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *