লীনা আসিফের পাশে বসে চা খাচ্ছে। চা খেতে খেতে হঠাৎ তার মনে হল—তাদের দুজনের সম্পর্কে একটা অস্বাভাবিকতা আছে। আসিফ কখনাে কোনাে কারণেই তার সঙ্গে রাগ করে নি।
চড়া গলায় কথা বলে নি। লীনা নিজে কোনাে মহামানবী নয়। আসিফের রাগ করার মতাে এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক কিছুই সে করেছে। অথচ সে সব যেন আসিফকে স্পর্শ করে নি। এর কারণটা কি? এও কি এক ধরনের অভিনয় নয়?
একজন বড়াে মাপের অভিনেতা কি সব সময়ই অভিনয় করে না? এক জন দক্ষ, শুধু দক্ষ নয়–অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেতা নিজেকে সব সময় দখলে রাখেন। সারাক্ষণ অভিনয় করে যান।
অভিনয় সব মানুষই করে। যে স্ত্রীকে অসহ্য বােধ হয়, তার সঙ্গেও সে হাসি মুখে কথা বলে। অভিনেতা সেই জিনিসটাকেই অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যান।
লীনা অস্বস্তি বােধ করছে। আসিফ সম্পর্কে এ রকম ধারণা তার শুধু আজ না, অনেকবারই হয়েছে। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে সন্দেহটা তার প্রথম হল। সে লক্ষ করল ভালবাসাবাসির সময় আসিফ একেক সময় একেক রকম আচরণ করে। যেন সে ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছে।
সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ
একজন মানুষ ভিন্ন–ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন–ভিন্ন আচরণ করতে পারে, কিন্তু তার মূল সুরটি কিছুতেই কাটবে না। মূল সুর অবশ্যই বজায় থাকবে। আসিফের বেলায় তা থাকে না। পুরাে ব্যাপারটাই তার বেলায় বদলে যায়। অভিনয় ছাড়া এ জিনিস সম্ভব নয়।
লীনা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে একটা হাত আসিফের গায়ে রাখল। মৃদু স্বরে ডাকল, এ্যাই।‘
আসিফ সঙ্গে–সঙ্গে জেগে উঠল। লীনা বলল, হাত মুখ ধুয়ে আস, চা গরম করে আনছি।‘
‘আরেকটু ঘুমুতে ইচ্ছা করছে যে। ‘তাহলে ঘুমাও।
লীনা আবার বারান্দায় চলে এল। যদিও সে জানে, আসিফ ঘুমুবে না, উঠে আসবে। সে ঠিক তাই রবে যা একজন আদর্শ স্বামীর করা উচিত। এর বাইরে সে একচুলও যাবে না।
আসিফ সত্যি–সত্যি উঠে এল। বাথরুম থেকে হাত–মুখ ধুয়ে এসে পাশে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, ‘এ তাে মনে হচ্ছে একেবারে প্রত্যুষ লগ্ন।
লীনা বলল, তুমি কি বেরুবে নাকি আজ?
‘কোথায় যাবে?
‘বৃটিশ কাউন্সিলে যাব। এগারটার সময় একটা ছােটখাট ওয়ার্কসপের মতো হবে। বৃটিশ এক জন মহিলা নাটকের বিশেষজ্ঞ এসেছেন। নাটক নিয়ে কথা বলবেন, শুনে আসি। তুমি যাবে?
সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ
‘না’
তােমার প্লেন তাে রাতে। চল না যাই। লীনা জবাব না দিয়ে চা আনতে গেল।
পাশের ঘরে উঁচু গলায় হাশমত আলি চিৎকার করছে, ‘তুই পেয়েছিস কী? তুই ভাবস কী? তুই কি ইয়ার্কি করস? তুই আমারে চিনস না?
গ্রাম্য ভাষা, কুৎসিত ভঙ্গির চেচামেচি। বেনুর গলা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। লীনা লক্ষ করল, আসিফ খুব আগ্রহ নিয়ে ঝগড়ার কথাবার্তা শােনার চেষ্টা করছে। এই আগ্রহ আশােভন। অন্যদের কুৎসিত চেচামেচি সে এত আগ্রহ নিয়ে শুনবে কেন? লীনা রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না।
তার মনে হল—ঝগড়াটা আসিফের শােনা উচিত। এক জন অভিনেতাকে চারপাশ থেকে শিখতে হবে। ক্যারেক্টর এ্যানালাইসিস করতে হবে। ঝগড়ার সময় কোন পর্দায় চেচাবে, কোন ভঙ্গিতে কথা বলবে, মুখের কোন মাংসপেশী ফুলে–ফুলে উঠবে, ভুরু কোঁচকাবে কি
কোঁচকাবে না, এসব লক্ষ না করতে পারলে বড় হবার পথ কোথায়?
লীনা চা এনে দিল। আসিফ চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির ভঙ্গি করল। লীনা বলল, ‘হাশমত সাহেবের চেঁচামেচি শুনতে কেমন লাগছে?
ইন্টারেস্টিং। একটা জিনিস লক্ষ করলাম—ঝগড়ার সময় বা প্রচণ্ড রাগের সময় মানুষের গলায় কোনাে রকম ভেরিয়েশন থাকে না। এক স্কেলে সে কথা বলে, এবং বলে অতি দ্রুত। আমার ধারণা, তার কথা বলার স্পিড় তখন তিনগুণ বেড়ে যায়। | সীনা ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তুমি দয়া করে হাশমত সাহেবকে বল তাে চুপ করার জনে। এই ভােরবেলায় উনি কী শুরু করেছেন? খুব খারাপ লাগছে।
সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ সঙ্গে–সঙ্গে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে চলে গেল। ভারি এবং গম্ভীর গলায় ডাকল, “হাশমত সাহেব, এই যে হাশমত সাহেব।
‘জ্বি।
একটু বাইরে আসুন তাে ভাই।
‘আসুন। আমার সঙ্গে একটা সিগারেট খান।
হাশমত সাহেব বিরক্ত মুখে বের হয়ে এলেন, ঝাঁঝাল গলায় বললেন, ‘অসহ্য, বুঝলেন ভাই। অসহ্য, কানের কাছে রাতদিন ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যান। লাইফ হেল করে দিয়েছে।‘
‘তাই বুঝি? ‘আর বলেন কেন ভাই। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে।
‘মাঝে–মাঝে মাথায় রক্ত ওঠা ভালাে। এতে ব্রেইন পরিষ্কার থাকে। বলতে বলতে আসিফ হাশমত সাহেবের কাঁধে হাত রেখে হাসল। লীনা দূর থেকে লক্ষ করল, এই হাসি শুধু হাসি নয়, এর মধ্যে অনেকখানি অভিনয় মিশে আছে। এই হাসি দিয়েই আসিফ অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে সংসারে অবুঝ মেয়েরা থাকে। তারা অনেক অন্যায় করে। এইসব অন্যায় দেখতে হয় ক্ষমা ও প্রশ্রয়ের চোখে।
সব কিছু ধরতে নেই।
‘নিন হাশমত সাহেব। একটা সিগারেট ধরান, তারপর এই চমৎকার সকালটা একটু দেখুন।
আর ভাই সকাল। রাতে ঘুমাতে দেয় নাই। খালি ফ্যাচফ্যাচ।
আসিফ আবার হাসল। নিজেই সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। ভাবিকে ডেকে বলুন তো, আমাদের দুজনকে দুকাপ চা দিতে। এরকম ভােরবেলায় রাগারাগি করা ঠিক হচ্ছে না। রাগারাগিটা রাতের জনা মুলতবি থাক। রাতে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করবেন।‘
সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ
হাশমত আলি সত্যি–সত্যি খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘ও বেনু, দেখি আমাদের চা দাও তাে। নােন বিসকিট কিছু আছে কিনা দেখ। আমার আবার খালি পেটে চা সয় হয় না।‘
বেনু চোখ মুছে চা বানাতে গেল। | আসিফ বলল, ‘বুঝলেন হাশমত সাহেব, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি ভাের নিয়ে একটা কবিতা মনে করতে। মনে করতে পারছি না। বাঙালি কবিরা ভাের নিয়ে বেশি
কবিতা লেখেন নি বলে মনে হচ্ছে।
‘লিখবে কোথেকে বলেন? কয়টা কবি ভােরবেলা ঘুম থেকে ওঠে? এরা রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত জাগে, ওঠে সকাল দশটার পর।
আসিফ শব্দ করে হেসে উঠল।
হাসি ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির চেয়েও সংক্রামক। হাশমত আলিও হাসতে শুরু কলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “ভােরের একটা কবিতা মনে পড়ছে রে ভাইভাের
হল দোর খােল... হা হা হা।‘
বেনু চা নিয়ে এসেছে। হাশমত বলল, বেনু, আসিফ ভাইকে বলেছ—যে ক‘দিন ভাবি থাকবে না দু’বেলা আমাদের সঙ্গে খাবে। না খেলে আমরা খুবই মাইন্ড করব। ভালাে করে বলে দাও।’
‘ভাইজান কি আমার কথা শুনব?
‘অফকোর্স শুনবে। আমরা থাকতে বাইরে খাবে, এটা কি কথা। ভাইসাবের উপলক্ষে ভালাে–মন্দ কিছু খাব। বেনু, জিরা বাটা দিয়ে তুমি যে গােশত রাঁধ, এইটা রাঁধবে মনে কর।
সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফের বড় ভালাে লাগছে। কিছুক্ষণ আগে কী কুৎসিত চেঁচামেচি হচ্ছিল। এখন কী চমৎকার করেই না দু‘জন কথা বলছে। এরা দু‘জন ভােরের আনন্দ অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
লীনা কাপড় গােছাচ্ছে। ঠিক হয়েছে, আসিফ বৃটিশ কাউন্সিলে যাবার পথে লীনার মার বাড়িতে তাকে রেখে আসবে।
লীনা বলল, তুমি আবার এয়ারপাের্ট উপস্থিত হয় না। কেন?
‘তুমি একা থাকবে, আমি চলে যাব ভাবতেই খারাপ লাগছে। শেষে কেঁদে–টেদে ফেলব। দুলাভাই এটা নিয়ে সারাজীবন ঠাট্টা করবেন। কেউ তােমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার ভালাে লাগে না।
আসিফ বলল, তােমার প্লেন তাে সেই রাতে। সারাদিন তােমার মার বাসায় কী করবে? তার চেয়ে চল, ঐ বৃটিশ মহিলা কী বলেন শুনি। অনেক শেখার ব্যাপার থাকতে পারে।‘
‘শেখার ব্যাপার থাকলে তুমি শেখ। আমার আর কিছু শিখতে ইচ্ছা করছে না।
আসিফ ইতস্তত করে বলল, তােমার সঙ্গে টাকা-পয়সা বিশেষ কিছু দিতে পারলাম না।
কিছু মনে কর না লীনা। যা দরকার লাগে, তুমি তােমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিও, আমি পরে ব্যবস্থা করব।
সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বলল, ‘সঙ্গে যা আছে, যথেষ্টই আছে। ঐ নিয়ে তােমাকে ভাবতে হবে না। তােমার জন্য কী আনব বল।‘
‘একটা কাজ করা পাঞ্জাবি আর জয়পুরী স্যান্ডেল। ‘আর কিছু?
আর কিছু না। ‘নাটকের উপর বইপত্র যদি কিছু পাই, আনব না?
অবশ্যই আনবে। লীনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। আসিফ বলল, ‘হাসছ কেন? ‘এম্নি হাসছি। এটা যদি অভিনয়ের দৃশ্য হত, তাহলে বােধ হয় হাসাটা ঠিক হত । তাই না?
‘কী বলছ তুমি বুঝতে পারছি না।‘
‘আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আজ ভাের থেকে মাথার মধ্যে শুধু। আবােল–তাবােল চিন্তা ঢুকছে। দেশের বাইরে যাচ্ছি, সে জন্যেই বােধ হয়। দেশের। বাইরে তাে কখনাে যাই নি।
তােমার শরীর ঠিক আছে তাে? শরীর ঠিক আছে। তুমি কেন জানি আজ অতিরিক্ত রকমের গম্ভীর হয়ে আছ। কী ব্যাপার লীনা?
লীনা বলল, একটু অপেক্ষা কর। ব্যাগটা গুছিয়ে নিই, তারপর হাসি মুখে তােমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি চাইলে জানালা বন্ধ করে, দরজার পর্দা ফেলে ঘর একটু আঁধার করে নেব। তারপর দু‘জনে মুখােমুখি, গভীর দুঃখে দুঃখী, আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব।‘
আসিফ তাকিয়ে আছে। লীনা হাসছে তরল ভঙ্গিতে।
(চলবে)