আসিফ বলল, এক কাপ চা খেয়ে নিই বজলু ভাই। খুব টায়ার্ড ফিল করছি।
‘এক চুমুকে চা শেষ কর। কুইক। সাতদিন পর শশা, অথচ এখনাে একটা দিন। ফুল রিহার্সেল দিতে পারলাম না।‘
লীনা ভেবেছিল আসিফ চায়ের পেয়ালা হাতে তার পাশে এসে দাঁড়াবে। টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলবে। তা সে করল না। চায়ের কাপ হাতে প্রণবকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। আসিফ নিজের বাসার বাইরে এলে স্ত্রীর সঙ্গে কেমন যেন আলগা একটা ব্যবহার করে। যেন সে লজ্জা পায়।
পুষ্প বলল, চায়ের কাপ হাতে বারান্দার দিকে যে গেলেন, উনি কি এই নাটকের নায়ক?
লীনা হেসে বলল, ‘তার চেহারাটা কি তােমার কাছে নায়কের মতাে মনে হল?
না, তা না।
‘হ্যা, এ–ই নায়ক। নাটকের শুরুটা বলি, তােমার ভালাে লাগবে। একজন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাস থেকে নাটক করা। গল্পটা খুব চমৎকার। শুনতে চাও?
‘হ্যা চাই।
এই নাটকের নায়ক হচ্ছেন একজন লেখক। নতুন বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর দিকে
তার যতটা সময় দেয়া দরকার ততটা দিতে পারছেন না। রাত দশটার পর উনি লেখার খাতা নিয়ে বসেন। স্ত্রী বেচারী একা একা শুয়ে থাকে। মেয়েটির বয়স খুব কম, এই ধর আঠার উনিশ। তার খুব ইচ্ছে করে স্বামীর সঙ্গে রাত জেগে গল্প করতে। স্বামী বেচারা তা বুঝতে পারে না। সে তার উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত। ঘটনাটা শুরু হয়েছে এক রাতে। স্বামী লিখছে। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। লেখকের স্ত্রী একটা জ্বলন্ত মােমবাতি হাতে বসার ঘরে ঢুকল।
‘লেখকের নাম কি? | ‘পুরাে নাটকে লেখকের কোনাে নাম নেই। তাকে সব সময় লেখক বলা হয়েছে, তবে লেখকের স্ত্রীর নাম হচ্ছে জরী।
‘আপনি হচ্ছেন লেখকের স্ত্রী, তাই না? ‘হ্যা। কী করে বুঝলে?” ‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল।
নাটক শুরু হল। স্টেজের এক প্রান্তে লেখার টেবিল। চেয়ারে পা তুলে আসিফ বসে আছে। বজলু সাহেব বললেন, ‘চেয়ারে পা তুলে বসেছ কেন? এটা কী রকম বসা?
আসিফ বলল, ‘ঘরােয়া ভাবে বসেছি বজলু ভাই। খুব রিলাক্সড হয়ে বসা। পা নামিয়ে ঠিকঠাক মতাে বসলে ফর্মাল একটা ভাব চলে আসে।
‘দেখতে ভালাে লাগছে না। দেখতে ভালাে লাগার একটা ব্যাপার আছে। দর্শক হিসাবে জিনিসটা দেখতে ভালাে লাগতে হবে। তােমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি....
বজলু সাহেব কথা শেষ করলেন না। আসিফ বলল, বজলু ভাই আমি চাচ্ছি যেন আমাকে ভালাে না লাগে। লেখকের সর্ব কাণ্ডকারখানায় তার স্ত্রী যেমন বিরক্ত আমি চাই দর্শকরাও যেন ঠিক তেমনি ভাবে বিরক্ত হয়।‘
বুজলু সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি পা নামিয়ে বস। আসিফ পা নামাল। ‘বা হাতে মাথা হেলান দিয়ে লিখতে শুরু কর।‘
পুষ্প মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতােই ব্যাপার। একজন লেখক গভীর আগ্রহ নিয়ে লিখছেন এটা এত সুন্দর বােঝা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে লেখা থেমে যাচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছে। লেখক একটা সিগারেট মুখে দিলেন। দেশলাই দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে ধরালেন না। নতুন কিছু মাথায় এসেছে। দেশলাই ফেলে কলম তুলে নিয়ে আবার ঝড়ের বেগে লিখতে শুরু করেছেন—এমন সময় বাতি নিভে গেল।
লেখক কী প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়েই না তাকাচ্ছেন টেবিল ল্যাম্পটার দিকে। লেখকের প্রতি সহানুভূতিতে পুষ্পের চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছে। এমন সময় দেখা গেল লেখকের স্ত্রী জরী আসছে। তার হাতে মােমবাতি। বাতাসের ঝাপ্টা থেকে বাতি আড়াল করে আসছে। তার মুখে কেমন যেন দুষ্টু দুষ্টু হাসি। পুষ্প দেখছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে। লেখক কথা বললেন। কি চমৎকার ভরাট গলা। স্বপ্ন মাখা স্বর।।
লেখক : জরী তুমি এখনাে জেগে আছ?
জরী : ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ শুনি খাটের নিচে খুট খুট শব্দ হচ্ছে। কে যেন আণায় খুক খুক করে কাশল। পুরুষ মানুষের কাশি। ভয়ে আমি অস্থির। খাটের নিচে
কে যেন বসে আছে।
লেখক : আবার আজেবাজে কথা শুরু করেছ?
জরী : মােটই কোনাে আজেবাজে কথা না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের খাটের নিচে একটা ভূত থাকে। পুরুষ ভূত| ভূতটার গায়ে তামাকের গন্ধ। | লেখক; জরী, তুমি দয়া করে মােমবাতিটা এখানে রেখে ঘুমিয়ে পড়। প্লিজ, প্লিজ—এই দেখ হাতজোড় করছি।
জরী : ঝড় বৃষ্টির রাতে একা একা ঘুমুব? ভূতটা যদি আমাকে কিছু করে ওর মতলবটা আমার কাছে বেশি ভালাে মনে হচ্ছে না।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
লেখক : তােমার সঙ্গে ঘুমুতে পারলে আমি খুবই খুশি হতাম। কিন্তু তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছ না—লেখালেখিটা একটা মুড়ের ব্যাপার। মুড সব সময় আসে।
নী।
জরী : এখন এসেছে? লেখক : হ্যা এসেছে। সারারাত আমি লিখব। জরী : আর আমি সারারাত ঐ ভূতটার সঙ্গে ঘুমুব?
লেখক : আমি একটা ক্লাইমেক্সে এসে থেমে আছি। আমার নায়ক অভাবে অনটনে পর্যদস্ত। বেকার, হাতে একটা পয়সা নেই। সকালবেলা খবর পেয়েছে তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে আত্মহত্যা করবে.....।
জরী : এখনাে করে নি? লেখক : না করে নি। তবে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পথে পথে ঘুরছে।
জরী : সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছে তাহলে আর দেরি করছ কেন? কোনাে একটা ট্রাকের নিচে ঝাপিয়ে পড়ুক। ঝামেলা চুকে যাক। আমরা আরাম করে ঘুমুতে যাই।
লেখক : বড় যন্ত্রণা করছ জরী।
জরী : আমি আর কত যন্ত্রণা করছি? তােমার নায়ক অনেক বেশি যন্ত্রণা করছে। স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েও পথে পথে ঘুরছে। এত ঘােরার দরকার কিরে ব্যাটা? লাফ দিয়ে কোনাে একটা ট্রাকের নিচে পড়ে যা। ঢাকা শহরে কি ট্রাকের অভাব?
লেখক; (কড়া স্বরে) জরী।।
জরী : আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। যদি চাও তাে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারি।
লেখক : এই মুহূর্তে আমি একটা জিনিস চাই, তা হচ্ছে নীরবে কাজ করার স্বাধীনতা।
জরী : বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছি। স্বাধীনতার সঙ্গে এক কাপ চাও দিয়ে যাচ্ছি।
পুষ্প দেখল জরী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্বামীর কাছ থেকে চলে আসছে। ঢুকেছে রান্নাঘরে। চা বানাচ্ছে। চা বানাতে বানাতে তার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখে আঁচল দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল তারপর চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে ঢুকল।
বজলু সাহেব চেচিয়ে বললেন, ‘স্টপ। অভিনয় থেমে গেল। বজলু সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ‘পুরাে ব্যাপারটা স্লো হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই নাটক স্লো। এরকম একটা
স্লো নাটকে তার চেয়েও স্লো এ্যাকশান পাবলিক মােটেও একসেপ্ট করবে না। চা বানানাের জন্যে পাশের ঘরে যাওয়া মানেই নাটক স্লো করে দেয়া। জরী, তােমাকে লেখকের পাশেই থাকতে হবে। ঐ ঘরেই ফ্লাস্কে চা বানানাে আছে। তুমি শুধু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দেবে।
লীনা বলল, বজলু ভাই একটা সমস্যা আছে তাে। ইমােশান বিল্ড আপ করার জন্যে আমার কিছু সময় দরকার। এই সময় তাে আমি পাচ্ছি না।‘
‘যা করার এই সময়ের মধ্যেই করতে হবে।‘
এত অল্প সময়ে চোখে পানি আনতে পারব বলে তাে মনে হচ্ছে না। ‘পারবে। অবশ্যই পারবে। না পারলেও ক্ষতি নেই। সাজেসানের উপর দিয়ে কেটে বের হয়ে যাবে। নাও শুরু কর। স্টার্ট। লেখকের পাশে তুমি দাঁড়িয়ে আছ। শান্ত ভঙ্গিতে বলছ—বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছি। স্বাধীনতার সঙ্গে–সঙ্গে এককাপ চা দিয়ে যাচ্ছি। ওকে স্টার্ট। জরী, ডেলিভারি এত সফট দিও না। একটু হার্ড দিও।
অভিনয় শুরু হল। লেখক একমনে লিখছেন। জরী ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে–ঢালতে লেখকের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তার মন বিষাদে ভারাক্রান্ত। এক সময় টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। পুষ্প অবাক হয়ে দেখল কত সহজে মেয়েটির চোখে পানি এসে গেছে। এটা যেন অভিনয় নয়। বাস্তব জীবন। স্বামীসঙ্গ কাতর একটি মেয়ের অভিমানের অশ্রু। লেখক চোখ তুলে তাকালেন এবং অবাক হয়ে বললেন
লেখক : কী হয়েছে, চোখে পানি কেন?
জরী : চোখ মুছতে–মুছতে) আমার খুব বাজে একটা চোখের অসুখ হয়েছে। রাত হলে চোখ কড় কড় করে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
লেখক : পন্টুকে একবার দেখাও না কেন? এই বলেই লেখক আবার লিখতে শুরু করেছেন।
জরী চলে আসছে। দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়াল। জরী তাকিয়ে আছে। লেখকের দিকে। লেখক একমনে লিখছেন। জরীর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
পুষ্প বুঝতেও পারে নি যে তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে। মেয়েটির কষ্ট্রে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি চেচিয়ে লেখককে বলবে—পাষণ্ড কোথাকার। সে কিছুই বলতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠল। সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। তার খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু সে চোখের পানি থামাতে পারছে না। আসিফ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
(চলবে)