বৃটিশ মহিলার বক্তৃতা আসিফের মােটেই ভালাে লাগল না। প্রথমত কথা বােঝা যাচ্ছে মনে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ তিনি খানিকক্ষণ চিবিয়ে ছােবড়া বানিয়ে বলছেন।
যা বলছেন, তার সঙ্গে অভিনয়ের যােগ তেমন নেই বলেই আসিফের ধারণা। ভদ্রমহিলা বলছেন স্টেজের ব্যাকগ্রাউডের আলাে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিকের সমন্বয় বিষয়ে। সবটাই মনে হচ্ছে কচকচানি থিওরি। সিমিটি রেখে কী করে সিমিট্রি ভাঙতে হবে, এই সব বিষয়। ডায়নামিক ড্রামা এবং স্ট্যাটিক ড্রামার সঙ্গে আলাে এবং শব্দের সম্পর্ক। এক পর্যায়ে ভদ্রমহিলা ব্ল্যাকবাের্ডে হাবিজাবি ইকোয়েশন লিখতে শুরু করলেন।।
আসিফের পাশে লিটল ঢাকা গ্রুপের মন্তাজ সাহেব বসেছিলেন। তিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে বললেন, ‘এই হারামজাদী তাে মনে হচ্ছে বিরাট ফাজিল। এ
তাে দেখি অঙ্ক করছে।
আসিফের কাছেও সমস্ত ব্যাপারটা বােগাস বলেই মনে হচ্ছে। উঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। সে বসেছে মাঝামাঝি জায়গায়, এখান থেকে চলে যাওয়া মুশকিল। এক জন উঠে দাঁড়িয়েছিল, ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে গলায় বললেন, ‘আমি কি আমার কথায় আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারছি না? কথায় না পারলেও রূপে তাে আপনাকে আটকে ফেলার কথা। আমি কি যথেষ্ট রূপবতী নই?”
সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ
চারদিকে তুমুল হাসির মধ্যে ভদ্রলোেককে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে পড়তে হল। এ রকম অবস্থায় হলঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রমহিলার বক্তৃতার প্রথম
পর্ব শেষ হল এক ঘন্টা পর। আসিফের কাছে মনে হল, সে অনন্তকাল ধরে এই চেয়ারে বসে আছে। বক্তৃতার দ্বিতীয় পর্ব শােনার মতাে মনের জোর পাচ্ছে না।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় পর্ব হল অসাধারণ। ভদ্র মহিলা কিছু ছবি বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। অভিনয় অংশ প্রতিটিতেই এক। হুবহু এক, কিন্তু আলাে এবং শব্দের মিশ্রণ একেকটা একেক রকম। শুধু এই কারণে কেমন বদলে যাচ্ছে অর্থ
অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা ছবি দেখাতে দেখাতে ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করছেন
দেখুন, নাটক রু হয় গীর্জায়। ধর্মযাজকরা গীর্জায় নাটকের মাধ্যমে লােকদের ধর্ম শিক্ষা দিতেন। তার মানে এই নয় যে, নাটক ব্যাপারটায় ঐশ্বরিক কিছু আছে।। কিছুই নেই। নাটকের মাধ্যমে আমরা মানুষের মনে আবেগ তৈরি করি। নাটকের গবেষকরা এখন কাজ করছেন আবেগ তৈরির মেকানিজম নিয়ে। নাটক তার রহস্যময়তা হারাতে বসেছে। এখন আমরা আবেগের ব্যাপারটা বিজ্ঞানের চোখে দেখতে শুরু করেছি। বিজ্ঞানের কাছে হৃদয় কিন্তু একটা রক্ত পাম্প করার যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।‘
আসিফ মুগ্ধ হয়ে গেল। বারবার মনে হল, লীনা পাশে থাকলে চমৎকার হত। একটা চমৎকার জিনিস বেচারি ‘মিস’ করল। আসিফের খুব ইচ্ছা করছিল ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে—আধুনিক কালের নাটকে কি অভিনেতা–অভিনেত্রীর গুরুত্ব কমে আসবে?
সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ
গুছিয়ে ইংরেজিটা তৈরি করতে পারল না বলে জিজ্ঞেস করতে পারল না। লিটল ঢাকার মন্তাজ সাহেব বলতে বাধ্য হলেন, “শালী জানে ভালােই! শেষ দৃশ্যে এসে শালী জমিয়ে দিয়েছে। কী বলেন আসিফ সাহেব?
আসিফ কিছু বলল না। তার মনে এক ধরনের মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কথা বলে এই মুগ্ধতা সে নষ্ট করতে চায় না।
সারাদিনেও তার মুগ্ধতা কাটল না। কানে বাজতে লাগল রূপবতী মহিলার চমৎকার ব্যাখ্যা। একের পর এক যুক্তির ইট বিছিয়ে বিশাল ইমারত তৈরি করা। | অবশ্যি মাঝে–মাঝে এইসব যুক্তিতে স্কুল থাকে। ভুল যুক্তির ইটে বিশাল ইমারতও তৈরি হয়। এক সময় সেই ভুল ধরা পড়ে। সুবিশাল প্রাসাদ মুহূর্তে ধসে যায়।
আসিফের সারাদিন কিছুই করার ছিল না। অনেক দিন পর দুপুরে টানা ঘুম দিল। ঘুম থেকে জেগে উঠে মনে হল লীলার সঙ্গে শেষবারের মতাে দেখা করে এলে কেমন হয়। এই চিন্তাও দীর্ঘস্থায়ী হল না। লীনার কাছে যাওয়া মানেই এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া, যাদের সঙ্গ তার ভালাে লাগে না। তারচে লীনা নেই, এই ধরনের বিরহ ভালাে লাগছে।
বেনু যত্নের চূড়ান্ত করছে। দুপুরে সাত–আট পদের রান্না করেছে। এর মধ্যে জিরা–মাংসও ছিল। খেতে মােটেই ভালাে হয় নি, তবু আসিফ যখন বলল, ‘বাহ্, এরকম কখনাে খাই নি তাে।‘ এতেই বেনুর চোখে পানি এসে গেল। বড় ভালাে লাগল আসিফের।
সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ
ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসবার আগেই বেনু এসে উপস্থিত। ট্রেতে করে চা–লুচি
হালুয়া নিয়ে এসেছে। তার মুখ হাসি–হাসি। তাকে দেখে কে বলবে এই মেয়ে সকালে কেঁদে–কেটে কী কাণ্ড করেছে।
চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বেনু বলল, ‘এইবার আপনাদের নাটক দেখব ভাইজান।‘
অবশ্যই দেখবেন। আমি নিয়ে যাব। ‘আপনাকে কতবার বলছি ভাইজান, আমারে তুমি করে বলবেন। আপনারে আমি বড় ভাইয়ের মতাে দেখি।
‘আচ্ছা বলব। তােমাদের ঝগড়া মিটে গেছে? বেন জবাব দিল না। লজ্জিত মুখে হাসল।
লুচিটা গরম–গরম তাজছি ভাইজান। একটু খান। পেটে একদম জায়গা নেই।‘ ‘কিচ্ছু হবে না ভাইজান, খান। একটা খান। একটা লুচিতে কী হয়? কিছু হয় ।
সন্ধ্যা মেলাবার পরপরই আসিফ রিহার্সেলে উপস্থিত হল। আজ একটা ফুল রিহার্সেল হবার কথা। কাঁটায়–কাঁটায় সাতটায় রিহার্সেল রু হবে, এ রকম কথা।
আসিফ দেখল সবাই প্রায় এসে গেছে। সবার মুখই বেশ গম্ভীর। বজলু বললেন, ‘বিরাট প্রবলেম হয়েছে আসিফ।
কী প্রবলেম? ‘ঐ মেয়েকে নিয়ে প্রবলেম। পুষ্প।‘ “কী প্রবলেম ? ‘মেয়ে জানিয়েছে অভিনয় করবে না। ‘সে কি!‘
‘এইসব চেংড়ি–ফেংড়ি নিয়ে এখন তাে দেখছি গভীর সমুদ্রে পড়লাম। কী করা যায় বল তাে?
সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ
‘অভিনয় করবে না কেন?
“তাও তাে জানি না। মীনা ফিরে আসার পর আমি নিজেই গেলাম, বুঝলে আমরা যেমন অবাক, ওদের বাসার লােকজনও অবাক। আমার প্রায় কেঁদে ফেলার মতাে অবস্থা, বুঝলে। আমার অবস্থা দেখে পুষ্পের বাবা নিজেই বললেন, ‘শেষ সময়ে তুমি তাদের অসুবিধায় ফেলছ, এটা তাে ঠিক না। অন্যায়। খুবই অন্যায়।”
পুশ কী বলল? ‘কিছুই বলে না। মাথাটা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বললেই বলেনা। আমার ইচ্ছা করছিল চড় দিয়ে বাঁদীর নখরামী ঘুচিয়ে দিই। বজলু রাগে চিড়বিড় করতে লাগলেন। থমথমে গলায় বললেন, ‘তুমি একটু আমার সঙ্গে বারান্দায় আস তাে। আড়ালে তােমার সঙ্গে দু–একটা কথা বলব।
আসিফ বারান্দায় গেল। বজলু সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, ‘তুমি একবার যাও। তুমি গেলে আসবে।
‘আমি গেলে আসবে কেন? ‘তুমি গেলে সে কেন আসবে সেটা তুমি নিজেও জান, আমিও জানি। খামােখা
কথা বাড়িয়ে লাভ আছে? তুমি তাকে নিয়ে আসতারপর এই শােটা পার হলে মেয়েটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেই হবে। এই যন্ত্রণাটা পার হােক। যাও, জলিলের গাড়ি আছে। গাড়ি নিয়ে যাও।
‘আজ থাক। আরেক দিন যাব।‘ ‘আজই যাও। এটা ফেলে রাখার ব্যাপার না। তুমি এক্ষুনি যাও।‘
যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
‘ঠিক হবে না বেঠিক হবে এটা নিয়ে পরে বিচার–বিবেচনা করা যাবে। তুমি কথা বাড়িও না, যাও।‘
পুষ্পের বাবা আসিফকে বললেন, ‘আপনি বসুন, আমি দেখি মেয়েকে আনা যায় কি না। সে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। মেয়েকে অভিনয় করতে পাঠিয়েও এক যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম।
সাজঘর (পর্ব-২০): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ বলল, আমি খুব লজ্জিত, আপনাদের অসুবিধায় ফেললাম। অবস্থা এমন যে, পুষ্প না এলে আমাদের নাটক বন্ধ করে দিতে হবে। চালিয়ে নিতে পারে, এ রকম দ্বিতীয় কেউ নেই।
‘বসন চা খান। দেখি কী করা যায়। চিনি দিয়ে সরবত করে ফেলা এক কাপ ঠাণ্ডা চা আসিফ শেষ করল। পুস্পের দেখা নেই। এক সময় পুষ্পের বাবা এসে শুকনাে গলায় বললেন, ‘কিছু মনে করবেন
, মেয়ে দরজাই খুলছে না।‘
আসিফ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘আমি কি একবার বলে দেখব? যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।
পুষ্পের বাবা বললেন, ‘যান বলে দেখুন। রুমি, ওনাকে দোতলায় নিয়ে যা। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আসিফ বলল, ‘পুষ্প, দরজা খােল।
পুষ্প সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বলল, ‘আপনি এসেছেন? আপনি নিজে এসেছেন? কি আশ্চর্য, আমাকে তাে কেউ বলে নি আপনি এসেছেন।
‘তুমি অভিনয় করবে না পুষ্প? পুশ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আপনি যা করতে বলবেন, আমি তা–ই
‘তাহলে মুখটা ধুয়ে নাও। চল আমার সঙ্গে।‘
গাড়িতে পুষ্প সারাক্ষণই কাঁদল। একবার শুধু ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরব?‘
আসিফ বলল, অবশ্যই। কেন ধরবে না?
(চলবে)