রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রিহার্সেল হল। ফুল রিহার্সেল, প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য। বজলু সাহেব হৃষ্ট চিত্তে বললেন, ‘জিনিস মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে গেছে। তােমাদের কী ধারণা?
প্রণব বাবু বললেন, ‘শেষ দৃশ্য আমার কাছে একটু লাউড় মনে হয়েছে।‘
‘লাউড তাে বটেই। এটার প্রয়ােজন আছে। আর কারাে কোনাে কথা আছে? থাকলে বল। ফ্রি ডিসকাশন হােক। আমার মন বলছে, একটা ভালাে জিনিস দাঁড়া
হয়েছে। তবে আমার ধারণা, থার্ড সিন স্লো হয়েছে।
‘থার্ভ সিন তাে স্লোই হবে।
‘এতটা হবে না। ডেলিভারিতে এতটা সময় খাওয়ার কিছু নেই। এক জন স্লো করবে, এক জন করবে ফাস্ট। দু‘ জনই স্লো করলে হবে না। ভেরিয়েশন দরকার।
‘আমার মতে বার্ড সিন ঠিকই আছে।” | ‘অন্য সবারও কি তাই মত? যদি তাই হয়, তাহলে দয়া করে এখনই বলেন। আমি কোনাে রকম খুঁত রাখতে চাই না।‘
মজনু চা নিয়ে এল। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বজলু সাহেব বললেন, ‘জিনিস দাঁড়িয়েছে কেমন, বল তাে মজনু।
মজনু দাঁত বের করে বলল, ‘ফাটাফাটি জিনিস হইছে। ‘সত্যি বলছিস? ‘সত্যি না বললে আমি বাপের ঘরের না।‘
বজলু সাহেব আরামের একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। যেন মজনুর কথায় তিনি খুব। ঔরসা পেলেন।
আসিফের বাসায় ফিরতে রাত এগারটা বেজে গেল। দরজার বেল টিপতেই লীনা এসে দরজা খুলে দিল।
আসিফ হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার? লীনা হাসি মুখে বলল, ‘কোনাে ব্যাপার না। যেতে ইচ্ছা করল না। ‘যেতে ইচ্ছা করল না মানে? ওরা চলে গেছেন? ‘া। মা, দুলাভাই খুব রাগারাগি করছিল। ‘যাও নি কেন? ‘ঘরে আস, তারপর বলি।‘
আসিফ ঘরে ঢুকল। তার বিস্ময় এখনাে পুরােপুরি কাটে নি। লীনা বলল, ‘আমাকে দেখে খুশি হয়েছ?
‘তুমি যাও নি কেন সেটা আগে শুনি।
এয়ারপাের্টে যাবার পর হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হল একা একা বাসায় ফিরবে। একা একা শুয়ে থাকবে। মনে হতেই চোখে পানি এসে গেল। তারপর চলে এলাম।
‘এইসব কী পাগলামী লীনা। ‘তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হও নি?
হয়েছি। ‘কতটুক খুশি হয়েছ? ‘অনেকখানি। ‘তাহলে তুমি এখনাে আমাকে জড়িয়ে ধরছ না কেন?
আসিফ গভীর আবেগে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল।
লীনা গাঢ় স্বরে বলল, ‘আজ সারাদিন আমার কী মনে হচ্ছিল জান? মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে ভালবাস না। তােমার ভালবাসার মধ্যে অনেকখানি অভিনয় আছে।
এখনাে কি সে রকম মনে হচ্ছে? না।
সারারাত দু’জন জেগে রইল। কত অর্থহীন কথা, কত অর্থহীন হাসি। বারবার লীনার চোখে পানি আসছে, সেই পানি মুছে সে হাসছে।।
আসিফ বলল, একটা গান কর না লীনা। লীনা শব্দ করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমার গান হয় নাকি?
‘এক সময় তাে গুনগুন করতে। এখনাে না হয় কর।‘
মাঝে–মাঝে কী মনে হয় জান? ‘কী মনে হয়?
‘মনে হয় অভিনয় না করে গান করলে পারতাম। গানের দিকে আমার ঝোঁক ছিল। তােমার জন্যে অভিনয়ে চলে এলাম।
তােমার কি মনে হয় ভুল করেছ? লীনা তার জবাব না দিয়ে বলল, ‘সত্যি গান শুনতে চাও, গাইব?‘ ‘গাও। ‘মাত্র চার লাইন কিন্তু। ‘গান চার লাইনেই ভালাে।
লীনামৃদুস্বরে গাইল—চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে। চার লাইন পর্যন্ত যেতেই পারল না। কেঁদে কেটে অস্থির হল। আসিফ বলল, কাঁদছ কেন?
জানি না কেন? আমার প্রায়ই কাঁদতে ইচ্ছে করে। তােমার করে না?
আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা হঠাৎ করে বলল, আমি না যাওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ তাে?‘
‘একবার তাে বললাম, খুশি হয়েছি।‘
আরেকবার বল।‘ ‘খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি।
‘না যাবার আরেকটা কারণও আছে। এটা তােমাকে বলি নি, কারণ তােমার মনটা খারাপ হবে।
‘মন খারাপ হবে না। তুমি বল।
এ মাসের সতের তারিখে আমাদের বড় মেয়ের মৃত্যুদিন। এই দিনে আমরা দু’জন দু’জায়গায় থাকব, তা কী করে হয়!
‘না, তা হয় না।‘
ঐ দিন আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে সারাক্ষণ পাশাপাশি বসে থাকব।
লীনা চোখের পানি মুছে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার মাঝে–মাঝে কী মনে হয় জান? আমরা যদি আমাদের জীবনের সবচে প্রিয় জিনিস ছেড়ে দিই, তাহলে হয়ত আমাদের এবারের বাচ্চাটা বেঁচে যাবে। এক ধরনের সেক্রিফাইস। আমার এই কথায় তুমি কি কিছু মনে করলে?
দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে আসিফ বলল, ‘না, কিছু মনে করি নি। এটা একটা কথার কথা।
‘কথার কথা কেন হবে? তােমার মনের মধ্যে এটা আছে। আছে না?’ লীনা চুপ
করে রইল।
আসিফ বলল, ‘বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?
লীনা বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বালাল। আর তখনি ওয়ারড্রোবের মাথায় রাখা ছবির ফ্রেম দু’টির দিকে আসিফের চোখ পড়ল। লােপা এবং পার বাঁধন ছবি। ট্রাঙ্কে। তালাবদ্ধ থাকে। কখনাে বের করা হয় না। আজ বের করা হয়েছে।
লীনা ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, সতের তারিখের পর আবার লুকিয়ে ফেলব।
আসিফ বলল, ‘লুকিয়ে ফেলার দরকার কি, থাকুক। তুমি যাও, পানি নিয়ে এস।
আসিফ তাকিয়ে রইল ছবি দুটির দিকে। আহ্, কী সুন্দর দুই মা–মণি। এক জন আবার রাগ করে ঠোট উন্টে আছে। অন্যজন কেমন চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। যেন পৃথিবীর রহসা দেখে তার বিস্ময়ের সীমা নেই।
আসিফের বুক জ্বালা করতে লাগল। ছবি দুটির দিকে তাকালেই তার অসহ্য কষ্ট হয়। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘ত্রপা, ত্রপা মামণি। কেমন আছ গাে?
ত্রপা জবাব দিল না, জবাব দিল লীনা। সে স্নিগ্ধ গলায় বলল, ‘পানি নাও।
আসিফ এক চুমুকে পানি শেষ করে সহজ গলায় বলল, ‘আমি আর অভিনয় করব না লীনা। তােমাকে কথা দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে দাও, চোখে আলাে লাগছে।
‘তুমি কি আমার উপর রাগ করলে?
না লীনা। রাগ করি নি। ‘আমি একটা কথার কথা বললাম। ‘বাতি নিভিয়ে দাও লীনা। বাতি নিভিয়ে দাও। লীনা বাতি নিভিয়ে দিল।
আসিফদের শাে হল না। শাে–এর দিন আসিফ এবং লীনা ছাড়া দলের সবাই একত্রিত হল। মজল বারান্দায় চায়ের কেতলি বসিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বজলু সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, ‘কেউ গিয়ে চড় দিয়ে গাধাটাকে থামাও তে, অসহ্য! বলতে বলতে তিনি নিজেও কেঁদে ফেললেন। এবং কাঁদলেন শিশুদের মতাে। শব্দ করে। তাঁকে ঘিরে মূর্তির মতাে সবাই বসে রইল।
কেউ একটি শব্দও করল না। শুধু পুষ্পকে দেখে মনে হল, যে কোনাে মুহূর্তে এই মেয়েটি ভেঙে পড়বে। তবে সে ভেঙে পড়ল না। সাজঘরের এক কোণায় চুপচাপ বসে রইল। বজলু সা েযখন বললেন, ‘খামােখা বসে আছে কেন সবাই? যাও, বাসায় চলে যাও।‘ তখনি শুধু তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কেউ এসে সান্ত্বনার হাত তার মাথায় রাখল না।
কিছুদিন পরই থিয়েটারের এই দলটি নতুন নাটকের মহড়া শুরু করল। নাটকের নাম—হলুদ নদী, সবুজ বন। মজনু আবার তার জায়াে সাইজের কেতলিতে চায়ের পানি বসিয়ে দিল। জলিল সাহেব জমিয়ে আদিরসের গল্প শুরু করলেন।
(চলবে)