লীনা ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার শরীরটা আসলেই খারাপ। কেন খারাপ তা সে নিজেও ঠিক জানে না। রাতে ঘুম ভালাে হচ্ছে না। একবার ঘুম ভাঙলে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
যে চার জন মেয়ে এসেছে তাদের এক জন আজই প্রথম এল। শ্যামলা একটি মেয়ে, মুখ থেকে বালিকা ভাবটা এখনাে যায় নি। সে অবশ্য লালমাটিয়া কলেজে আই এ পড়ছে। এবার সেকেন্ড ইয়ার। ভালাে নাম ইসরাত বেগম। সবাই অবশ্যি তাকে পুষ্প–পুষ্প ডাকছে।
মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব লজ্জা পাচ্ছে, তবে কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছে। সে একা পড়ে গেছে। অন্য মেয়েরা জলিল সাহেবের কাছে চেয়ার টেনে বসেছে। এলিল সাহেব ভূতের গল্প শুরু করেছেন। ভূতের গল্পগুলাে অবশ্যি আদিরসের গলের মতাে জমছে না।
লীনা বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরে ঢুকল। পুস্পের পাশের চেয়ারে এসে বসল। হাসি
মুখে বলল, ‘নাম কি তোমার?
‘বাহ খুব ভালাে নাম।
বলে লীনা নিজেই একটু লজ্জা পেল। বাহ খুব ভালাে নাম তাে এই জাতীয় কথাগুলাে সাধারণত ছােট বাচ্চাদের বলা হয়। এই মেয়েটি ছােট বাচ্চা নয়।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
“তুমি কি আগে অভিনয় করেছ? “জ্বি না। আমি হয়ত পারব না।
‘কেন পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে। অভিনয় কঠিন কিছু না। আমি যদি পারি তুমিও পারবে।‘
‘বাসা থেকে করতে দেবে কিনা তাও তাে জানি না।
সে কি। বাসায় কাউকে কিছু বল নি? ‘জুি না। ‘বল নি কেন?
বাসায় বললাম, তারপর এখানে কিছু পারলাম না, আপনারা বাদ দিলেন
লীনা খানিকটা অবাক হল। এই মেয়েকে যতটা লাজুক শুরুতে মনে হচ্ছিল, এ ততটা লাজুক নয়। গলার স্বর পরিষ্কার ও স্পষ্ট। এ পারবে। লীনা বলল, আমাদের দিকটাও কিন্তু তুমি দেখ নি। ধরা যাক আমরা তােমাকে নিলাম, তারপর বাসা থেকে
বলল—হবে না। তখন আমরা ঝামেলায় পড়ব না?
‘আমি আপনাদের দিকটা ভাবি নি, আমি শুধু আমার নিজের দিকটাই ভেবেছি।‘ “সবাই তাই ভাবে পুষ্প।‘
নাটকের পরিচালক বজলু ভাই এসে ঢুকলেন। আজ তিনিও দেরি করেছেন। অসম্ভব রােগা, অসম্ভব কালাে এবং প্রায় ছ‘ফুটের মতাে লম্বা এক জন মানুষ। খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন বলে তাঁর অন্য নাম হচ্ছে ‘হাঞ্চ ব্যাক অব মিরপুর।
বজলু ভাই এসেই বিরক্ত স্বরে বললেন, তােমরা বসে আছ কেন? শুরু করে দিলেই হত।
জলিল সাহেব বললেন, ‘আপনি নেই, শুরু করব কী ভাবে? ‘আমি না থাকলে শুরু হবে না, এটা কেমন কথা? ‘আসিফ ভাইও এখনাে আসেন নি।‘
‘বল কী? এদের হয়েছে কী? দেখি চা দিতে বল। চা খেয়ে ম্যারাথন। আজ ফুল রিহার্সেল হবে। নতুন মেয়ে একটা আসার কথা। এসেছে? কুসুম কিংবা পুষ্প এই
জাতীয় নাম।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
পুষ্প উঠে দাঁড়াল। বজলু সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। পুষ্প খুব অস্বস্তি বােধ করছে। এতক্ষণ কেউ তেমন করে তার দিকে তাকায় নি, এখন একসঙ্গে সবাই তাফাচ্ছে।
তােমারই নাম কুসুম? ‘আমার নাম পুষ্প।
একই ব্যাপার। তৈলাধার পাত্র কিংবা পাত্ৰাধার তৈল—অভিনয় করেছ কখনাে?
‘জ্বি না।‘
এইতাে একটা ভুল কথা বললে—অভিনয় তাে আমরা সারাক্ষণই করছি। করছি ? বাড়িতে মেহমান এসেছে, তুমি খুব বিরক্ত, তবু তার সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করতে হচ্ছে। দেখাতে হচ্ছে যে তুমি আনন্দিত। এটা অভিনয় না? অভিনয় তাে বটেই। কঠিন
অভিনয়। আমাদের প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে হয়।
পুষ্প তাকিয়ে আছে। এই লােকটিকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কথা বলার সময় লােকটির মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসছে। আর কথা বলছে কেমন মাস্টারের ভঙ্গিতে। কথাবার্তায় একটা সবজান্তা ভাব। এই রকম সবজান্তা লােক তার ভালাে লাগে না।
‘জ্বি।
‘তুমি একটা কাজ কর। একটু দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে এসে দাঁড়াও। তারপর তুমি তােমার মাকে ডাক। এমন ভাবে ডাকবে যেন তাঁকে তুমি জরুরি খবর দিতে চাচ্ছ।
‘কী খবর?
মনে কর একটা দুঃসংবাদ।‘
পুষ্প তাই করল। যদিও তার মােটেও ভালাে লাগছে না। একটু দূর থেকে হেঁটে এসে বলল, “মা, মা।‘
বজলু সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, কিছুই তাে হল না, আবার কর।
পুষ্পের মুখ লাল হয়ে গেছে। সে একবার ভাবল কিছু করবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তা কি ঠিক হবে? সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। পুষ্প আবার একটু দূরে সরে
গেল। এগিয়ে এল জড়াননা পায়ে। আবার ডাকল, ‘মা, মা।
বজলু সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘রােবটের মতাে কথা বলছ। ফ্রিলি বল। পরিষ্কার গলায় বল। জায়গাটা আবার কর।
পুষ্প বলল, “আর করব না, আমার ইচ্ছে করছে না। ‘ইচ্ছে করছে না মানে? ‘আমি অভিনয় করব না।
পুষ্প লীনার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কী কম বিশ্রী ভঙ্গিতে লােকটা বলল কিছুই তাে হল না। কিছুই না হওয়াটা যেন তার। অপরাধ।
পুষ্পের ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতে। রাত এখনাে তেমন হয় নি। সে একটা কিশা নিয়ে চলে যেতে পারবে। তার এত ভয় টয় নেই। তবে ইচ্ছা করলেই তাে আর যাওয়া যায় না। মীনা আপা তাকে নিয়ে এসেছেন। ফিরতে হবে মীনা আপার সঙ্গেই। মীনা আপার কাণ্ড কারখানাও অদ্ভূত। তাকে নিয়ে আসার পর আর কোনাে খোঁজখবর নেই। ফর্সা মতাে একটা লােকের পাশে বসে ক্রমাগত কথা বলছে। ফর্সা লােকটাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে এইসব কথা মন দিয়ে শুনছে। বরং মনে হচ্ছে ফর্সা লােকটা। বিক্ত হচ্ছে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
মীনা আপা পুষ্পদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। কৃষি ব্যাংকে কাজ করেন আর
নাটক থিয়েটার করেন। বয়স ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে। এখনাে বিয়ে হয় নি। পুষ্পের ধারণা
বিয়ে হবার সম্ভাবনা খুব কম। মীনা আপা বছর তিন আগে থেকে মােটা হতে শুরু করেছেন। এখন প্রায় মৈনাক পর্বত। থুতনিতে ভাঁজ পড়েছে।
হাঁটার সময় থপ থপ শব্দ
মীনা আপার ধারণা টনসিল অপারেশনের জন্যে তাঁর এটা হয়েছে। টনসিল অপারেশন না হলে আগের মতাে হালকা পাতলা থাকতেন। এই নাটকে মীনা আপা কিসের পাট করেন কে জানে?
আসিফ এসে ঢুকল ঠিক সাড়ে আটটায়। দরজা থেকেই লীনার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসল। এই হাসির অনেকগুলাে অর্থ। আট বছর পাশাপাশি থাকায় লীনা এখন সব কটি অর্থ ধরতে পারে। অর্থগুলাে হচ্ছে—দেরির জন্যে আমি লজ্জিত, সারাদিনের পরিশ্রমে আমি খানিকটা ক্লান্ত এবং একটা খারাপ খবর আছে।
আসিফকে ঠিক সুপুরুষ বলা যাবে না। শক্ত সমর্থ গড়ন। মাথা ভর্তি অগােছালাে কোঁকড়ানাে চুল। চোখ দুটি ছােট, ঠোঁট বেশ পুরু। চওড়া কাঁধ। সব কিছু মিলিয়েও আলাদা কিছু আকর্ষণ তার মধ্যে আছে।
লীনা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। আট বছর এর সঙ্গে বিবাহিত জীবন কাটানাের পরেও এই মানুষটাকে দেখলে তার মধ্যে তরল অনুভূতি হয়। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে
করে।
আসিফকে ঢুকতে দেখেই বজলু সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে হুংকার দিলেন, ‘স্টার্ট কর। দ্বিতীয় দৃশ্য থেকে শুরু হবে। আজ কোনাে প্রম্পটিং হবে না। একেকবার ডায়লগ ভুলে গেলে পাঁচ টাকা করে জরিমানা। আসিফ যাও স্টেজে উঠে পড়। তােমার চেয়ার আর টেবিল দাও, বাঁ দিকে একটু পেছনে। দর্শকরা যেন শুধু সাইড ভিউ পায়।
মিজান বলল, পেছনের চৌকির পশ্চিম দিকের কোণায় একটা ভাঙা আছে। খেয়াল রাখবেন কাইন্ডলি।