কেরােসিনের চুলায় জাখাে সাইজের এক কেতলি। মজনু পাশে বসে আছে—একটু পর–পর কেতলির মুখ তুলে পানি ফুটছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছে। তার হিসেব মতাে ইতােমধ্যে পানি ফুটে যাওয়া উচিত।
অথচ ফুটছে না। ব্যাপারটা কি?
মজনুর বয়স তের–চৌদ্দ কিন্তু দেখায় অনেক বেশি। তার মুখ চিমসে গিয়েছে, গালের হাড় উঁচু, মাথার চুল জায়গায় জায়গায় পড়ে গেছে। উপরের পাটির দুটি দাঁত ভাঙা ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচ করে থুথু ফেলা ছাড়া তার মধ্যে আর কোনাে ছেলেমানুষী নেই।
মজনু পূর্ব নাট্যদলের’ টি বয়। এদের সঙ্গে সে গত তিন বছর ধরে লেগে আছে। তার কাজ হচ্ছে রিহার্সেল চলাকালীন সময়ে এক শ থেকে দেড় শ‘ কাপ চা বানানাে। এর বিনিময়ে মাসে সে নরুই টাকা করে পায় এবং রিহার্সেলের এই ঘরে রাতে ঘুমুতে পারে। এমন কোনাে লােভনীয় চাকরি নয়। প্রতি সপ্তাহে মজনু একবার করে ভাবে চাকরি ছেড়ে দেবে। ছাড়তে পারে না। তার নেশা ধরে গেছে। রিহার্সেল না শুনলে তার ভালাে ঘুম হয় না। বৃহস্পতি এবং শুক্র এই দু‘দিন রিহার্সেল হয় না। মজনুর খুব অস্থির লাগে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার এই কথা ভেবে এখন থেকেই মজনুর মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ হলে সে কিছুক্ষণ পর পর দাঁতের ফাঁক দিয়ে খুথু ফেলে।
খনাে ফেলছে এবং আড়ে আড়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কেউ দেখে ফেললে কপালে যন্ত্রণা আছে। তার থুথু ফেলা কেউ সহ্য করে না।
প্রণব বাবু দরজা দিয়ে ঢুকলেন। মজনু অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়ল। প্রণব বাবুকে সে দু’চোখে দেখতে পারে না। তার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে মনে মনে বলে, ‘হারামজাদা মালাউন।
‘মজনু। মজনু জবাব দিল না। তাকালও না।
‘মজনু, জল ফুটল নাকি রে?
চুলায় আগুন আছে নাকি দেখতাে, তুই দেখি রাত বারটা বাজাবি।
মজনু প্রণব বাবুর উল্টোদিকে মুখ নিয়ে খুব সাবধানে একদলা থুথু ফেলে মনে মনে বলল, ‘হারামজাদা কুত্তা।
এই দলের দু’জন লােককে মজনু সহা করতে পারে না। এক জন প্রণব বাবু অন্যজন জলিল সাহেব। অথচ এই দু’জনই নিতান্ত ভালােমানুষ। বিভিন্ন উপলক্ষে মজনুকে টাকা–পয়সা দেন।
প্রণব বাবু পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বের করে মজনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মধুর স্বরে বললেন, ‘পাঁচটা ফাইভ–ফাইভ নিয়ে আয়। বিদেশি। যাবি আর আসবি।
মজনু বেরিয়ে গেল। বিদেশি সিগারেট আনতে তার খুব আগ্রহ। দেশিটাই সে। কেনে, কেউ ধরতে পারে না। সব বেকুবের দল। অথচ তারা নিজেরা তা জানে না। পৃথিবীতে বােকার সংখ্যা এত বেশি কেন এই জিনিসটা নিয়ে প্রায়ই মজনু ভাবে।
রিহার্সেল হয় পুরানা পল্টনের জনতা পাবলিক লাইব্রেরির হল ঘরে। দুটো চৌকি একত্র করে একটা স্টেজ তৈরি করা আছে। এই পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা পূর্বা নাট্যদলের সঙ্গে জড়িত বলে এখানে রিহার্সেলের সুযােগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে বেশিদিন পাওয়া যাবে না। হল ঘরটা লাইব্রেরির রিডিংরুম হয়ে যাবে।
হল ঘরে নাটকের পাত্র–পাত্রীরা উপস্থিত হচ্ছে। মহড়া শুরু হতে দেরি হচ্ছে; কারণ আসিফ এখনাে এসে উপস্থিত হয় নি। আসিফের স্ত্রী লীনা অনেকক্ষণ হল এসেছে। অন্য কোনাে মেয়ে এখনাে উপস্থিত হয় নি।
লীনার বয়স পঁচিশ–ছাবিশ। তাকে কখনাে সে রকম মনে হয় না। হালকা পাতলা গড়নের জন্যে আঠারাে উনিশ বছরের তরুণীর মতাে মনে হয়। লীনার মুখটি স্নিগ্ধ। তবে আজ তাকে কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছে। মিজান বসেছে লীনার পাশে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাবি আপনার শরীরটা কি খারাপ?
লীনা জবাব না দিয়ে হাসল। যে হাসির মানে হচ্ছে—শরীর ভালােই আছে। মিজান বলল, ‘আসিফ ভাই দেরি করছেন কেন জানেন?
জানি।
লীনা আবার হাসল। তার হাসি রােগ আছে। যে কোনাে কথা বলবার আগে একটু হলেও হাসে। এবং কথা কখনাে পুরােপুরি বলে না।।
মিজান বিরক্ত হয়ে বলল, জানলে বলুন। আপনি অর্ধেক কথা বলেন, অর্ধেক পেটে রেখে দেন, বড় বিরক্ত লাগে।
লীনা বলল, ও তার বােনের বাসায় যাবে। ওর ভাগ্নির শরীর খারাপ। ওখানেই মনে হয় দেরি হচ্ছে। মিজান ক্রু কুঁচকে বলল, কোনােদিন টাইমলি রিহার্সেল শুরু করতে পারি না। কোনাে মানে হয়? | লীনার বেশ মজা লাগছে। মিজানের কথা বলার ভঙ্গিটাই মজার। এমন ভাবে সে। কথা বলে যেন পুরাে নাটকের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। অথচ সে এই বছরেই মাত্র গ্রুপে জয়েন করেছে। নাটকে এখনাে কোনাে রােল পায় নি। পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। মিজানের গলাটা মেয়েলি। তবে এ নিয়ে তার কোনাে ক্ষোভ নেই। সে যে লেগে
থাকতে পারছে এতেই সে খুশি।
| মিজানদের থেকে একটু দূরে জলিল সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে নিচু গলায় আড়া দিচ্ছেন। আচ্ছা ঠিক না। কথা বলছেন জলিল সাহেব একাই। অন্যরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। আদিরসের গল্প। জলিল সাহেব আদিরস বিষয়ক রসিকতা অতি চমৎকার করেন। তবে সব সময় করেন না। এমন সময় করেন যখন আশেপাশে মেয়েরা কেউ থাকে। আজ লীনা কাছেই আছে।
জলিল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘গল্পটা হচ্ছে একটা ভীমরুল নিয়ে। ভীমরুল হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। ভীমরুল হুল ফোটালে কী হয় জান তাে? ফুলে বিশাল হয়ে যায়। এখন চিন্তা কর, এক জন লােকের একটা বিশেষ জায়গায় যদি ভীমরুল হুল ফোটায় তাহলে ?
জলিল সাহেবের কথা শেষ হল না, তার আগেই একেকজন হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে।
লীনা বলল, “মিজান, ওরা হাসাহাসি করছে কী নিয়ে জান? মিজান বলল, ‘জলিল সাহেব আজেবাজে গল্প বলেন, ঐ নিয়ে হাসাহাসি হয়। ‘আজেবাজে গল্প মানে কী রকম গল্প? ‘বাদ দেন তাে ভাবি।
জলিল সাহেবের গল্প আরাে খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। আবার সবাই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। ঘরের ভেতর খুব গরম লাগছে। লীনা বারান্দায় চলে এল। বারান্দা থেকেই দেখল মেয়েরা সব চলে এসেছে। মেয়েদের আনার জন্যে একটা গাড়ি যায়। নতুন মেয়েটির আজ আসার কথা, সে এসেছে কিনা কে জানে।
মজনু চা বানাচ্ছে। প্রথম কাপটা সে লীনার দিকে বাড়িয়ে দিল। লীনা বলল, চা খাব না রে। গরম লাগছে? ‘ঠাণ্ডা কিছু আইনা দিমু?
‘আফনের শইলডা কি খারাপ আফা?”
না শরীর খারাপ না।