সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

লীনা আসিফের পাশে বসে চা খাচ্ছে। চা খেতে খেতে হঠাৎ তার মনে হলতাদের দুজনের সম্পর্কে একটা অস্বাভাবিকতা আছেআসিফ কখনাে কোনাে কারণেই তার সঙ্গে রাগ করে নি

সাজঘরচড়া গলায় কথা বলে নিলীনা নিজে কোনাে মহামানবী নয়আসিফের রাগ করার মতাে এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক কিছুই সে করেছেঅথচ সে সব যেন আসিফকে স্পর্শ করে নিএর কারণটা কি? এও কি এক ধরনের অভিনয় নয়

একজন বড়াে মাপের অভিনেতা কি সব সময়ই অভিনয় করে না? এক জন দক্ষ, শুধু দক্ষ নয়অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেতা নিজেকে সব সময় দখলে রাখেনসারাক্ষণ অভিনয় করে যান। 

অভিনয় সব মানুষই করেযে স্ত্রীকে অসহ্য বােধ হয়, তার সঙ্গেও সে হাসি মুখে কথা বলেঅভিনেতা সেই জিনিসটাকেই অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যান। 

লীনা অস্বস্তি বােধ করছে। আসিফ সম্পর্কে রকম ধারণা তার শুধু আজ না, অনেকবারই হয়েছেবিয়ের দ্বিতীয় বছরে সন্দেহটা তার প্রথম হলসে লক্ষ করল ভালবাসাবাসির সময় আসিফ একেক সময় একেক রকম আচরণ করেযেন সে ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছে

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

একজন মানুষ ভিন্নভিন্ন পরিবেশে ভিন্নভিন্ন আচরণ করতে পারে, কিন্তু তার মূল সুরটি কিছুতেই কাটবে নামূল সুর অবশ্যই বজায় থাকবেআসিফের বেলায় তা থাকে নাপুরাে ব্যাপারটাই তার বেলায় বদলে যায়অভিনয় ছাড়া জিনিস সম্ভব নয়। 

লীনা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে একটা হাত আসিফের গায়ে রাখলমৃদু স্বরে ডাকল, এ্যাই‘ 

আসিফ সঙ্গেসঙ্গে জেগে উঠললীনা বলল, হাত মুখ ধুয়ে আস, চা গরম করে আনছি‘ 

আরেকটু ঘুমুতে ইচ্ছা করছে যেতাহলে ঘুমাও। 

লীনা আবার বারান্দায় চলে এলযদিও সে জানে, আসিফ ঘুমুবে না, উঠে আসবেসে ঠিক তাই রবে যা একজন আদর্শ স্বামীর করা উচিতএর বাইরে সে একচুলও যাবে না। 

আসিফ সত্যিসত্যি উঠে এলবাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে পাশে দাঁড়ালহাসিমুখে বলল, তাে মনে হচ্ছে একেবারে প্রত্যুষ লগ্ন। 

লীনা বলল, তুমি কি বেরুবে নাকি আজ

কোথায় যাবে

বৃটিশ কাউন্সিলে যাবএগারটার সময় একটা ছােটখাট ওয়ার্কসপের মতো হবেবৃটিশ এক জন মহিলা নাটকের বিশেষজ্ঞ এসেছেননাটক নিয়ে কথা বলবেন, শুনে আসিতুমি যাবে

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

না’ 

তােমার প্লেন তাে রাতেচল না যাইলীনা জবাব না দিয়ে চা আনতে গেল। 

পাশের ঘরে উঁচু গলায় হাশমত আলি চিৎকার করছে, তুই পেয়েছিস কী? তুই ভাবস কী? তুই কি ইয়ার্কি করস? তুই আমারে চিনস না

গ্রাম্য ভাষা, কুৎসিত ভঙ্গির চেচামেচিবেনুর গলা পাওয়া যাচ্ছে নাতবে সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেলীনা লক্ষ করল, আসিফ খুব আগ্রহ নিয়ে ঝগড়ার কথাবার্তা শােনার চেষ্টা করছেএই আগ্রহ আশােভনঅন্যদের কুৎসিত চেচামেচি সে এত আগ্রহ নিয়ে শুনবে কেন? লীনা রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না

তার মনে হলঝগড়াটা আসিফের শােনা উচিতএক জন অভিনেতাকে চারপাশ থেকে শিখতে হবেক্যারেক্টর এ্যানালাইসিস করতে হবেঝগড়ার সময় কোন পর্দায় চেচাবে, কোন ভঙ্গিতে কথা বলবে, মুখের কোন মাংসপেশী ফুলেফুলে উঠবে, ভুরু কোঁচকাবে কি 

কোঁচকাবে না, এসব লক্ষ না করতে পারলে বড় হবার পথ কোথায়

লীনা চা এনে দিলআসিফ চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির ভঙ্গি করললীনা বলল, ‘হাশমত সাহেবের চেঁচামেচি শুনতে কেমন লাগছে

ইন্টারেস্টিংএকটা জিনিস লক্ষ করলামঝগড়ার সময় বা প্রচণ্ড রাগের সময় মানুষের গলায় কোনাে রকম ভেরিয়েশন থাকে নাএক স্কেলে সে কথা বলে, এবং বলে অতি দ্রুতআমার ধারণা, তার কথা বলার স্পিড় তখন তিনগুণ বেড়ে যায়| সীনা ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি দয়া করে হাশমত সাহেবকে বল তাে চুপ করার জনেএই ভােরবেলায় উনি কী শুরু করেছেন? খুব খারাপ লাগছে। 

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ সঙ্গেসঙ্গে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে চলে গেলভারি এবং গম্ভীর গলায় ডাকল, হাশমত সাহেব, এই যে হাশমত সাহেব। 

জ্বি। 

একটু বাইরে আসুন তাে ভাই। 

আসুনআমার সঙ্গে একটা সিগারেট খান। 

হাশমত সাহেব বিরক্ত মুখে বের হয়ে এলেন, ঝাঁঝাল গলায় বললেন, অসহ্য, বুঝলেন ভাই। অসহ্য, কানের কাছে রাতদিন ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যানলাইফ হেল করে দিয়েছে‘ 

তাই বুঝি? আর বলেন কেন ভাইআমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। 

মাঝেমাঝে মাথায় রক্ত ওঠা ভালােএতে ব্রেইন পরিষ্কার থাকেবলতে বলতে আসিফ হাশমত সাহেবের কাঁধে হাত রেখে হাসললীনা দূর থেকে লক্ষ করল, এই হাসি শুধু হাসি নয়, এর মধ্যে অনেকখানি অভিনয় মিশে আছেএই হাসি দিয়েই আসিফ অনেক কিছু বলতে চাচ্ছেবুঝিয়ে দিচ্ছে সংসারে অবুঝ মেয়েরা থাকেতারা অনেক অন্যায় করেএইসব অন্যায় দেখতে হয় ক্ষমা প্রশ্রয়ের চোখে। 

সব কিছু ধরতে নেই। 

নিন হাশমত সাহেবএকটা সিগারেট ধরান, তারপর এই চমৎকার সকালটা একটু দেখুন। 

আর ভাই সকালরাতে ঘুমাতে দেয় নাইখালি ফ্যাচফ্যাচ। 

আসিফ আবার হাসলনিজেই সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছেভাবিকে ডেকে বলুন তো, আমাদের দুজনকে দুকাপ চা দিতেএরকম ভােরবেলায় রাগারাগি করা ঠিক হচ্ছে নারাগারাগিটা রাতের জনা মুলতবি থাকরাতে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করবেন‘ 

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

হাশমত আলি সত্যিসত্যি খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, বেনু, দেখি আমাদের চা দাও তােনােন বিসকিট কিছু আছে কিনা দেখআমার আবার খালি পেটে চা সয় হয় না‘ 

বেনু চোখ মুছে চা বানাতে গেল| আসিফ বলল, বুঝলেন হাশমত সাহেব, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি ভাের নিয়ে একটা কবিতা মনে করতেমনে করতে পারছি নাবাঙালি কবিরা ভাের নিয়ে বেশি 

কবিতা লেখেন নি বলে মনে হচ্ছে। 

লিখবে কোথেকে বলেন? কয়টা কবি ভােরবেলা ঘুম থেকে ওঠে? এরা রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত জাগে, ওঠে সকাল দশটার পর। 

আসিফ শব্দ করে হেসে উঠল। 

হাসি ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির চেয়েও সংক্রামকহাশমত আলিও হাসতে শুরু কলেনহাসতে হাসতে বললেন, ভােরের একটা কবিতা মনে পড়ছে রে ভাইভাের 

হল দোর খােল... হা হা হা‘ 

বেনু চা নিয়ে এসেছেহাশমত বলল, বেনু, আসিফ ভাইকে বলেছযে দিন ভাবি থাকবে না দুবেলা আমাদের সঙ্গে খাবেনা খেলে আমরা খুবই মাইন্ড করবভালাে করে বলে দাও।’ 

ভাইজান কি আমার কথা শুনব

অফকোর্স শুনবেআমরা থাকতে বাইরে খাবে, এটা কি কথাভাইসাবের উপলক্ষে ভালােমন্দ কিছু খাব। বেনু, জিরা বাটা দিয়ে তুমি যে গােশত রাঁধ, এইটা রাঁধবে মনে কর। 

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

আসিফের বড় ভালাে লাগছেকিছুক্ষণ আগে কী কুৎসিত চেঁচামেচি হচ্ছিলএখন কী চমৎকার করেই না দুজন কথা বলছেএরা দুজন ভােরের আনন্দ অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। 

লীনা কাপড় গােছাচ্ছেঠিক হয়েছে, আসিফ বৃটিশ কাউন্সিলে যাবার পথে লীনার মার বাড়িতে তাকে রেখে আসবে। 

লীনা বলল, তুমি আবার এয়ারপাের্ট উপস্থিত হয় না। কেন? 

তুমি একা থাকবে, আমি চলে যাব ভাবতেই খারাপ লাগছেশেষে কেঁদেটেদে ফেলবদুলাভাই এটা নিয়ে সারাজীবন ঠাট্টা করবেনকেউ তােমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার ভালাে লাগে না। 

আসিফ বলল, তােমার প্লেন তাে সেই রাতেসারাদিন তােমার মার বাসায় কী করবে? তার চেয়ে চল, বৃটিশ মহিলা কী বলেন শুনিঅনেক শেখার ব্যাপার থাকতে পারে‘ 

শেখার ব্যাপার থাকলে তুমি শেখআমার আর কিছু শিখতে ইচ্ছা করছে না। 

আসিফ ইতস্তত করে বলল, তােমার সঙ্গে টাকা-পয়সা বিশেষ কিছু দিতে পারলাম না

 কিছু মনে কর না লীনাযা দরকার লাগে, তুমি তােমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিও, আমি পরে ব্যবস্থা করব। 

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

লীনা বলল, সঙ্গে যা আছে, যথেষ্টই আছেনিয়ে তােমাকে ভাবতে হবে নাতােমার জন্য কী আনব বল‘ 

একটা কাজ করা পাঞ্জাবি আর জয়পুরী স্যান্ডেলআর কিছু

আর কিছু না‘নাটকের উপর বইপত্র যদি কিছু পাই, আনব না

অবশ্যই আনবেলীনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগলআসিফ বলল, হাসছ কেন? এম্নি হাসছিএটা যদি অভিনয়ের দৃশ্য হত, তাহলে বােধ হয় হাসাটা ঠিক হত তাই না

‘কী বলছ তুমি বুঝতে পারছি না‘ 

আমি নিজেও বুঝতে পারছি নাআজ ভাের থেকে মাথার মধ্যে শুধুআবােলতাবােল চিন্তা ঢুকছেদেশের বাইরে যাচ্ছি, সে জন্যেই বােধ হয়দেশেরবাইরে তাে কখনাে যাই নি। 

তােমার রীর ঠিক আছে তাে? শরীর ঠিক আছেতুমি কেন জানি আজ অতিরিক্ত রকমের গম্ভীর হয়ে আছকী ব্যাপার লীনা

লীনা বলল, একটু অপেক্ষা করব্যাগটা গুছিয়ে নিই, তারপর হাসি মুখে তােমার সঙ্গে গল্প করবতুমি চাইলে জানালা বন্ধ করে, দরজার পর্দা ফেলে ঘর একটু আঁধার করে নেবতারপর দুজনে মুখােমুখি, গভীর দুঃখে দুঃখী, আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব‘ 

আসিফ তাকিয়ে আছেলীনা হাসছে তরল ভঙ্গিতে

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-১৮): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *