সাজঘর (পর্ব-১): হুমায়ূন আহমেদ

কেরােসিনের চুলায় জাখাে সাইজের এক কেতলিমজনু পাশে বসে আছেএকটু পরপর কেতলির মুখ তুলে পানি ফুটছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছেতার হিসেব মতাে ইতােমধ্যে পানি ফুটে যাওয়া উচিতসাজঘর

অথচ ফুটছে নাব্যাপারটা কি

মজনুর বয়স তেরচৌদ্দ কিন্তু দেখায় অনেক বেশিতার মুখ চিমসে গিয়েছে, গালের হাড় উঁচু, মাথার চুল জায়গায় জায়গায় পড়ে গেছেউপরের পাটির দুটি দাঁত ভাঙা ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচ করে থুথু ফেলা ছাড়া তার মধ্যে আর কোনাে ছেলেমানুষী নেই। 

মজনু পূর্ব নাট্যদলেরটি বয়এদের সঙ্গে সে গত তিন বছর ধরে লেগে আছেতার কাজ হচ্ছে রিহার্সেল চলাকালীন সময়ে এক থেকে দেড় কাপ চা বানানােএর বিনিময়ে মাসে সে নরুই টাকা করে পায় এবং রিহার্সেলের এই ঘরে রাতে ঘুমুতে পারেএমন কোনাে লােভনীয় চাকরি নয়প্রতি সপ্তাহে মজনু একবার করে ভাবে চাকরি ছেড়ে দেবেছাড়তে পারে নাতার নেশা ধরে গেছেরিহার্সেল না শুনলে তার ভালাে ঘুম হয় নাবৃহস্পতি এবং শুক্র এই দুদিন রিহার্সেল হয় নামজনুর খুব অস্থির লাগেআগামীকাল বৃহস্পতিবার এই কথা ভেবে এখন থেকেই মজনুর মেজাজ খারাপমেজাজ খারাপ হলে সে কিছুক্ষণ পর পর দাঁতের ফাঁক দিয়ে খুথু ফেলে। 

খনাে ফেলছে এবং আড়ে আড়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছেকেউ দেখে ফেললে কপালে যন্ত্রণা আছেতার থুথু ফেলা কেউ সহ্য করে না। 

প্রণব বাবু দরজা দিয়ে ঢুকলেনমজনু অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়লপ্রণব বাবুকে সে দুচোখে দেখতে পারে নাতার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে মনে মনে বলে, হারামজাদা মালাউন। 

মজনুমজনু জবাব দিল নাতাকালও না। 

মজনু, জল ফুটল নাকি রে

চুলায় আগুন আছে নাকি দেখতাে, তুই দেখি রাত বারটা বাজাবি। 

মজনু প্রণব বাবুর উল্টোদিকে মুখ নিয়ে খুব সাবধানে একদলা থুথু ফেলে মনে মনে বলল, হারামজাদা কুত্তা। 

এই দলের দুজন লােককে মজনু সহা করতে পারে নাএক জন প্রণব বাবু অন্যজন জলিল সাহেবঅথচ এই দুজনই নিতান্ত ভালােমানুষবিভিন্ন উপলক্ষে মজনুকে টাকাপয়সা দেন। 

প্রণব বাবু পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বের করে মজনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেনমধুর স্বরে বললেন, পাঁচটা ফাইভফাইভ নিয়ে আয়বিদেশিযাবি আর আসবি। 

মজনু বেরিয়ে গেলবিদেশি সিগারেট আনতে তার খুব আগ্রহদেশিটাই সেকেনে, কেউ ধরতে পারে নাসব বেকুবের দলঅথচ তারা নিজেরা তা জানে নাপৃথিবীতে বােকার সংখ্যা এত বেশি কেন এই জিনিসটা নিয়ে প্রায়ই মজনু ভাবে। 

রিহার্সেল হয় পুরানা পল্টনের জনতা পাবলিক লাইব্রেরির হল ঘরেদুটো চৌকি একত্র করে একটা স্টেজ তৈরি করা আছেএই পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা পূর্বা নাট্যদলের সঙ্গে জড়িত বলে এখানে রিহার্সেলের সুযােগ পাওয়া যাচ্ছেতবে বেশিদিন পাওয়া যাবে নাহল ঘরটা লাইব্রেরির রিডিংরুম হয়ে যাবে। 

হল ঘরে নাটকের পাত্রপাত্রীরা উপস্থিত হচ্ছেমহড়া শুরু হতে দেরি হচ্ছে; কারণ আসিফ এখনাে এসে উপস্থিত হয় নিআসিফের স্ত্রী লীনা অনেকক্ষণ হল এসেছেঅন্য কোনাে মেয়ে এখনাে উপস্থিত হয় নি। 

লীনার বয়স পঁচিশছাবিশতাকে কখনাে সে রকম মনে হয় নাহালকা পাতলা গড়নের জন্যে আঠারাে উনিশ বছরের তরুণীর মতাে মনে হয়লীনার মুখটি স্নিগ্ধতবে আজ তাকে কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছেমিজান বসেছে লীনার পাশেসে জিজ্ঞেস করল, ভাবি আপনার শরীরটা কি খারাপ

লীনা জবাব না দিয়ে হাসলযে হাসির মানে হচ্ছেশরীর ভালােই আছেমিজান বলল, আসিফ ভাই দেরি করছেন কেন জানেন

জানি। 

লীনা আবার হাসলতার হাসি রােগ আছেযে কোনাে কথা বলবার আগে একটু হলেও হাসেএবং কথা কখনাে পুরােপুরি বলে না। 

মিজান বিরক্ত হয়ে বলল, জানলে বলুনআপনি অর্ধেক কথা বলেন, অর্ধেক পেটে রেখে দেন, বড় বিরক্ত লাগে। 

লীনা বলল, তার বােনের বাসায় যাবেওর ভাগ্নির শরীর খারাপওখানেই মনে হয় দেরি হচ্ছেমিজান ক্রু কুঁচকে বলল, কোনােদিন টাইমলি রিহার্সেল শুরু করতে পারি নাকোনাে মানে হয়? | লীনার বেশ মজা লাগছেমিজানের কথা বলার ভঙ্গিটাই মজারএমন ভাবে সেকথা বলে যেন পুরাে নাটকের দায়িত্ব তার ঘাড়েঅথচ সে এই বছরেই মাত্র গ্রুপে জয়েন করেছেনাটকে এখনাে কোনাে রােল পায় নিপাওয়ার সম্ভাবনাও কমমিজানের গলাটা মেয়েলিতবে নিয়ে তার কোনাে ক্ষোভ নেইসে যে লেগে 

থাকতে পারছে এতেই সে খুশি। 

| মিজানদের থেকে একটু দূরে জলিল সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে নিচু গলায় আড়া দিচ্ছেন। আচ্ছা ঠিক নাকথা বলছেন জলিল সাহেব একাইঅন্যরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছেআদিরসের গল্পজলিল সাহেব আদিরস বিষয়ক রসিকতা অতি চমৎকার করেনতবে সব সময় করেন নাএমন সময় করেন যখন আশেপাশে মেয়েরা কেউ থাকেআজ লীনা কাছেই আছে। 

জলিল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, গল্পটা হচ্ছে একটা ভীমরুল নিয়েভীমরুল হুল ফুটিয়ে দিয়েছেভীমরুল হুল ফোটালে কী হয় জান তাে? ফুলে বিশাল হয়ে যায়এখন চিন্তা কর, এক জন লােকের একটা বিশেষ জায়গায় যদি ভীমরুল হুল ফোটায় তাহলে

জলিল সাহেবের কথা শেষ হল না, তার আগেই একেকজন হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। 

লীনা বলল, মিজান, ওরা হাসাহাসি করছে কী নিয়ে জান? মিজান বলল, জলিল সাহেব আজেবাজে গল্প বলেন, নিয়ে হাসাহাসি হয়আজেবাজে গল্প মানে কী রকম গল্প? বাদ দেন তাে ভাবি। 

জলিল সাহেবের গল্প আরাে খানিকটা অগ্রসর হয়েছেআবার সবাই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছেঘরের ভেতর খুব গরম লাগছেলীনা বারান্দায় চলে এলবারান্দা থেকেই দেখল মেয়েরা সব চলে এসেছেমেয়েদের আনার জন্যে একটা গাড়ি যায়নতুন মেয়েটির আজ আসার কথা, সে এসেছে কিনা কে জানে। 

মজনু চা বানাচ্ছেপ্রথম কাপটা সে লীনার দিকে বাড়িয়ে দিললীনা বলল, চা খাব না রেগরম লাগছে? ঠাণ্ডা কিছু আইনা দিমু

আফনের শইলডা কি খারাপ আফা?” 

না শরীর খারাপ না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *