সাজঘর (পর্ব-২): হুমায়ূন আহমেদ

লীনা ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললতার শরীরটা আসলেই খারাপ। কেন খারাপ তা সে নিজেও ঠিক জানে নারাতে ঘুম ভালাে হচ্ছে নাএকবার ঘুম ভাঙলে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় নাকেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। 

সাজঘরযে চার জন মেয়ে এসেছে তাদের এক জন আজই প্রথম এলশ্যামলা একটি মেয়ে, মুখ থেকে বালিকা ভাবটা এখনাে যায় নিসে অবশ্য লালমাটিয়া কলেজে আই পড়ছেএবার সেকেন্ড ইয়ারভালাে নাম ইসরাত বেগমসবাই অবশ্যি তাকে পুষ্পপুষ্প ডাকছে। 

মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব লজ্জা পাচ্ছে, তবে কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছেসে একা পড়ে গেছেঅন্য মেয়েরা জলিল সাহেবের কাছে চেয়ার টেনে বসেছেএলিল সাহেব ভূতের গল্প শুরু করেছেনভূতের গল্পগুলাে অবশ্যি আদিরসের গলের মতাে জমছে না। 

লীনা বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরে ঢুকলপুস্পের পাশের চেয়ারে এসে বসলহাসি 

মুখে বলল, নাম কি তোমার

বাহ খুব ভালাে নাম। 

বলে লীনা নিজেই একটু লজ্জা পেলবাহ খুব ভালাে নাম তাে এই জাতীয় কথাগুলাে সাধারণত ছােট বাচ্চাদের বলা হয়এই মেয়েটি ছােট বাচ্চা নয়

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

 তুমি কি আগে অভিনয় করেছ? জ্বি নাআমি হয়ত পারব না। 

কেন পারবে নানিশ্চয়ই পারবেঅভিনয় কঠিন কিছু নাআমি যদি পারি তুমিও পারবে‘ 

বাসা থেকে করতে দেবে কিনা তাও তাে জানি না। 

সে কিবাসায় কাউকে কিছু বল নি? জুি নাবল নি কেন

বাসায় বললাম, তারপর এখানে কিছু পারলাম না, আপনারা বাদ দিলেন 

লীনা খানিকটা অবাক হলএই মেয়েকে যতটা লাজুক শুরুতে মনে হচ্ছিল, ততটা লাজুক নয়গলার স্বর পরিষ্কার স্পষ্টপারবেলীনা বলল, আমাদের দিকটাও কিন্তু তুমি দেখ নিধরা যাক আমরা তােমাকে নিলাম, তারপর বাসা থেকে 

বললহবে নাতখন আমরা ঝামেলায় পড়ব না

আমি আপনাদের দিকটা ভাবি নি, আমি শুধু আমার নিজের দিকটাই ভেবেছিসবাই তাই ভাবে পুষ্প‘ 

নাটকের পরিচালক বজলু ভাই এসে ঢুকলেনআজ তিনিও দেরি করেছেনঅসম্ভব রােগা, অসম্ভব কালাে এবং প্রায় ফুটের মতাে লম্বা এক জন মানুষখানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন বলে তাঁর অন্য নাম হচ্ছে হাঞ্চ ব্যাক অব মিরপুর। 

বজলু ভাই এসেই বিরক্ত স্বরে বললেন, তােমরা বসে আছ কেন? শুরু করে দিলেই হত। 

জলিল সাহেব বললেন, আপনি নেই, শুরু করব কী ভাবে? আমি না থাকলে শুরু হবে না, এটা কেমন কথা? আসিফ ভাইও এখনাে আসেন নি‘ 

বল কী? এদের হয়েছে কী? দেখি চা দিতে বলচা খেয়ে ম্যারাথনআজ ফুল রিহার্সেল হবেনতুন মেয়ে একটা আসার কথাএসেছে? কুসুম কিংবা পুষ্প এই 

জাতীয় নাম

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

পুষ্প উঠে দাঁড়াল। বজলু সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। পুষ্প খুব অস্বস্তি বােধ করছেএতক্ষণ কেউ তেমন করে তার দিকে তাকায় নি, এখন একসঙ্গে সবাই তাফাচ্ছে। 

তােমারই নাম কুসুম? আমার নাম পুষ্প। 

একই ব্যাপারতৈলাধার পাত্র কিংবা পাত্ৰাধার তৈলঅভিনয় করেছ কখনাে

জ্বি না‘ 

এইতাে একটা ভুল কথা বললেঅভিনয় তাে আমরা সারাক্ষণই করছিকরছি ? বাড়িতে মেহমান এসেছে, তুমি খুব বিরক্ত, তবু তার সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করতে হচ্ছেদেখাতে হচ্ছে যে তুমি আনন্দিতএটা অভিনয় না? অভিনয় তাে বটেইকঠিন 

অভিনয়আমাদের প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে হয়। 

পুষ্প তাকিয়ে আছেএই লােকটিকে তার পছন্দ হচ্ছে নাকথা বলার সময় লােকটির মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসছেআর কথা বলছে কেমন মাস্টারের ভঙ্গিতেকথাবার্তায় একটা সবজান্তা ভাবএই রকম সবজান্তা লােক তার ভালাে লাগে না। 

জ্বি। 

তুমি একটা কাজ করএকটু দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে এসে দাঁড়াওতারপর তুমি তােমার মাকে ডাকএমন ভাবে ডাকবে যেন তাঁকে তুমি জরুরি খবর দিতে চাচ্ছ। 

কী খবর

মনে কর একটা দুঃসংবাদ।‘ 

পুষ্প তাই করলযদিও তার মােটেও ভালাে লাগছে নাএকটু দূর থেকে হেঁটে এসে বলল, মা, মা‘ 

বজলু সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, কিছুই তাে হল না, আবার কর। 

পুষ্পের মুখ লাল হয়ে গেছেসে একবার ভাবল কিছু করবে নাদাঁড়িয়ে থাকবেকিন্তু তা কি ঠিক হবে? সবাই তার দিকে তাকাচ্ছেপুষ্প আবার একটু দূরে সরে 

গেলএগিয়ে এল জড়াননা পায়েআবার ডাকল, মা, মা। 

বজলু সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, রােবটের মতাে কথা বলছফ্রিলি বলপরিষ্কার গলায় বলজায়গাটা আবার কর। 

পুষ্প বলল, আর করব না, আমার ইচ্ছে করছে নাইচ্ছে করছে না মানে? আমি অভিনয় করব না। 

পুষ্প লীনার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লতার চোখে পানি এসে যাচ্ছেকী কম বিশ্রী ভঙ্গিতে লােকটা বলল কিছুই তাে হল নাকিছুই না হওয়াটা যেন তারঅপরাধ। 

পুষ্পের ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতেরাত এখনাে তেমন হয় নিসে একটা কিশা নিয়ে চলে যেতে পারবেতার এত ভয় টয় নেইতবে ইচ্ছা করলেই তাে আর যাওয়া যায় নামীনা আপা তাকে নিয়ে এসেছেনফিরতে হবে মীনা আপার সঙ্গেইমীনা আপার কাণ্ড কারখানাও অদ্ভূততাকে নিয়ে আসার পর আর কোনাে খোঁজখবর নেইফর্সা মতাে একটা লােকের পাশে বসে ক্রমাগত কথা বলছেফর্সা লােকটাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে এইসব কথা মন দিয়ে শুনছেবরং মনে হচ্ছে ফর্সা লােকটাবিক্ত হচ্ছে। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

মীনা আপা পুষ্পদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। কৃষি ব্যাংকে কাজ করেন আর 

নাটক থিয়েটার করেনবয়স ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছেএখনাে বিয়ে হয় নিপুষ্পের ধারণা 

বিয়ে হবার সম্ভাবনা খুব কমমীনা আপা বছর তিন আগে থেকে মােটা হতে শুরু করেছেনএখন প্রায় মৈনাক পর্বতথুতনিতে ভাঁজ পড়েছে

 হাঁটার সময় থপ থপ শব্দ 

মীনা আপার ধারণা টনসিল অপারেশনের জন্যে তাঁর এটা হয়েছেটনসিল অপারেশন না হলে আগের মতাে হালকা পাতলা থাকতেনএই নাটকে মীনা আপা কিসের পাট করেন কে জানে

আসিফ এসে ঢুকল ঠিক সাড়ে আটটায়দরজা থেকেই লীনার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসলএই হাসির অনেকগুলাে অর্থআট বছর পাশাপাশি থাকায় লীনা এখন সব কটি অর্থ ধরতে পারেঅর্থগুলাে হচ্ছেদেরির জন্যে আমি লজ্জিত, সারাদিনের পরিশ্রমে আমি খানিকটা ক্লান্ত এবং একটা খারাপ খবর আছে। 

আসিফকে ঠিক সুপুরুষ বলা যাবে নাশক্ত সমর্থ গড়নমাথা ভর্তি অগােছালাে কোঁকড়ানাে চুলচোখ দুটি ছােট, ঠোঁট বেশ পুরুচওড়া কাঁধসব কিছু মিলিয়েও আলাদা কিছু আকর্ষণ তার মধ্যে আছে। 

লীনা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেললআট বছর এর সঙ্গে বিবাহিত জীবন কাটানাের পরেও এই মানুষটাকে দেখলে তার মধ্যে তরল অনুভূতি হয়পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে 

করে। 

আসিফকে ঢুকতে দেখেই বজলু সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে হুংকার দিলেন, স্টার্ট করদ্বিতীয় দৃশ্য থেকে শুরু হবেআজ কোনাে প্রম্পটিং হবে নাএকেকবার ডায়লগ ভুলে গেলে পাঁচ টাকা করে জরিমানাআসিফ যাও স্টেজে উঠে পড়তােমার চেয়ার আর টেবিল দাও, বাঁ দিকে একটু পেছনেদর্শকরা যেন শুধু সাইড ভিউ পায়। 

মিজান বলল, পেছনের চৌকির পশ্চিম দিকের কোণায় একটা ভাঙা আছেখেয়াল রাখবেন কাইন্ডলি। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *