গ্রুপ নাটকের কত সমস্যা, তার পরেও যে গ্রুপ নাটক টিকে আছে—কেন আছে? এই কারণেই আছে।
বিদায় নেবার সময় লীনা আপা তার দিকে তাকিয়ে এমন মিষ্টি করে হাসল, তবু তার অসম্ভব মন খারাপ হল। কারণটা খুব অদূত। বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। তারা সবাই বারান্দায়। জলিল ভাই বললেন, সবাইকে আমি গাড়িতে পৌছে দেব। দরকার হলে দু‘ট্রিপ দেব। নাে প্রবলেম। সবাই তাতে খুশি। আর আশ্চর্য, আসিফ ভাই বলল, ‘আমাদের পৌছে দিতে হবে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কিশায় করে যাওয়ার অন্যরকম আনন্দ আছে। কাজেই শুভ রাত্রি।
তারা সত্যি–সত্যি রাস্তায় নামল। আসিফ ভাই লীনা আপার হাত ধরে হাঁটছেন। বৃষ্টির মধ্যে দু‘জন নেমে যাচ্ছে।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটছে। কি অপূর্ব দৃশ্য! প্রথম কয়েক মুহূর্ত পুষ্পের মন আনন্দে পূর্ণ হল। তার পরপরই চোখে পানি এসে পড়ার মতাে কষ্ট হতে লাগল।
কেন তার কষ্ট হচ্ছে এটা সে জানে। কিন্তু তার বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে না। তার
কষ্টের কারণটা সে জানে, অথচ কাউকে সে বলতে পারবে না—এও একটা বিরাট কষ্ট। ভালাে এক জন বন্ধু যদি তার থাকত, তাহলে কি সে তাকে এটা বলতে পারত? না পারত না। কোনােদিন কাউকে এটা বলা যাবে না। চিরকাল গােপন রাখার মতো কিছু কিছু ঘটনা সব মানুষের জীবনেই হয়ত ঘটে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
বাইরের কেউ কোনােদিন তা জানতে পারে না। বড়চাচার মেয়ে মিতুরও একটা গােপন কথা আছে, যা সে কাউকে বলতে পারবে না। শুধু পুষ্পকে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, একটা গােপন কথা তােকে বলব। কাউকে না বলতে পারলে আমি মরে যাব।‘ পুষ্প বলল, ‘কী?‘
মিতু বলল, কিছু না, এম্নি ঠাট্টা করছি।‘ বলতে বলতে আবার কেঁদে অস্থির হল। মিতুর গােপন কথা পুষ্প জানে না। মিতু বলে নি। কাউকে হয়ত সে আর বলবে না। গােপন কথা গােপনই থেকে যাবে।
পুষ্প বাড়িতে ঢুকে শান্ত ভঙ্গিতে হাত–মুখ ধুয়ে মাকে গিয়ে বলল, ‘ভাত দাও মা। মমতা বললেন, ‘তাের কী হয়েছে রে? এমন লাগছে কেন?
ভীষণ মাথা ধরেছে। খেয়ে শুয়ে পড়ব। ‘তাের চাচীর ওখানে গিয়ে খেয়ে আয়। ভাল ছাড়া ঘরে আর কিছু খাবার নেই। ‘ডাল দিয়েই খাব। ও ঘরে এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না।
মমতা উঠে গিয়ে রান্নাঘরেই মেয়েকে ভাত বেড়ে দিলেন। পূষ্প বলল, তুমি খাবে না মা? মমতা বললেন, ‘বুকে অম্বলের ব্যথা উঠেছে, এক কাপ দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব। তােকে একটা ডিম ভেঙ্গে দেই।‘
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘দাও।‘ মমতা ডিম ভাজতে ভাজতে বললেন, ‘আজ এক কাণ্ড হয়েছে সন্ধ্যাবেলা একটা গাড়ি করে দু’তিন জন মহিলা এসে উপস্থিত। কাউকে চিনি না। বললাম কাকে চান? | ‘মােটামতাে একজন মহিলা বললেন, আমরা আপনার প্রতিবেশী, বেড়াতে এসেছি। আমার তখনি সন্দেহ হল।
প্রতিবেশী হলে গাড়ি করে আসবে কেন? কেমন অস্বস্তি—অস্বস্তি ভাব। হেন তেন নানান কথার পর ফস করে বলল, আপনার বন্ধু মেয়েটার কি বিয়ে দেবেন? চিন্তা কর অবস্থা। চিনি না জানি না এসেই বলে কি না—বড় মেয়ের বিয়ে দেবেন? পুষ্প বলল, তুমি কী বললে?‘
‘আমি আবার কী বলব? আমি বললাম, জ্বি না। মেয়ের বিয়ের কথা এখনাে ভাবছি না। ওমা, তার পরেও যায় না। বসেই আছে।
পুষ্প বলল, ‘চুপ কর তাে মা। শুনতে ভালাে লাগছে না।
‘আহা, আসল মজাটা তাে শুনলি না। খুব ফর্সা করে এক জন মহিলা আছেন, উনি বললেন—বিয়ের সম্পর্ক এলে মুখের উপর না বলতে নেই আপা। প্রপােজাল শুনুন, তারপর বলুন না৷
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘আমি বললাম, এম. এ পাশ করার আগে মেয়ের বাবা মেয়ের বিয়ে দেবে না।
ভদ্রমহিলা বললেন, এম, এ পাশ তাে বিয়ের পরেও করতে পারে। কী যে যন্ত্রণা। কিছুতেই যাবে না।‘
তারপর বিয়ে করলে কী ভাবে?
‘শেষ পর্যন্ত বললাম, আপা, আমাদের এক জায়গায় যাবার কথা আছে। তারপর উঠল।
পুষ্প বলল, ‘তােমার মজার কথা শেষ হয়েছে, না আরাে বাকি আছে?‘
‘আসলটাই তাে বলা হয় নি। ওরা চলে গেলে দেখি টেবিলের উপর চশমা পরা একটা ছেলের ছবি। ইচ্ছা করে ফেলে গেছে। মিতুর কাছে ছবিটা আছে। দেখতে চাইলে ওকে বল।‘
‘আমি কেন দেখতে চাইব?
‘আহা রেগে যাচ্ছিস কেন? দেখতে না চাইলে দেখবি না। নাটক থিয়েটার করতে পারিস, একটা ছেলের ছবি দেখলে তাের মান যাবে নাকি?
‘নাটক থিয়েটার আমি আর করব না। ‘কী বললি?
নাটক আমি আর করব না।‘ ‘হঠাৎ কী হল?
আমার ভালাে লাগছে না।
পুষ্প উঠে চলে গেল। সে রাতে মিতুর সঙ্গে শােয়। আজ নিশ্চয়ই দেশের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে। চিড়িয়াখানা দেখবে কিংবা চিকিৎসা করাবে। কারণ মিতুর বিছানায় অপরিচিত এক জন মহিলা ঘুমুচ্ছেন। মিতুও তার স্বভাব মতাে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। পুষ্প তার নিজের শােবার জায়গা খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হল না। ভেতরের দিকের বারান্দায় চলে গেল।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
রেলিং দেয়া বারান্দার এক কোণে একটা ইজিচেয়ার। পুর বাবা এই চেয়ারে বসে রােজ সকালে খবরের কাগজ পড়েন। রাতে চেয়ারটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ নেয়া হয় নি। পুষ্প চেয়ারে এসে বসল।
বৃষ্টি হচ্ছে না। ঝিঝি ডাকছে। ঝিঝি ডাকা মানে বাকি রাতটায় আর বৃষ্টি হবে না। আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদ উঠবে। চাঁদ উঠলে পুষ্পদের। বাড়ির ভেতরটা খুব সুন্দর দেখা যায়। ভেতরের উঠোনে দুটো প্রকাও কামিনী গাছ আছে। সেই গাছে চাঁদের আলাে পড়ে। বড়ই রহস্যময় লাগে।
পুষ্প চুপচাপ বসে আছে। বসে থাকতে থাকতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমৎকার একটা স্বপ্নও দেখল। এই স্বপ্নটি বড় মধুর ছিল, তবু সে ঘুমের মধ্যেই খুব কাঁদল।
খুব ভােরে লীনার ঘুম ভাঙল। এই ভােরগুলােকেই বােধ হয় কাকভাের বলে। তারস্বরে কাক ডাকছে। ঘরের ভেতর আঁধার ও আলাে। সেই আলাে–অন্ধকারে মিশে পৃথিবীটাকে অনারকম করে রেখেছে। শহরের ভােরে পাখির ডাক শােনা যায় না।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
কর্কশ কাক ডাকে। কাককে তাে আর কেউ পাখি ভাবে না।
আসিফ পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। একটা হাত মুখের উপর ফেলে রাখায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। লীনার একবার ইচ্ছা করল, আসিফকে ডেকে তােলে। এত আরাম করে সে ঘুমুচ্ছে যে ডাকতে ইচ্ছা করল না। লীনা দরজা খুলে বাইরে এল। রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে। বেনু তার বাচ্চার জন্যে দুধ গরম করছে। লীনা রান্নাঘরে ঢুকল। চায়ের পানি চড়াবে। অনেকদিন বেড–টি খাওয়া হয় না।
বেনু মুখ তুলে লীনাকে দেখল। কিছু বলল না। বেনুর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। লীনা বলল, বাচ্চা জেগে গেছে?
‘চা খাবে বেনু? আমি চা করছি।‘ ‘চা খাব না। আজ আপনি চলে যাবেন, তাই না?
‘মন খারাপ লাগে?
একটু লাগে। তােমারও কি মন খারাপ? কেমন যেন লাগছে। ঝগড়া–টগড়া হয়েছে?
বেনু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনটা খুব খারাপ। খুকির বাবা কাল রাতে আমাকে চড় দিয়েছে। নিজের বাবা–মা কোনােদিন আমার গায়ে হাত তুলে নাই।
আর ও কি না, ..।
বেনুর বাচ্চা কাঁদছে। সে দুধ নিয়ে চলে গেল। লীনাকে সুন্দর ভােরবেলায় অসুন্দর একটি ছবির মুখােমুখি হতে হল। বেচারা বেনু। আজ সারাদিন খুব মন খারাপ করে থাকবে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
আগামীকাল বা পরশুও এরকম যাবে। তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবে। স্বামীর সঙ্গে হাসবে, গল্প করবে। স্বামীর প্রয়ােজনে লাজুক ভঙ্গিতে রাউজের হুক খুলবে। তারপর আবার একদিন এ রকম একটা কাণ্ড ঘটবে। স্বামী চড় বসাবে কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে মেঝেতে।।
লীনা দুকাপ চা বানিয়ে শােবার ঘরে ঢুকল। আসিফ একটা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে নিয়েছে। বেচারার বােধ হয় শীত করছিল। ডেকে তুলে চা খেতে বলবে? না থাক, বেচারা ঘুমুক। যদিও ডেকে তুললেই ভালাে হত। আজ লীনা চলে যাবে। যাবার দিনটায় যত বেশি পারা যায় গল্প করা উচিত।
(চলবে)