সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

বৃটিশ মহিলার বক্তৃতা আসিফের মােটেই ভালাে লাগল নাপ্রথমত কথা বােঝা যাচ্ছে মনে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ তিনি খানিকক্ষণ চিবিয়ে ছােবড়া বানিয়ে বলছেন

সাজঘরযা বলছেন, তার সঙ্গে অভিনয়ের যােগ তেমন নেই বলেই আসিফের ধারণাভদ্রমহিলা বলছেন স্টেজের ব্যাকগ্রাউডের আলাে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিকের সমন্বয় বিষয়েসবটাই মনে হচ্ছে কচকচানি থিওরিসিমিটি রেখে কী করে সিমিট্রি ভাঙতে হবে, এই সব বিষয়ডায়নামিক ড্রামা এবং স্ট্যাটিক ড্রামার সঙ্গে আলাে এবং শব্দের সম্পর্কএক পর্যায়ে ভদ্রমহিলা ব্ল্যাকবাের্ডে হাবিজাবি ইকোয়েশন লিখতে শুরু করলেন। 

আসিফের পাশে লিটল ঢাকা গ্রুপের মন্তাজ সাহেব বসেছিলেনতিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে বললেন, এই হারামজাদী তাে মনে হচ্ছে বিরাট ফাজিলএ 

তাে দেখি অঙ্ক করছে। 

আসিফের কাছেও সমস্ত ব্যাপারটা বােগাস বলেই মনে হচ্ছেউঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছেসে বসেছে মাঝামাঝি জায়গায়, এখান থেকে চলে যাওয়া মুশকিল। এক জন উঠে দাঁড়িয়েছিল, ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে গলায় বললেন, আমি কি আমার কথায় আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারছি না? কথায় না পারলেও রূপে তাে আপনাকে আটকে ফেলার কথা। আমি কি যথেষ্ট রূপবতী নই?” 

সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

চারদিকে তুমুল হাসির মধ্যে ভদ্রলোেককে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে পড়তে হল। এ রকম অবস্থায় হলঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে নাভদ্রমহিলার বক্তৃতার প্রথম 

পর্ব শেষ হল এক ঘন্টা পরআসিফের কাছে মনে হল, সে অনন্তকাল ধরে এই চেয়ারে বসে আছেবক্তৃতার দ্বিতীয় পর্ব শােনার মতাে মনের জোর পাচ্ছে না। 

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় পর্ব হল অসাধারণভদ্র মহিলা কিছু ছবি বানিয়ে নিয়ে এসেছেনঅভিনয় অংশ প্রতিটিতেই একহুবহু এক, কিন্তু আলাে এবং শব্দের মিশ্রণ একেকটা একেক রকমশুধু এই কারণে কেমন বদলে যাচ্ছে অর্থ 

অন্যরকম হয়ে যাচ্ছেএই ব্যাপারটা ছবি দেখাতে দেখাতে ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করছেন 

দেখুন, নাটক রু হয় গীর্জায়ধর্মযাজকরা গীর্জায় নাটকের মাধ্যমে লােকদের ধর্ম শিক্ষা দিতেনতার মানে এই নয় যে, নাটক ব্যাপারটায় ঐশ্বরিক কিছু আছেকিছুই নেইনাটকের মাধ্যমে আমরা মানুষের মনে আবেগ তৈরি করিনাটকের গবেষকরা এখন কাজ করছেন আবেগ তৈরির মেকানিজম নিয়েনাটক তার রহস্যময়তা হারাতে বসেছেএখন আমরা আবেগের ব্যাপারটা বিজ্ঞানের চোখে দেখতে শুরু করেছিবিজ্ঞানের কাছে হৃদয় কিন্তু একটা রক্ত পাম্প করার যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়‘ 

আসিফ মুগ্ধ হয়ে গেলবারবার মনে হল, লীনা পাশে থাকলে চমৎকার হতএকটা চমৎকার জিনিস বেচারি মিসকরলআসিফের খুব ইচ্ছা করছিল ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেআধুনিক কালের নাটকে কি অভিনেতাঅভিনেত্রীর গুরুত্ব কমে আসবে

সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

গুছিয়ে ইংরেজিটা তৈরি করতে পারল না বলে জিজ্ঞেস করতে পারল নালিটল ঢাকার মন্তাজ সাহেব বলতে বাধ্য হলেন, শালী জানে ভালােই! শেষ দৃশ্যে এসে শালী জমিয়ে দিয়েছে। কী বলেন আসিফ সাহেব

আসিফ কিছু বলল নাতার মনে এক ধরনের মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছেকথা বলে এই মুগ্ধতা সে নষ্ট করতে চায় না। 

সারাদিনেও তার মুগ্ধতা কাটল নাকানে বাজতে লাগল রূপবতী মহিলার চমৎকার ব্যাখ্যাএকের পর এক যুক্তির ইট বিছিয়ে বিশাল ইমারত তৈরি করা| অবশ্যি মাঝেমাঝে এইসব যুক্তিতে স্কুল থাকেভুল যুক্তির ইটে বিশাল ইমারতও তৈরি হয়। এক সময় সেই ভুল ধরা পড়েসুবিশাল প্রাসাদ মুহূর্তে ধসে যায়। 

আসিফের সারাদিন কিছুই করার ছিল নাঅনেক দিন পর দুপুরে টানা ঘুম দিলঘুম থেকে জেগে উঠে মনে হল লীলার সঙ্গে শেষবারের মতাে দেখা করে এলে কেমন হয়এই চিন্তাও দীর্ঘস্থায়ী হল নালীনার কাছে যাওয়া মানেই এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া, যাদের সঙ্গ তার ভালাে লাগে নাতারচে লীনা নেই, এই ধরনের বিরহ ভালাে লাগছে। 

বেনু যত্নের চূড়ান্ত করছেদুপুরে সাতআট পদের রান্না করেছেএর মধ্যে জিরামাংসও ছিল। খেতে মােটেই ভালাে হয় নি, তবু আসিফ যখন বলল, বাহ্, এরকম কখনাে খাই নি তােএতেই বেনুর চোখে পানি এসে গেলবড় ভালাে লাগল আসিফের। 

সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসবার আগেই বেনু এসে উপস্থিতট্রেতে করে চালুচি 

হালুয়া নিয়ে এসেছেতার মুখ হাসিহাসিতাকে দেখে কে বলবে এই মেয়ে সকালে কেঁদেকেটে কী কাণ্ড করেছে। 

চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বেনু বলল, এইবার আপনাদের নাটক দেখব ভাইজান‘ 

অবশ্যই দেখবেনআমি নিয়ে যাবআপনাকে কতবার বলছি ভাইজান, আমারে তুমি করে বলবেনআপনারে আমি বড় ভাইয়ের মতাে দেখি। 

আচ্ছা বলবতােমাদের ঝগড়া মিটে গেছে? বেন জবাব দিল নালজ্জিত মুখে হাসল। 

লুচিটা গরমগরম তাজছি ভাইজানএকটু খানপেটে একদম জায়গা নেইকিচ্ছু হবে না ভাইজান, খানএকটা খানএকটা লুচিতে কী হয়? কিছু হয় । 

সন্ধ্যা মেলাবার পরপরই আসিফ রিহার্সেলে উপস্থিত হলআজ একটা ফুল রিহার্সেল হবার কথাকাঁটায়কাঁটায় সাতটায় রিহার্সেল রু হবে, রকম কথা। 

আসিফ দেখল সবাই প্রায় এসে গেছেসবার মুখই বেশ গম্ভীরবজলু বললেন, বিরাট প্রবলেম হয়েছে আসিফ। 

কী প্রবলেম? মেয়েকে নিয়ে প্রবলেমপুষ্পকী প্রবলেম ? মেয়ে জানিয়েছে অভিনয় করবে নাসে কি!‘ 

এইসব চেংড়িফেংড়ি নিয়ে এখন তাে দেখছি গভীর সমুদ্রে পড়লামকী করা যায় বল তাে

সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

অভিনয় করবে না কেন

তাও তাে জানি নামীনা ফিরে আসার পর আমি নিজেই গেলাম, বুঝলে আমরা যেমন অবাক, ওদের বাসার লােকজনও অবাকআমার প্রায় কেঁদে ফেলার মতাে অবস্থা, বুঝলেআমার অবস্থা দেখে পুষ্পের বাবা নিজেই বললেন, শেষ সময়ে তুমি তাদের অসুবিধায় ফেলছ, এটা তাে ঠিক নাঅন্যায়খুবই অন্যায়” 

পুশ কী বলল? কিছুই বলে নামাথাটা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছেকিছু বললেই বলেনাআমার ইচ্ছা করছিল চড় দিয়ে বাঁদীর নখরামী ঘুচিয়ে দিইবজলু রাগে চিড়বিড় করতে লাগলেনথমথমে গলায় বললেন, তুমি একটু আমার সঙ্গে বারান্দায় আস তােআড়ালে তােমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলব। 

আসিফ বারান্দায় গেলবজলু সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, তুমি একবার যাওতুমি গেলে আসবে। 

আমি গেলে আসবে কেন? তুমি গেলে সে কেন আসবে সেটা তুমি নিজেও জান, আমিও জানিখামােখা 

কথা বাড়িয়ে লাভ আছে? তুমি তাকে নিয়ে আসতারপর এই শােটা পার হলে মেয়েটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেই হবেএই যন্ত্রণাটা পার হােকযাও, জলিলের গাড়ি আছেগাড়ি নিয়ে যাও। 

আজ থাকআরেক দিন যাবআজই যাওএটা ফেলে রাখার ব্যাপার নাতুমি এক্ষুনি যাও‘ 

যাওয়াটা কি ঠিক হবে

ঠিক হবে না বেঠিক হবে এটা নিয়ে পরে বিচারবিবেচনা করা যাবেতুমি কথা বাড়িও না, যাও‘ 

পুষ্পের বাবা আসিফকে বললেন, আপনি বসুন, আমি দেখি মেয়েকে আনা যায় কি নাসে দরজা বন্ধ করে বসে আছেমেয়েকে অভিনয় করতে পাঠিয়েও এক যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম। 

সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ বলল, আমি খুব লজ্জিত, আপনাদের অসুবিধায় ফেললাম। অবস্থা এমন যে, পুষ্প না এলে আমাদের নাটক বন্ধ করে দিতে হবেচালিয়ে নিতে পারে, রকম দ্বিতীয় কেউ নেই। 

বসন চা খানদেখি কী করা যায়চিনি দিয়ে সরবত করে ফেলা এক কাপ ঠাণ্ডা চা আসিফ শেষ করলপুস্পের দেখা নেইএক সময় পুষ্পের বাবা এসে শুকনাে গলায় বললেন, কিছু মনে করবেন 

, মেয়ে দরজাই খুলছে না‘ 

আসিফ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আমি কি একবার বলে দেখব? যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে। 

পুষ্পের বাবা বললেন, যান বলে দেখুনরুমি, ওনাকে দোতলায় নিয়ে যাবন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আসিফ বলল, পুষ্প, দরজা খােল। 

পুষ্প সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বলল, আপনি এসেছেন? আপনি নিজে এসেছেন? কি আশ্চর্য, আমাকে তাে কেউ বলে নি আপনি এসেছেন। 

তুমি অভিনয় করবে না পুষ্প? পুশ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আপনি যা করতে বলবেন, আমি তাই 

তাহলে মুখটা ধুয়ে নাওচল আমার সঙ্গে‘ 

গাড়িতে পুষ্প সারাক্ষণই কাঁদলএকবার শুধু ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরব?‘ 

আসিফ বলল, অবশ্যইকেন ধরবে না?

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-১৯): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *